বড় পূজার দিনগুলোতে আমাদের পাড়ার কারোরই দিনরাতের হিসেব থাকে না। বাইরবাড়ির বারোয়ারি মন্দিরে ভোরবেলায় ঢাকে কাঠি পড়তেই জেগে ওঠে সারা পাড়া। তবে আমাদের বাড়িতে দিন শুরু হয় তারও আগে। দেবদারু বাগানের মাথায় জমে থাকা কুয়াশায় রাতের জমাট অন্ধকার হারিয়ে যাবার আগেই বড়ঘরে বাতি জ্বলে ওঠে এসব দিন। উঠোনের কোণে নতুন বানানো উনুনে নতুন এঁটেল মাটির প্রলেপ পড়ে দিনের আলো আসার আগেই। আর ওদিকে ফুলের সাজিও ভরে ওঠে পদ্মফুলের কুঁড়ি পাপড়ি মেলার আগেই আগেই।
তবে আজ ফুলের সাজি নয়, পদ্মফুলের কুঁড়ি কলাপাতা জড়িয়ে হাজির হয় এ বাড়িতে। আর সে পদ্ম কুঁড়ি থেকে ফুল হবার আগেই এ বাড়ির উঠোন হেসে ওঠে তাঁর আপ্লুত হাসিতে,
পদ্মপুকুর বুজে যাতিছে মা, ডরে ছিলাম সন্ধি পূজাত ফুল আনতি পারবো কিনা….
আইনুল চাচার হাত থেকে পদ্মের কুঁড়িগুলো লাল বারান্দায় পড়তেই বাইরবাড়ির মন্দিরে ঢাকে বোল ওঠে। ধুনুচিতে পড়ে ধুনো। ফুলতোলা জামা পড়ে আমি গিয়ে দাঁড়াই মন্দিরের সামনে। ভোগের বগি থালে রাখা ক্ষীরের সন্দেশ আর রসবড়া দেখেই আমার সব আনন্দ হুট করে ফুরিয়ে যায়। ফিরে যাওয়ার দুঃখটুকু খুঁজে পাই মন্দিরে ঐ প্রতিমার চোখেও।
গিন্নি, তোমাকে তো প্রতিমার মতোই লাগছে এই জামা পরে…..
ভোগের একটা ক্ষীরের সন্দেশ আমার হাতে গুঁজে দেয় দাদু। গলার কাছে আটকে থাকা দুঃখটুকু আমি ভুলতে চাই হাতের সন্দেশে,
ও দাদু, আজ সন্ধিপূজায় আমি প্রদীপে ঘি দেবো কিন্তু।
তবে প্রতি বড়পূজাতেই আমার এই আবদার হেরে যায় ঘুমের কাছে। সারাদিন হৈ হৈ করে কাটালেও মধ্যরাতের সন্ধিপূজার সময় আমি তলিয়ে যাই ঘুমের দেশে। তবে সে ঘুমের ঘোরেও আমি টের পাই ১০৮টি ঘিয়ের প্রদীপের আঁচ ঠাকুমার হাতের ওম হয়ে আমার কপাল আর বুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর হালকা হয়ে আসা ঘুমে আমি শুনতে পাই,
সকল আগাবিঘা কেটে যাক আমার দিদির….
বিপদ নয় তো আমার ভয় ফুরিয়ে আসা দিনে, তরতর করে এগিয়ে আসা ফিরে যাবার দিনে। তাই নবমী ফুরিয়ে দশমীর সকাল আসতেই আমার চোখে কষ্ট জমে জল হয় বারবার। আর আমার সে কষ্টকে বুঝেই ঢাকেও সুর ওঠে,
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন…
দশমীর ভোগে পড়ে ঝিঙেশাইল চালের জলভাত, নারকেল কচুর ঘণ্ট, মান সেদ্ধ, থোড়ের ডাল আর ছানার সন্দেশ। দেবদারু বাগানের তলার বারোয়ারি আনন্দ এবার সত্যিসত্যিই ফুরিয়ে যায়। এরপর জলভরা মাটির হাঁড়িতে দর্পণ বিসর্জনের সময় যখন প্রতিমার মুখটা ঝাপসা হয়ে আসে, আমি বুঝে যাই কড়ে গোনা দিন নয়, এখন হিসেব শুধু কিছু মুহূর্তের।
ও দিদি, এদিকে আসো। অপরাজিতার ডাল বেঁধে যাও।
হলুদ মাখানো সুতায় অপরাজিতার ছোট্ট একটা ডাল আমার হাতে ঠাকুমা বেঁধে দিতেই বাঘকাকুর মাথায় ওঠে ভরা। লাল কাপড়ে ঢাকা সেই ভরা বড়ঘরের উঠে যেতেই শেষ হয়ে যায় বড়পূজা।
কিন্তু তাই বলে কি আর ঠাকুমার অবসর আছে? সন্ধ্যা নামতেই এপাড়া ওপাড়া থেকে সবাই আসবে বিজয়ার প্রণাম করতে। আর তাঁতঘরের ওই ক-জন তো বাড়ির ছোটদের নিয়ে মিষ্টিমুখ করতে আসবে হৈ হৈ করে।
তাই এদিন বাড়িতে ঠাকুমা বানায় তিলপিঠা। সারাবছর হয় না বলেই কিনা জানি না, তিলপিঠার স্বাদ আর ঘ্রাণ দিনকয়েক পরেও এ বাড়ির উঠানে ঠায় বসে থাকে। তিলপিঠার কাদম্বিনী ধান মাদলা গ্রাম থেকে এসেছে সেই কবে। সেই ধান রোদের ওম দিয়ে মাটির ডোলায় জমিয়ে রাখে বেশ কয়েক মাস ঠাকুমা। আশ্বিন এলে সেই রোদমাখানো ধান গায়ে মাখে ভোরের নীহার। সেই ধান ঢেঁকির গড়ে পড়লেই বের হয়ে আসে নরম রোদের মতো কোমল চাল।
আজ সেই চাল ধামা ভরে নেমেছে কাঠের উপরতলা থেকে দুপুরের আগেই। মনিপিসি বড় পাথরের খাবড়িতে ভিজিয়ে রেখেছিল যত্ন করে। লালবারান্দায় পূর্ণির মা বসে গেছে সেই চাল গুঁড়ো করতে। আর বড়বৌমা শিলপাটায় বাটতে বসে গেছে কোরা নারিকেল। একটু পর এই নারিকেল বাটার সাথে মিশিয়ে বেটে নেওয়া হবে সাদা তিলও।
খানিকক্ষণ পরে প্রতিমা নামানো হবে দেবদারু তলায়। সিঁদুর বরণের আগেই ঠাকুমা বানিয়ে ফেলবে তিলপিঠা। তাই ঠাকুমার এখন দম ফেলবার ফুরসতও নেই। খোলা উনুনে পেয়ারা গাছের দুটো শুকনো ডাল আর কতগুলো পাটখড়ি দিয়ে আঁচ দিয়ে দিল ঠাকুমা। উনুনে বসল খাবড়ি। তাতে পড়বে নারিকেল আর তিলবাটা।
ও ঠাকুমা, তিলের ক্ষীরসা বানাবে?
খাবড়িতে পড়ল দুধ। পাতলা সর পড়তেই ঠাকুমা অনবরত নেড়ে ঘন করে নিল দুধটুকু। সেই ঘন দুধে নারিকেল আর তিলবাটা পড়তেই বাইরবাড়িতে ধ্বনি পড়ল,
দূর্গা মাইকি জয়…….
ঠাকুমা আরও কয়েকটা খড়ি ঠেলে উনুনের আঁচ বাড়ায়। খাবড়িতে ফুটছে তিল-নারিকেল বাটা। এবার ঠাকুমা জলে ভেজানো তাল মিছড়ি দিয়ে দিল ক্ষীরসাতে। তা ঘন হতেই উনুন থেকে নামিয়ে নিল ঠাকুমা।
এবার উনুনে উঠল এ বাড়ির সবচেয়ে বড় লোহার কড়াই। তাতে গুড় মেশানো জল। এই জল ফুটলে সেদ্ধ করে বানানো হবে কাদম্বিনী চালগুঁড়ার কাই। মুঠোভরে সাদাতিলও ঠাকুমা ছড়িয়ে দেবে সেই কাইয়ের ভেতর।
দেবদারু তলায় একে একে জড়ো হচ্ছে পাড়ার সবাই। মন্দির থেকে খুলে ফেলা হচ্ছে কাগজ কাটা ফুল, কাপড়ের রঙধনু আর হ্যাজাক বাতি।
কাদম্বিনী চালগুঁড়ার সাদা তিল মেশানো কাই নেমে গিয়েছে উনুন থেকে। হাতে ঘি মাখিয়ে সেই কাইয়ের লেচির ভেতর ক্ষীরসা ভরে গোল গোল পিঠা বানিয়ে নিচ্ছে ঠাকুমা।
মা উনুনে এবার চড়িয়ে দিল পেতলের আরেকটি খাবড়ি। তাতে মনিপিসি ঢেলে দিল অনেকটা তেল। সেই তেল পুরোপুরি তেতে ওঠার আগেই তাতে তিলপিঠা গড়িয়ে দিল ঠাকুমা।
ও ঠাকুমা, তাড়াতাড়ি করো, সবাই সিঁদুর বরণ করতে চলে আসবে তো।
উঠোনে এখন পেয়ারা গাছের লম্বা ছায়া। তাতে মিশে যাচ্ছে তারে মেলে রাখা শুকোতে দেওয়া কাপড়ের ছায়া। আশ্বিনের শেষবেলার রোদ থেকে মুছে যাচ্ছে দিনের আঁচ।
বরইগাছের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ল একটু বাতাসে।
সারা উঠোনে ঘুরপাক খেতে খেতে সেই বাতাস গায়ে মেখে নিল কাদম্বিনী চালের ঘ্রাণ।
ও ঠাকুমা, তিলপিঠা ঘ্রাণ ছড়িয়েছে অনেক… তুলে ফেলো… হয়ে গেছে দেখো।
ঠাকুমা লাল হয়ে আসা তিলপিঠা ফেলে কলাপাতায় ঢাকা ধামায়। খানিক সময়ের মধ্যেই ভরে যায় ধামা।
মা আর বৌমারা সবাই নতুন কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে গেছে সিঁদুর বরণের জন্য। উনুনের শেষ তেলপিঠা পড়ল এবার ধামায়।
আজ সারাপাড়ার সাথে গোলেনূর দাদীও এসে দাঁড়িয়েছে দেবদারু তলায়। ঠাকুমার সিঁদুর বরণ দেখতে দেখতে গোলেনূর দাদীর স্বগতোক্তি,
সিঁদুর বরণের দিন বৌ’ক দেখতি প্রতিমার নাহালই লাগে…
আশ্বিন বেলার গা থেকে আলো মুছে গেল হুট করেই। ছায়াহীন দেবদারু তলার আলোও ডুবে গেল করোতোয়ার জলে বারোয়ারির আনন্দ বিসর্জন হতেই।
সাহাপাড়ার মসজিদে মুয়াজ্জিন আজানের সুর ধরতেই ফাঁকা মন্দিরে মাটির প্রদীপ পড়ল। ঠাকুমা সেই প্রদীপের আঁচ আমার কপাল আর বুকে ছুঁইয়ে আবার বলে উঠল,
আগাবিঘা কেটে যাক…
টিমটিমে প্রদীপের আলোয় সিঁদুর মাখা ঠাকুমাকে আমার কাছেও প্রতিমার মতোই লাগছে।