আইন পাশ হচ্ছে আইনসভায়, দ্রুত ও আলোচনাহীন। নতুন আইন কার্যকর হচ্ছে। নাগরিকরা যথারীতি, সে আইন পালনে বাধ্য। গণতন্ত্রের, চালু গণতন্ত্রের নিয়ম এমনই। সারা বিশ্বে এরকমটাই স্বীকৃত, মান্য। সিরিয়াস৯-র এবারের বিষয় আইনের শাসন। এই সংখ্যায় অতিমারী পর্যায়ে আইনের শাসন নিয়ে লিখেছেন সুজাত ভদ্র; উত্তর পূর্ব ভারতে আইনের শাসন বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে নিয়ে লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র। এ ছাড়া রয়েছে ভারতে আইনের শাসনের সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়ে একটি আলোচনা, এবং আইনের শাসনের দার্শনিক ও প্রায়োগিক দিককে সমস্যায়িত করে একটি লেখাও থাকল এবারের সংখ্যায়।
এই নিবন্ধে দেখানো হয়েছে উত্তর পূর্ব ভারত, বিশেষত আসাম কীভাবে ভারত রাষ্ট্রের অপর হয়ে থেকেছে শুরু থেকে, এবং সে অপরীকরণের অন্যতম মদতদাতা রাষ্ট্রশক্তি। আইনের শাসনের নামে যে কোনও রকমের নিপীড়ন চলেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। আইনের শাসন কার্যত এখানে ভারী বুটের শব্দ, বারুদের গন্ধ ও আর্তনাদ।
১
উত্তর-পূর্ব ভারত। অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা এই সাতটি রাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অঞ্চল। সাত বোনের দেশ নামেও এর পরিচয়।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্য মনে করে ব্রিটিশ শাসনকালে সীমান্ত সুরক্ষা অথবা অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধা আদায়ের জন্য তাদের জোর করে ভারতের মানচিত্রের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এবং এই অন্তর্ভূক্তিকালে মানুষের কোনও মতামত নেওয়াই হয়নি। ফলে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে অথবা জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম এই অঞ্চলের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য।
• ১৯৫০ সাল নাগাদ, নাগা জাতীয় কাউন্সিল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে একটি সহিংস ব্যর্থ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। জেড ফিজোর নেতৃত্বে তারা নাগাদের জন্য নাগালিম নামে একটি স্বাধীন দেশ দাবি করেছিল। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় এনএসসিএন এবং আরও পরে এনএসসিএন দুইভাগ হয় আইসাক মুঈভা গ্রুপ ও খাপলাং গ্রুপ। দাবি প্রত্যাহৃত হয়নি।
• ১৯৭১ সালে মেঘালয় আসাম রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে আচিক জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক কাউন্সিল (এএনভিসি) এর নেতৃত্বে গারো পাহাড়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছে। যদিও সেখানে আসাম মডেলে জাতিদাঙ্গা মাঝে মাঝেই প্রবল হয়ে ওঠে।
• ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর মণিপুর ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ হয়ে যায়। মণিপুরের ভারত রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সংকল্পে এবং ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়াকে অনিচ্ছাকৃত দাবি করে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী সংগঠনের জন্ম হয়। সশস্ত্র বাহিনী মণিপুরে প্রবল অত্যাচার চালায় বিশেষত মহিলাদের ধর্ষণ আর পুরুষদের উপর অত্যাচার করে নিখোঁজ করে দেওয়া ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এসবের প্রতিবাদে মণিপুরী মহিলারা নগ্ন হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদেরও ধর্ষণ করো শ্লোগানে অভিনব প্রতিবাদ জানান। শর্মিলা চানু ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় জুড়ে অনশন চালান। রাষ্ট্রশক্তি ইউএনএলএফ, পিএলএ, প্রিপাক এবং কেসিপি, কেআরএ এর মত অনেক সংগঠনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
• ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে ত্রিপুরা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফটি) একটি ত্রিপুরি জাতীয়তাবাদী সংগঠন যা ত্রিপুরাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। ১৯৯০ সালের মার্চে গঠিত হয় অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স। বিজয় রাংখলের নেতৃত্বে তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ভারত এবং আশেপাশের বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের বহিষ্কার।
• অসম-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল তানিল্যান্ড (এনএলসিটি) সক্রিয় ছিল এবং এর সদস্যরা তানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যারা দাবি তানিল্যান্ড গঠনের দাবিদার। অরুণাচল প্রদেশে আদিবাসী বিদ্রোহ আন্দোলনের একমাত্র ঘটনাটি ছিল অরুণাচল ড্রাগন ফোর্স (এডিএফ) এর উত্থানে, যা ২০০১ সালে পূর্ব ভারত লিবারেশন ফ্রন্ট (ইএলএফ) হিসাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।
• ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। লালডেঙ্গার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিতে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এমএনএফ। মিজোরামের বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং সুরক্ষা বলের অফিসে তারা আক্রমণ চালায়, এবং দখল করে। ২৫ মার্চ ১৯৬৬ পাল্টা আক্রমণে ভারত সরকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অফিস গুলি পুনর্দখল করে নেয়। পরবর্তী বেশ কয়েকবছর বিদ্রোহীরা পাল্টা লড়াই চালায়। এই সময়েই ভারত সরকার আইজলের সিভিল এলাকায় বিমান আক্রমণ চালিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে বিদ্রোহীরা বাধ্য হয় শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে।
আরও পড়ুন, অতিমারী ও রাষ্ট্রের শাসক চোখ নিয়ে সুজাত ভদ্রের লেখা
১৯৫৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম এবং নাগাল্যান্ড, এএফএসপিএ (সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইনের) জারি করে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল যাতে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা দমন করা যায়। আইনের শাসনের নামে ভারতীয় রাষ্ট্র যে দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে গেছে তার প্রথমটি হলো সেনাবাহিনী নামিয়ে সব ধরণের দমনমূলক আইন প্রয়োগ করে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলকে অগ্নিগর্ভ করে রেখে, উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা করে, সব বিদ্রোহ দমন করা। আর তার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের সহায়তায়, আইনসভার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বহুধাবিভক্ত গোষ্ঠীভেদকে উৎসাহিত করে, বিরোধ বাধিয়ে, সংঘর্ষ বাধিয়ে রাজত্ব করা। এই মুহূর্তে প্রদেশগুলিতে আপাত শান্তি বিরাজমান। শ্মশানের শান্তি। তবু সেখানে টহলরত ভারী বুটের শব্দ। আফস্পা আতঙ্ক। ধর্ষিতা মহিলা আর নিখোঁজ পুরুষদের পরিবার নিঃশব্দ কান্নায় উতরোল। বালির বস্তার পিছনে সঙ্গীন উঁচিয়ে সেনা। আর এই সব অসহায় ক্রোধ ফেটে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রণাঙ্গনে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সরকারি কর্মীর হাতে, পুলিশের হাতে, সেনাবাহিনীর হাতে, বিচারকদের হাতে, সাংবাদিকদের বা প্রচার মাধ্যমের হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে, এমনকি জঙ্গিদের হাতেও থাকে স্বেচ্ছাচারিতার অগাধ ক্ষমতার উপস্থিতি। তারাই ক্ষমতা বৃত্তের ভরকেন্দ্র। সাধারণ মানুষ এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
২
কিন্তু এই সব প্রদেশের মধ্যে শুধু স্থানিক নয়, এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরেও আইনের শাসনের বিকৃতির জন্য সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে আসাম। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল শিবসাগরের রং-ঘরে আলফার পত্তন হয়। গত শতাব্দীর আট এবং নয়ের দশকে আলফা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়া জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। স্বাধীন আসামের লক্ষ্যে, ভারতবর্ষের উপনিবেশ না হয়ে থাকার উদ্দেশ্যে, আলাদা রাষ্ট্রগঠনের যুদ্ধে আলফাই ছিল দুই দশক ধরে অসমীয়া জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূল ভিত্তি। আসামের ভূমিপুত্রদের জন্য, স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করা ছিল তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। বহুল সংখ্যক অসমীয়া যুবক আলফার দলভুক্ত হয়। ১৯৯০ সালের নভেম্বরে আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (UAPA) অনুযায়ী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আলফাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একদিকে চিন অন্যদিকে বাংলাদেশ এবং বার্মা সংযোগ এবং পাশাপাশি ভারত থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে বিপদসংকেত হিসাবে দেখা দেয়। ভারতীয় সেনা নভেম্বর ১৯৯০-এ অপারেশন বজরং, সেপ্টেম্বর ১৯৯১-এ অপারেশন রাইনো, ডিসেম্বর ২০০৩-এ অপারেশন অল ক্লিয়ার এবং অপারেশন রাইনো ২ সম্পন্ন করে। দুই দশকে বিদ্রোহী ও সরকারের সংঘর্ষে প্রায় ১০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছেন আসামে।
এদিকে তখন আসাম জুড়ে চলছে আসু এবং অগপ নেতৃত্বে বাংলাদেশি অভিবাসন বিরোধী বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন। অসমীয়া জনগণকে আলফার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আসাম চুক্তি সম্পাদন করার ব্যাপারে অতি উৎসাহী এবং বাঞ্ছাকল্পতরু হয়ে উঠেছিলেন। আসাম চুক্তি হলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বা তার পরে আসামে আসা বিদেশিদের আইন অনুসারে শনাক্ত করা, নাম মুছে ফেলা এবং বহিষ্কার করার চুক্তি। বিদেশি চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ন দীর্ঘ সময় যাবৎ আসামের রাজনীতির একটা রোগলক্ষণ। বর্তমানের দুনিয়া কাঁপানো এনআরসি প্রক্রিয়ারও আগে ছিল “ইললিগ্যাল মাইনরিটি (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইবুন্যাল) আইন” বা আইএমডিটি অ্যাক্ট, যা সংসদে পাশ হয় ১৯৮৩ সালে, ইন্দিরার সময়। ১৯৯৭ সালে যখন ভোটার তালিকায় ব্যাপক সংশোধন করা হয় তখন যাঁরা সঠিক প্রমাণপত্র দাখিল করতে পারেন নি, তাদের নামের আগে ‘ডি’ (ডাউটফুল) শব্দটি লিখে দেওয়া হয়। কাগজেকলমে তিন ডি হচ্ছে ‘ডিটেকশন, ডিলিশন, ডিপোর্টেশান’।
আরও পড়ুন, ভারতে আইনের শাসনের সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়ে আলোচনা
২০০৫ সালে একটি আবেদনের ভিত্তিতে শীর্ষ আদালতের তিন সদস্যের বেঞ্চ আইএমডিটি অ্যাক্ট বাতিল ঘোষণা করেন। বিলটি যখন বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে যায় তখন বাদী পক্ষ দুটি গলদ চিহ্নিত করেন। প্রথমত এই বিলে বলা ছিল একজন নাগরিক মাত্র দশজন বিদেশির নামে অভিযোগ জানাতে পারবে। দ্বিতীয়ত ‘বার্ডেন অব প্রুফ’ অভিযুক্তের ওপর না হয়ে অভিযোগকারীর ওপর ন্যস্ত করা। এঁদের দাবি ছিল আইন এমনভাবে সংশোধিত হোক যাতে যে কেউ খেয়াল খুশি মতো যতজন ইচ্ছে লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দিতে পারেন। আর অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা আদতে বিদেশি নন। অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ এই আইনটিকে বাতিল করার দায়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ সম্বন্ধে লিখেছেন ৩০ বছরের সুপ্রিম কোর্টের জীবনে তিনি এখনও পর্যন্ত এই পর্যায়ের অনুদার, কর্তৃত্ববাদী, প্রকৃতপক্ষে মানসিকভাবে ফ্যাসিবাদী ও সাম্প্রদায়িক, সংবিধানের এই দুর্ধর্ষ ব্যাখ্যা, মৌলিক আইনি নীতির প্রতি এই ধরণের অজ্ঞানতা ও বিশ্বাসঘাতকতা, আর মানবাধিকার ও মৌলিক মানুষের মূল্যবোধের সংবেদনশীলতাহীন কোন বিচার এবং রায়ের সম্মুখীন হননি। রায়ে বলা হয়েছিল নিজেকে এদেশের নাগরিক প্রমাণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র নয় সেই অভিযুক্ত মানুষটির উপরেই বর্তায়, কেননা তিনিই সবচাইতে ভাল জানেন তিনি বিদেশি কিনা। প্রশান্ত ভূষণ বলেছিলেন সে তো একজন খুনীও জানে সে খুন করেছে কি না। কিন্তু তা প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই রায় ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তিটাকেই নড়বড়ে করে দিল, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী।
এনআরসি বা সিএএ নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল বিরোধিতায় নামেনি। শুধুমাত্র চেষ্টা করে গেছে এবং যাচ্ছে, গোটা বিষয়টাকে আদালত চত্বরে ঢুকিয়ে দিতে, যাতে বিষয়টি সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যায়। আইনের ব্যখ্যা, পরিস্থিতির ব্যাখ্যা, ইতিহাস ও ভূগোলের রকমারি ব্যাখ্যায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের স্ব-নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস। তালিকাচ্যুত উনিশ লক্ষকে এবার ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ করতে হবে তারা এদেশের নাগরিক। সীতার সতীত্বের মত বারবার নাগরিকত্বের আইনি পরীক্ষা। সে অবশ্য গণতন্ত্রে সব প্রক্রিয়াই আইনি প্রক্রিয়া। আইন না মেনে গণতন্ত্রে কোনও কাজ করা সম্ভব নয়। আইন ভাঙা সম্ভব নয়, এবং আইন না জানা কোন অজুহাত হতে পারে না। বলা হয় আইন অন্ধ। আইন অন্ধ, বিচার অন্ধ, অথচ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে অনন্ত চক্ষুষ্মান হতে হবে। জীবদ্দশার বা তার পরেও এক নির্মম আইনের শাসনে ধ্বস্ত হতে থাকবে তাদের জীবন। সঙ্গে বেঁচে থাকবে ভারতবর্ষের শরীরে দুই দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। এনআরসি এবং সিএএ।
৩
উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা করে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে সীমাহীন ক্ষমতা অর্পণ করার ফলে উত্তর পূর্ব ভারত বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলের সুস্থিতি নষ্ট করে দিয়েছে। রাজ্য সরকারগুলি এই আফস্পা আইনটি কার্যকর করার দরকার আছে কিনা তা প্রস্তাব দিতে পারে। তবে আইনের ধারা (৩) এর অধীনে এখনও তাদের মতামত উপেক্ষা করে রাজ্যপাল বা কেন্দ্রীয় সরকার কোনও অঞ্চলকে উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা করতে পারে।
আফস্পা সশস্ত্র বাহিনীকে "উপদ্রুত অঞ্চলে" জনসাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অবাধ ক্ষমতা দেয়। কোনও অঞ্চলে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির জমায়েত নিষিদ্ধ করা, কোনও ব্যক্তি আইন লঙ্ঘন করছে বলে মনে করলে বলপ্রয়োগ করতে পারে। বিনা পরোয়ানায় একজনকে গ্রেপ্তার করতে পারে; হেফাজতে নিতে পারে, ওয়ারেন্ট ছাড়াই কোনও স্থান প্রবেশ বা খানাতল্লাশিও করতে পারে। সতর্ক করার পর প্রয়োজনবোধে গুলি করে হত্যাও করতে পারে। এর জন্য সেনাবাহিনীকে কোনও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না।
আরও পড়ুন, আইনের শাসন শেষত কতটা কার্যকর হতে পারে?
ভারত সরকার নিয়োজিত বিচারপতি জীবন রেড্ডি কমিশন আফস্পা বাতিল করার সুপারিশ করেছিল, কারণ "আইনটি ঘৃণা, উৎপীড়ন এবং স্বেচ্ছাচারিতার প্রতীক”। কমিশন ০৬.০৬.২০০৫ এ তার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ১০ বছর পর ২০১৫ সালে ভারত সরকার এএফএসপিএ বাতিলের জন্য বিচারপতি জীবন রেড্ডি কমিশনের যে সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে।
২৩ মার্চ ২০০৯, ইউএন কমিশনার ভারতকে আফস্পা বাতিলের জন্য বলেছিলেন। তিনি আইনটিকে "প্রাচীন ও ঔপনিবেশিক যুগের আইন হিসাবে অভিহিত করেছেন যা সমসাময়িক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানকে লঙ্ঘন করে।"
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে আফস্পা (এএফএসপিএ)-র সশস্ত্র বাহিনীর করা যে কোনও এনকাউন্টারকে সম্পূর্ণ তদন্তের মুখোমুখি করা উচিত। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, "ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সাধারণ ব্যক্তি বা জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী কিনা তা বিচার্য নয় বা আক্রমণকারী ছিল কিনা তা বিচার্য নয়। আইন জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী, রাষ্ট্র বা একজন সাধারণ ব্যক্তি সবার জন্যই সমান। এটি গণতন্ত্রের প্রয়োজন এবং আইনের শাসন সংরক্ষণ এবং স্বতন্ত্র স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা।সরকার বাধ্য হয়েছে অঞ্চলের প্রায় সবকটি প্রদেশের জঙ্গি নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে। এত বছরে আইনের শাসন উত্তর-পূর্বকে আতঙ্ক, ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ, হেফাজতে অত্যাচার ও হত্যা, জাতিদাঙ্গা, সীমাহীন দারিদ্র্য আর অনুন্নয়ন ছাড়া কিছুই দেয়নি।
আমার একটি জিজ্ঞাসা আছে। ১ ৯৭১ এর পরে Bangladesh কেন Assam, Manipur এর Sadhinotar পক্খে কোন সমর্থন করেনি ?