।। ষোল ।।
এক জায়গার নাম বা সেখানকার কোনও জিনিসের নাম অনেক সময়েই অন্য কোথাও ঠাঁই পেয়ে যায়। আর নতুন জায়গায় সেটা এমনই চালু হয়ে যায় যে পরে আর তাকে আলাদা করে বেছে নেওয়া যায় না। আগে একবার পাউরুটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলাম ‘পাউ’ শব্দটা আসলে ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশ থেকে এসেছে। আনারস আসলে ‘ananas’ যেটা এদেশে এসেছিল সেই পর্তুগীজদের হাত ধরে, তারা নাকি পেয়েছিল আর এক রোনাল্ডোর দেশ ব্রেজিল থেকে। আমার আপনার সাধের চিংড়ি মাছের মালাইকারি যে এসেছিল মালয়েশিয়া থেকে সে তো নিশ্চয় জানেন। মালাইকারিতে দুধের সর লাগে না, ‘মালয়’টাই আসলে হয়ে গেছে মালাই। আর এটাও আপনার জানা যে চিন দেশের বিভিন্ন জায়গার বা ভাষার নাম জানার জন্য অ্যাটলাস পাড়তে হয় না, পাড়ার চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে মেনুকার্ড আনিয়ে নিলেই হয় – হুনান, সেজোয়ান (সিচুয়ান), মাঞ্চুরিয়া, ক্যান্টোনিজ, সাংহাই, দেংদেং (শেষেরটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও মেনুকার্ডে পেলেন না ? অবাক হবেন না। খাবারের নাম নয়, ওটা হল চাইনিজ ভাষায় ‘ইত্যাদি’)।
এত বাজে বকলাম একটাই কারণে। দিল্লির পথেঘাটে যত মিষ্টির দোকান পাবেন, তার অনেক জায়গায় দেখবেন বড় বড় করে লেখা আছে ‘বেঙ্গলি সুইটস’, যদিও সেখানে বাঙালি মিষ্টি পাওয়ার আশা নেই। মান্ডি হাউসের কাছে তো পুরো একখানা ‘বেঙ্গলি মার্কেট’ও আছে। সেখানে এখন গেলে দেখবেন পাশাপাশি তিনখানা ‘বেঙ্গলি সুইট হাউস’ বিরাজ করছে। আছে ‘বেঙ্গলি পেস্ট্রি শপ’। ১৯৩০-এর দশকে ওই মার্কেট স্থাপন করেছিলেন লালা বেঙ্গলি মল লোহিয়া। তাঁর নামের মধ্যে ‘বেঙ্গলি’ ছিল, যদিও তিনি নিজে ‘বেঙ্গলি’ ছিলেন না। নাথুরাম গুপ্তা সেখানে খুলে ফেললেন চায়ের দোকান যা পরে হল বিখ্যাত নাথুস সুইটস। রাস্তার উল্টোদিকে লালা ভীম সাঁইও সেকালে দোকানে দিয়েছিলেন যা পরবর্তী কালে তিনটে দোকান হয়েছে। দেওয়ালির সময়ে এসব দোকানে মারাত্মক ভিড় হয়। ভাল লাড্ডু ও অন্যান্য উত্তর ভারতীয় মিষ্টি পাওয়া যায়। লাড্ডুর বড় বড় দোকান আছে অবশ্য। অন্য দিকে, চিত্তরঞ্জন পার্ক, যেখানে বাঙালি মিষ্টি পাওয়া যায়, সেখানে আবার দোকানে ‘বেঙ্গলি সুইটস’ লেখা থাকে না। শুনলাম দুর্গা পুজোর সময়ে কিছু কিছু প্যান্ডেলে অমন মিষ্টি পাওয়া যায়। যাই হোক, অস্যার্থ হইল দৃষ্টিহীন বালকের নাম পদ্মলোচন হইতে কোনও বাধা নাই। সেই জন্যই বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী ? ফলেন পরিচিয়তে’।
এক বৃক্ষ থেকে পাওয়া ফল, আর তার থেকে তৈরি করা এক বিশেষ মিষ্টি নিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি হাজির হয়েছেন বিমান জ্যেঠু, আমার বাবার এক সময়ের সহকর্মী আর তার চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু। চিত্তরঞ্জন পার্কের কাছেই কালকাজিতে তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি উঠেছেন উনি। এই বন্ধু আমার বাবারও পরিচিত, দিল্লি আসার পরে পরেই তাঁর সাথে দেখা করতে গেছিলাম। গিয়ে দেখেছিলাম ডিসেম্বরের ঠান্ডায় ঘরের মধ্যেই তিনি জুতো মোজা সহ বাইরে যাওয়ার মত পোশাকে রেডি হয়ে বসে আছেন, যদিও কোথাও যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। পরে এই ব্যাপার আরও কিছু বাড়িতে দেখেছি। এবার অবশ্য গরমের সময়ে গেছি, মূলতঃ বিমান জ্যেঠুর সাথে দেখা করতে আর মা আমার জন্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছেন ওনার হাত দিয়ে, সেগুলো নিতে।
কোথায় যেন পড়েছিলাম ম্যাচিওরড হওয়ার পরিচয় বড় বড় কথা বলা নয়, ছোট ছোট জিনিস বুঝতে পারা। পার্ল বাকও বলেছেন এমন অনেক মানুষ আছে যারা বড় বড় সুখের আশায় ছোট ছোট আনন্দকে অনুভব করতে পারে না। সেই আনন্দের খানিকটা বুঝতে পারলাম প্রীতবিহারে ফিরে বিমান জ্যেঠুর আনা জিনিসগুলোর মধ্যে একটাকে দেখে। কলকাতার সন্দেশ এসেছিল, তাতে আমার দিল্লিবাসী দিল মোগ্যাম্বোর মত খুশ হয়েছিল ঠিকই, তবে তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ হয়েছিল যেটা পেয়ে তা হল একটা অতি সাধারণ জিনিস - নারকোল নাড়ু, একটু ভুল হল বাড়িতে বানানো নারকোল নাড়ু।
নাড়ু অনেকগুলো ছিল। আমি আর তথা খেলাম। অফিসেও নিয়ে গেছিলাম কিছু। অলয় টপাটপ কয়েকটা খেয়ে নিল। বলল, ওকে কেউ হ্যাংলা ভাবলেও কিছু আসে যায় না। আসলে বাড়ির নাড়ু এখানে বসে পেলে মনে হয় স্বর্গীয় কোনও কিছু হাতে পেয়েছি।
নারকোল একটা সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মত জিনিস। তা নিরামিষ রান্নায় দেওয়া যায়, আমিষ খাবারে মেশানো হয়। এ দিয়ে ঠাকুরের নৈবেদ্যর জন্য সন্দেশ বানানো যায়, আবার জম্পেশ পার্টির জন্য পিনা কোলাডা তৈরিতেও নারকোল প্রয়োজন। যদি জানা না থাকে, তাই বলে দিই পিনা কোলাডা হল হোয়াইট রাম, নারকোলের দুধ বা ক্রিম আর আনারসের রস দিয়ে। সাথে আরও কিছু দেওয়া যায় স্বাদে তারতম্য আনার জন্য, তবে যা লাগেই তা হল আইস কিউব, গরমের দিনে ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল।
এদিকে বাড়ি যাব বলে ছুটির কথা বলেছি বসকে, তবে এখনও মঞ্জুর হয়নি। দিল্লি এসেছি ছয় মাস হয়ে গেছে, একটু একটু ঘরোয়া অসুখে ভুগতে শুরু করেছি। কী বলছেন ? কী রকমের ‘ঘরোয়া অসুখ’ ? আরে যাকে ইংরেজিতে ‘হোম সিক’ হওয়া বলে, তাই। ওই জন্য দিল্লির গরম এখন বেশি বেশি লাগছে। গরম পড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আরম্ভ হয়েছে লোডশেডিং, আর সেই সঙ্গে শুরু হল জলের সমস্যা। মাঝে মাঝে স্নান বাদ দিতে হচ্ছে। তবে বৃষ্টি হলে কতটা কষ্ট হয় না। যেদিন আমি আর তথাগত অনেক রাত অব্দি ইন্ডিয়া গেটে ঘুরে বেড়ালাম। রাত সাড়ে এগারোটার সময় কি ভীড়? প্রচণ্ড গরম বলে সবাই এখানে বেড়াতে আসে। এক সঙ্গে এত আইসক্রিমওয়ালা আমি কখনও দেখিনি। ফোয়ারার পাশে বসে আমরাও আইসক্রিম খেলাম আর দেখলাম গ্রীষ্মের রাতে দিল্লির রাজপথে (এ রাস্তার নাম এখন কর্তব্য পথ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন) সাধারণ মানুষের ভিড়।
রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে থেকে যে রাস্তাটা সোজা এগিয়ে গেছে সেটাই রাজপথ আর সে পথ গেছে বিয়াল্লিশ মিটার উঁচু ইন্ডিয়া গেটের নিচ দিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে ৭০,০০০ ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ সেনার হয়ে লড়াই করার সময় মারা যায়, তাদেরই স্মৃতিতে বানানো হয়েছিল এটি। তবে এই স্মৃতি স্তম্ভে খোদাই করা আছে যে ১৩,৫১৬ জন ব্রিটিশ আর ভারতীয় সৈন্যের নাম, তাঁরা নিহত হয়েছিলেন ১৯১৯ এর আফগান যুদ্ধে। এডউইন লুটিয়েনের নকশা করা এই স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯২১ সালে আর ভাইসরয় লর্ড আরউইন তার ১০ বছর পর এটি উদ্বোধন করেন।
এখানেই ছিল ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’, যা ওয়ার মেমোরিয়ালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর কাছেই আর একটি স্থায়ী ছাউনির (ক্যানোপি) নিচে ছিল সম্রাট পঞ্চম জর্জের মূর্তি। ১৯৬৮ সালে সেটিকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে ওই স্থান শূণ্যই ছিল। সম্প্রতি (২০২২-এর সেপ্টেম্বরে) সেই জায়গা পূর্ণ করেছে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের মূর্তি। ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’-র সরে যাওয়া আর নেতাজীর মূর্তি নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলাও কম কিছু হয়নি।
উপরে দেওয়া নিখিল মানানের ছবিটা দেখুন। এই জায়গাটাই ইন্ডিয়া গেট চত্বর, গেটটা রয়েছে সামনে আর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ক্যানোপির খানিকটা অংশ। এখানেই বসেছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীর মূর্তি তাইহোকুতে যাঁর অন্তর্ধান নিয়ে রহস্যের কুয়াশা ৭৭ বছর পরেও কাটেনি।
সব কুয়াশা কাটে না। নেতাজির অন্তর্ধান না হয় অনেক বড় আন্তর্জাতিক ব্যাপার, একাধিক দেশ নাকি জড়িত। ছোটখাটো অন্তর্ধানও তাই বলে কম কিছু নয়। তেমনই একখানা ঘটনা ঘটে গেল প্রীতবিহারে আর সেই সূত্রে জানা গেল মানুষের সংস্কার নিয়ে এমন একটা ব্যাপার যা কোনও দিন মাথাতেও আসেনি। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।