আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো সংগঠন কেন? মানে বাংলা ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে আগে তো ধরুন মানে ভাষা ও চেতনা সমিতি ছিল, তারপর অসিতবাবুদের বাংলার মুখ ছিল, তারপরেও এতগুলো সংগঠন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে কেন?
প্রয়োজনীয় হয়েছে এই কারণে যে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য, নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হতে চলেছে। এটা তারই প্রমাণ। কারণ যখন নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন হয় সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এক একজন মানুষ বা এক এক গোষ্ঠীর মানুষ এক এক রকম ভাবে জিনিসটাকে দেখেন, যেটাকে ইংরাজিতে ভ্যান্টেজ পয়েন্ট বলে। তো সেই জায়গা থেকে তাঁরা সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, হয়ত একজনের সাথে আরেকজনের ওপর ওপর মিলছে না কিন্তু মূল জায়গাটা কোথাও একই থেকে যাচ্ছে, এক্সপ্রেশনটা কিছুটা আলাদা, এবং এটাই প্রমাণ করে যে আসলে এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা মানুষজন করছেন এবং খুব সিরিয়াসনেসের সঙ্গে করছেন, যার ফলেই তাঁরা তাদের উদ্যোগগুলোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন এবং নিজেদের মতন করে বড় করার চেষ্টা করছেন, যদিও শেষে সেই অভিমুখটা একই।
এই যে আপনি বললেন যে মূল জায়গাগুলো একই থেকে যাচ্ছে, সেটা যদি সত্যিই থেকে যাচ্ছে, তাহলে মানে, মূল জায়গা গুলো যদি এক থাকে তাহলে একটা ছাতার নিচে সবার একসাথে কাজ করা কি সম্ভব হচ্ছিল না, নাকি কোনও বড় জায়গা আছে তফাতের?
আসলে আমার যেটা মনে হয় যে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকেই সেরা যে পথ, শ্রেষ্ঠ পথ কোনটা তার একটা খোঁজ চালাচ্ছে। সেই খোঁজটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা শুধুমাত্র শুরুটা আর শেষটা দেখি, মাঝের যাত্রাপথটা দেখি না, কিন্তু যাত্রাপথটাও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই যাত্রাপথটা ঠিক কী হতে পারে সেটা এক এক জন মানুষ, এক একটা সংগঠন, দল, যাই বলুন, তারা তাদের মতন করে করছে, এবং কোথাও গিয়ে হয়ত তখন প্রয়োজন পড়লে, তারা একসাথে মিলেও যেতে পারে। সেটা একটা ছাতা হবে কি একটা সংগঠন কি একটা দল হবে, তা আমরা এই মুহূর্তে জানিনা, কিন্তু মূল লক্ষটা যতক্ষণ এক থাকবে ততক্ষণ তারা আলাদা আলাদা করে রাস্তার খোঁজ করলেও যেখানে তাঁরা পৌঁছতে চাইছেন সেই গন্তব্যস্থলটা একই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন, বাংলা পক্ষর গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
এইটার সূত্র ধরে একটা প্রশ্ন, আপনি কথাটা বললেন বলে আমার মনে হল, যে আপনারা তো, মানে, আপনাদের সংগঠনটা সম্প্রতি তৈরি হয়েছে, আপনারা আগে বাংলা পক্ষের সঙ্গে ছিলেন। এই বাংলা পক্ষ থেকে তাহলে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
বেরিয়ে যাওয়ার যে কারণ আমরা সেই সময়ে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলাম যে কোথাও গিয়ে আমাদের মনে হয়েছিল যে জায়গাটা, যে মতাদর্শের জায়গা থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, কোথাও তার থেকে বিচ্যুতি ঘটছে। তার কিছু কিছু প্রকাশ ছিল, যেমন আমরা কখনই জাতিবিদ্বেষী হতে চাইনি, কিছু ক্ষেত্রে হয়ত বা জাতিবিদ্বেষের ছোঁওয়া লাগছিল, এবং এনআরসি-র পরে যখন সিএবি আসে, সেটা পরবর্তীকালে সিএএ হয়, আমাদের কোথাও মনে হয়েছিল যে যতটা সোচ্চার আমরা এনআরসি নিয়ে হয়েছিলাম, ততটা হয়ত সিএএ নিয়ে হওয়া হচ্ছে না, আমাদের মতন করে তার একটি বিশ্লেষণ ছিল, সেটা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ছিল এবং আমাদের মনে হয়েছিল সি এ এ নিয়েও ততটা সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন, সেটা ওই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা হতে পারিনি, যে কোনো কারণেই হোক। এছাড়া আরও কিছু আন্তঃসাংগঠনিক কারণ ছিল যেগুলো আমরা প্রকাশ্যে কখনও বলিনি বা বলবও না…
না যেগুলো আপনারা প্রকাশ্যে বলেন নি সেগুলো নিয়ে আমার কিছু করার নেই, মানে আমি আসলে জায়গাগুলো বুঝতে চাইছি, যে মানে, ধরুন আমি একটা, মানে আমার বেশি কথা বলা উচিৎ না, আপনাকেই বলতে দেওয়া উচিৎ। আমি তবুও একটা উদাহরণ দিই, যে ধরুন বাংলায় নাটকের দল। বাংলায় নাটকের দল প্রচুর এটা বলে আমরা শ্লাঘা বোধ করি, কিতু বাংলায় নাটকের দল তো আসলে প্রচুর এই কারণেও যে দুজন ‘বড়’ একসঙ্গে থাকতে পারেন না, এরকম কি কোনও ছাপ, মানে এরকম কোনও আশঙ্কা হয় আপনার, ব্যক্তিগতভাবে বা সাংগঠনিক ভাবে, যে আমাদের “আমি” বড় হয়ে যাচ্ছে?
দেখুন এই আশঙ্কা বা এই সম্ভাবনা নেই বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। যতক্ষণ ব্যক্তি থাকবে ততক্ষণ ব্যক্তিত্ব থাকবে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নিয়েই সংগঠন তৈরি হয়, তাদের মধ্যেকার ঠোকাঠুকিগুলোও খুব স্বাভাবিক ঘটনা এবং ম্যাচ্যুরিটির প্রকাশ যেটা, সেটা হচ্ছে এই সংঘাত ইত্যাদিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বা মিটিয়ে নিয়ে একসাথে থেকে সংগঠনটাকে আরও বড় করা আন্দোলনটাকে আরও বৃহত্তর করা। আসলে এটাও একটা প্রক্রিয়া, এটা জোর করে চাপিয়ে দিয়ে হয়না, এটার একটা অরগ্যানিক প্রসেস থাকা দরকার এবং সেই অরগ্যানিক প্রসেসের অংশই হচ্ছে এই যেরকম সেল ডিভিশন হয়, কোষ বিভাজন হয় তেমনি সংগঠনও বিভাজিত হয়, তাতে যদি আন্দোলনটা দুর্বল হয়ে যায় তাহলে সেটা খারাপ। কিন্তু সেই আন্দোলন যদি আরও শক্তিবৃদ্ধি করে এই বিভাজনের ফলে, তার কায়াকলেবরের যদি আরও বাড়বাড়ন্ত ঘটে, তাহলে সেই ধরণের বিভাজনটাই অরগ্যানিক প্রসেসের অংশ। সে সংঘাতের ফলে হোক, মতবিরোধের ফলে হোক, মতান্তরের ফলে হোক, যে কারণেই হোক না কেন।
এবার এটার সাথে সাযুজ্য রেখে আমি একটা প্রশ্ন করি, যেটা সমমনস্ক সংগঠন গুলোর সঙ্গে আপনারা কি কোনও যৌথ কর্মসূচি নিয়েছেন বা কী ককী ধরনের যৌথ কর্মসূচি নিয়েছেন?
একাধিকবার। আমরা যেমন ধরুন, যৌথ কর্মসূচির মধ্যে কিছুদিন আগেই আমরা যেটা করেছিলাম রাজভবন অভিযান ছিল তার মধ্যে। তারপর এই জাস্ট কদিন আগেই ঘটল যে আরপিএফ-এর ঘটনাটা, সেইখানে আমরা বাঙালির তরফ থেকে সক্রিয়ভাবে তাঁরা সমর্থন জানিয়েছিলেন। এমনি ভাবে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সাথে আমরা একাধিক কর্মসূচি করেছি, বিভিন্ন বাম মনস্ক সংগঠনের সঙ্গে আমাদের একাধিক কর্মসূচি হয়েছে, এমনকি রাজ্যের শাসকদল যারা, তাঁদের ঘনিষ্ঠ মানুষজনদের সঙ্গেও আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে যৌথ কর্মসূচি হয়েছে। ইস্যুভিত্তিক ভাবে যৌথ কর্মসূচি আমরা করেই থাকি এবং আগামী দিনেও করব।
আরও পড়ুন, বাংলার মুখের অসিতবরণ রায়ের সাক্ষাৎকার
এবার এই সাংগঠনিক জায়গা থেকে এবার একটু অন্যান্য জায়গাগুলোয় আসা যাক। সেটা হচ্ছে যে ভারতের সামগ্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে আপনাদের কী ধারণা? ভারতীয় কি একটি জাতি পরিচয়, নাকি বাঙালি একটি জাতি পরিচয়, নাকি দুটোই?
বাঙালি একটি জাতি পরিচয়, এবং ভারতীয় একটি রাষ্ট্রীয় পরিচয়। এবং ভারতে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত বহু জাতি রয়েছে কারণ জাতি শব্দটি বা জাতির ধারণাটি আসে ভাষা থেকে। যেহেতু বহু ভাষা আছে, স্বাভাবিকভাবে বহু জাতি আছে, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, এবং এই সবটা মিলিয়েই ভারতবর্ষ। এবং ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র, এটি একটি জাতিরাষ্ট্র নয়, বহু জাতির সমাবেশে সে একটি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে এবং তার একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, সেটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারত একটি রাষ্ট্র তৈরি হয়নি। সেটা আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। সেই দিক থেকে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ঠিক যেরকম হওয়া উচিৎ ছিল সেরকমটি নেই। প্রথম থেকেই যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হচ্ছে, তখন রাজ্যের হাতে যতটা ক্ষমতা থাকা উচিৎ ছিল, তথাকথিত কেন্দ্র যেটাকে আমরা বলি, কেন্দ্র বলে আসলে কিছু নেই, তার হাতে ক্ষমতা যতটা কম থাকার কথা ছিল সেটা হয়নি। ভারসাম্য যে কোনো কারণেই হোক ঠিকঠাক ভাবে থাকেনি বলেই আজকের দিনে এক দেশ এক ভোট এক নেতা এই গোছের জিনিসপত্র গুলো উঠে আসছে। কিন্তু ভারতের মত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যদি ঠিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটা থাকতো, তাহলে এগুলো হওয়ার কোনও কারণ ছিল না।
বাংলা ভাষা সংস্কৃতির প্রসার প্রচারের জন্য রাজ্য সরকারের উপর চাপ তৈরির ব্যাপারে আপনারা বা অন্য কোনও সংগঠন মানে বাঙালি জাতি বা বাংলা জাতীয়তাবাদী বিবাদ নিয়ে অন্য কোনও সংগঠন তেমন ভাবে ক্রিয়াশীল নয় - এটার কারণ কী বলতে পারেন?
আমি এটা সরাসরি নাকচ করছি কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের কাছেই আমাদের অধিকাংশ দাবিগুলো পেশ করা হয়। চাপ সৃষ্টির প্রশ্নটা আসলে খুবই আপেক্ষিক। মানে কোনটাকে আমি চাপ সৃষ্টি বলব কোনটাকে বলব না, তা নির্ভর করছে কে বলছে, কোন সময়ে বলছে, তার ওপর। আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যখন ডমিসাইল চালুর দাবি আমরা করি সেটা তো এক অর্থে রাজ্য সরকারের কাছেই ছিল এবং তা নিয়ে আমরা লাগাতার আমাদের কাজগুলো আমরা করে গেছি, সেটা আন্দোলন…
তখন বোধহয় আপনারা বাংলা পক্ষের সঙ্গে ছিলেন!
হ্যাঁ তখন অবিভক্ত বাংলা পক্ষই ছিল। আমি গোটাটা নিয়ে, ধারাটা নিয়েই বলি…
না না, বুঝতে পেরেছি।
তো সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা প্রফেসরদের সঙ্গে কথা বলা, ডিপার্টমেন্ট হেডের সঙ্গে কথা বলা, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলা, যাবতীয় জিনিসই করেছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের যে ইউনিয়নগুলো আছে তাদের জিনিসটার যৌক্তিকতা বোঝানো - সবাই যে বুঝলেন তা নয় - কেউ বুঝেছেন কেউ বিরোধিতা করেছেন - স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমরা পোস্টার লাগানো, লিফলেট দেওয়া, ছোট মিছিল, বড় মিছিল নয়, দু দশজন মিলে মিছিল করে যাওয়া - এগুলো কিন্তু আমরা লাগাতার করেছি তারপরেই কিন্তু ডমিসাইলটা চালু হয়েছে। এটা একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র।
এইটার সাপেক্ষে আমার একটি দ্বিতীয় প্রশ্ন আছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রশ্ন। ধরুন আপনি যাদবপুরের ডমিসাইলের কথা বললেন, যাদবপুরের ডমিসাইল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। কিন্তু যেখানে সত্যি সত্যিই যাদবপুরের, যাদবপুরকে যদি আমি, আপনি অস্বীকার করবেন না নিশ্চয়ই, যে সেটা একটা অভিজাত ব্যাপার।
নিশ্চয়ই।
এইবার আপনি যদি ডিসট্রিক্ট কোর্টে যান, সাব ডিভিশনাল কোর্টে যান, রেজিস্ট্রি অফিসে যান, মানে রেজিস্ট্রি অফিসে হয়ত এখনও সেই একটা বাংলা টাইপের একটা কিছু বাংলা লেখা হয়, কিন্তু আদালতে কুৎসিত ভাষায় একটা ইংরাজি লেখা হয়। কুৎসিত ভাষাটা বলে নয়, একটা ইংরাজি লেখা হয় যা মানুষের বোধগম্য নয় আর কী! এবং যে মানুষ বাদী এবং যে মানুষ বিবাদী তাদের পক্ষে সেই ভাষাটা সম্পূর্ণ মানে সম্পূর্ণ একটা ভিনগ্রহের ভাষাও হতে পারে। এইটার ব্যাপারে… এইটা কি অনেক বেশি জরুরি নয় যাদবপুর ডমিসাইলের থেকে? এর ব্যাপারে আপনাদের কী উদ্যোগ?
এখানে বলি, আদালতে যে ভাষাগুলি চিরাচরিত ভাবে ব্যবহার হয়ে এসেছে ইংরাজির আগে, সেগুলি আসলে ঠিক বাংলাও নয়…
না বাংলা নয় তো, ফারসি ভাষা…
যার ফলে এবার বাংলায় আইনের যে ভাষা সেটা এখনও তৈরিই হয়নি। এবং ইংরেজদের আসার ফলে পরবর্তীকালে সেই ফারসিটা ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। মাঝখানে বাংলাটা বা ইভেন অন্যান্য রাজ্যের ভাষাতেও কিন্তু আইনটা আমরা কিন্তু পড়ি না। তো এই আইনের বিষয়টা এতটাই বিস্তৃত একটি জায়গা যেটাকে স্থানীয় একটি ভাষা বা বাঙালির কথাই যদি বলি, সেই বাংলা ভাষায় সেটাকে বই লেখা, আদালতে তার কাজকর্ম করা ইত্যাদি, একটি অত্যন্ত লম্বা পথ পাড়ি দেবার পরেই এই রকম একটি বিশাল দাবি নিয়ে সত্যি সত্যি কাজ করা সম্ভব হবে। মানে মুখে কথায় কথায় আমরা বলতেই পারি যে আদালতের সব কাজকর্ম বাংলায় হওয়া চাই, কিন্তু বাস্তবে যদি কেউ আমায় বলে তুমি ভাই আইনের বাংলা বই আমাকে দেখাও, আমি কিন্তু দু তিনটের বেশি দেখাতেই পারব না। কারণ সেই বইটা কেউ লেখেনি। তো এই জায়গাটা পৌঁছতে আমাদের এখনও অনেক দেরি আছে। আগে আমাদের ভিতটা তৈরি করতে হবে, তার উপরে সুপার স্ট্রাকচারের প্রশ্ন আসছে। তো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই দাবিটার গুরুত্ব কোনও ভাবেই আমরা ডমিসাইলের, মানে যাদবপুরের ডমিসাইলের থেকে কম বা বেশি এসব কিছু বলছি না। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কিন্তু এটি এক্ষুনি এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা করতে পারব - এটা বাস্তব চিত্র নয়। কিন্তু আগামী দিনে যাতে পারি, তার জন্যেই কিন্তু আমরা ধাপগুলো নেওয়া শুরু করেছি। ফুটস্টেপ গুলো আর কী!
এটা আরেকটু একটু লিঙ্গার করি, যে এই যে ধরুন চার্জশিট দেওয়া হয়, একটা চার্জশিট, সেটা তো পুলিশ দেয়, আদালতের কাছে দেয়। সেই চার্জশিটের ভাষাও, যার নামে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, সেই ভাষাটা অন্তত বেশ কিছু রাজ্যে তাদের নিজস্ব ভাষা দেওয়া হয়। মানে গৌতম নাওলাখার ক্ষেত্রে এটা প্রশ্নও উঠেছিল যে কিকরে মারাঠি ভাষায় লেখা চার্জশিট সবাই বুঝে ফেলল। তো আমাদের এখানে তো সেরকম কোনও প্রসিডিওর নেই।
এখানে বহু থানা থেকেই বাংলায় চার্জশিট দেওয়া হয়, সেটা আমি নিজে পেশায় আইনজীবী বলে সেটা জানি, এবার সেটাও এই কারণে দেওয়া হয় না যে ধরুন যে মানুষটার বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে সে পড়ে বুঝতে পারবে। সেটা এই কারণে দেওয়া হয় যে যিনি লিখছেন তিনি ইংরিজিতে খুব একটা সড়গড় নন। এটা হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি। বাংলা ভাষার প্রতি টান, বা দায়বদ্ধতার ফলে আমি চার্জশিটটা বাংলায় লিখব বা আইন রয়েছে, নিয়ম রয়েছে তার ফলে বাংলায় লিখছি এটা এখনও নয় এখানে। ব্যবহারিক কারণেই কেউ বাংলায় লেখেন, কলকাতা ঘেঁষা হলে ইংরাজিতে লিখবেন। এবার এই বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাতে হতে হবে বা বাংলার অন্যান্য যে ভূমিজ ভাষা তাতে হতে হবে, এই জায়গাতে আসতে আমাদের এখনও অনেকটা দেরি আছে। প্রয়োজনীয়তা কোনও ভাবেই অস্বীকার করছি না, ভীষণ দরকার। এবার যদি বলেন এক্ষুনি দরকার, আমি বলব হ্যাঁ এক্ষুনি দরকার। কিন্তু এটা নিয়ে সচেতনতা তৈরির যে প্রক্রিয়া আমরা সেটা সবে শুরু করেছি, কয়েক বছর হল। সময় লাগবে, একটা সময়ের পর কিন্তু এই দাবিটা সাধারণ যারা মানুষ কোর্টে আছেন, তাঁরাই তোলা শুরু করবেন। আমরা তখন সাহায্য করতে থাকব শুধুমাত্র। সেই দাবিটাকে রিয়ালাইজ করাতে চাই।
অনির্বাণ এই যে আপনি বলছেন যে এই আদালতের প্রক্রিয়াটা খুব, মানে আমি আপনার সাথে বেস সুপার স্ট্রাকচারের ব্যাপারে একমত হতে পারে বা নাও হতে পারি, কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়, আপনার সাথে একমত হওয়া তো আমার উদ্দেশ্য নয়, আপনি যে এটা বললেন এটা চমৎকার। কিন্তু আমি এবার এটার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, যে যার জন্য খুব আইন লাগবে না, একটু সচেতনতা লাগবে, ডাক্তারি প্রেস্ক্রিপশান লেখা। 1 Tab BD, 1 Tab PC - এবার আপনি বলবেন যে না ওটা তো লাতিন থেকে এসছে, লাতিন ভাষা থেকে এসেছে, কিন্তু এগুলো তো ঠিক ... মানে আমি আইন, ওটা একটা লম্বা প্রসেস, সে যুক্তিটা এখানে খাটবে না। প্রেসক্রিপশন লেখা অত কঠিন নয় মানে সরকারি হাসপাতালে যাঁরা যান… আমি নিজে আর জি কর - এ গিয়ে দেখেছি একজন ভদ্রমহিলা দোরে দোরে ঘুরে বেরাচ্ছেন তাঁর প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারবাবু কী লিখে দিয়েছেন সেইটুকু জানার জন্যে। মানে এইটাও কি করা সম্ভব নয়?
এবার দেখুন, কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
না মানে এক্ষুনি, আপনি যেরকম বললেন আদালতের ক্ষেত্রে কোনও বইই পাওয়া যায়না। সেটা এর ক্ষেত্রেও সত্যি যে চিকিৎসা শাস্ত্রের কটা বইই বা পাওয়া যাবে বাংলায়। কিন্তু সেটা তো শুধু এই কারণে নয় যে ডাক্তাররা বাংলায় সড়গড় নন, এরকম তো খুব বেশি নয় বোধহয় বাংলায় এখনও…
খুবই কম। ফলে এটা তো একটু সচেতনতার ব্যাপার এবং বাইরে থেকে যেভাবে যাদবপুর ডমিসাইলের ক্ষেত্রে প্রেসার ক্রিয়েট করা গিয়েছিল সেরকম প্রেসার তো এখানেও ক্রিয়েট করা সম্ভব বোধহয়। আমি জানি না। আমি বোঝার জন্য জিজ্ঞাসা করছি, আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছি না।
না বুঝতে পেরেছি। বাস্তব জায়গাটা হচ্ছে ধরুন যাদবপুরটা একটা ইন্সটিটিউশান ছিল। আমরা সামগ্রিক ভাবে গোটা বাংলা জুড়েই চাকরির ক্ষেত্রে এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ডমিসাইলের দাবি তুলছি। সেখানে উচ্চশিক্ষার পোস্টে সেখানে মেডিকাল ব্যাপারটা যেহেতু এখন কেন্দ্রের হাতে চলে গেছে নিটের ফলে, যার ফলে ওই অংশটা কিছুটা বাইরে চলে গেছে যদিও আমরা নিটের বিরুদ্ধে আমাদের দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। এবার সামগ্রিক ভাবেই পড়াশোনা এই প্রশ্নটা যতক্ষণ না ডমিসাইলটা সেখানে না হচ্ছে ততক্ষণ অবধি তার এই যে পরবর্তী ধাপ, এই যে প্রেস্ক্রিপশানটা বলছেন এটি একটি ব্যবহারিক জায়গা। ইতিমধ্যে যে ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন তাঁদের কাছে আমরা আবেদন জানাতেই পারি কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে সরকারি কোনও আইন করা হবে কিনা সেই জায়গাটাও ভেবে দেখার জায়গা আছে। কিন্তু আমরা তাকাতে চাইছি সামনের দিকে সামনের দিনে যারা মেডিকাল প্রফেশনে হোক বা যেকোনো প্রফেশনে হোক, তাঁরা যখন আসছেন, তাঁদের মধ্যে যেন বাঙালি হিসাবে এই জাত্যাভিমা টুকু থাকে যে ইংরাজি লিখতে পারা টা কোনও সার্থকতার জায়গা নয়, বরং ব্যবহারিক পোস্টে বাংলায় আমি পরিষেবা দিচ্ছি বা নিচ্ছি এটাই আমার জাতি হিসাবে সার্থকতা। এইটা হচ্ছে লারজার পিকচার। ইমিডিয়েট ডিমান্ডের প্রশ্নে আমি আপনার সাথে একমত। হ্যাঁ এই ডিমান্ডটা করাই উচিৎ। হতে পারে আমরা হয়ত এটা ভেবে উঠতে পারিনি। আপনি আমাকে বললেন এটা নিয়ে পরবর্তীকালে আলোচনা হবে, আমরা এই দাবিটা তুলবো। বিভিন্ন যে ডাক্তারদের ফোরাম আছে, যদিও তাঁরা সবাই সরকারি ডাক্তার তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই আমরা এই দাবির চিঠি পাঠাতেই পারি। কিন্তু মূল জায়গাটা হল যে তাঁরা কেন করবেন। এই কেন করবেন-এর উত্তরটা আমাদের কাছে হচ্ছে যে বাঙালি হিসাবে একটা জাত্যাভিমানের প্রশ্নে পড়বে যেটা শুধুমাত্র আইনে আছে কি নেই, কেউ একটা দাবি জানালো কি জানালো না এটার উপর নির্ভর যেন না করে - এটাই আমার বলার জায়গা। এবার আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, ইংরাজিটাকে যদি আমরা আমাদের সাথে রাখি, তার কিছু শব্দ যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যে ঢুকে গেছে, এখন তো চেয়ার টেবিল টাকে কেউ ইংরাজি বলে ধরে না, তেমন ভাবে চেয়ার টেবিল টা আমাদের বাংলায় ঢুকে যাবে যেমন ভাবে পাজামাটা ইংরাজি তে ঢুকে গেছে। এবার প্রশ্ন টা হল, আমি ভাষার বিরুদ্ধে কি কোন কথা বলছি আসলে? যখন হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলছি, আমি হিন্দির বিরুদ্ধে তা কিন্তু নয়, যেমন ভাবে ইংরাজি ভাষাটাকে রাষ্ট্রের সহায়তায় আমার ওপর একদম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা যেকোনো ভাষা, যেটা হিন্দির ক্ষেত্রে আসলে হয়, তখনই কিন্তু আমার রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রশ্ন আসছে। নাহলে আমার ভাষার মধ্যে তিন চারটে পাঁচটা করে শব্দ ঢুকল কি ঢুকল না, তা নিয়ে আমি এই কারণে মাথাব্যথা করবো না কারণ এই ভাবেই একটা ভাষা সজীব থাকে এবং বছরের পর বছর সে বেঁচে থাকে ; অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে এবং নিজের ভাষা থেকে অন্যকে শব্দ দিয়ে।
না, আমার কিন্তু এইটা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই, আমরা যেভাবে ফারসি শব্দ, মানে আমাদের বাংলা ভাষায় দেশি শব্দ-বিদেশি শব্দ আছে এবং ভাষা একটা বদ্ধ জলাও নয়। এটা আমি মনে করিনা, বা এই জায়গা থেকে আমি প্রশ্ন টা করছিও না। আমি প্রশ্নটা করতে চাইছি যে কালচারালি হিন্দি আমাদের ওপর, আপনি বলছেন রাজনৈতিক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তো কালচারালি আমরা এমন একটা জায়গার মধ্যে আছি যেখানে ইংরাজি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই কথাটা আমরা মেনে নিতেই চাইছি না, এটা আমার আশঙ্কা। ধরুন আপনি আমার সাথে কথা বলার সময় একদম শুরুতে, আপনারও অসুবিধা হল না আমারও হল না আপনি বললেন ভ্যান্টেজ পয়েন্ট, কিন্তু আমি যেটা জানতে চাই, জাত্যাভিমান যদি থাকে, ভাষার প্রতি সম্মান যদি থাকে, তবে এই যে ভ্যান্টেজ পয়েন্ট, এই যে আমি আপনাকে বলছি কমিউনিকেট করা, মানে এগুলির বাংলা প্রতিশব্দ নেই বলে তো নয়, এটা আমরা ব্যবহার করিনা, আর এই না ব্যবহার করার পিছনে আমাদের জাত্যাভিমানের কোন ঘাটতি আছে কিনা বা ইংরাজির ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে, হিন্দির ক্ষেত্রে সেটা নেই, হিন্দির ক্ষেত্রে আমরা একটু হয়ত একটু অতি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, কারণ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছিনা সেইরকম চাপিয়ে দেওয়া, সেই চাপিয়ে দেওয়াটার বিরুদ্ধে আমরা সরব হচ্ছিনা এরকম কোনো বাস্তবতা নেই তো?
না, এখানে আমি আবার ডিফার করছি এই কারণে যে, ইংরাজি যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক ভাষা, সেটা সূক্ষ্ম ভাবে হোক বা স্থূল ভাবে হোক, যদি আমাদের ভাষার মধ্যে ঢুকেও যা, আমরা যদি সচেতন ভাবে বাংলাটাকে ভুলে না যাই, অবচেতন ভাবে সম্ভবত ভুলবো না। সচেতন ভাবে ভুলে না গেলে ইংরাজি যে ফাঁক দিয়েই ঢুকুক না কেন, তাতে আমাদের আখেরে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাবে, এটা আমরা মনে করছি না, অন্তত আজকের দিনে নয়।
আচ্ছা, এই যে আপনি পাঠক্রম তৈরির ব্যাপারে বিজ্ঞান প্রযুক্তি উচ্চশিক্ষা, এই পাঠক্রম তৈরির ব্যাপারে আপনারা কি কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন? নিয়ে থাকলে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটা একটু বলবেন?
এটা ঠিক বুঝলাম না।
মানে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি উচ্চশিক্ষার পাঠক্রম বাংলায় তৈরি করার ব্যাপারে, যেগুলো নেই আসল, যেটা নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম, সেইটা তৈরি করার ব্যাপারে আপনারা কি কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন?
খুবই প্রাথমিক স্তরে, উদ্যোগটা হচ্ছে যে কিছু শিক্ষাবিদ এবং রিসার্চ যারা করছেন, এই মুহূর্তে ছাত্রই বলা যায় তাদের, তাদের সাথে আমাদের বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞানের কথাটাই আমি আগে বলছি, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আমাদের বেশ কিছু কথা হয়েছে অনেকেই আছেন যারা পপুলার সায়েন্সটাকে অন্তত বাংলায় মানুষের কাছে আনার কাজ করছেন, তো তাদের সাথে আমাদের একটা বাক্যালাপ হয়েছে, এবার খুব কংক্রিট ভাবে কী আমরা ভবিষ্যতে করতে পারি সেটা এখনও ওই বাক্যালাপের স্তরেই রয়েছে, এখনও সেটাকে লোকের সামনে আনার মতো কিছু করে উঠতে পারিনি, কিন্তু এই কথাবার্তাটা শুরু হয়েছে যে ভাই বাংলায় দরকার এবং তার জন্য আমাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে। এই আলোচনাটা আমরা শুরু করেছি।
এই ILP মানে Inner Line Permit, এটার ব্যাপারে আপনাদের কি মনে হয়, মানে দরকার না তুলে দেওয়া উচিৎ?
Inner Line Permit জিনিসটা, একটু ইতিহাসের জায়গায় যদি যাই, ১৯৫২-তে, আসামে কংগ্রেসের যিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন গোপীনাথ বরদলই, উনি সেই সময়ে জহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখেছিলেন, যে বাইরের থেকে লোক আসুক, অন্য রাজ্য থেকে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু তাদের ভোট দেওয়ার অধিকার আমরা দেবো না। বা, সরকারের তরফ থেকে দেওয়া উচিৎ হবে না। তো এই জায়গা থেকেই Inner Line Permit Outer line permit এসব কথা উঠে আসে, উত্তর পূর্বের অনেক জায়গাতেই এটা আছে এবং ভবিষ্যতে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রেও এই ধরনের ILP র প্রয়োজনীয়তা খুব সম্ভব হবে বলেই আমরা মনে করছি। এই মুহূর্তে যদি তা নাও বা থাকে, যেভাবে জনবিন্যাস অত্যন্ত দ্রুতভাবে পাল্টাচ্ছে, এবং পশ্চিমবাংলার মধ্যে বহু এলাকা যেখানকার সাধারণ ভূমি সন্তান যাঁরা ছিলেন, এখন তাঁরা আর নেই। তাঁরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন, সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছেন, ঘরছাড়া হয়ে যাচ্ছেন বলা যেতে পারে, তাতে হয়তো ILP র প্রয়োজন ভীষণভাবে পড়বে এবং গোপীনাথ বরদোলোইর কথাটা আমাদের পশ্চিমবাংলার প্রেক্ষিতেও ভেবে দেখার সময় আসছে আস্তে আস্তে।
আপনারা কি নিজেদের প্রাদেশিক বলে মনে করেন? মানে এবিষয়ে যদি সমালোচনা হয় যে ওরা প্রাদেশিক সংগঠন, তাহলে আপনি কী বলবেন?
নির্ভর করছে প্রাদেশিক বলতে কী বোঝাচ্ছে তার ওপর, যদি বলে বাঙালির হয়ে কথা বলছে, দেখ প্রাদেশিক, তাহলে আমরা প্রাদেশিক। যদি নিজের জাতির হয়ে কথা বলা প্রাদেশিকতা হয়, তাতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যাঁরা লড়েছেন, তাঁদের কেউ বিপ্লবী বলেছেন, কেউ আতঙ্কবাদী, সুতরাং ওতে কিছু যায় আসেনা।
আমরা প্রায় শেষে এসে গেছি। এই যে বাংলা ভাষা দুটো দেশে চালু, ভারত আর বাংলাদেশ; অবাধ যাতায়াত এবং বাজার চালু হলে বাংলা ভাষার বাজার বৃদ্ধি পাবে এবং উপকার হবে, এরকম কি আপনারা মনে করেন?
একদম মনে করি। নেপালের সাথে ভারতের যেরকম ওপেন বর্ডার আছে ঠিক সেইরকম ভাবে ওপেন বর্ডার বাকি ক্ষেত্রে যদি নাও হয় অন্তত বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাদের আদানপ্রদান টা আরও বেশি বৃদ্ধি হওয়া দরকার বলেই আমরা মনে করি এবং তাতে শুধু মাত্র যে বাংলার লাভ হবে তা তো নয়, গোটা ভারতেরও লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু আমাদের বাঙালিদের লাভটা বেশি হবে। এবং সেটা হবে বলেই সম্ভবত হতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই আশঙ্কাটাও বলে রাখলাম।
হিন্দি সিনেমা দিয়ে বা ওই হিন্দি খবর দিয়ে, মূলত হিন্দি সিনেমা দিয়েই হিন্দি বিস্তার করা হয়, সত্যিই হয়, মানে এই বলিউড এবং হিন্দি সিনেমা নিয়ে আপনাদের কী মতামত?
বলিউড অত্যন্ত সচেতন ভাবে, এমনভাবে দেখানো হয় যাতে ভারতীয় সিনেমা মানে বলিউড। বা ভারত ইক্যুয়াল টু হিন্দি এই ব্যাপারটা; আর খবরের চ্যানেলের ক্ষেত্রে আপনাকে বলি, নাম করেই বলছি Republic Bharat যেটা আসলে হিন্দি চ্যানেল, TV9 Bharatbarsha যেটা আসলে হিন্দি চ্যানেল, NDTV INDIA যেটা আসলে হিন্দি চ্যানেল, তো তারা বলছে না যে NDTV হিন্দি বা Republic হিন্দি কিন্তু যখন বাংলায় আসছে তখন বলছে Republic বাংলা, অর্থাৎ ভারত মানে হিন্দি এবং তারপরে বাকিরা এটার অত্যন্ত উগ্র এবং প্রচণ্ড টাকার জোর দিয়ে নিজেদের জোর দিয়ে প্রকাশ (inaudible), গোটা ভারতের, সত্যিকারের ভারত বলতে যা বোঝায়, তার যে ক্যানভাস সেটাকে ধ্বংস করার কাজই করছে। কোনও এক সময়ে আমাদের বাঙালির প্রচুর শিল্পীরা ওখানে কাজ করেছে, কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তার রাজনৈতিক যে প্রভাবটা এই বলিউড ফেলতে চলেছে তা বোধহয় বুঝতে পারেননি, বুলি করেছিলেন, তো এই জায়গায় দাঁড়িয়ে হিন্দিটাকে এই যে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া, মাথার মধ্যে - মগজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া কোনও সরাসরি রাজনৈতিক intervention ছাড়া, এটা একদম বলিউড করেছে এবং আগামী দিনে এই যে চক্র, এটাকে পাল্টাতে হবে। বলিউড একটি বিশাল ব্যাপার, গোটা বিশ্ব হয়তো ভারত বলতে বলিউডকে চেনে যার ফলে বাইরের থেকে কেউ এলেই বলে নমস্তে অথচ নমস্কার বলে না, তো এই সবটাই পাল্টানোর প্রক্রিয়া, সার ভারত জুড়েই আসলে শুরু হয়েছে অনেকদিন ধরে, মানে কোথাও হয়তো অনেকটা সময় ধরে চলছে, আমরা হয়তো পরে শুরু করলাম। কিন্তু ওই যেটা বললাম, সব পথ গিয়ে শেষে ওই একটা জায়গাতেই মিলবে যেরম প্রত্যেকটি জাতি তার নিজস্ব সম্মান নিয়ে বাঁচবে। যেখানে রাষ্ট্রের খবরদারি এভাবে থাকবে না। কোনও একটি ভাষা কোনও একটি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে না, রাষ্ট্রের অন্তত কোনও ভূমিকা থাকবে না।
আপনাদের সংগঠন, মানে বাংলা পক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে, সেই সংগঠন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী কী কর্মসূচি নিয়েছে বলে আপনারা মনে করছেন এবং কী রকম ভাবে কতো মানুষ অংশগ্রহণ করছে?
প্রথম যেটি সবচেয়ে বড়ো কর্মসূচি আমরা করি, সেটা হল বাবুল সুপ্রিয়, তখনও তিনি মন্ত্রী, তিনি মুস্তাফিউর রহমান বলে একটি ছেলেকে ফেসবুকে একদম প্রকাশ্যে অপমান করেছিলেন, তার নাগরিকত্বের প্রশ্ন তুলে, তার বিরুদ্ধে আমরা মুস্তাফিউরের সাথে যোগাযোগ করি, এবং ও হচ্ছে বীরভূমের ছেলে, তাকে যাদবপুরে আমরা নিয়ে আসি, যাদবপুরে কবীর সুমন মহাশয়ের উপস্থিতিতে আমরা একটি প্রতিবাদ সভা করি, সেটি আমাদের প্রথম বড়ো প্রোগ্রাম, যেখানে যাদবপুর অঞ্চলের আসলে অনেক স্টুডেন্ট সাধারণ মানুষ এবং কিছুটা অন্য জায়গা থেকেও তারা এসেছিলেন এরকম কিছু জন ছিলেন, যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেটাই বড়ো কর্মসূচি ছিল যার পরে বাবুল সুপ্রিয় কে statement দিতে হয়, দিতে বাধ্য হয় যে আমি ওই ভাবে বলতে চাইনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় হল যে আমরা যখন CAA NRC-র বিরুদ্ধে পার্ক সার্কাসে বহু মহিলাদের অবস্থান চলছিল, মূলত মহিলাদের, সেটাতে একটি উর্দুভাষী মহিলাকে নিয়ে মুসলিমদের অবস্থান হচ্ছে এরকম একটি ট্যাগ লেগে যায়, তো আমরা সেখানে অংশগ্রহণ করি। অন্য কোনও কারণে নয়, কারণ আমরা overall CAA NRC র বিরুদ্ধে কাজটা করছিলাম, সেই প্রক্রিয়ার জায়গা থেকেই অংশগ্রহণ করি এবং সেইখানে এই ভাষা বা জাতিগত যে বেরিয়ার, আমি এখানে বেরিয়ার শব্দটিই ব্যবহার করছি। সেইটাকে আমরা অতিক্রম করি কারণ বাংলা পক্ষ-য় যখন আমরা ছিলাম, তখন এই একটা প্রশ্ন ছিল যে এরা আসলে জাতিবিদ্বেষী এবং বাঙালি ছাড়া যারা রয়েছে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে তাদের প্রতি এদের আচরণ ঠিক নয়, তো সেই জায়গা থেকেই আমরা সচেতন ভাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি, আমাদের নিজেদের মধ্যে, এখানকার মানুষ যারা এবং আমাদের সাথে তাদের যে আদানপ্রদান হয় তার ফলশ্রুতি হচ্ছে যে সেখানে জয় বাংলা শ্লোগান ওঠে, লালন সাঁই এর গান হয়, বাংলা গান হয়, সেইখানকার মানুষজন যারা বাঙালি নন, মানে বহু পুরুষের বাসিন্দা তারাও গলা মেলাচ্ছেন, তো সমবেত ভাবে সেটি একটি সত্যিকারের প্রতিরোধ হয়ে উঠছে other than মুসলিম বা উর্দু মুসলিম মহিলাদের প্রতিবাদের থেকে সেটা আসলেই একটি প্রতিবাদ হয়ে উঠছিল যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করে, এইটা দ্বিতীয়। আর তৃতীয় যেটা হয় সেটা হচ্ছে এই আগের বছরে যে রবীন্দ্র সরোবরে ছট পুজোর নাম করে যে তাণ্ডব যা হয়, আমরা তা সক্রিয় ভাবে সারা রাত জেগে এবং সারা সকাল দুপুরটা, গোটা দুটো দিন মিলিয়ে আমাদের যারা স্বেচ্ছাসেবক বা সদস্য যারা রয়েছেন, তারা গোটা লেকটাকে পাহারা দিয়ে, এই যারা পুণ্যের নামে তাণ্ডব করতে ঢোকেন, তাদেরকে একদম সক্রিয় ভাবে আটকেছেন। আমরা মনে করি এটা আমাদের এযাবৎকালে সবচেয়ে চূড়ান্ত সাফল্যের জায়গা কর্মসূচির দিক থেকে, যেখানে আমরা সব মিলিয়ে ছিলাম ৩০-৪০ জন কিন্তু, ওদিক থেকে যে চাপটা ছিল, সেটা ছিল কয়েকশো লোকেরা। মারমুখী জনতাকেও আমরা ঠেকিয়েছিলাম। কিন্তু আটকেছিলাম সেদিন।
অনেক ধন্যবাদ অনির্বাণবাবু।
খুবই শিক্ষনীয় আলাপচারিতা। নিছক সাক্ষাৎকারের ঘেরাটোপের বাইরে কথোপকথন গড়ায় এর ব্যাপ্তি বেড়েছে।
"এইবার আপনি যদি ডিসট্রিক্ট কোর্টে যান, সাব ডিভিশনাল কোর্টে যান, রেজিস্ট্রি অফিসে যান, মানে রেজিস্ট্রি অফিসে হয়ত এখনও সেই একটা বাংলা টাইপের একটা কিছু বাংলা লেখা হয়, কিন্তু আদালতে কুৎসিত ভাষায় একটা ইংরাজি লেখা হয়। কুৎসিত ভাষাটা বলে নয়, একটা ইংরাজি লেখা হয় যা মানুষের বোধগম্য নয় আর কী! "
তাপস দা, জেনে খুশী হবে, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর এপারে হাইকোর্ট একুশের শহীদদের শ্রদ্ধা দেখিয়ে হাইকোর্ট একটি মামলার রায় বাংলায় দিয়েছে।
অন্য সব মামলার রায়ের সার সংক্ষেপ ওয়েবসাইটে বাংলায় প্রকাশের আদেশও রয়েছে।