'হাত-রথ থাকতে থাকতেই পৃথিবীর সবকিছু দেখে ফেলা উচিত' এমন একটা কথা বলত ক্ষয়ে আসা এক বৃদ্ধা। যখন বলত তখন মুখ থাকত জানলার দিকে ঘোরানো,দৃষ্টি লোহার শিক পেরিয়ে অনেক দূরে। হাত অবধি বোঝা যেত কিন্তু রথ কী করে থাকতে পারে একজন মানুষের! রামায়ণ মহাভারতের কাল তো পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন। ওঁর নিজের শরীরকে চাকা লাগানো কাঠের রথ বলে মনে হত হয়তো।
ওই বৃদ্ধার কাছে আরেকজন বৃদ্ধা আসত বিকেলের দিকে গল্পগুজব করতে। খুব যে কথা হত এমন নয়, কিছুটা কথা বলে দুজনে চুপ করে থাকত।যখন চুপ করে আছে, তখনো কিন্তু চুপ করে নেই, কথা বলছে মনে হত। বাড়ি ফেরার সময় হলে বলত - মনা, ড্যানার কাছখান ধর, উঠুম, মুত চাপসে। শরীরের কোথায় রথ থাকে যেমন বুঝতাম না তেমন দিশা করতে পারতাম না শরীরের কোথায় ড্যানা থাকে। পরে কলোনীর সেই ঠাকুমা চেনালেন - ঘাড়ের কাছে উঁচু হয়ে থাকা হাড়ের ওই জায়গাটাকে ড্যানা বলে। ড্যানা থেকেই তাহলে কি ডানা! অর্থাৎ একদিন মানুষের পাখিজন্ম ছিল।
এইসব কথা শুনতাম আর আমার মাথা টলমল করত। প্রতিদিনের পৃথিবীর সঙ্গে দেখাশোনা করে উঠতে পারতাম না। একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলাম। শুয়ে বসে ভাত খেতে, বিড়ি ফুঁকে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো জীবন।
চৈত্র মাসের দুপুরবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হত রোদ আসলে অস্ত্র। বিশেষত গ্রীষ্মের রোদ। সারা পৃথিবী পুরাণকল্পনা হয়ে জ্বলজ্বল করছে। নেমে আসছে রোদের তীর, শেল, বর্শা, ব্যথা ও বেদনা। ত্রিশ পার না করা খেটে খাওয়া এক মানুষকে দেখতাম ইটভাটার পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে তারপর শুয়ে পড়ছে ধুলোতে। লুঙ্গি হাঁটু অবধি ওঠানো, নাভির নীচ থেকে চুইয়ে নেমেছে চুলের রেখা, কন্ঠার হাড় উঁচু হয়ে গেছে চেঁচিয়ে গান করতে করতে, মদের রসে চোখ লাল, পায়ে মাটি।রোদ লেগেছে লোকটার। ঘোর ঘোর ভাব। গাছের নীচে গামছা বিছিয়ে সে ঘুমিয়ে। অল্প অল্প শিরশিরে বাতাস। দেহ থেকে খানিক দূরে সবুজ রঙের একটা সাপ মিলিয়ে গেল। রোদ-খড়্গ লেগে নিজেকে ঘুড়ি বোধ হচ্ছিল ওঁর, শরীর একটু হাল্কা, ঘোর ঘোর, দুশো ছটা হাড়ে অল্প অল্প টান, আর একটু টান লাগলেই ভগবান লাটাই গুটিয়ে নিত, আকাশের ঘুড়ি ফিরে যেত আকাশে। পরে ওই লোকটা আমাকে বলেছে গুরুর দিব্যি খেয়ে, দেহতত্ত্বের গান শুনে শুনে নিজের বয়সের ত্রিশ বছর অবধি নৌকা মনে হত, ত্রিশ থেকে এখন অবধি হলুদ রঙের একটা ঘুড়ি মনে হয়।
নিয়ম মেনে এরপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা এল। পৃথিবী তিমিমাছের মতোন শ্বাস ছাড়ল। তাপ থিতোতে শুরু করল।
সেই মানুষ ঘুড়িদেহ ছেড়ে উঠে বসে হাই তোলে। অনেকক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই বয়ে চলা জলেই ওদের আড়াইশো ঘর বসতি ছিল। মা গঙ্গা খেয়ে নিয়েছে। ভাবে, বিকেলের পর এখানে শুয়ে হাবিজাবি স্বপ্ন দেখছিলাম।
সবুজ সাপটা ফিরে গিয়েছে গর্তে। বটগাছের মাথায় তারার দীপাবলি হয়েছে। গরমকালের অন্ধকার বলে সব দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
আমি ওই দুজন বৃদ্ধা ও লোকটাকে ছেড়ে দিলেও ওরা আমায় কিছুতেই ছাড়ছিল না। ওদের হাওয়ায় সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াতাম। রাত হলেই শরীরে জামাকাপড় রাখতে ইচ্ছে করত না। একদিন চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি নাভিতে একটা ছোট সুর্দশনপোকা পুষলে কেমন হয়। দৃষ্টি বুকে তুলে দেখি, ডানদিকের স্তনবৃন্ত বাঁ দিকের চেয়ে বড়ো, ওরা পরস্পরের বোন হয়।
রাত্রিবেলা বাড়ি এলাম। খানিক হেঁটে জানলা দিয়ে দেখি, মেয়েমানুষ শুয়ে আছে মেয়েমানুষের মতো হয়ে। বিছানায় নতুন চাদর পাতা। লাল রঙের বনজঙ্গল আঁকা। মাথার কাছে জানালাটা। বাইরে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার আকাশমণি গাছের মাথা। আলো নেভানো, পাখা চলছে,তবু হাতের কাছে একটা হাতপাখা রাখা।
ঘর থেকে বেরিয়ে বটগাছের কাছে নদীতে এলাম। জামাপ্যান্ট খুললাম অনেক সময় নিয়ে। ঘনকালো শরীরে অন্ধকারে চকচক করছে। নগ্ন শরীর অর্ধেক জলে রাখা।
মাথার কাছে বিরাট খোঁপার মতো মেঘ। কয়েকটা কুচোমাছ এসে খেলা করছে। খেপিয়ে তুলছে আমায়। আমার বুকের দুই বোনে এসে মুখ দিচ্ছে, ঠুকরে যাচ্ছে। জাগিয়ে দিচ্ছে আমায়। একটু একটু শরীর জলে গলে যাচ্ছে। নিশ্বাসে জল, প্রশ্বাসে জল। নাকের ফুটোতে, কানের ফুটোতে, মুখের ফুটোতে, লিঙ্গের ফুটোতে মাছেরা এসে চুমু খেয়ে চলে যাচ্ছে। ডুবে যেতে যেতে বুঝতে পারছি শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। জেগে উঠছে শরীর। সবুজ সাপটাকে দেখতে পাচ্ছি। ডাঙায় একটু একটু করে আলো ফুটছে। আর আমি একেবারে জলের নীচে, পাঁকের নীচে, ঝরা পাতাদের বিছানার নীচে তলিয়ে যাচ্ছি