।। বার ।।
“এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা
হেঁটে দেখতে শিখুন’’
- ‘বাবুমশাই’, শঙ্খ ঘোষ।
রাজনৈতিক দলগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় – দক্ষিণ, বাম আর মধ্যপন্থী। মধ্য পথের পথিকরা কেউ একটু ডান দিকে ঘেঁষা, কেউ বা বাম। নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও একটা জিনিস মোটামুটি কমন। শঙ্খ ঘোষ যেমন বললেন এ কলকাতার মধ্যে আর একটা কলকাতা (বা অন্য যে কোনও মহানগরীর মধ্যে) লুকিয়ে আছে, যাকে পায়ে হেঁটে চিনতে হয়, তেমনি সব বড় বড় পার্টিগুলোর মধ্যেই আছে ছোট ছোট অনেক পার্টি। এরা যে আছে তা সবাই জানে, তবে জোর গলায় স্বীকার করে না কেউ, করতে নেই। মাঝে মধ্যে এই গোষ্ঠীগুলো একজোট হয়ে দলের জন্য কাজ করে, আর বাকি সময়ে… যাকগে, জানি আপনি সমঝদার লোক।
গত কিস্তি শেষ হয়েছিল একটা ‘অদ্ভুত ঘটনা’র ইঙ্গিত দিয়ে। একটা লোককে অন্যান্য দলের সবাই মিলে দেশের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ নেওয়ার অনুরোধ করছে আর তার নিজের পার্টি তাতে রাজী হচ্ছে না, এমনটা তো রোজ রোজ ঘটে না। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, জ্যোতি বসুর কথা হচ্ছে। লোকসভায় তো কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না, বাজপেয়ী পদত্যাগ করলেন, কংগ্রেসও রাজী হল না সরকার গড়তে। তখন সমাজবাদী পার্টির প্রধান মুলায়ম সিং যাদব প্রস্তাব দিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেই প্রধানমন্ত্রী করা হোক। জ্যোতিবাবু বললেন বাম দলগুলোর তো অত সাংসদ নেই। হরকিষণ সিং সুরজিত, এইচ ডি দেবে গৌড়া, রামকৃষ্ণ হেগড়ে, বিজু পট্টনায়ক, লালু প্রসাদ প্রমুখ বড় বড় নেতারা এ বিষয়ে আলোচনা করলেন। সিপিআই(এম) এই নিয়ে মিটিং করল আর সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হল সংখ্যা যখন পক্ষে নেই, পুরোটাই অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে, তখন এই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কোনও মানে নেই। পরে জ্যোতি বসু নিজে এই সিদ্ধান্তকে পার্টির ‘ঐতিহাসিক ভুল’ আখ্যা দেবেন। তাঁর যুক্তি হল বামপন্থীদের মতবাদকে দেশের মানুষের সামনে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করার একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।
পরে এই নিয়ে প্রচুর নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, প্রাইমটাইমে চেঁচামেচি হয়েছে। তাই আর ঘ্যানঘ্যান করার দরকার নেই। আমাদের আরও অনেক কাজ আছে। তাছাড়া অদ্ভুত ঘটনা কি আর একটা!
যেমন, আমায় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেক্সপিয়ারের মত করে বলতে গেলে সেটা এই রকম হবে – টু ডাইন অর নট টু ডাইন। ব্যাপারটা হলে অফিস থেকে একটা সংস্থায় পাঠিয়েছে, কয়েকজনের সাথে দেখা করে কথা বলে একটা বিষয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। তাঁরা দেখা করতে বলেছেন একটা নাম করা ক্লাবে। সেখানে তাঁরা নাকি ডিনারও খাওয়াবেন। “বস বললেন, “গমন কর বৎস, উৎকৃষ্ট রূপে ডিনার করিবে। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া নাসিকা গর্জন সহযোগে নিদ্রা যাইবে। অতঃপর কল্য অফিসে পদার্পন করিয়া রিপোর্ট দাখিল করিও।”
তা না হয় করিব, আপাততঃ ক্লাবে তো যাই সন্ধ্যা বেলা। যাবার পর প্রাথমিক আলাপচারিতার মধ্যেই বুঝতে পারলাম এনাদের মধ্যে সব চেয়ে ছোট যিনি কম করে পঞ্চাশটি বসন্ত পার করেছেন, আর বাকি সাত-আট জন বয়সের সিঁড়ি বেয়ে আরও বেশ কয়েক ধাপ উপরে উঠে গেছেন। এবং তাঁদের প্রত্যেকেই নানা গড়নের সুদৃশ্য গ্লাসে সোনালী রুপালী মেরুন কমলা ইত্যাদি রঙের পানীয় সাথে নিয়ে আমার সাথে আলোচনার জন্য রেডি হয়ে আছেন। এক যাত্রায় যাতে পৃথক ফল না হয় সে জন্য আমাকেও কোনও একটা রঙ বেছে নিতে অনুরোধ করা হল। দু মিনিটেই বুঝে গেলাম ‘না’ উত্তর এঁরা শুনবেন না। রাতেই বাড়ি ফিরে আমার রিপোর্ট বানিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল, পান করার অভ্যাসও তেমন নেই বললেই হয়। অতয়েব ওনাদের প্রাথমিক অফার কমলা রঙ (আমার ধারনাকে নিশ্চিত করে পরে অরিজিত বলেছিল ওটা একটা ককটেল, নাম ‘ব্লাডি মেরি’) সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে একটা বিয়ার চেয়ে নিলাম। সাথে নানা কিসিমের অনুপান ছিলই। তারপর কিঞ্চিৎ কথা বলার পরেই স্পষ্ট হল অফিস যা আশা করছে তার সিকি ভাগও আমার রিপোর্টে থাকবে না, তেমন তথ্যই নেই। ভাগ্যক্রমে তেমন সম্ভাবনা যে থাকতে পারে, সেটাও বস বলে দিয়েছিলেন। অতয়েব নোটবুকে সামান্য কিছু লিখে নিয়ে ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়দের ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়তে গেলাম। অনেকটা দূরে ফিরতে হবে। এবং তারপরেই ঝামেলার শুরু।
প্রথম ভদ্রমহিলাঃ সে কি! ডিনার না করে যায় না কি!
প্রথম ভদ্রলোকঃ না না, বললেই হল ডিনার করব না। অনিতা (যিনি আমায় পাঠিয়েছেন) কী বলবে!
আমিঃ কিছু বলবেন না। তাছাড়া স্ন্যাক্স খেয়েছি তো, আসি।
দ্বিতীয় ভদ্রলোকঃ (অনেক বয়স) দাঁড়াও, রিপোর্ট কবে দেবে বেটা?
আমিঃ আজই (পুরো বাজে কথা)। ম্যাম থাকবেন (এটা সত্যি), তাই তো তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইছি।
দ্বিতীয় ভদ্রলোকঃ কতক্ষণ লাগবে লিখতে?
আমিঃ ইয়ে… মানে… ধরুন…
দ্বিতীয় ভদ্রলোকঃ আধ ঘন্টা? পঁয়তাল্লিস মিনিট?
আমিঃ হ্যাঁ… মানে… ওই রকমই হবে।
দ্বিতীয় ভদ্রলোকঃ গুড। কাগজ কলম চেয়ার টেবিল দিচ্ছি, লিখে ফেল। তারপর ডিনার করে ফিরবে।
আমিঃ না না, ফাইনাল করার আগে আমায় একটু গর্গ ম্যামের সাথে কনসাল্ট করতেও হবে।
প্রথম ভদ্রলোকঃ (ইনি অনেকগুলো কমলা রঙ সাঁটিয়েছেন ইতিমধ্যে) অনিতা ইজ সাপোজড টু স্টে টিল লেট ইভনিং ইন দ্য অফিস।
দ্বিতীয় ভদ্রলোকঃ বেটা, তুম রিপোর্ট লিখ লো। গর্গকো ফ্যাক্স কর দেঙ্গে ইঁহাসে। ফির হাম সব এক সাথ ডিনার করেঙ্গে। বাড়ি যাওয়া নিয়ে চিন্তা মৎ করো, আমরা পোঁছে দেব।
বাকিরা হৈহৈ করে সেই প্রস্তাব সমর্থন করলেন।
আমি তো প্রমাদ গুণলাম। তারপর ভাগ্যক্রমে দেখি ফ্যাক্স মেশিন কাজ করছে না। আমি কেটে পড়ার ধান্দা করছি, ওদিকে ডিনার আমায় ওনারা করিয়েই ছাড়বেন। নতুন রাস্তা খুঁজে বার করলেন। সেটা হল আমায় গাড়ি করে অফিসে নিয়ে যাবেন এক ড্রাইভার, তিনি অপেক্ষা করবেন আমার তথাকথিত রিপোর্ট লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত, এবং আমায় ক্লাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।
কী আর করা, অফিসে এসে অনিতা গর্গ ম্যামকে সব বললাম। তিনি হেসেই খুন। বললেন আধ ঘন্টা বসে যাও, তারপর ফিরে গিয়ে ভাল করে ডিনার করো। আর হ্যাঁ, তোমার বাড়ি পৌঁছে দেওয়াটা কিন্তু এনসিওর করে নিও। রিপোর্ট নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করলে বলবে আমায় দিয়ে দিয়েছ।
ডিনার তো খুবই ভাল হল। আর তারপরেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন জানতে পারলাম আমায় মোটর বাইক চালিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন সেই প্রথম ভদ্রলোক যিনি একের পর এক কমলা রঙ-এর গ্লাস খালি করে চলেছেন এবং ওনার কথাবার্তাও আমার একটু ইয়ে ইয়ে লাগছে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আজ কিছু একটা ঘটবে। ওনার চেহারা খুব ভাল, জানালেন পাওয়ার লিফটার না ওয়েট লিফটার কিছু একটা ছিলেন এক কালে। হেলমেট টেলমেট নেই। খুব ভয়ে ভয়ে পিলিয়ন রাইড করতে উঠে দেখলাম, ওনার গলা কাঁপলেও হাত স্টেডি। রাত প্রায় সাড়ে এগারটায় আমায় বাড়ির দরজায় নামিয়ে উনি ফিরে গেলেন।
আমি ফাঁকা ঘরে তালা খুলে ঢুকলাম। তথা চুপি চুপি কলকাতা গেছে একটা দরকারে অফিসে না জানিয়ে, আমায় কাল অফিস গিয়ে বলতে হবে ওর শরীর ভাল না, তাই আসতে পারেনি।
পর দিন অফিসের সিনিয়রদের কয়েকজনের কাছে শোনা গেল যদিও আমাদের মানে আমি, তথাগত, অমিতাভ আর দাশগুপ্তকে কলকাতার অফিসের জন্যই নেওয়া হয়েছে, তবুও চাইলে দিল্লি থেকে যাওয়া সম্ভব, যদি ট্রেনিং পিরিয়ডে ভাল কাজ করে বসদের খুশি করতে পারি। সিনিয়রদের বক্তব্য হল দিল্লিতে কাজের যত সুবিধে, কলকাতায় অতটা হবে না। কথাটা ঠিক, তবে কিনা কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকি থাকতে হবে সেটা ভাবতেও কেমন যেন লাগে। দিল্লির এক বড় নেতা বলেছিলেন এ হল ‘ডাইং সিটি’, আর কলকাতার এক কবি বলেছিলেন এ শহর জানে তাঁর প্রথম সব কিছু – ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, প্রেম-অপ্রেম, রাজনীতি-সংস্কৃতি – সব কিছু। তেমনই ভাবেই আমাদেরও যেন মজ্জায় মজ্জায় মিশে গেছে সে। আমি কলকাতা ছাড়লেও কলকাতা আমায় ছাড়বে কি? কবির ভাষায় “পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু।” কলকাতা ফেরা, না দিল্লিতে থেকে যাওয়া - এই সিদ্ধান্তটাও নিতে হবে।
পরের দিন আমার অফ। ভাবলাম একটা সিনেমা দেখে আসব। আর সেটা করতে গিয়ে যা কান্ড বাধালাম তা আর বলার নয়। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।