।। ২৬ ।।
সবই এক দিন শেষ হয়ে যায়।
ভাল সময়, মন্দ অসুখ, প্রিয় জন, আর অপ্রিয় কাজ।
ভাল তেমন হল কই আর এ বছরটা দেখলে ফিরে?
শিখিনি কী অনেক কিছু, নতুন ভাবে বেঁচে থাকাও?
হয়তো সেটা পছন্দ নয়, মন্দ মনে হয় পুরোটাই।
তবুও তো জাপটে ধরি, তারই মাঝে যেটুকু পাই।
আশেপাশে যা ঘটে যায়, আমার হাতে নেই তো কিছু।
তবু নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার ইচ্ছে রাখি ষোল আনা।
সবই এক দিন শেষ হয়ে যায়।
যেমন যাচ্ছে চলে আর একটা দিন, অনেকগুলো দিনের মত।
কাল আসবে আর একটা দিন, আগেও যেমন রোজ এসেছে।
কাল সকালেও রোদ আসবে। নতুন আসা, নতুন আশা।
আর তারই মাঝে মুখোশ পরে, মুখোশ খুলেই না হয় বাঁচি...
দিল্লি মহানগরীতে আমাদের কেটে গেল ১৩টা মাস। ডিসেম্বরের শেষ দিন চলে গিয়ে নতুন বছর এসে গেল। তবু আমাদের সেই পুরনো সমস্যার – মানে ঘরে ফেরার আগমনী গান যে কবে বাজবে – তার কোনও সমাধান এল না। রাগ করে অফিস পার্টিতে বেশি বেশি করে খেয়ে ফেললাম। কে যেন বলেছিল বেশি খাওয়া নাকি ডিপ্রেশনের লক্ষণ। কে জানে বাবা ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম কি না তখন। আমি অল্প কয়েকটা গ্রিটিংস কার্ড কিনে বন্ধুদের পাঠিয়েছিলাম। আমিও একটা পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিলঃ “Never hesitate to smile or spread a word of cheer You smile at one, he smiles at you and so, one smile makes two.” সুন্দর কথা, কার্ডে দারুণ দারুণ সব কথা লেখা থাকে, কারা যে লেখে কে জানে। সবই তো আর বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি হতে পারে না।
তথাগতর বাবা-মা এসেছেন, ও ওনাদের সাথে বসু লজে থাকছে কয়েকদিন হল। ফলে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমি একা। তার মধ্যে উটকো ঝামেলা - ভাল রকম লোডসেডিং চলছে। সাড়ে নটায় অফিস থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করার পর দেখি বিদ্যুৎ মহাপ্রতু ঘর অন্ধকার করে আমার নাকের ডগা দিয়ে কেটে পড়লেন। সামনে একটা মোমবাতি জ্বলছে, শিখাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে আর দেওয়ালের গায়ে আমার একটা বিশাল ছায়া লাফালাফি করছে। এই রকম সময়ে ভূতের গপ্পো টপ্পো জমে ভাল।
একা একা আধো অন্ধকারে বসে ভূতের কথা ভাবতে শাস্ত্রের নিষেধ আছে। তাই মোমের আলোতেই বুদ্ধদেব গুহর ‘সবিনয় নিবেদন’ বইখানা নতুন করে পড়ে ফেললাম। বাঘ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি টাইপের ব্যাপার। মনের জঙ্গল আর বনের জঙ্গল বেশ মেশাতে পারেন ভদ্রলোক। মনে হল যদি কোনও জঙ্গল থেকে ঘুরে আসতে পারলে ভাল হত। আসলে রুটিন থেকে বেরোন আর কি। রেল লাইনের বাঁধা পথে চলতে চলতে বিরক্ত হয়েই কি কামরাগুলো মাঝে মাঝে লাফিয়ে বেডিয়ে আসে? বাপ রে, কী সাংঘাতিক উপমা! নিজেই আঁৎকে উঠলাম।
ওদিকে পর পর চার দিন বাড়িতে ফোন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করে দেখলাম - সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। কিন্তু হায়, কোনও ভাবেই ডায়ালিং-রূপ মেনকা রিংগিং রূপ দুর্বাশার ধ্যান ভাঙাতে পারল না। বলে না কপালে নাইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কি! কলকাতায় বাড়ির কাছে এক বন্ধুর ফোন বুথ আছে, তাকে পেলাম, জিজ্ঞেস করলাম আমাদের এক্সচেঞ্জ-এর নম্বর বদলে গেছে কিনা। না-বাচক উত্তর পেয়ে মনে হল বাড়ির ফোন বোধ হয় মৃত।
ল্যান্ডলাইন ফোনের মৃত্যু হওয়া সে আমলে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বর্ষাকালে জল জমলে ফোন মারা যাবে, রাস্তা খুঁড়ে কাজ হলে ফোন পটল তুলবে, এমনকি সম্পূর্ণ বিনা কারণেও (মানে আমাদের বুদ্ধিতে যার ব্যাখা মিলবে না) ফোন নির্বিকল্প সমাধি নেবে। আবার তিনি কবে বেঁচে উঠবেন তা কেউ জানে না। অন্য কারও বাড়ির বা অফিসের ফোন (যিনি জীবিত আছেন) থেকে কমপ্লেন বুক করতে হত। তারপর লাইন চালু হতে দু’দিনও লাগতে পারে, আবার দু’মাসও। পুরো ভুতুড়ে ব্যাপার। নাটকীয় ব্যাপার স্যাপার কিছু হলে আমার পরিচিত এক কাকু মুখ বাঁকিয়ে বলতেন ‘নসকা’! মানে নকসা-কে একটু ঘুরিয়ে বলা আর কি। ফোনের এই অদ্ভুতুড়ে বিষয়টাও আমার ‘নসকা’ বলে মনে হত।
এর মধ্যে আমি আর তথা মিলে কয়েকটা নাটক দেখেছি। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে ‘আন্তিগোনে’, অস্মিতার ‘কোর্টমার্শাল’ (কলকাতায় রঙ্গকর্মী যেটা করে) আর পিপলস লিটল থিয়েটারের ‘ব্যারিকেড’।
ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার ক্যাম্পাসটা বেশ ভাল লাগল। ১৯৫৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির একটা শাখা হিসেবে এটি গড়ে ওঠে। তবে ১৯৭৫ থেকে দেশের নাটক শেখার প্রধান প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন ভাবে কাজ শুরু করে। গ্রীক নাট্যকার সোফোক্লেসের লেখা ‘ইডিপাস’ ট্রিলজির তৃতীয়টি হল ‘আন্তিগোনে’। সেটি অভিনয় করলেন ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা।
ইডিপাস না জেনে নিজের বাবাকে হত্যা করেন আর মাকে বিবাহ করেন, রাজা হন থিবসের। তাদেরই কন্যা আন্তিগোনে। সব জানার পর ইডিপাস নিজেকে অন্ধ করে দেন, নির্বাসিত করেন রাজ্যের বাইরে। বাবার মৃত্যুর পর আন্তিগোনে থিবস ফিরে আসেন, সেখানে তাঁর দুই ভাই একে অন্যের হাতে নিহত হয়েছেন; রাজা হয়েছেন ইডিপাসের ভাই ক্রেয়ন। দুই ভাইয়ের একজনকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে তার শেষকৃত্য করা হবে না বলে ঘোষণা করেন তিনি। এই আদেশ না মেনে বিদ্রোহী হন আন্তিগোনে, মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন দাদার দেহ। ফলে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেন ক্রেয়ন – গুহার মধ্যে অনাহারে মরতে হবে তাঁকে। পরে আদেশ ফিরিয়ে নিতে ছুটে যান মহারাজা, তবে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আন্তিগোনে আত্মহত্যা করেছেন, তাঁর প্রেমিক ক্রেয়নের ছেলে হ্যামন নিজেকে শেষ করেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে একই পথ বেছে নেন হ্যামনের মা। মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকে।
‘আন্তিগোনে’ আমাদের সামনে কয়েকটা দ্বন্দ্ব উপস্থিত করে। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা হলেও সেই দ্বন্দ্বগুলো আজও সাংঘাতিক ভাবে বর্তমান – বিবেক আর আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রক্তের সম্পর্ক আর রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব, এবং সামাজিক নিয়মের সমর্থক আর বিরোধীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
যদিও অনেকেরই জানা, তবু গল্পটা না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। ‘ইডিপাস’ কে রাজা অয়দিপাউস নামেও ডাকা হয়। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ট্রাজেডির বিশেষত্ব হল নায়কের করুণ পরিণতির কারণ হল নিজেরই জীবনের লুকিয়ে থাকা কঠিন সত্য জানার জন্য তার তীব্র আকাঙ্খা।
এছাড়াও দেখলাম সেনাবাহিনীর মধ্যে জাতপাতের সমস্যা নিয়ে ‘কোর্টমার্শাল’ আর উৎপল দত্তের ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাটক ব্যারিকেড, যা লেখা হয়েছিল জার্মানীর পটভূমিকায়, যদিও এর নাকি উৎস ছিল ১৯৭১ সালে ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুর হত্যা।
যাই হোক, প্রজাতন্ত্র দিবস আসছে। জানা গেছে ব্রেজিলের রাষ্ট্রপতি ফার্নান্ডো হেনরিক কার্ডোসো এবারের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হবেন। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ চলছে কয়েক দিন ধরে। আর এইরকমই এক সময়ে আমি অফিসে আসছিলাম বাসে করে, যখন একটা ঘটনা ঘটল আর বুঝতে পারলাম ভয় কোথায় গেড়ে বসেছে মানুষের মনে। কিসের ভয়? বলছি।
আমি বাসে আসন পাইনি, দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলাম। খুব একটা ভিড় ছিল না, সঙ্গের ব্যাগটা ধরতে দিয়েছিলাম সামনে বসে থাকা ভদ্রলোককে। খেয়াল হল টিকিট কাটা হয়নি। কলকাতার বাস তো নয় যে কন্ডাকটর এগিয়ে এসে টিকিট কাটবে; আমাকেই যেতে হবে তার কাছে – বাসের পিছনের দরজার পাশে যেখানে তিনি গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। ওয়ালেট থেকে টাকা বার করে ওদিকে এগোতে যাব, সামনের ভদ্রলোক আমার ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন। বললাম, “এই তো, আসছি এখুনি।” উনি বললেন, “ব্যাগ নিয়ে যান।” বললাম, “আরে টিকিটটা কেটেই আসছি।” ভদ্রলোকের উত্তর, “ব্যাগ নিয়ে টিকিট কেটে আসুন। তারপর আবার আমায় দেবেন।” আমি অবাক হয়ে ব্যাগটা নিলাম; টিকিট কেটে ওই একই জায়গায় ফিরে এসে ফের ওনাকে ব্যাগটা দিলাম; উনি অম্লানবদনে সেটা নিয়ে নিলেন, যেন কিছুই হয়নি।
আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না। অফিসে এসে একজনকে ঘটনাটা বলাতে তিনি আমায় বুঝিয়ে দিলেন – ওই ভদ্রলোক ভয় পেয়েছিলেন। কেন? ওনার আশঙ্কা ছিল যদি ব্যাগে বোমাটোমা কিছু থাকে, আর আমি যদি টিকিট কাটার অছিলায় বাস থেকে নেমে যাই! জঙ্গী হামলার ভয় যে কোন জায়গায় পৌঁছেছে সেটা এই ঘটনাটা না হলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না।
ওদিকে আর একটা ঘটনা ঘটল। আমরা মানে কলকাতা ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে যারা অপেক্ষা করেছিলাম, তারা হঠাৎ করেই একজন কমে গেলাম। দাশগুপ্ত সাহেবের বাড়ি থেকে খবর এসেছে ওনার বাবা অসুস্থ, দ্রুত একটা অপারেশন করাতে হবে। অফিসের অনুমতি নিয়ে নিজের শহরে ফেরত গেল সে। দাশগুপ্ত সাহেবকে নয়া দিল্লি রেল স্টেশনে ছাড়ার জন্য কেবল আমিই ছিলাম। বাকিদের ডিউটি ছিল বলে আসতে পারেনি। খারাপ লাগছিল, কারণে অকারণে প্রচুর পিছনে লেগেছি ওর। ট্রেন ছাড়ার আগে সাহেব আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “মন খারাপ করিস না। শিগগিরই তোদের পালা আসবে।”
ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর লম্বা প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল আমাদের পালা কবে আসবে। আর ভাল লাগছে না।
উঁচুনিচু ঠোক্কর খেতে খেতে রুটিন মাফিক দিনগুলো চলে যাচ্ছে, আর তারই মাঝে একটা দিন এল যাকে সুমন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন “মসৃন, ভোর থেকে শুরু করে রাতের শয্যায়…।” (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।