
যে প্রসঙ্গ নিয়ে লিখছি নিশ্চয় তা আসামের বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য মুখ্যত পরিকল্পিত। কোটি কোটি টাকা দিয়ে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যেসব বাজনাদারদের বিভিন্ন চ্যানেলে, বিষক্রিয়ায় দক্ষ আইটি সেলে সেলে, গোয়েন্দা দপ্তরগুলিতে পুষে চলেছে, তাদের সমবেত শিবারবে সত্যমিথ্যা একাকার। একটা গোড়ার কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার: হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান নীতির মন্থনে একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে মহাতিমিঙ্গিল গুজরাতী পুঁজির দুই প্রধান মনসবদার। এদের নির্লজ্জতা ও হিংস্রতার পরিণামে দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের সুনামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির খিলানগুলি ভাঙে ফেলেছে। এদের প্রধানতম শ্ত্রু বাঙালি, অথচ নিজেদের ভাষা-অস্তিত্ব-সংস্কৃতি-নাগরিক অধিকার লুণ্ঠিত হতে দেখেও আমরা অন্তরে-বাহিরে অন্ধ। কোনো খাঁটি বাঙালি কখনও তার জাতির ঘৃণ্যতম শত্রুর পদলেহন করতে পারে না। নাগরিক পঞ্জি, ক্যাব (ক্যাআ) যে শুধুমাত্র আসামের বাঙালিদের সর্বনাশ করেই ক্ষান্ত হবে না, পশ্চিমবঙ্গের নানা বর্গের বাংলাভাষীদেরও চূড়ান্ত সর্বনাশ করবে—সেই সচেতনতা নেই।
নাগরিক পঞ্জির নীল নকশা আসামে পরীক্ষিত হচ্ছে। আপাতত মনে হচ্ছে, ধূর্ত ও প্রতারক শাসক এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে গেছে। কিন্তু এ কেবল তাদের রণকৌশল অনুযায়ী সাময়িক ভাবে পিছুহটা মাত্র; আসলে তাও কথার কথা। পেছনে ওরা যায়নি; চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা ও কেউটে সাপের অমোঘতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতির উপযোগী বিরাম নিয়েছে মাত্র। আসামের ক্ষেত্রে হিন্দি-অসমিয়া প্রভুত্ববাদী আঁতাতজনিত হিন্দুত্বকে তুরুপের তাস করেছে। ঐতিহাসিক কিছু বাধ্যবাধকতায় পূর্ববঙ্গ উৎসজাত বাঙলাভাষীরা আসামে সামূহিক হীনম্মন্যতার সহজ শিকার। তাই নাগরিক পঞ্জির নামে তাদের বৈধ ভারতীয়তার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত করলেও কেউ হচ্ছেন ময়ূরপুচ্ছধারী কাক, কেউ বা স্বতঃপ্রণোদিত ট্রয়ের ঘোড়া। শাসকবর্গ যে এদের স্বজাতিদ্রোহ ও নিরবচ্ছিন্ন ভৃত্যবৃত্তি সত্ত্বেও বিশ্বাস করে না, বছরের পর বছর এমনকি দশকের পর দশক অতিবাহিত হলেও এই নির্মম সত্য এদের মগজে ঢোকে না। তাই আসাম চুক্তি রূপায়ণ—নাগরিক পঞ্জি নবায়ন—ডি ভোটার—ক্যাব (ক্যাআ)—৬ নং ধারা বাস্তবায়ন ইত্যাদির মুষল-প্রহারে দেশের সংবিধানের মৌলিক নীতিকে নস্যাৎ করলেও ময়ূরপুচ্ছধারী কাকদের কিছুই যায় আসে না।
এই যে কথাগুলি লিখলাম, সমস্তই সম্ভবত দিবালোকের মতো স্পষ্ট এবং বহুবার উচ্চারিত। সমস্যা এখানেই যে আমরা অনেকেই স্বয়ংনির্বাচিত কূপমণ্ডূকতায় আক্রান্ত। নিজেদের আলাদা আলাদা কুয়োয় (রাজ্যের পরিসর, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল, ধর্মগোষ্ঠী, হিন্দুদের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রমভিত্তিক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, উপভাষিক পরিচিতি, বিভ্রান্তি-লালিত রাজনৈতিক দল, উপদল ইত্যাদি) আবদ্ধ থেকে ইতিহাস-নৃতত্ত্ব-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানবুদ্ধিকে অনুসরণ করার কোনো তাগিদই দেখাই না। ফলে আবহমান ভারত হিন্দুস্থানে রূপান্তরিত হলেও সে খবর রাখি না; তার ওপর বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের মগজধোলাইয়ের প্রচারে সর্বস্ব-অপহরণকারী শাসকের দানবিক ও পৈশাচিক চরিত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বদলে তাদের অবতার বলে বন্দনা করি। তাই তাদের নিশ্ছিদ্র মিথ্যাচার ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তুলে ক্যাব (ক্যাআ)-এর মতো জনবিরোধী আসুরিক অত্যাচারের স্বরূপ বুঝতে দেরি করে ফেলি। প্রকৃতপক্ষে এখনও কি সামগ্রিক পরিস্থিতির নিরিখে এর স্বরূপ বোঝার আদৌ কোনো চেষ্টা করছি? অথচ এই মূল কথাটি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় সমবেত উচ্চারণে বাংলাভাষীদের জানানো আবশ্যিক ছিল; অবিভক্ত ভারতবর্ষে যাঁরা নাগরিক এবং অবাঞ্ছিত ও আরোপিত দেশভাগের ফলে অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কিংবা ধর্মান্ধ সমাজ ও প্রশাসনের (প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন) যোগসাজশে বর্তমান খণ্ডিত ভারতে পরিব্রজন করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের সবাইয়ের প্রকৃতপক্ষে ভারতের আদিবাসিন্দা বা ভূমিপুত্র হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিত। বস্তুত অবিভক্ত ভারতবর্ষের বর্তমান সন্ততিরা খণ্ডিত ভারতের আসামে-পশ্চিমবঙ্গের-ত্রিপুরায় এবং অন্য কোনো প্রদেশে—যেখানে বাস করুন না কেন, তাঁরা সবাই ভূমিপুত্র এবং তাঁদের সংবিধানসম্মত অধিকারগুলি শুধুমাত্র অন্ধ জাতিবিদ্বেষ ও আক্রোশবশত কেড়ে নিতে চাইলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নগ্ন দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য।
অতএব আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ‘কৌশল’ হিসেবে নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি), ক্যাআ ইত্যাদি নিয়ে জাতিবিদ্বেষ-সর্বস্ব রাষ্ট্রনায়কেরা আপাতত কোনো কথা না বললেও কোভিদ অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গ প্রতিরোধের অজুহাত সহ ওই দুটি স্থগিত ব্রহ্মাস্ত্র-প্রয়োগ সম্পর্কে জনগণের মনোযোগ শিথিল করা চলবে না। আর আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার যে অসমিয়াভাষী জনগণকে আসাম চুক্তির ৬ নং ধারা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক আইনগত প্রশাসনিক সুরক্ষা দেওয়ার নামে শর্মা কমিটি যে শক্তিশেল প্রয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, তাতে গাঁওপঞ্চায়েত হেকে জেলা পরিষদ, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা, রাজ্যসভা পর্যন্ত অসমিয়া ভূমিপুত্রদের জন্য ১০০% সংরক্ষণ নিশ্চিত হবে। সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে ১০০% জীবিকা তাদের জন্য সংরক্ষিত হবে। এ ছাড়া হরিশঙ্কর ব্রহ্ম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সমস্ত জমি কেনাবেচার অধিকার অসমিয়া ভূমিপুত্রদের জন্য ১০০% সংরক্ষণ করা হবে। তো, ভারতীয় গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ধূলিসাৎ করে আসাম সরকার বাঙালিদের ‘তিন নম্বর ছাগলছানা’ করার সব আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। ক্যাআ-র নামে বাঙালিদের জন্য কী নিশ্ছিদ্র চক্রব্যূহ তৈরি হয়েছে, সেই খবর কি সত্যিই রাখি আমরা?
নির্বাচন নামক প্রহসন আসবে এবং যাবে। কিন্তু হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান নীতির গিলোটিনে বাঙালি জাতির মুণ্ডপাত অব্যাহত থাকবে। দেশ বলতে থাকবে শুধু ফাঁপা মানচিত্র যার সার্বিক দখল নিয়ে চলেছে আদানি-আম্বানিদের গৃহভৃত্য বিজেপি সরকার। এই সরকারের লাগাম যাদের হাতের মুঠোয়, তাদের চক্ষুলজ্জা নেই, বিবেক নেই, ইতিহাসবোধ নেই। বাঙালি ওদের বিচারে উইপোকা, ঘুসপেটিয়া। ক্যাআ-কে বুঝে নিতে হবে সেই নিরিখে। সীমিত পরিসরে শুধু একথাই লিখব: দেশভাগ কারা কেন করেছিল, এই প্রশ্নটা আবার উত্থাপিত হোক। খোদ পশ্চিমবঙ্গে সেই বিন্দুতে শুরু হয়েছিল বাঙালি-সত্তার পাতালযাত্রা। গত সাত বছরে দেশ জুড়ে বাঙালি হারিয়েছে তার অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। আসামে ক্যাআ, এনআরসি ইত্যাদি পরীক্ষাগারের অব্যর্থ দাওয়াই। যতদিন ভারতবর্ষ ছিল, তা বাঙালিরও অন্বিষ্ট ছিল। কিন্তু বিদ্বেষের বিষে আচ্ছন্ন ‘হিন্দুস্থান’? তা কি আদৌ বাঙালির?
santosh banerjee | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:৪৫498442