কিছুদিন ধরে NRC নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। দুশ্চিন্তা এজন্য নয় যে বাপ ঠাকুরদার দেশে জন্মে দীর্ঘদিন সরকারকে আয়কর ও কয়েকবার ভোট দিয়েও বাঞ্ছিত কাগজ না দেখাতে পেরে ডিটেনশন সেন্টারে গিয়ে শেষ জীবনটা ডোলের মিল খেয়ে বাঁজা কাব্যচর্চা করে কাটাতে হবে। চিন্তা এও নয় যে তাহলে হয়তো বাকি জীবনে কালেভদ্রে বৌ, ছেলের সাথে গরাদের ভেতর থেকেই কথা বলে কাটবে। কারণ বিপুল অর্থব্যয়ে সংঘটিত NRC নামক অর্থহীন পয়জারটাই NRC বা Nothing Really Credible বিবেচিত হয়ে হয়তো আদালতের রায়ে বা সরকার বদলে গিয়ে বাতিল হয়ে যেতে পারে। শেষবেষ যদি তা লাগুও হয় তা আমার জীবদ্দশায় হবে কিনা কে জানে। দুশ্চিন্তার কারণ - কী পদ্ধতিতে তা নির্ধারিত হবে?
তখন একদিন হঠাৎ 'হঠাৎ যদি উঠলো কথা' নামক একটি তুমিনল নালা চোখে পড়লো। প্রথমেই নজর কাড়লো সেই নালার নারী নোঙ্গর। তার নাম পৌলমী নাগ। নিবাস উত্তর কলকাতা। পড়াশোনা জয়পুরিয়া কলেজ থেকে সাংবাদিকতা। দেখে মনে হোলো দেশের নানা দূর্নীতি ও অব্যবস্থায় সে এক অসন্তষ্ট হৃষ্টপুষ্ট যুবতী।
তার চশমাটি নাক থেকে হড়কে গালে ঠেকনো দিয়ে টিকে থাকে। ফলতঃ ফ্রেমের উপরাংশ তার ধারালো চক্ষুদ্বয়ের উর্ধ্বরেখার সাথে মিলে থাকে। সে যখন ঝুলে পড়া চশমায়, ঝকঝকে দন্তশোভায়, ক্ষুরধার কথায় মানানসই মস্তক সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুগম্ভীর ভাবে পেশ করে তখনও আমার তাকে দেখে বেশ মজা লাগে।
একথা 'হঠাৎ যদি' পৌলমী শুনতে পায় তাহলে নিশ্চিত আরো অসন্তুষ্ট হয়ে আরো সিরিয়াসলি বলবে - আপনাদের মতো লঘুচিত্ত বুড়োদের জন্যই দেশের আজ এই অবস্থা। সিরিয়াস বিষয়ে সিরিয়াসলি আলোচনা করছি তাও আপনার মজা লাগছে? কিন্তু কী করি। আমার জন্ম বোধহয় ফাজলামি তিথির ফচকেমি লগ্নে রসিকতা নক্ষত্রে, তাই কুষ্টিতে লেখা আছে ইয়ারকি রাশি ও চ্যাংড়ামি গণ। তাই লঘু মজা, খেলো রসিকতা করার জন্য আঙ্গুল, মুখ মুখিয়ে থাকে। মন তো থাকেই।
তার চক্ষুদুটিও 'প্রজাতন্ত্র' টিভির মূখ্য পুরুষ নোঙ্গর - 'সাগর গোপতি' সদৃশ বুদ্ধিদীপ্ত। তবে 'হযউক' নালার মহিলা নোঙ্গর 'সাগরের' মতো লাফালাফি বা তর্জনী আস্ফালন করে আড়াইশো ডেসিবেলে গর্জন করেন না। শোনা গেছে নিয়মিত সমূদ্রগর্জন শুনে ছায়াপথের এক দূরবর্তী তারা থেকে - যেখানে মানুষের চেয়ে অনুন্নত কোনো প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে - বেতার তরঙ্গে বিপন্ন বার্তা পাঠিয়েছে - "ব্লিপ, ব্লিপ, হ্যালো পৃথিবী, আমরা তোমাদের গ্ৰহ থেকে এক নোঙ্গর 'সাগরের' কথা বেতার তরঙ্গের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি, তাই জানতে চাইছি পৃথিবীবাসীর, বিশেষ করে ভারতবাসীর কানের কী অবস্থা?"
তো সেই যুবতী নোঙ্গর লম্বা হাতার ব্লাউজে, মার্জিত পোষাকে, পরিমিত প্রসাধনে পরিপাটি হয়ে পরিচ্ছন্ন ভাষায় প্রভূত বিশ্লেষণ সহকারে সেদিনের নির্ধারিত বিষয়ে তার বক্তব্য পেশ করেন। তাই তার কথা শুনতে বেশ লাগে। মনে হয় এনাদের মতো অপেশাদার নোঙ্গরদের দেখে 'মহাসাগর' গোষ্ঠীর পেশাদার নোঙ্গররা কেন বোঝে না যে কেবল গর্জন করলেই বক্তব্যের ওজন বাড়ে না। তাতে থাকা চাই কিছু সারবস্তুও। কারণ দর্শকদের যতটা নির্বোধ ভেবে তারা তাদের ফাঁকির পসরা সাজিয়ে টিভির পর্দায় সাংবাদিকতার নামে বাণিজ্য করতে হাজির হন - সবার না হলেও - অনেকের কাছেই তা রীতিমতো বিরক্তিকর লাগে।
হঠাৎ ওঠা কথার মতো অনেক কিছুই হঠাৎ হয়। হঠাৎ আসে অতিমারী। হঠাৎ হারায় চাকরি। হঠাৎ মানুষ প্রেমে পড়ে। হঠাৎ তাকে তোলে ঘরে। হঠাৎ ফুরোয় মোহের ঘোর। হঠাৎ ভাঙে তিথিডোর। এভাবে নানা কিছু বহুদিন ধরে ভোগ, যত্ন, সঞ্চয়, অবহেলা, অপব্যবহার করার পর হঠাৎ কোনো পরিস্থিতি, ঘটনা, কথা, দৃশ্যে হঠাৎই হয় বোধোদয়।
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘুমচোখে দুফোঁটা আইটোন দিয়ে একটা টুলে বসে আমি ফুট ম্যাসাজারে পা দুটো ঢুকিয়ে দিই। মেশিন কোঁয়াও কোঁয়াও করে ম্যাসাজ করতে থাকে পায়ের পাতা। আমি চোখ বুঁজে আফিমখোর বুড়োর মতো ঝিমোতে থাকি। শরীর থেকে ধীরে ধীরে কেটে যায় বাঁচাবুচা ঘুমের রেশ। তারপর উঠে একটু হাত পা নাড়ি। শরীর নামক যন্ত্রটাকেও তো চালু রাখতে হবে। না হলে করোনার কড়কানি কমলে আবার 'একলা চলো রে' হবে কী করে? আসলে আমি মূলতঃ ঘুমকাতুরে। কোনোকালেই আমার ভোরে উঠতে ভালো লাগে না। অথচ ভোরের মহিমাময় সৌন্দর্য উপভোগ করতেও ভালো লাগে। এ যেন পেটরোগার রাবড়ি ভোজনের বাসনা। ছড়াবে তবু ছাড়বে না।
ড্রয়িং রুমের যেখানে বসে রোজ আমার এই প্রাতঃবিলাস হয় তার ডান দিকে পরপর তিন থাক ও বাঁদিকে মেঝেতে পাশাপাশি দুটো কার্ডবোর্ড কার্টন রাখা আছে। পাঁচটাই Amazon Pantry থেকে পাওয়া। কার্টনগুলো ভালো। তাই ফেলিনি। ডানদিকের তিন থাকে থাকে বই ও বেড়ানোর সামগ্ৰী। বাঁদিকের মেঝেতে দুটো কার্টন Items Quarantine Chamber. চায়না, দুবাই থেকে আসা সম্ভাব্য করোনা আক্রান্ত যাত্রীদের মতো দোকান থেকে কেনা মুদীর মালগুলো প্রথমে ঢোকে এক নম্বরে। তিনদিন পড়ে থাকে সেখানে। প্যাকেটের গায়ে করোনো ভাইরাস লেগে থাকলেও কাউকে কামড়াতে না পেরে তিনদিনে তারা অনশনে মারা যাবে। এমনই নিদান দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন যাচ্ছে (মারা) রাস্তায় কিছু পরিযায়ী শ্রমিক। করোনা আতঙ্কে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে। তারপর দ্রব্যগুলি আসে দু নম্বর কার্টনের সেফ জোনে। বৌমণিকে করোনাকালীন SOP বুঝিয়ে দিয়েছি। তিনি দুনম্বরী বাক্স থেকে মাল নেন।
তো সেদিন পা ম্যাসাজ করতে করতে তন্দ্রাজড়ানো চোখ পড়লো ডানদিকের কার্টনে লেখা লোগোটার দিকে। আগে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু সেদিন '
হঠাৎ যখন পড়লো চোখে' তখন লোগোটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো তার তাৎপর্য। হয়তো এ তাৎপর্যের সাথে আমার পরিচিত সবাই বহু আগে থেকেই পরিচিত। আমারই উপলব্ধি হোলো হালে। লেট লতিফ বলে।
লোগোর নীচে তীরের ন্যাজটা a তে শুরু হয়ে মুখটা শেষ হয়েছে z তে। তার পর দুটো অক্ষর on. অর্থাৎ লোগোটা যদিও বিখ্যাত বর্ষাবনের নাম তবে সে যেন গ্ৰাহককে বলতে চাইছে - a to z যা চাইবে, on dot পৌঁছে যাবে ঘরে। তীরটাও স্মাইলির মতো - অর্থাৎ be happy, ডু ফূর্তি and be rest assured about on time delivery.
বহু বিখ্যাত কোম্পানির নামের আদ্যক্ষর ক্যাপিটাল লেটার - Google, Microsoft, Apple, Volvo, Reliance, Airtel ইত্যাদি। Indigo’র আদ্যক্ষর তো স্বগর্বে ঘোষণা করছে আমিত্ব - I'm the best. কারুর ব্র্যান্ড আবার অল ক্যাপ - TATA, BMW, AMD যদিও শেষোক্ত ব্র্যান্ডের বড়দার ঘোষণা subtle & intelligent - “intel” - কারণ সে জানে তার খেলা চলে insideএ।
কিন্তু আমাজনের কারবার বহুজনকে নিয়ে যাদের কারুর আবার বোল্ড, ক্যাপিটাল অক্ষর দেখে চোখ কড়কড় করে। তেমন লোকজন বেশী হয়ে আমাজন বয়কট করলে বেজোসকে বেচাকেনা বন্ধ করতে হবে। তাই হয়তো আমাজনের লোগো অল লোয়ার কেস।
আজীবন আমরা নিয়ত বহু কিছু দেখি, শুনি, তবে কখনো 'হযপচো' বা 'হযশুকা' (শুনি কানে) থেকে হঠাৎ হতে পারে 'হযহম' (হলো মনে)। অপ্রত্যাশিত দৃশ্য, আলটপকা কথা, আচমকা উপলব্ধি - এসবের অভিঘাত কখনো হতে পারে অনন্য এবং সূদুরপ্রসারী।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।