মূল ছবিঃ নিখিল মানান
।। সাত ।।
‘পাক্কা আণ্ডা’। দিল্লিতে আসার পর আমার শেখা প্রথম নতুন হিন্দি শব্দ আর প্রথম খাওয়া স্ট্রিট ফুড। জিনিসটা আর কিছুই না – পাতি ডিম সেদ্ধ। বিজয় নগরে আসার আগে তো হোটেলে উঠেছিলাম। সেখান পৌঁছে ঘরে মালপত্তর রেখে আমি আর তথা বেরিয়েছিলাম জায়গাটা একটু এক্সপ্লোর করতে। হোটেলটা বড় রাস্তা থেকে ঢুকে একটা মেজ রাস্তায়। আর সেখানে পথের ধারে একটা লোক ডিম বিক্রি করছে। কাঁচা এবং সেদ্ধ। একটা লোক শুধু যে ওই দুই পদার্থ বেচে তা আগে দেখিনি। অফিস পাড়ায় বা অন্যান্য জায়গায় যারা টোস্ট, অমলেট ইত্যাদি বিক্রি করে তারা ডিম সেদ্ধ বেচে থাকে দেখেছি। নুন আর গোলমরিচ গুঁড়ো সহযোগে দু জনে দুখানা ‘পাক্কা আন্ডা’ গলাধঃকরণ করলাম, নতুন শব্দ বলে কথা।
দিল্লির স্টেপল স্ট্রিট ফুড হল চাট, যেমন বম্বে, থুড়ি, মুম্বাইতে হল পাও। যেমন পাও-এর সাথে নানা জিনিস দিয়ে হরেক কিসিমের পাও তৈরি হয় (যেমন বড়া পাও, পাও ভাজি, মিশাল পাও ইত্যাদি), তেমনই দিল্লির চাট-এর কোনও শেষ নাই, খেয়ে আশ মেটানোর চেষ্টা বৃথা তাই। আলু চাট, পালক পাত্তা চাট (পালং শাক), শাকরকান্ডি চাট (রাঙা আলু), কুল্লে কি চাট (আলু আর নানাবিধ ফল)। দিল্লিওয়ালারা ফল ভালই খায়, বাঙালিদের মত কেবল অসুখ করলে আর প্রসাদ হিসেবে নয়। ফলগুলো পাওয়াও যায় খুব ভাল। চাট বানানোর সময়ে মিশিয়ে দেয় পাতি লেবুর রস, চাট মশলা, টক দই, আরও দু একটা গোপন মশলা। তার যা স্বাদ, আহা আহা…
হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পারছি আপনার জিভে জল আসছে (আমারও আসছে কি না, তাই বলছি)। যাই হোক, একটু ভারি খাবার চাইলে আছে পুরি সবজি, ছোলে-ভাটুরে বা কুলচে-ছোলে। এর প্রায় সবই পরিবেশন করা হয় টক দই সহ। বলে রাখি এই সব ছোলেই হচ্ছে কাবলি ছোলা। আগের কিস্তিতে যে কালা ছোলে (বা কালা চানা)-র কথা বলেছিলাম, তাতেই কেবল ছোট ছোলা দেখেছি যা (আদা সহযোগে) ভেজানো খেয়ে আপনি সক্কাল সক্কাল মর্নিং ওয়াকে বেরোন। এই খানে চুপি চুপি বলে রাখা ভাল দাশগুপ্ত সাহেবকে যতই আওয়াজ দিই না কেন, ওই কালা ছোলে আমারও পোষাত না। তার চেয়ে কলকাতার স্টেপল খাবার ঝালমুড়ি খাওয়া বা আশাপূর্ণা দেবীর রেসিপি ফলো করা অনেক ভাল – “মুড়ির সঙ্গে ছাতু, ছাতু মুড়ির সঙ্গে তেল, আর তেল মুড়ি ছাতুর সঙ্গে কাঁচা লংকার কুচি”। ‘ভূতুড়ে কুকুর’ গল্পে চোর ভণ্টাদা আর তার সাকরেদ হর্তুকি যেমন খেত।
কিন্তু মুশকিল হল ভণ্টাদারা খেত বাংলায় বসে, যেখানে মুড়ি যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। দিল্লিতে আমরা, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, মুড়ি পাইনি (এখানে একটা কান্নার ইমোজি দিতে পারলে ভাল হত)। আমাদের অফিস ছিল পার্লামেন্ট স্ট্রিটে, যাকে সংসদ মার্গও বলা হয়। অফিসের এক সিনিয়র বাঙালি বললেন, “এই তো গোল মার্কেটেই পাওয়া যায়”। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে যাবতীয় দোকান ঘুরে ঘুরে চোখে ধোঁয়া দেখছি, গোল মার্কেটকে চৌকো মনে হচ্ছে, তবু মুড়ির দেখা নাই রে, মুড়ির দেখা নাই। তথাগত মুড়মুড়া বলে একটা পদার্থ কোত্থেকে কিনে আনল এক দিন, সেটা খানিকটা মুড়ির মত দেখতে, ভঙ্গকুলীন গোত্রের কেউ হতে পারে। তবে খেতে একেবারেই আলাদা। বাঙালিস্তান চিত্তরঞ্জন পার্কে পাওয়া যাবে বলে শুনলাম, কিন্তু সেখানে অন্য কাজে যখন গেছি তখন আর মুড়ির কথা মনে পড়েনি।
বুঝতে পারছি, সামান্য মুড়ির জন্য আমার এত দরদ উথলে উঠতে আপনার বিরক্তি লাগছে। কী করব বলুন, আদতে বীরভূম জেলার লোক তো, ঢেঁকিতে চড়ে সেখানকার আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে নারদ মুনির কী অবস্থা হয়েছিল জানেনই তো। অ, জানেন না, তাইলে শুনুন। বেলা তখন দশটা হবে। প্রভু নারায়নের নাম জপতে জপতে বীরভূমের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন নারদ। হঠাৎ সোঁ সোঁ করে একটা অদ্ভুত শব্দ। কী ব্যাপার? মেঘ করল নাকি? ঝড় এল? না তো, আকাশ দিব্যি পরিস্কার। ওদিকে সোঁ সোঁ আওয়াজটা হয়েই চলেছে। ভয় পেয়ে স্পিড বাড়িয়ে দ্রুত চলে গেলেন নারদ। নারায়নের কাছে গিয়ে সব খুলে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “ওটা কিসের শব্দ ছিল?” প্রভু শান্ত স্বরে বললেন, “তোমার ভীত হওয়ার কোনও কারণ ছিল না নারদ। ওইটা ওখানকার সাধারণ জনের ব্রেকফাস্টের সময়।” নারদ কিছু বুঝলেন না, বিস্তারিত জানতে চাইলেন। নারায়ন মৃদু হাসলেন, তাঁর আশীর্বাদে ভক্তের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলীত হল। নারদ দেখলেন লোকেরা বড় বড় বাটিতে করে মুড়ি খাচ্ছে। সেই মুড়ি ভেজানোর জন্য যেই বাটিতে জল ঢালছে, মুড়ি সে জল শুষে নিচ্ছে। আর হাজার হাজার লোকের বাটির কোটি কোটি মুড়ির দানা এক যোগে ভিজে যাওয়াতে আওয়াজ উঠছে “সোঁ সোঁ”।
আজ্ঞে না, মুড়ির মহিমার এই কীর্তন আমার রচনা নয়, কোথায় পেয়েছি, কার লেখা তাও ভুলে মেরে দিয়েছি। তবে সেটা এই রকমেরই কিছু একটা ছিল।
যাই হোক, এদিকে নতুন ঘর পাওয়া গেছে। তিন মাস থাকার পর উত্তর দিল্লির পাট চুকিয়ে আমরা চলে যাব পূর্ব দিল্লির প্রীত বিহারে। জায়গাটা যমুনা নদীর ও-পারে, দিল্লির পরিভাষায় ‘ট্রান্স-ইয়ামুনা’ বা যমনা-পার। যার সূত্রে এ ঘর পাওয়া গেল, আমার সেই বান্ধবীর বান্ধবীকে কোনও দিন দেখিনি, ফোনেই সব কথা হয়েছে। এখন আছে ফেসবুক ফ্রেন্ড, আরও আগে ছিল কলম বন্ধু, যাদের মধ্যে দেখা হত না। এদের মাঝে রয়েছে আমাদের ফোন-বন্ধু, যার নামটা পর্যন্ত এখন আর মনে করতে পারছি না। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বান্ধবীর হাত দিয়ে তাঁকে একটা কেক পাঠিয়েছিলাম আমি আর তথা।
পছন্দ মত ঘর পাওয়া যে সমস্যার তা তো জানাই, কিন্তু পুরোন ঘর ছাড়াও যে বিস্তর ঝকমারি তা জানা ছিল না। প্রথমেই মনে পড়ল, কড়কড়ে দেড়টি হাজার টাকা জমা আছে, তার পর মনে এল ‘একটি পেরেকের কাহিনী’। উঁহু, একটি নয়, দুটি পেরেক যাদের মাঝে ঝুলে আছে কলকাতা থেকে আনা দড়ি। তথাগত বলল অসুবিধে নেই, মালিক যদি টাকা ফেরত না দেয়, তবে শুধু কলসি কিনলেই হবে। রাম-লক্ষণের জন্য ছিল সরযূ, আর আমাদের জন্য যমুনা।
শেষ মাসের ভাড়া দেওয়ার সময়ে শর্মাজীকে বললাম আমাদের টাকা জমা আছে, সেখান থেকে অ্যাডজাস্ট করুন। কিছুক্ষণের মধ্যে ডানা-বাবু অ্যাব্রলের ফোন এল। অফিস ঘরে গিয়ে কানে ফোন লাগিয়ে যা শুনলাম তা হলঃ ছ-মাসের জায়গায় (‘চলবে না’ নং ১) তিন মাস পর যে তিনি আমাদের যেতে দিচ্ছেন, তাই কি যথেষ্ট নয়? শেষ মাসের হলেও ভাড়া নগদে দিতে হবে, আর জমা টাকা বাড়ি ছাড়ার সময় ফেরত পাওয়া যাবে। অগত্যা...
কাল চলে যাব, তার আগে পেরেকের কাহিনী কি ভাবে শেষ করা যায়? শর্মাজী দেওয়ালে গর্ত করে, তাতে কাঠের টুকরো গুঁজে যা লাগিয়েছিলেন, সেগুলো আসলে হুক। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা হল, বড্ড টাইট। তথাগতর বুদ্ধিতে চামচ ব্যবহার করলাম স্প্যানারের মত, ফল পেলাম। এক দিকের কাঠের টুকরোটাও বেরিয়ে চলে এল। দেওয়ালে দগদগে হয়ে ফুটে বেরোল তিন মাস আগের করা আমাদের অপরাধের প্রমাণ। এই জন্যই বলে ‘ক্রাইম ডাজ নট পে’। দিল্লির অজস্র অপরাধের তালিকায় আমাদেরটাও জুড়ে গেল। অন্যদিকের কাঠটা কিন্তু ‘নট নড়ন চরন নট কিচ্ছু’ হয়ে রইল নিজের জায়গায় সেঁটে রইল। আকাট মুখ্যু যেমন ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে আটকে থাকে, কান ধরেও তাকে অন্য জায়গায় নড়ানো যায় না।
এবার? একদিকের গর্ত বোজাতে হবে, অন্যদিকের কাঠ লোকাতে হবে। আমি বললাম কুছ পরোয়া নেহি। ‘ডেটোফিক্স’ লাগাব। কলকাতার বাড়িতে স্ক্রু, হুক লাগাতে হলে দেওয়ালে গর্ত করে ‘ডেটোফিক্স’-এর সাদা গুঁড়ো সামান্য জলে ভিজিয়ে মেখে গর্তে ঢুকিয়ে দিতাম, তার পর স্ক্রু বা হুক গুঁজলেই কেল্লা ফতে। এ ক্ষেত্রে কাজটা উলটো, হুক সরিয়ে ফেলেছি, এবার ‘ডেটোফিক্স’ দিয়ে গর্ত বোজাতে হবে। চলো হার্ডওয়্যারের দোকান।
অর্থনীতির ছাত্র তথাগত ব্র্যান্ডনেম আর প্রোডাক্ট নেম-এর পার্থক্যের কথা বলেছিল এক বার। যেমন ক্যাডবেরি, সার্ফ বা মোবিল হল ব্র্যাণ্ডনেম, প্রোডাক্টগুলো হল যথাক্রমে চকলেট, ডিটারজেন্ট পাউডার আর ইঞ্জিন অয়েল। সেদিন থিওরিতে বুঝেছিলাম, আজ প্র্যাকটিক্যাল পাশ করলাম। পাঁচ সাতটা হার্ডওয়্যারের দোকান ঘুরেও যখন ‘ডেটোফিক্স’ পাওয়া গেল না, তখন বুঝলাম ওটা ব্র্যান্ড নেম, প্রোডাক্ট নেম নয়। প্রোডাক্টটা যে ঠিক কি সেটাও আমাদের টুটাফুটা হিন্দি দিয়ে বোঝাতে পারলাম না। বুঝলাম হিন্দিটা কিছুই শিখিনি, ডাব্বাওয়ালার সঙ্গে লড়াইয়ে যতই জিতি না কেন।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছি। একটা উদ্ভট আইডিয়া মাথায় এল। মুদীর দোকানে গিয়ে বললাম ৫০ গ্রাম আটা দেখি। বেচারা জীবনে কাউকে ৫০ গ্রাম আটা বেচেনি, হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তথাগতর দয়া হলঃ ঠিক আছে, ১০০ গ্রাম দিন। বাড়ি ফিরে আটায় জল দিয়ে ‘ডেটোফিক্স’-এর কায়দায় গর্ত বোজালাম, তাই দিয়েই কাঠের ওপর জামা পরিয়ে দিলাম। সকাল বেলায় গোছগাছ-এর ফিনিশিং টাচ শেষ হলে তথাগত জানলার পাল্লা খুলে দিল। জামা পরা কাঠ আড়ালে চলে গেল। এক তলায় অফিস ঘরে ফোনে কথা বলতে বলতে ডানা-বাবু নিতান্ত অবহেলায় আমাদের টাকা ফেরত দিলেন। শেষ বার ওপরে এসে দেখি শর্মাজী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কি সব খুঁজছে। তথাগত তাড়াতাড়ি ওর হাতে কুড়িটা টাকা গুঁজে দিল। এক মাস আগে ছেলের ‘চেচক’ হয়েছে শুনেছিল, তাই ফল টল কেনার জন্য।
মাল পত্র টেম্পোতে তুলে রওনা দিলাম। দেখলাম এই তিন-চাকা মালবাহী গাড়ির এগজস্ট পাইপ থাকে সামনের চাকার সঙ্গে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার ব্যাপার ছিল (পেরেকের ভয়ে), ভাল করে তাকিয়েও দেখলাম না আমাদের যাওয়া কেউ দেখছে কি না। কেবল দেখলাম উল্টোদিকের বাড়ির দো-তলার বারান্দায় সর্দারজী আলস্যে গা এলিয়ে বসে চুল শুকোচ্ছেন অন্যান্য রবিবারের মত। কয়েকটা বাচ্চা রাস্তায় ক্রিকেট খেলছে। অফিসের এক ভদ্রলোক কাছেই থাকতেন, দু-এক বার গেছি। তাঁকে বলে আসা হল না। টেলিফোন বুথটা পেরোলাম, বাবা-মাকে ফোন করতাম এখান থেকে, কখনো সখনো বন্ধুদেরও। টেম্পো বিজয় নগরের গন্ডি ছাড়িয়ে এল। বাঁ-দিকে আউটার রিং রোড, কিংসওয়ে ক্যাম্প বাস স্ট্যান্ড, ওখানে রাতে খেতে যেতাম। মনে হল, এখানে জীবন আমাদের খুব ধীর গতিতে কাটল, এই ধীরে চলা টেম্পোর মত।
তিন মাস যে এত দিন তা আগে জানতাম না। অফিসের প্রাথমিক পর্ব কেটে গেছে, এবার কিছু কিছু দায়িত্ব দেবে, কাজের ক্ষেত্রে গতি আসবে। অফিসের বাইরেও এবার অন্য ঘর, অন্য জায়গা, অন্য অন্য মানুষজন। সেখানে কেমন হবে জীবন, রাজধানী এক্সপ্রেসের মত, নাকি লোকাল ট্রেনের মত? টেম্পোর গতি আরো একটু কমে এল। দেখলাম আইটিও (ইনকাম ট্যাক্স অফিস) মোড় পেরিয়ে যমুনা নদীর ব্রিজ এসে গেছে। প্রীত বিহার আর বেশি দূরে নয়। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।