এইখানে, হুজুগের দেশে, টাইমলাইন ভাষা হায় পান্তা আশ্লেষে, ভর্তা ও মাছ ভাজায় থেমে গেছে, নড়িবে না আর। অথচ এ খাবার, এ-যাবৎ কপালে মারিয়াছে চাপড়, চাষার জোগান, খাবি খাইতেছে আঁতেল জনগণ।
দাঁত টাঁত উড়ে যাবার অস্পষ্ট ও না-বোধগম্য জটিল হাবিজাবি বাক্যের এই গল্পটি কতক আহামরি বটে। ব্যাপার হল, বিশ্ব কাঁপিয়ে পান্তা আজ, নয়া টপিকে বাঙালির গদগদ মেলোড্রামা মন্থনে, লাইমলাইটে। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশওয়ার চৌধুরী পান্তাভাত, আলুভর্তা ও তদুপরে একখানি শুকনো লঙ্কা এবং নোনতা স্বাদের সার্ডিন মাছভাজা রেঁধে পরিবেশন করেছেন। হদ্দমুদ্দের জনগণ যেখানে তাবৎ উৎসাহ নিয়েছিল কাচ্চি বিরিয়ানি কিংবা চিকেন সিসলিকের আশায়, তাতে এক্কেরে এক গামলা জল ঢেলে ঘুলিয়ে পান্তা করে ছেড়েছেন কিশওয়ার। সেই যখন তিনি হাঁসের মাংসের চর্বি দিয়ে মাশরুম রাঁধছিলেন এবং বিচারক অ্যান্ডির 'হোয়্যার ইজ দ্য কিশওয়ার' মন্তব্যে ক্ষণিক বিরতি; সিগনেচার ডিশ হিসেবে যে এরপর পান্তা আসতে চলেছে তা বোধ করি বঙ্গ ভাগ্যাকাশের স্বঘোষিত তারাকুলের কেউই ভাবেননি। রেস্তোরাঁয় না পাওয়া যাওয়া সেই 'পাওয়ারফুল' কমফর্ট ফুডের সাথে ধূমায়িত কয়লার এমন অভাবনীয় মিশেলে সমাপ্তি, এই আত্মবিশ্বাসকে, দাঁতে দাঁত কষে ছক ভাঙতে মনে যে দশগুণ বাইসেপ রাখতে হয়, তাকে গড় কেটে স্যালুট।
এইবার আসি আসল কথায়। ইউটিউবের বদান্যতায় যে বাঙালির এখন ঘরে ঘরে শেফ, বিভুঁইয়ের মাস্টারশেফের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিযোগীদের ড্রিবলিং করে টিকে থাকা শীর্ষ তিনের একমাত্র মহিলাটির জটিল-কুটিল খাবারের বদলে এই 'সাধারণ' রান্নাটি ফাইনাল ডিশ হিসেবে পরিবেশনায় তাঁরা কিঞ্চিৎ পাজল্ড। এমনিতেই ক্লান্তিকর মানিমেকিং সর্বস্ব মধ্যবিত্ত মিডিওকার বাঙালি, আঁতেল প্রমাণান্তে, এট্টু গাঁয়ের ছোঁয়া পেলেই আহা উহু করতে করতে গায়ের ক্যামাফ্লোজখানা নালেঝোলে ভিজিয়ে ফেলেন; তাঁরা গালভরা নাম দেন 'ফোক', তাপ্পর ফোকি (রি নয়, সেটার সহমর্মী কোনভাবেই নন বলেই বাহুল্য) সেজে নববর্ষে পান্তা ইলিশ খান, মাঝেমাঝে মাটির দেওয়ালে সাজা রেঁস্তোরায় কচুভর্তা খেয়ে ভাবসমাধি যান। অতএব, এই পান্তাকে অ্যান্টিক্লাস স্ট্রাগলের মর্যাদা না বাঙালির নেকু স্মৃতিরোমন্থনের সোৎসাহ পৌষপার্বণ বলা হবে সে সিদ্ধান্তে আসতে তাঁরা গলদঘর্ম হচ্ছেন, বৈকি।
ক্লাস ফাইভের রচনাকার মাত্রেই যেসব পান্তাজড়িত স্মৃতি এই কদিনে দেখলাম, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার ছিঁটেফোঁটাও আমার নেই এবং এর মধ্যে আমি না চাইলেও, আমাদের জীবনের প্রাচুর্যের মাঝে অনটনজনিত এসব খাবারের পুঁজিবাদী আত্তীকরণের প্রতি প্রচ্ছন্ন মদতকে সলিড্যারিটির নামে চালানোকে,বলতেই হবে গাম্বাট অজুহাত। না, আমি নিয়মিত পান্তা খাইনি এবং আমার মা-মাসিও তা কখনও রোজ ছোঁননি। আমার বছর সাতেক বয়স থেকেই বাড়িতে ফ্রিজ দেখেছি এবং তার আগের কালে সাড়ে তিনজনের সংসারে অতিরিক্ত ভাত হাতে গুণে কয়েক দিনই বাঁচত, সেভাবেই হিসেব করে রাঁধার বয়ান মায়ের থেকে শুনেছি। বরং নানিকে শুনেছি জনা ছাব্বিশের সংসারের সকলের পেট রোজ একই মাপ না দেওয়াতে অধিকাংশ দিনই উদ্বৃত্ত ভাতকে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পান্তা খেতে। এবং বিশ্বাস করুন, টকে যাওয়া পান্তা বেশ কয়েকদিন আলু বা কুচো চিংড়ির তেল-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তার সাথে মেখে আঙুল চেটে খেলেও বাকি দিন সে খাবার দায়ে পড়েই নানি খেত। বাড়ির 'ছেলে-কর্তা'দের জন্য ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত থালায় ঢালতে গিয়ে সেদিকে জুলুজুলু দৃষ্টি যেত সেই মেয়ের, যে, সকালে পান্তার পর বিকেল গড়িয়ে সন্ধের খানিক আগে কিংবা রাতে সবার খাওয়া শেষে পড়ে থাকা আলুনি ভাত খেতে খেতে গরম ভাতকে রেলিস করত মনে মনে।
এই যে দায়ে পড়ে খাওয়া কিংবা খেতে বাধ্য হওয়া; হালের পান্তা-ভর্তা-মাছ ভাজার ত্র্যহস্পর্শের নান্দনিক দেওয়ালভর্তি উচ্ছ্বাস, তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। যে মেয়ে গরম ভাতের স্বপ্ন নিয়ে পান্তা খেতে বসে, তদুপেক্ষা যে মেয়ে দিনে একটিবার এই খাবারকে প্রসাদভ্রমে পেটে ঢালে তার অবস্থা আরও সমীচীন। ঠিক যেমন আমাদের যথেষ্ট বিত্ত থাকে - ইফতারে কী কী খাব ভাবার অথচ মুখে 'গরিব দরদী' ভণিতা নিয়ে স্বর্গীয় খেজুরের আঁটি কুড়াই কিংবা 'ফাস্টিং' ডায়েটের পিত্তি, হুজুগে গা ভাসানো একদিনের পান্তাপ্রীতিও তেমনি মর্মস্পর্শীর নামে স্বার্থকোলে ঠকঠক করে কাঁপা তেল।
তাই কুর্নিশ অবশ্যই করুন কিশওয়ারের উদ্ভাবন-সাহস-প্রেজেন্টেশন-রন্ধনশৈলীকে, মন্থন করুন সুনীল-বিভূতিভূষণ-রবীন্দ্রনাথের পান্তাস্মৃতিকে; কিন্তু ভর্তা/বড়া/তেল-পিয়াঁজ-লেবু/নারকেল কোড়া/মাছ ভাজার সামান্যটুকুও জোগাড় করার সামর্থহীন মানুষদের নুন দিয়ে পান্তা খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়াকে রোম্যান্টিসাইজ করার বাহানা দিলে নিজেই নিজের 'সাম্যবাদী' সাজিনু নিতম্বে একটি স্ল্যাপস্টিক মার্কা লাথি কষিয়া মারিবেন।
পান্তা নিয়ে যে পরিমান ন্যাকামো দেখতে হচ্ছে ক'দিন, তার বিপরীতের মত শুনে স্বস্তি পেলুম
একদম। রোমান্টিসাইজ করতে দেখলেই
"নুন আনতে পান্তা ফুরায় " প্রবচনটির ব্যবহার মোক্ষম
পান্তা নিয়ে তো রীতিমতো গবেষণাপত্র লিখে ফেলেছেন আর সবাই। এই লেখাটি মুখোশ ছিঁড়ে আসল চেহারা দেখিয়ে দিল। চিরটাকাল তাই তো জানতাম , পান্তা গরিব মানুষের সহজ সমাধান।
সাহসী লেখা।
সেই যে বলে না সাহেবদের থেকে পাত্তা না পেলে আমাদের দেশের লোকের খেয়াল পড়েনা। সে গীতাঞ্জলি থেকে পথের পাঁচালি ই হোক আর পান্তাভাত। মাস্টারশেফ জেতার পর পান্তা র বিবিধ গুনগান করে যে এত্তো এত্তো লেখা বেরোচ্ছে , জানতে ইচ্ছে করে তাঁরা নিজের বাড়িতে কতদিন রেগুলার পান্তা খেয়ে থাকেন।
আহাআআ... পান্তাটো নাহয় জুটেই নাই দিদিভাই... তা বাদে কলম টো তে অ্যামুন আধা-আঁতেল উচ্ছো ক্যানে?
@পিউ রায়
কী করব, দিদি! আঁতেল সাজার সমূহ শখ অথচ জীবনে ফুল মার্কস কখনো পাইনি কিনা, বুঝলেন।