জাম আর জামরুলের বিশাল গাছ দুটো এমনিতেই উঠোনে রোদ ঠিকঠাক আসতে দেয় না, তার উপর ক’দিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই বৃষ্টির সাথে হুটহাট বাতাসের ঝাপটা। সে ঝাপটায় বৃষ্টির জলে ভেসে যায় আমাদের ভাড়া-বাসার বারান্দা। ঘর থেকে বারান্দাটা বেশ খানিকটা নীচু। আমি মাকে ফাঁকি দিয়ে ঘরের দরজায় বসে সেই বারান্দায় বৃষ্টিতে পা ভেজাই।
মাকে ফাঁকি দিলেও মুসা’র মাকে কিন্তু ফাঁকি দিতে পারি না।
- আপা ভিজতাছো ক্যান, সর্দি ধরবিনি কইদিলাম।
আমি তো শুধু পা ভিজাই কিন্তু মুসা’র মা তো ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। আর তা হবেই বা না কেন? সেই কোন সকাল থেকে বারবার উঠোনের পাতা সরাচ্ছে। ঝাপটা বাতাসে জাম-জামরুলের পাতা পড়ে পুরো উঠোন ভরে গেছে। আর এর সাথে ঝমঝম বৃষ্টির জল জমছে উঠোনে। পাতাগুলো সরিয়ে দিলে জল খানিকটা সরে যায় উঠোন থেকে।
আমলাপাড়ার প্রায় সব বাড়িতেই অল্প বৃষ্টিতে জল জমে। শহরের শেষপ্রান্তের নিরিবিলি এই এলাকাটা বেশ নীচু। নদীর খুব কাছে হওয়ায় নদী উপচে যখন তখন জল ঢুকে পড়ে এখানে। তাই জলের সাথে এখানকার মানুষগুলোর খুব ভাব।
- আপা যাও ঘরের ভিতরে যাও, অসময়ের বৃষ্টি রোগ বালাই ছড়ায়। যাও কইলাম ঘরের ভিতরে।
মুসা’র মার কথায় আমি ঘরের ভেতরে চলে আসি। আজ আর ভেজা বারান্দায় কেরোসিন স্টোভ জ্বলেনি আমাদের। ও ঘরের এক কোণায় মা স্টোভের পলতায় আগুন দিয়েছে। তাতে চড়েছে চালেডালে। সাথে বেগুন ভাজি আর ঘি।
কিন্তু গা মাথা মুছে দুপুরের পাতের সামনে বসলাম শুধু। পাঁচফোড়নের চালেডালে খাবার ইচ্ছাটুকু কেন যেন ফুরিয়ে গেল আমার। পাতের চালেডালে শুধু হাত নাড়ছি দেখে মা পাশে এসে বসল,
“মনি খেয়ে নাও। তোমার চোখমুখ এমন ছলছল করছে কেনো? তাড়াতাড়ি খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।”
না, চালেডালে নয়, ঢকঢক করে জল খাই। মা এবার কপালে হাত রাখলো,
“গা টাও তো কেমন ছ্যানছ্যান করছে।”
ব্যস্! আমিও সুযোগ পেয়ে গেলাম,
“মা, খেতে ইচ্ছে করছে না একটুও”। মা আর জোর করল না। বিছানায় গা মেলতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে জড়ো হল। চোখদুটো এমনিতেই বন্ধ হয়ে এল। আর ও’টুকুই। এরপরের কথা তেমনভাবে মনে পড়ে না আমার। মনে থাকবে কী করে? জ্বর এলেই তো আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ি। মাথায় জল ঢালতে হয় একটু পরপর। প্যারাসিটামলে জ্বর একটু কমতে না কমতেই আবার হুড়হুড় করে বেড়ে যায়। আর আমি সেই জ্বরের ঘোরে পৌঁছে যাই লাল বারান্দার আমার সেই বাড়িতে,
ওই তো ঠাকুমা তুলসীগাছের মাথায় জল ঢালছে। সারা বৈশাখ মাসজুড়ে ঠাকুমা তুলসীগাছের মাথায় জল ঢালে। আর ওই তো মনিপিসি, বাইরবাড়ির বারান্দায় বসে চটের আসনে ফুল তুলছে,
- ও মনিপিসি, তোমার পরীক্ষা তো এসে গেল, পড়তে হবে না তোমার?
আমার কথার উত্তর দেয় না মনিপিসি।
ওই তো দাদুর রেডিওটা এখনো বেজে চলেছে, দাদু তো ঘুমিয়ে পড়েছে সেই কখন। কাঠের টেবিলে থাকা রেডিও থেকে খুব আস্তে আস্তে ভেসে আসছে,
- হয় যদি বদনাম হোক আরো
আমি তো এখন আর নই কারো
অন্ধ গলির এই যে আঁধার
বন্ধু হলো আজ আমার
জীবন ভরে ছিল
শুধু হাসি শুধু গান
কোথা যে হারালো…….
আমি পায়ে পায়ে ঠাকুমার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পেয়ারা গাছের ছায়া দুলছে ঠাকুমার গায়ে। দুপুরের বাতাসে উঠোনে মেলে রাখা আধা শুকনো কাপড়গুলো এদিক ওদিক উড়ে সুযোগ পেলেই ঠাকুমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
- ও ঠাকুমা, একটু গুড়ের চা বানাবে? খুব খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।
ঠাকুমা পেতলের ঘটি হাতে কলতলা চলে যায়। আমার দিকে তাকানোর সময় নেই ঠাকুমার। আমি আবার ডাকি,
ও ঠাকুমা
আবার ডাকি,
ও ঠাকুমা
না, ঠাকুমা আমার ডাকে সাড়া দেয় না। আমার কষ্ট হয়, আমার কান্না পায়। ঠাকুমা আমাকে দেখতেই পায় না। আমার কথা শোনার সময় নেই ঠাকুমার। আমি গুঙিয়ে কেঁদে উঠি।
আবার জ্বরের ভেতর ভুলভাল বকছো, মা মনি, মা আমার…
মা আমার কপালে জলপট্টি দেয়। জ্বর বেড়েছে আবার।
প্যারাসিটামল আর জলপট্টিতে দিনরাত কাটতে থাকে আমার। সাথে দুধ আর পাউরুটি। যতটুকু খাই তার চেয়ে বেশি উগরে দিই।
জ্বর কমে ছাড়ল দিনকয়েক পর। কিন্তু জেঁকে বসা জ্বরের অরুচি ছাড়ে কই?
মা আমার জন্য গন্ধ ভাদালের বড়া বানায়, রাঁধুনি ফোড়নে পাবদা মাছের পাতলা ঝোল করে, আদা বাটায় নদীর তাজা বেলে মাছ, খারকোল বাটে, শিউলি পাতার রস করে — কোনোকিছুতেই মুখের রুচি ফেরে না আমার।
ক’দিনেই চোখের কোল বসে গেছে আমার। বাবা কালিবাড়ির বাজার থেকে বেদানা নিয়ে আসে, স্টেশন বাজার থেকে কচি ডাব – কিন্তু কিছুই কেন যেন খেতে মন চায় না আমার। বিকেলে নদীর পাড়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। বড়দাদির নতুন পায়রার লোভও আমাকে টানে না।
স্কুল যাই না তাও প্রায় দিন সাতেক। এই তো গতকালই উষাদি স্কুলে যাবার পথে দেখতে এসেছিল আমায়,
“মুখটা ওমন শুকিয়ে গেছে কেনো স্মৃতিকণা? ভালো না লাগলেও খেতে হবে তো।”
এরপর মাকে ডেকে রুচি ফেরানোর টোটকা দিল,
“দিদি, মৌরি বাটায় মুরগি করে দাও, ওর রুচি ফিরবে।”
এর মধ্যে বড়দাদি, মুসা’র মা, শিখা দি’র মা সবাই টোটকা দিয়েছে। মা সবার কথাই শুনেছে। তাতে যা হয়েছে – আমি হয়তো একবেলা খানিকটা খেয়েছি।
আর সেই একবেলার খাওয়ানোর লোভেই বাবাকে দিয়ে বাচ্চা মুরগি আনিয়েছে মা আজ।
অসময়ের বৃষ্টি ফুরিয়েছে। ভেজা বারান্দার জল টেনে নিয়েছে সকালের রোদ। মা কেরোসিনের স্টোভে আগুন দিয়েছে। নীল আঁচে বসেছে লোহার কড়াই। তাতে সর্ষের তেল। তেজপাতা ফোড়নে পড়ল। আগে থেকে মিহি করে বেটে রাখা মৌরি বাটায় মাংসগুলো হাতে মাখিয়ে নিল মা। সাথে শুকনো মরিচ আর আদা বাটা। কুচানো পেঁয়াজ পড়লো কড়াইয়ে। খানিকটা লবণ আর হলুদ গুড়ো। পেঁয়াজের রঙ বদল হতেই মা মাখানো মাংস আর কেটে রাখা লম্বাটে পেঁপের টুকরো ঢেলে দিল কড়াইয়ে। মৌরি মাখানো মাংস তেলে পড়তেই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। নেড়েচেড়ে কড়াইয়ে ঢাকনা দিল মা।
আমি বারান্দার এককোণে চুপচাপ বসে আছি। মসজিদের মাঠ থেকে বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় ভেসে আসছে। প্রতিদিন বারবেলার পড়ার সাথে সাথে স্কুল শেষ করে সবাই বাড়ি ফেরে। সে সময় অনেকেই মসজিদের মাঠে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলে। অন্যদিন হলে আমি টিনের দরজা অল্প একটু ফাঁকা করে ওদের খেলা দেখতাম। কিন্তু আজ আর ইচ্ছা হল না।
স্টোভের অল্প আঁচে মৌরি মাংস নেড়েচেড়ে কষিয়ে নিচ্ছে মা। জল ছেড়ে কচি মুরগির মাংসগুলোর সাথে সেদ্ধ হচ্ছে পেঁপের টুকরোগুলোও। অল্প একটু জিরাবাটা মিশিয়ে দেয় মা এবার। এখন জল টেনে তেল বের হওয়ার অপেক্ষা।
মুসা’র মা ও বাড়ির কাজ সেরে আমাদের বাসার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে,
“ঘ্রাণ ছুটছে তো খুব, আপা আজ কিন্তু কয় গ্রাস ভাত খাইয়ো কইলাম।”
মা গরম জলে ঝোল দেয় মৌরি মাংসে।
মাঠের মসজিদে আজান পড়ল এবার। মা আর দেরি করে না। বাবা আরেকটু পরে দুপুরের টিফিনে বাসায় আসবে।
বারান্দায় চটের আসন পড়ে।
মৌরি মাংসের ঝোল লাল তেল ভাসিয়ে টগবগ করে ফুটছে। খুব অল্প মিহি করে বাটা গরম মসলা দিয়ে স্টোভ থেকে নামিয়ে মৌরি মুরগি নামিয়ে ফেলে মা।
আমার পাত পড়ল। ঠাকুমার পাঠানো ঝিঙেশাইল চালের নরম ভাত আর মৌরি মুরগি। সাথে বাবার পাতও পড়ল।
আজ বাবা খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ঠাকুমার চিঠি এসেছে যে বাড়ি থেকে।
ঠাকুমার সেই চিঠি পড়ার লোভ, নাকি মৌরি মুরগির সুঘ্রাণ তা বুঝতে পারলাম না – আজ অনেকদিন পর আমার পাত পুরো খালি হল।
দুপুরের ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে মা আজ পড়ছে ঠাকুমার চিঠি।
স্নেহাস্পদ বড় বৌমা,
পত্রের শুরুতে আমার আশীর্বাদ নিও। বাবা দুলাল আর দিদির জন্য রইলো আমার আশীর্বাদ।
পর সমাচার এই যে, গতরাতে দিদিকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমার দিদির শরীর ভালো আছে তো। আমার দিদির জন্য বাদল বাড়িতে শিন্নি মানত করেছি…
আমি পাশ ঘুরে শুই। চোখ বন্ধ করে ঠাকুমার মুখটা চোখের সামনে আনি। মৌরির ঘ্রাণমাখা হাতে ঠাকুমার পেট জড়িয়ে এখন আমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
রাস্তা থেকে ভেসে আসছে ঘোষদাদুর হাঁক,
মাঠা… মাঠা…
সেই ডাক ছাপিয়ে আমি কান পাতি বাবুইপাখির ডাকে। জাম গাছে ক’দিন হল বাসা বেঁধেছে।
এবার ঠাকুমার চিঠির উত্তরে লিখতে হবে এই তাঁতি পাখির গল্প। ঠাকুমা যে সবসময় বাবুইকে তাঁতি পাখি ডাকে।