‘ব্যক্তিগত লাভ’ কী ভাবে হবে? কেন, দুর্নীতি করে। জনগণের টাকা নানাভাবে আত্মসাৎ করে। পৃথিবীর কোনও দেশই এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই, কোথাও কম, কোথাও বেশি; কোথাও এর ফলে সাধারণ লোক সরাসরি ধাক্কা খায়, আবার কোথাও বা পরোক্ষে। এই নিয়ে চাদ্দিকে এখন হেব্বি হুলুস্থুলু। এই মন্ত্রী হ্যান করেছেন, সেই নেতা ত্যান করেছেন। সকালের কাগজে কাগজে এই নিয়ে বিস্তর লেখালেখি চলছে, সন্ধ্যায় চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচুর খেস্তাখিস্তি…, থুড়ি, আলোচনা হচ্ছে নেতাদের নিয়ে। বাবার এক বন্ধু বলতেন “নেতা, না ন্যাতা?” সে উনি যাই বলুন, নেতারা কিন্তু মশাই ফাটাফাটি। কেউ এমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন যার অস্তিত্বই নেই, কেউ আবার এমন বিষয় নিয়ে কলেজে পড়েছেন যা খুঁজেই পাওয়া যায় না। ইস্যু একই থাকে, কিন্তু তা নিয়ে নেতার মতামত নির্ভর করে তিনি কখন কোন পার্টিতে আছেন তার ওপর।
কথায় বলে সমুদ্রের ঢেউ গুনেও রোজগার করা যায়, যদি সে কাজটা সরকারি হয়। ঢেউ-এর যেমন কমতি নেই, তেমনি খামতি নেই নানা কিসিমের স্ক্যামের, এ ব্যাপারে কেন্দ্র, বিভিন্ন রাজ্য সবাই সমান। তবে সব ক্ষেত্রেই যে নেতাদের সাথে দুর্নীতির সরাসরি যোগ খুঁজে পাওয়া যায় তা অবশ্য নয়। দুর্নীতির অভিযোগ আছে হেলিকপ্টার বা জিপ কেনার মত বড় বড় ব্যাপার থেকে শুরু করে স্কুলের বাচ্চাদের মিড ডে মিল দেওয়া, গরীব মানুষকে ধুতি-শাড়ি বিলি করা বা শিক্ষিত বেকারদের চাকরি দেওয়া নিয়েও। এছাড়াও আছে সিমেন্ট, ইউরিয়া, চিনি, পশু খাদ্য, কফিন, কয়লা, কামান, স্টক মার্কেট, ব্যাংক, মিশাইল, খেলাধুলো, স্ট্যাম্প পেপার, জুতো – নাহ, একটু দম নেওয়া যাক। আরে মশাই, ছিছিক্কার পরে করবেন, আগে বিশালতাটা দেখুন, বৈচিত্রটা বুঝুন। প্রবাদে বলে না, ভ্যারাইটি ইজ দ্য স্পাইস অফ লাইফ।
গ্রীক ট্র্যাজেডিতে একটা শব্দ ব্যবহার হয়, ‘হুব্রিস’। মানে হল সেই প্রবল ঔদ্ধত্য বা অহংকার যা ধ্বংস ডেকে আনে। গ্রীক নাটক থাক, সবার চেনাজানা একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। খরগোস-এর হুব্রিস দেখা গেছিল দৌড়ের সময়ে, যখন সে মনে করেছিল তাকে হারাবার ক্ষমতা কচ্ছপের নেই। শুনেছি আগেকার দিনে রাজারা নিজেদেরই তৈরি আইন মানতে বাধ্য থাকতেন না। আজকের রাজনীতিকরাও মনে করেন তাঁরা সব আইনের ঊর্ধে আর এমন কিছু কাজ করেন যা হয় তাঁদের পতনের কারণ।
হ্যাঁ হ্যাঁ জানি আপনি কি ভাবছেন। ‘ঘোটালা’ তো আর ভারতবর্ষে নতুন নয়, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালে যে হাঁস প্রথম জীপ কেলেঙ্কারি নামের সোনার ডিম পেড়েছিল, গত কয়েক দশক ধরে এমন ডিম যে সে কত পেড়েছে তার ইয়ন্তা নেই। কিন্তু তাই বলে কি আর সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে নাকি!
হয়নি, আর সে জন্যই হাওয়ালা কেলেঙ্কারি নিয়ে গোলমালের মধ্যেই শুরু হল “নিউ ডেলহি ওয়ার্ড বুক ফেয়ার”। ১৯৭২ থেকে শুরু করে এক বছর অন্তর এই বিশ্ব বই মেলা হয়ে আসছে দিল্লিতে। আর প্রতি বছর হয় “ডেলহি বুক ফেয়ার’’।
এক সহকর্মীর সঙ্গে গেলাম “ওয়ার্ড বুক ফেয়ার'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। দেখে ভাল লাগল মঞ্চে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই, আছেন দেশ বিদেশ থেকে আসা লেখক লেখিকারা। এসেছেন ঘরের পাশে বাংলাদেশ থেকে সেলিনা হোসেনও। না, “লজ্জা” লিখে যুগপৎ প্রশংসিত ও ধিকৃত তসলিমা নাসরিনের জায়গা অবশ্য নেই।
দিল্লির এক প্রতিষ্ঠানের সদস্য-সদস্যারা সমবেত ভাবে শুরু করলেন উদ্বোধনী সঙ্গীত: “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...”। আমি শুনতে লাগলাম, অনুভব করলাম ওই আগুনের পরশ আমার প্রতিটি অঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছে, আমি পূর্ণ হচ্ছি। গানটা চমৎকার গাওয়া হচ্ছিল আর আমায় ঘিরে রেখেছিল একটা অদ্ভুত আবেগ। আমার অবাঙ্গালী সহকর্মী পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন গানের অর্থ, আমি ভাল করে শুনতেও পেলাম না। বাংলা ভাষাটা, রবীন্দ্রনাথের ভাষাটা, যে আমার নিজের মাতৃভাষা, সে জন্য এত গর্ব আর কখনো হয়নি। আমি পূর্বাঞ্চলের এক রাজ্যের মানুষ এক সময়ে দেশ জুড়ে যার মর্যাদা ছিল, যে মর্যাদা এখন অতীতের ছেঁড়া ফাটা সাদা-কালো ছবি মাত্র, রাজধানীর বুকে রবীন্দ্রনাথ সে মর্যাদা যেন তাঁর গান দিয়ে আমায় ফিরিয়ে দিলেন। বাকিরা আমার প্রাপ্তি বুঝতে পারল কি না তাতে কি এসে যায়? এই অনুষ্ঠানে আরও দু-এক জন বাঙ্গালী শ্রোতা নিশ্চয় আছেন (যেমন সেলিনা হোসেন), এই গান তাঁদের কি দিল তাতেও কি কিছু এসে যায়? এটা কেবল আমার প্রাপ্তি হয়েই থাক না। পশ্চিমবঙ্গে বসে “আগুনের পরশমণি” অন্ততঃ পাঁচশোবার শুনেছি, এমন তো কখনও হয়নি। পন্ডিতেরা বলেন বিদেশে না গেলে স্বদেশ চেনা যায় না, আজ বুঝলাম অন্য রাজ্যে না গেলে নিজের রাজ্যের মর্ম বোঝা যায় না।
ঘুরে দেখলাম বিশ্ব বই মেলা। কলকাতার বইমেলার সঙ্গে তুলনা চলে না, না আকারে না দর্শক সংখ্যায়। যেখানে এই মেলা হয় সেই প্রগতি ময়দান-টা নামেই ময়দান। আসলে সুন্দর ভাবে সাজানো আর প্রায় পুরোটাই কংক্রিটে বাঁধানো এক্সিবিসনের জায়গা। বাঁধানো জায়গাগুলোতে আছে ১৮-টা প্যাভিলিয়ন, সেগুলোর নাম ইন্দিরা প্যাভিলিয়ন, নেহরু প্যাভিলিয়ন, ডিফেন্স প্যাভিলিয়ন এই রকম। ফাঁকা জায়গাগুলোয় সবুজ লন আর মরসুমী ফুলগাছের সারি। ১৯৮২-তে চালু হয় প্রগতি ময়দান, মালিক হল ভারত সরকারের শিল্প-বানিজ্য মন্ত্রকের অধীন ইণ্ডিয়া ট্রেড প্রমোশন অর্গানাইজেশন। কলকাতা বই মেলায় গেলে যে রকম ফ্রি-তে প্রচুর ধুলো গায়ে মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়, তেমন সুযোগ এখানে নেই (এখন অবশ্য ওই ধরনেরই ব্যাবস্থা কলকাতা বই মেলার জন্যও করা হয়েছে)। খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, তবে লোক খুব কম বলে অবাক লাগছিল। তবে সে জন্য একটা সুবিধে হল, বেশ কিছু স্টলের লোকেদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া গেল, যার থেকে বেরিয়ে এল একটা তথ্য - আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় ভারতীয় বই-এর বাজার দারুন ভাল। তার কারণ হল পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপালের তুলনায় আমাদের দেশে বই ছাপার খরচ কম।
এই দেশগুলোর প্রতিনিধিরা জানালেন গল্প-উপন্যাস, ধর্মচর্চা, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান - এ রকম সব ধরণের ভারতীয় বই-এরই ভাল বাজার রয়েছে তাঁদের দেশে কারণ দাম কম, লেখার মানও ভাল। করাচীর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এসেছিলেন রিচার্ড স্যামসন মল। তিনি পরিস্কার বললেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা এমন কি পাকিস্তানের-এর চেয়েও ভারতে ছাপা বই-এর দাম কম। নেপাল আর ভুটানের প্রতিনিধিদেরও একই বক্তব্য। মালদ্বীপের স্টলের ভদ্রলোক জানালেন তাঁর দেশে উচ্চশিক্ষার হার বেশি নয়, তাই বই-এর বাজার বেশ ছোট।
বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকার ন্যাশনাল বুক সেন্টার-এর ডেপুটি ডিরেক্টর। তাঁর কাছে শুনলাম কাগজ, কালি, ছাপানোর খরচ সব-ই বাংলাদেশে বেশি, তাই সে দেশে যত বই দেখা যায় তার সিংহভাগই ভারতের।
তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় উঠল বুক পাইরেসির কথা। কলকাতায় প্রায়ই শোনা যায় নামী লেখকদের বই দু-নম্বরী করে ছাপা হয় ঢাকায়, আর তা বিকোয় ভালই, যদিও তা থেকে এক পয়সাও জোটে না লেখক বা তাঁর আসল পাবলিশারের। আনন্দ পাবলিশার্স-এর প্রকাশক বাদল বসুর লেখা থেকে পরে জানতে পারি গৌরকিশোর ঘোষের বিখ্যাত বই ‘প্রেম নেই’ সমরেশ মজুমদারের লেখা বলে ছেপেছিল বাংলাদেশের এক সংস্থা আর সেই বই আমেরিকা থেকে কিনে এনেছিলেন স্বয়ং সমরেশ মজুমদার। তাই নিয়ে কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছিল।
শফিকুল নিজেও অবশ্য একটা অনুযোগ করলেন। “আপনাদের তো শুধু অভিযোগ বাংলাদেশ পাইরেসি করছে। তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’-র পাইরেটেড ভারশন তো পশ্চিম বাংলায় ঢালাও বিক্রি হয়েছে।”
‘লজ্জা’র জন্য লজ্জা পেতেই হল, কারণ কথাটা দুশো ভাগ সত্যি। লোকাল ট্রেনে আদর্শ লিপি, নার্সারি রাইমস যেমন বিক্রি হয়, তেমনি “লজ্জা” বিক্রি হতে দেখেছি, দশ না কুড়ি টাকা দরে। ব্যবসায়ীরা বুঝেছিল বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর) নিয়ে লেখা 'লঙ্জা' পশ্চিমবঙ্গের লোক, বিশেষতঃ যারা ওপার বাংলা থেকে এসেছে, তাদের কাছে বিকোবে ভাল। প্রচুর ফ্রি পাবলিসিটিও পেয়েছিল বইটা - ওপারে লেখিকার ওপর আক্রমণ আর বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা, আর এ পারে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে বিপক্ষে প্রচার। “লজ্জা” প্রকাশিত হল ১৯৯৩-তে, পরের বছর তসলিমাকে দেশ ছাড়তে হল।
জন এফ কেনেডি এক বার বলেছিলেন “চীনা ভাষায় ‘সংকট’ কথাটা লিখতে দু-বার কাগজে কলম ছোঁয়াতে হয় - এক বার ‘বিপদ’ বোঝাতে, অন্য বার ‘সুযোগ’। তাই সংকটের সময়ে যেমন বিপদ থেকে সাবধান থাকতে হয়, তেমনি সুযোগের কথাটাও মাথায় রাখতে হয়।” “লজ্জা” লিখে ওপারে সংকটে পড়েছিলেন তসলিমা, কিন্তু তাঁর বিপদের সময়ে সুযোগ নিতে ভোলেনি এপারের দু-নম্বরী বই ব্যবসায়ীরা। শুধু তারা কেন, তসলিমার বিপদ দু-পারের রাজনীতির ব্যবসায়ীদেরও যে কত সুযোগ এনে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
রাজধানী শহর আমার সামনেও একটা সুযোগ এনে দিয়েছে, সেটা হল… না, তার আগে একটা অন্য কথা বলি। আরও দুটো জায়গায় বাড়ি দেখে এলাম – দক্ষিণ পশ্চিম দিল্লির মুনিরকায় আর দক্ষিণ পূর্ব দিল্লির বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে, যাকে চলতে কথায় লোকে সি আর পার্ক বলে। মুনিরকার কাছেই আছে আইআইটি আর জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি (জেএনইউ)। চিত্তরঞ্জন পার্ক দিল্লিতে বাঙালী সংস্কৃতির পীঠস্থান, এখানকার কালী বাড়িও খুব বিখ্যাত। মুনিরকার বাড়ি আমাদের পছন্দ হল না আর সিআর পার্কের বাড়ির ভাড়া এবং আনুষাঙ্গিক অর্থনৈতিক শর্ত যা দালালের কাছ থেকে জানা গেল তাতে বোঝা গেল সে বড় কঠিন ঠাঁই। পরিস্কার হয়ে গেল যে দালালের সাহায্যে ভাড়া নেওয়া আমাদের পকেটের পক্ষে অসম্ভব। এই দুর্দিনে কেবল বন্ধুরাই ভরসা।
কিছুটা সেই বন্ধুদের সাহায্যে, আর বাকিটা আবিষ্কারের আনন্দে ইতিমধ্যেই যে বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ জ্ঞান লাভ হয়েছে তা ঠিকঠাক বোঝাতে নারায়ন দেবনাথের কমিক্সের সাহায্য নেওয়া ভাল। হাঁদাভোঁদা আর নন্টেফন্টে-কেল্টুদার কীর্তিকাহিনীতে যে সব অতুলনীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দ পাওয়া যেত তার মধ্যে ছিল ‘উলস চাকুস চুকুস’, জিভে জল আনা খাবার চেটেপুটে খাওয়ার শব্দ। অর্থাৎ রাজধানীর স্ট্রিট ফুড। দিল্লিতে থেকে সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার না করে কোন মূর্খ ? আলকাতরা মার্কা ছোলার তরকারি যারা রাঁধে তারা চুলও বাঁধে, মানে জিভে জল আনা চাটও বানায় স্যার। (ক্রমশঃ)