তাঁর ডেস্টিনি ছিল লেখা। একদিন বলেছিলেন, “আমি যে লিখবো এটা জলপাইগুড়ির সবাই জানতেন। ও দীনেশ রায়ের ভাই,ওর তো লেখাই কাজ। আমিও জীবনভর আর কিছু করার কথা ভাবিনি। আমি লিখে গেছি। আমি লিখেই গেছি। আমার লেখার পাঠক নেই জেনেও। আমি আমার মতো করে লিখি। কাউকে কেয়ার করিনি।“ কি অদ্ভুত সমাপতন । লেখক, একটা মানুষ যে মাইনরিটি কমপ্লেক্স থেকে পরিপার্শ্বকে অস্বীকার করে,সে যে ভিতরে ভিতরে কতটা স্নেহলালায়িত এই শেষ দিনগুলিতে তা দেখেছি। লকডাউনের অন্ধকারে, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এর বাধ্যতামূলক প্রায় সঙ্গহীন আইসোলেশনে, শুধুমাত্র পরিবারের ঘেরাটোপে যে মানুষটি অনন্তযাত্রায় গেলেন, চুল্লিতে ঢুকলেন, বাংলা ভাষার শেষ মহিকান যোদ্ধা, তাঁর কি এভাবে যাওয়া শোভা পায়? একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, যে অক্ষরকাঙালও ছিল খুব। দেবেশ রায় পুড়ে গেলেন।
মালবিকা গুহমুস্তাফি, প্রথম থেকে দেবেশ রায় এবং সেতুবন্ধন-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ এর সেতু হয়ে কাজ করে গেছেন। কিভাবে 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়' আমার একটি প্রকাশিত প্রবন্ধ দেবেশবাবুর চোখে পড়েছিল আমার জানা নেই। কিন্তু ২৯শে জুলাই ২০১৮, তাঁর নির্দেশ আসে যে ওই প্রবন্ধটি তিনি সেতুবন্ধনে প্রকাশ করতে চান। দেবেশবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র রৌম্য আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, অনুজপ্রতিম বন্ধু ও সহকর্মী। আমি উত্তর না দেওয়ায় তিনি এবার রৌম্যকে ডেকে পাঠান এবং বলেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা নিয়ে আসতে। আমি সবিনয়ে জানাই যে লেখাটি প্রকাশিত এবং মাঝখানে একটা সময় অতিবাহিত হওয়ায় কিছুটা প্রেক্ষিত হারিয়েছেও বটে। তবু এরপরেও উনি লেখাটি প্রকাশ করতে চান, কেননা ওঁর ধারণায় সেতুবন্ধন এর পাঠক আর ওয়েব পোর্টালের পাঠক ভিন্ন। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
এরপর দীর্ঘ সময়ে আমি মেইলে একের পর এক এন.আর.সি, সি.এ.এ বিষয়ে প্রবন্ধ এমনকি কবিতাগুচ্ছও পাঠাই, সেগুলি ছাপাও হয়। তাঁর সঙ্গে তখন আমার যোগাযোগ ই-মেল বা মালবিকার মাধ্যমে। এরই মধ্যে একদিন শ্রীমতি গুহমুস্তাফি জানান যে দেবেশবাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে চান এবং স্টার থিয়েটারে যে বিনোদিনী হল, সেখানে একটি আর্ট এক্সিবিশনে তিনি উপস্থিত থাকবেন আমি যেন পজিটিভলি তাঁর সাথে দেখা করি। ঘটনাচক্রে প্রদর্শনীটি ছিল আমার বন্ধু দীপ্ত দাশগুপ্তের ছবির। এক্সিবিশনে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ভাস্কর সুনীল পাল, দেবেশ রায় প্রভৃতি। গোটা অনুষ্ঠান কন্ডাক্ট করেন দেবেশ রায় এবং সাহিত্য ও ছবির বিষয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তি দেখে আমি মুগ্ধ হই। অনুষ্ঠানের শেষে তাঁকে প্রণাম করে যখন বলি যে আমার নাম পার্থ, তখন তিনি চকিত হয়ে বলেন, "আরে! আপনার এত কম বয়স তো আশাই করিনি। এত গম্ভীর গম্ভীর কথা লেখেন কী করে?" আমি বললাম, আমার বয়সের গাছ পাথর নেই, আর আপনি আমাকে 'আপনি' করে বলবেন না কারণ সর্ববিষয়েই আমি আপনার থেকে অনেক ছোটো। আমাকে 'আপনি' বলেন কেন? মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, "আমি সবাইকে আপনিই বলি"। এটা কী উত্তর হলো কে জানে? সেদিন জেনেছিলাম ইনি আমার চেয়ে চব্বিশ বছরের বড়।
দশ'ই নভেম্বর,২০১৯ থেকে তার বাড়িতে আমি সাকুল্যে গেছি দশ থেকে বারো দিন, গড়ে দিনে চার’ ঘণ্টা। চারশো ঘন্টায় আমি কি করে যেন কনফিডেন্স পেয়ে গেছিলাম যে সামনের এই মানুষটিকে মনের যা ইচ্ছে বলা যায়, তিনি ক্রুদ্ধ হবেন না, অপমান করবেন না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আচ্ছা লোকে আপনাকে এত ভয় পায় কেন? তিনি অবাক বিস্ময়ে মুখ তুলে বললেন, "আমিতো ভীতিপ্রদ নই বলেই জানি।" আমি বললাম আচ্ছা না হয় সমীহই হল। তখন একটু গলা নামিয়ে বললেন, "ওইটা আমি একটু মেইনটেইন করি। না করলে এত বাজে বাজে লেখা আমাকে পড়তে দিয়ে যায় লোকে, আর দিলে আমি না পড়ে ফেরত দিই না, তাই খুব খারাপ লেখা যাতে বেশি পড়তে না হয় সেজন্য একটু সমীহ করার মত ভাব আনার চেষ্টা করি। যাতে মনে হয় যে খারাপ লেখা হলে এই মানুষটি খুব বিরক্ত হবেন। তাতে একটা প্রাথমিক ফিল্টারিং হয়ে যায়।" আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা কমিউনিস্ট পার্টি যখন ভাগ হলো, আমরা যতটুকু জানি যে সৃষ্টিশীল এবং মেধাবী মানুষেরা সিপিআই'তে থেকে গেছে, আর সিপিএম মধ্যমেধার ক্যাডারকুল কে হস্তগত করতে পেরেছিল। এটা কেন? এটা কীভাবে হয়েছিল? উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, "আপনি তো সেই শ্রীকৃষ্ণ আর নারায়ণী সেনার গল্প শোনালেন। দূর্যোধন নারায়ণী সেনা পেল আর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে। এগুলো গল্প। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি বন্ধুত্বের বিষয়ে আমার কোন বাছাই ছিল না। শক্তি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল,আবার পূর্ণেন্দুও ছিল, সর্বোপরি দীপেন ছিল।" সত্যিই তাঁর সখ্যতার কোনও গণ্ডী ছিল না। কবি শঙ্খ ঘোষ থেকে সাম্প্রতিক গদ্যকার শাক্যজিত ভট্টাচার্য, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তাপস দাশের পাশাপাশি গদ্যকার অমর মিত্র, দীপেনের সঙ্গে শক্তি, পূর্ণেন্দুর সঙ্গে সুদূর আসামের সুজিত চৌধুরী এবং তাঁর ভাললাগার, ভালবাসার তালিকা দীর্ঘতর। আমি তাঁর বাড়ির ছেলে হলে অবশ্যই ঈর্ষাকাতর হতাম। কিন্তু এ কদিনেই আমি নিজের মত করে একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলাম। তাঁর দুটি জগত। এক তাঁর ঘরের লোক, দুই বাইরের লোক। প্রথমপক্ষ 'তুমি' আর দ্বিতীয়পক্ষ 'আপনি'। 'আপনি' মানে দূরের তা কিন্তু নয়। বরং অনেক তুমির থেকেও তাঁর ঘনিষ্ট বেশী। কিন্তু তুমি'রা হচ্ছে টাইমটেস্টেড। নিশ্চিন্ত অধিকারস্থল। আমি জানিনা তাঁর জীবনে কতজন 'আপনি' থেকে 'তুমি' হয়েছেন। আমি তো সামনে থেকে দেখেছি শুধু সমরেশবাবু, দেবর্ষি, রৌম্য, সোমা, আর মালবিকাকে 'তুমি' বলতে। পুত্রবধূ তৃপা, নাতি বিহান, কোরক সহ যতদূর জানি পারিবারিক সবাই 'তুমি'। দেবর্ষির বন্ধুরা (মালবিকা-মলয় সহ) হয়তো, 'তুমি'। রৌম্যের বন্ধুরা যেমন বিক্রম, কল্লোল এরা নিশ্চয়ই 'তুই' বা তুমি'ই হবে।
একদিন প্রশ্ন করলেন, "আপনি তো কবিতাও লেখেন। কোন কোন কাগজে লেখেন?" আমি বললাম কোন কাগজে না। কবিতা লিখি, নিজেই পড়ি, টাকা পয়সা পেলে ছোটো একটা কবিতার বই ছাপিয়ে দি। ব্যস। "না, মানে পাঠকের কাছে পৌঁছোন কী করে?" আমি তো পাঠকের কাছে পৌঁছাই না। বললাম তো, নিজেই পড়ি। উনি বললেন, "না আপনাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। আপনি একটা কাজ করুন। পরশু আপনার এন.আর.সি নিয়ে যা যা লেখা আছে, সব একসঙ্গে করে নিয়ে আসুন, বই বার করতে হবে একটা।" আমি বললাম আমার বই ? তিনি তখন প্রায় আনমনা বলে যাচ্ছেন, "বই তো ছাপিয়েই দেওয়া যায়। কিন্তু পাঠকের হাতে তো পৌঁছাতে হবে। আপনি আমায় দিয়ে যান। আমি একজন পাবলিশারের খোঁজ করি, যে যত্ন করে বইটা ছাপবে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটা ব্যবস্থা করবে। দেখি সুধাংশুদের সঙ্গে কথা বলি।" আমায় বললেন, "ঠিক আছে আপনি ম্যানুস্ক্রিপ্টটা তো পৌঁছে দিয়ে যান, তারপর দেখা যাক।"
দেবেশ রায়ের প্রচ্ছন্ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্য মমতা প্রীতিতে বহুবার এমন হয়েছে যে আমি বলতে বাধ্য হয়েছি আপনি একজন কমিউনিস্ট হয়ে এই কথা বলছেন? মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবে এটা আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর প্রশ্ন, "আপনি কি নকশাল ?" বলেই বললেন, "হলেও আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু মমতার মধ্যে যে প্রচন্ড বন্য শক্তির স্ফুরণ দেখেছি তা আর কোন দলের কোন নেতার মধ্যে আছে বলে এখন আমি বিশ্বাস করি না। মমতার দল একটি বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের দল। সেই সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রেখে আপনি আমায় বোঝান যে, মমতার বিকল্প হিসেবে কোন রাজনৈতিক নেতাকে আপনি এই আন্দোলনের পুরোভাগে নিয়ে আসতে পারেন?" এর পর থেকেই সম্ভবতঃ কমিউনিস্টরা দেবেশ রায় কে এড়িয় চলেন। তাঁর আজীবনের সুকৃতি নস্যাৎ হয়ে যায়। আমি যেদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল'এ, বরিশাল কেন রাখলেন? তিনি তো বরিশালে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। জটিল সাহিত্যবোধে, অনেক গভীরতর কথা বলা যেতো, কিন্তু দেবেশ রায় প্রথমেই বললেন, "তখনকার সময়ে জায়গার নাম দিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ চেনানো হতো। যেমন বরিশালের যোগেন মন্ডল, তিস্তাপারের বাঘারু , জলপাইগুড়ির দেবেশ এরকম। এর বেশি কোন কারণ তখন আমার মাথায় ছিলনা। আমার মাথায় ছিল একটা ঘোর, যে ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আমি দিস্তার পর দিস্তা বরিশালের যোগেন মন্ডল লিখেছি, শুধু প্রাকৃতিক কর্ম ছাড়া লেখা থেকে চোখ সরাইনি। অসুস্থ হয়ে পড়তাম, একটু সুস্থ হয়ে আবার লিখতে বসতাম।" আমি জিজ্ঞেস করলাম ঐরকম একটা জায়গায় যেখানে যোগেন মন্ডল পাড়ি দিচ্ছেন পাকিস্তানে, সেখানে বইটা শেষ করলেন কেন? তাঁর উত্তর ছিল, "আমি শুধু ঐটুকুই বলতে চেয়েছি। তার পরের অংশে আমার কোন আগ্রহ বা দায়িত্ব নেই। আমি তো ইতিহাস লিখছি না উপন্যাস লিখছি।"
হঠাৎই একদিন ফোন পেলাম "আপনি কি একবার আসতে পারবেন?" যাওয়ার পর তিনি 'আপন পাঠ' এর প্রকাশকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন "দে'জ এর সুধাংশু উৎসাহ দেখালো না, তাই আমি সন্দীপকে বললাম বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিতে।" আমি আজও বুঝতেই পারিনি যে মাত্র কয়েক দিনের পরিচয় এবং তার আগের মাত্র কয়েক মাসে সেতুবন্ধনে কিছু প্রক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখা ছাড়া যার কোন সাহিত্য পেডিগ্রি নেই, সেই মানুষের বই বার করার জন্য দেবেশ রায় এত উদগ্রীব কেন? জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি বইটি পড়েছেন? আপনার কি পড়ার পর মনে হয়েছে যে এই লেখাগুলি বই হিসেবে ছাপানোর যোগ্য? তাঁর উত্তর ছিল "আমি সাহিত্যগুণ বিচার করিনি। আমার মনে হয়েছে যে এই ধরনের একটি তথ্যসমৃদ্ধ এবং যার রাজনৈতিক বীক্ষা রয়েছে, এরকম একটি গ্রন্থ দেশের নাগরিকদের হাতে পৌঁছানো দরকার। তবে আপনার বইটি সম্পর্কে আমার একটি মাত্র পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। বইটির নাম দিয়েছেন 'তমসাব্রত'। কিন্তু এই ধরনের একটি বইয়ের এত আলঙ্কারিক নাম কেন? এই নামের ব্যঞ্জনায় মন কথাগুলি তো চাপা পড়ে যাবে। যেখানে রিক্ত, নিরন্ন, উদ্বাস্তু মানুষগুলি এন.আর.সি অথবা সি.এ.এ এর বলি হতে যাচ্ছে, তাদের কাছে তো এই অর্থ কোনদিনও পৌঁছাবেনা।" আমি ফস করে জিজ্ঞাসা করলাম এই বইটির ভূমিকা কি আপনি লিখে দেবেন? মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিলেন এবং বললেন "যে প্রথমত বিজেপির ভূমিকা সম্পর্কে আমার একটি অবস্থান রয়েছে যে অবস্থানের সঙ্গে আপনার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় এমন নয়। দ্বিতীয়তঃ আমি বিশ্বাস করি যে আমার নিজের নামে একটি বইও বেশি বিক্রি হবেনা। ফলে কোনো দিক থেকেই আপনার কোন লাভ নেই।" বললাম, আমি চাই কোন নতুন লেখক কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে নয়, ভারতবর্ষ যেভাবে এক অন্ধকার বৃত্তের দিকে এগিয়ে চলেছে তার বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থানের বিস্তৃত বর্ণনা আপনি আপনার মত করে উপক্রমনিকায় লিখুন। তিনি শর্ত দিলেন, "লিখতে পারি, যদি আমার নাম প্রচ্ছদে না থাকে।"
বিগত ছয় মাসে বারংবার তার বাড়িতে যাওয়ার সুবাদে যেন আলিবাবার রত্ন গুহা আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছিল। টুকরো টুকরো করে তিনি আমায় তাঁর বহু আত্মকথা শোনালেন। এর জন্য ঈশ্বরের ধন্যবাদ প্রাপ্য। 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' যেদিন বেরিয়েছিল তিনি স্ত্রীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে পালিয়ে গিয়েছিলেন টেনশন সহ্য করতে না পেরে। আবার তারাশংকর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসেন এবং তাঁর খোঁজ করেন তখন তিনি লজ্জায় সিঁটিয়ে লুকিয়ে ছিলেন গেটের পাশে, অন্ধকারে। যেখান থেকে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে উদ্ধার করেন। নন্দনে সত্যজিত রায়ের দীর্ঘ ছায়ার গল্প, দিল্লীর গল্প, শান্তিনিকেতনের গল্প, জলপাইগুড়ির গল্প, তিস্তার গল্প, দাদা দীনেশ রায়ের গল্প। বাড়িতে সহধর্মিনী আর বৌঠানের গল্প, ছেলেকে নিয়ে গর্বিত বাপের অফুরাণ গল্প, পুত্রবধূ আর নাতি বিহানের গল্প, গল্পবুড়োর ভাঁড়ার কবে আর শেষ হয়? তাঁর ভিতর এক শিশু লুকিয়ে ছিল, লুকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে গাম্ভীর্যের আবরণ ছিন্ন করে সেই শিশুটি উঁকি মারতো। তিনি ছিলেন প্রশংসায় অকৃপণ আর সমালোচনায় দুর্মুখ। প্রত্যেক শিল্পী-সাহিত্যিক যেন তাঁর গোষ্ঠীর লোক এবং তাদের প্রশংসা করা, কঠোর সমালোচনা করা তাঁর মালিন্যহীন দায়িত্ব। শিশুর মতই মিষ্টি খাবার বায়না ধরতেন, গোটা কলকাতায় কোথায় কোথায় ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় তাই নিয়ে আলোচনা করতেন এবং বলতেন যে, "মিষ্টি নিয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট আমার পছন্দ হয় না। মিষ্টির ব্যাপারে আমি সাবেক পন্থী।" একাকীত্ব থেকে দূরে থাকতে চাইতেন কেননা মানুষের মধ্যে থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু দেবর্ষি যখন তাঁকে নিয়ে যেতে চাইতেন, গাঁইগুঁই জুড়ে দিতেন। অথচ ছেলের গুণমুগ্ধ, ছেলের বৌ, নাতির প্রতি ভালবাসায় কোনও খামতি ছিল না।
শেষ দেখার আগের দিন আমি তাঁর সঙ্গে গল্প করতেই গেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বারবার দেশভাগ, বঙ্গভঙ্গ এবং সিলেট রেফারেন্ডামের কথা আসছিল। এই সূত্রেই পৃথক বরাক'এর বিভিন্ন তাত্ত্বিক অবস্থানের কথা উঠে আসে। প্রতিক্ষণের সূত্র, প্রয়াত সুজিত চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় সখ্যতা ছিল। কথা প্রসঙ্গে বললেন, "ছোট রাজ্য দাবী করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে কোনও রাজ্যকে আগে স্বনির্ভর হতে হবে, ওটা পুরোনো কনসেপ্ট। কিন্তু আগে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে ঠেকানো যে কোন ভারতীয় নাগরিকের প্রাথমিক এবং পবিত্র কর্তব্য। ভাষা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সামনে কোনও ঐক্যবদ্ধ রূপ তুলে ধরতে পারে নি। তাই আমি অনুরোধ করবো আগে বিজেপিকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করুন। তারপর নাহয় পৃথক রাজ্যের দাবী তুলবেন।"
আমাকে বলেছিলেন, "লেখার সময় কোনও হীনমন্যতা মনের মধ্যে বহন করবেন না। মনে রাখবেন আপনি লিখছেন বিশ্বসাহিত্যের ধারাবাহিকতা বহন করে। লিখছেন সময়ের জন্য। আপনার ভাষাশৈলী, আপনার বানানবিধি, আপনার জার্নি একক আপনার।" আমি লেখার ব্যাপারে আপোষহীন। এমনকি বহুবার প্রুফ সংশোধন করি। বইপাড়ায় আমার নতুন প্রকাশককে পুরোনো প্রকাশকেরা মজা করে জিজ্ঞাসা করেন "কীরে, কতবার প্রুফ ফেরৎ পাঠালো?" তাতে আমার কী এসে যায়? আমি জনপ্রিয় লেখক নই, সে তো পৃথিবীর বহু মহান শিল্পী, সাহিত্যিকই নয়। আমার কাজ হলো আমার মতো করে, নিষ্কলুষ থেকে, আমার জার্নি কমপ্লিট করা। আমার লেখায় আমি সৎ। প্রবঞ্চনা করি না। আমি আমার লেখার কাছেই সৎ থাকতে চাই। পাঠক বা প্রকাশকের কাছে নয়।
এই লেখায় আমি এমন কিছু লিখিনি যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত নয়। এমন কোনও উদ্ধৃতি নেই যা বিতর্কিত, যা নিয়ে মৃত মানুষটিকে ডিফেন্ড করতে হয় এবং তিনি সে সুযোগ না পান। আমার লেখা পড়ে যদি কেউ দেবেশ রায়ের চরিত্র-বিশ্লেষণ, বা পাঠ-বিশ্লেষণ করতে বসেন, তার চাইতে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বাংলা সাহিত্যর জন্য আর কিছু হয় না। মফস্বল শহর থেকে এসে কোলকাতার মত মহানগরে একটুকরো জায়গা বানাতে যেভাবে যন্ত্রণাদীর্ণ হতে হয়, সেই উদ্বাস্তু মানসিকতা ভূমিপুত্রেরা বোঝে না। আমিও তেমনিভাবেই একদিন এ শহরে এসেছিলাম। এটাই বোধহয় দুই অসমবয়সী বৃদ্ধের ভালবাসার সেতু ছিল। সইলো না। লোভ দেখিয়েই মানুষটাকে কেড়ে নিল সময়। আমার ক্ষত হলো, আমার ক্ষতি হলো। কেননা তিনিই হাত ধরে তুলছিলেন। তিনিই হাত ছেড়ে দিলেন।
মন ছুঁয়ে গেল।
Pranam
আন্তরিক লেখা।
বাংলা ভাষার শেষ মহিকান -- কথাটা কাঁটার মতো বুকের ভিতর গেঁথে গেল...
অনেক কিছু জানা গেল। সুন্দর লেখা। ধন্যবাদ পার্থদা।