মাত্র কয়েক দশক আগেই আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা কী, তাই নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক হয়ে গিয়েছিল। উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীরা তখন বুঝে গিয়েছে বরাক উপত্যকার বাঙালী জাত্যাভিমানে ভাঙ্গন না ধরাতে পারলে, অত বড় একটা ভূখণ্ডকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ এই সময়কালে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগাতে। বরাকভ্যালির, তথা সমগ্র আসামের মুসলিম কমিউনিটিকে সেন্সাসে নিজেদেরকে অসমীয়াভাষী হিসাবে দেখানোর প্ররোচনা থেকে শুরু করে, ৬১ র বাংলাভাষা আন্দোলনের সময়কালে হাইলাকান্দিতে ভাষা দাঙ্গা, এবং পরিণামে ১৯ জুন পুলিশের গুলিতে ১১ জন মুসলিমের মৃত্যু, সবই অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সুবিধাই করে দিয়েছে।
যদিও ভাষা শহিদ স্টেশন কোনও একটি মাত্র ভাষার প্রাধান্যের পরিচায়ক নয়, সর্বজনীন একটি আবেদন সম্মত দাবী, তবু একথা অনুমেয় যে শিলচর স্টেশনকে বেছে নেওয়াই একষট্টির উনিশে মে-র স্মৃতিবিজড়িত আবেগপ্রসূত। বিধানসভায় চন্দ্রমোহন পাটোয়ারীর অনৃতভাষণের প্রতিপক্ষে সত্যপ্রতিষ্ঠা অতএব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগের সময়ে, আসাম গেজেট সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ (পৃষ্ঠা নং ১৪৬৪) এর একটি ধারাকে সকলে বিকৃতভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। যেখানে লিখিত রয়েছে প্রভিশান অনুসারে “আসামের আদিবাসিন্দার অর্থ, আসাম রাজ্যের অধিবাসী এবং অসমিয়া ভাষা বা আসামের কোনও উপজাতীয় উপভাষায় কথা বলা ব্যক্তি। অথবা কাছাড়ের ক্ষেত্রে, সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানুষ ।" রজাঘরিয়া স্বঘোষিত ভাষাতত্ববিদেরা বলতে শুরু করলেন যেহেতু কাছাড়ের (অবিভক্ত) আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে নির্দিষ্ট করা হয়নি, অতএব বাঙালীর সংখ্যাগুরু স্ট্যাটাস একটি ভ্রান্তিবিলাস। এরা কিন্তু সরকারী ভাষা আইন, আসাম ১৯৬০ এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেনা, যেখানে এই আইনকে পরিষ্কার ভাষায় “কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষার ব্যবহার সুরক্ষাকবচ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনটির ৫নং ধারায় বলা হয়েছে “ধারা ৩-এর কোনও কিছুকে বিরোধিতা না করেও, বাংলা ভাষা প্রশাসনিক ও অন্যান্য সরকারী প্রয়োজনে এবং কাছাড় জেলাতে জেলা পর্যায়ে ব্যবহৃত হবে, যতক্ষণ না জেলার মহকুমা পরিষদ এবং পৌর বোর্ডসমূহ জেলায় উপস্থিত একটি যৌথ সভায় যোগদানকারী সদস্যরা উপরি লিখিত একই উদ্দেশ্যে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সরকারী ভাষা গ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়।” ফলে যাঁরা বলেন যে বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক ভাষা বাংলা নয়, তাঁদের প্রথমেই এই আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো উচিত ছিল। প্রামাণ্য না হলেও, জনশ্রুতি অনুসারে, জেলার মহকুমা পরিষদ এবং পৌর বোর্ডসমূহের ওপর এতি অতিরিক্ত ক্ষমতা আরোপনের বিরুদ্ধেই ১৯৬১-র ভাষা আল্দোলনের শুরু। ১১ জন শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারের প্রাবল্যে আসাম সরকার বাধ্য হয় অফিশিয়াল আইনটি সংশোধন করতে। আসাম অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ (সংশোধন) আইন, ১৯৬১ তে বলা হয়েছে
আসাম আইন XXXIII এর ৫নং ধারার সংশোধনী:
৩. মুখ্য আইনের ধারা ৫, নিম্নলিখিত অংশ দ্বারা, প্রতিস্থাপিত হলো:
“৫. ধারা ৩-এ থাকা বিধানগুলির প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই, বাংলা ভাষা, প্রশাসনের এবং অন্যান্য সরকারী প্রয়োজনে কাছাড় জেলার জেলাপর্যায় পর্যন্ত ব্যবহার করা হবে।”
লক্ষ্য করে দেখুন, এই সংশোধনীতে দুটি নির্দিষ্টকরণ রয়েছে। মহকুমা পরিষদের উপর যে স্থানীয়ভাবে অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তনের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এটা ভাষা আন্দোলনের সাফল্য। দ্বিতীয়, বাংলা ভাষাকেই, প্রশাসনের এবং অন্যান্য সরকারি প্রয়োজনে কাছাড় জেলার সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আজও সেই আইনই বলবৎ রয়েছে। এবং প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট আসাম সরকারও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে অসমীয়া ভাষার বিজয়রথ ছোটালেও, বরাক এবং পরবর্তীতে বোডোল্যাণ্ডকে সরকারী ভাবে ধারাবাহিক ছাড় দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অতএব বরাক উপত্যকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী (বাঙালী) তাদের মাতৃভাষার (বাঙলা) অধিকার রক্ষার সংগ্রামে শহিদদের স্মৃতিতে স্টেশনের নামাকরণ করার বিরোধিতা করতে পারে না। ১৯৬১ সাল থেকে ২০২০, প্রায় ষাট বছর হাইবারনেশনের পর মনে হলো, বাঙালি বরাকে সংখ্যালঘু, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্প্রীতি ও উন্নয়ন বাধা প্রাপ্ত হবে একটি স্টেশনের নাম “ভাষা শহিদ “এই পরিবর্তনটুকুর ফলে ? আসলে এই উপত্যকাতেও বাঙালিকে সংখ্যা লঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা, এবং পাশাপাশি অসমীয়া ভাষাকে সংখ্যাগুরু প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই অসমীয়া আধিপত্যবাদ সফল হতে পারে।
তাই কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যসরকারের রিপোর্টের ভিত্তিতে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ভাষা শহিদ স্টেশন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, রাজ্য সরকারের চৌহদ্দিতে এসে তা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কেননা ভাষা শহীদ নামাকরণের মধ্য দিয়েই একষট্টির বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ১১ জন ভাষা শহিদ স্বীকৃতি পেয়ে যায়, যা অসমীয়াদের মধ্যের ভাষিক আগ্রাসনপন্থীরা এতকাল সন্তর্পনে এড়িয়ে এসেছেন। শিলচর স্টেশনে গুলি চালনার পর সরকারী তদন্ত কমিশন মেহরোত্রা কমিশনের রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি। এছাড়াও বরাক উপত্যকায় প্রচলিত বাংলার উপভাষা সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা বাঅসমীয়া উপভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার গূঢ় অভীপ্সা ধাক্কা খায়। যদিও সরকারি সর্বস্তরে বরাক উপত্যকার ভাষাকে বাংলা ভাষা হিসাবেই উল্লেখ করা হয়। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন মুখ্মন্ত্রী তরুণ গগৈ, রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদকে কী লিখেছিলেন দেখা যাক।
তৎকালীন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তার মতামত জানিয়ে জুলাই ১৮.২০০৮ রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদকে এ বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন( ডিও নং - সিএমও ১/২০০৮/২৪১৯)। তিনি লেখেন, “প্রিয় লালুপ্রসাদ, আমি এই চিঠি লিখছি শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে আসামের বরাক ভ্যালির শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ভাষাশহিদ স্টেশন শিলচর করার বিষয়ে।
প্রতিবছর উনিশে মে শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। যে ১১ জন সত্যাগ্রহী তাদের চূড়ান্ত বলিদান দিয়েছিলেন মাতৃভাষার কারণে, ১৯৬১ সালের ১৯শে মে তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। বরাকভ্যালির মানুষ পছন্দ করবে অনুপ্রাণিত করার মত শহীদ-স্মৃতিকে অনন্ত স্থায়িত্ব এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে সাধারণ মানুষ, নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিভিন্ন সংস্থা ইত্যাদি সঙ্গে জোরালোভাবে সমর্থন করেছে যে শিলচর রেলওয়ে স্টেশন ওই ১১ জন সত্যাগ্রহী, যারা তাদের জীবন বলিদান দিয়েছেন ওই রেলওয়ে স্টেশন ক্যাম্পাসে, তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে। এইসব স্ব-ব্যাখ্যামূলক উপস্থাপনা, যা এই বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়ক এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, শিলচরের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছে, তা এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। এই উপরিল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি আপনাকে অনুরোধ করব দয়া করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে, যাতে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে “ভাষা-শহিদ স্টেশন শিলচর” হিসেবে নতুনভাবে নামকরণ করা যায়।”
চিঠিটিতে তরুণ গগৈ শিলচর স্টেশনের নাম পরিবর্তনের পক্ষেই লালুপ্রসাদকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তিনি একবারের জন্যও বাংলা ভাষা কথাটির উল্লেখ করেন নি। মাতৃভাষা বলেছেন, কিন্তু বাংলা ভাষা বলেন নি। অসমীয়া রাজনীতিকেরা বরাকভ্যালির ভাষা বাংলা নয় প্রমাণ করতে যেখানে বদ্ধপরিকর, সেখানে তরুণ গগৈ স্রোতের বিপরীতে হেঁটে জনপ্রিয়তা খোয়াবেন কেন? অথচ আইন অনুযায়ী বরাকের ভাষা বাংলা। সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা বাংলাভাষা কথাটিই ব্যবহারে অভ্যস্ত। রাজনীতিকেরা শুধু ব্যতিক্রম। দশকের পর দশক তারা প্রশাসনিক আক্রমণের পাশাপাশি শিশুসুলভ বৌদ্ধিক আক্রমণ চালিয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে বরাক উপত্যকার ভাষা আসলে বাংলা নয়। অসমীয়ার উপভাষা। বড় জোর তাকে বরাকী বলা যেতে পারে। তাছাড়া বরাকের ভূমিপুত্র ডিমাসা বা মৈতেই মণিপুরী এবং মুসলিম কমিউনিটির কিছু ইন্ডেজেনিয়াস মানুষ। বাঙালিরা এখানে বহিরাগত।
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিভাজনের খেলাও। মুসলিম কমিউনিটিকে টোপ দেওয়া হচ্ছে তোমরা নিজেদের ভূমিপুত্র দাবি করো। হিন্দুদের বহিরাগত বলো। এবং প্রচার করো তোমাদের ভাষা অসমীয়াও নয়, বাংলাও নয়, সিলেটি। বলো সিলেটি নিজেই একটি ভাষা, তার স্ক্রিপ্ট নাগরী। গোপনে এমন প্রচারও চলছে যে বরাক এবং বাংলাদেশের সিলেট জেলা নিয়ে আলাদা রাজ্যের ডাক দিতে হবে। মোদ্দা কথা যেহেতু সিলেটি বাংলা নয়, ফলে বরাকে বাংলাভাষার দাবি এমনিতেই নস্যাৎ হয়ে যাবে। ডিমাসা, মার, মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, এগুলি তো আলাদা ভাষা, ফলে আলাদা জনগোষ্ঠী। আসামে বাংলা সংখ্যালঘুদেরই ভাষা ছিল, এবারে বরাকে বাংলাকে সংখ্যালঘুর ভাষা করে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। অসমীয়াভাষার ধাবন্ত রথের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাবে বঙ্গভাষা। তাই বরাক -উপত্যকা জুড়ে শুরু হয়েছে সিলেটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, বাংলা নয় (বাংলাদেশেও এই নিয়ে কোনদিন কোনও দাবি উঠেছে বলে শুনিনি), এই মর্মে নিভৃতে প্রচার।।
বরাকের মূল জনগোষ্ঠী মূলত শ্রীহট্ট অর্থাৎ সিলেট অরিজিন। এবার নতুন এক পদ্ধতি অবলম্বন করে অসম সাহিত্যসভার নেতৃত্বে বলা শুরু হলো বাংলা ভাষার সঙ্গে সিলেটি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। অসম সাহিত্যসভার হাইলাকান্দি অধিবেশনে তৎকালীন অগপ সরকারের মন্ত্রী শহিদুল আলম চৌধুরী প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। শাসকশ্রেণির মদতপুষ্ট কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলিমদের দিয়ে এই দাবিও তোলানো হলো, যে এই বরাকী আসলে অসমীয়া ভাষার একটি উপভাষা। যদিও কেউই তাদের দাবিকে আমল দেয় নি না বরাকে, না বাংলাদেশে। বরাকের বহু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর প্রতিআক্রমণে তারা সারস্বত বিতর্কে এঁটে উঠতে না পেরে তখনকার মতো ক্ষান্ত দেয়। ফলে এ কথা প্রমাণিত যে, যদিও অসমীয়াভাষী রাজনৈতিক নেতারা এবং তাদের পাপেট বরাক উপত্যকাজাত বিধায়ক-সাংসদ-দালালবাহিনী বরাকে বাংলাভাষার অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর, তবু সরকারি ভাবে বাংলাই আজও বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা।