
হুড়মুড় করে মাসের ৮ তারিখ চলেই এল। তায় আবার ছাগলের তৃতীয় সন্তান মার্কা বচ্ছরকার মাস , টাকাপত্তরকে গুছিয়ে বিছিয়ে আচ্ছেদিনের নজর বাঁচিয়ে যতটুকু সেভ করা যায় পরের মাস থেকে তার লম্বা প্ল্যানিং চলে হালের জাতীয় পশুর জাবরকাটা স্পিডে। তবুও সেলিব্রেশনের সুড়সুড়ি নিয়ে প্রাক চৈত্রসেলের চকমকি ঠুকে নারী-দিবসের গায়ে বেশ একখান হ্যাঁচ্চো ফেলার তোড়জোড় : ৭০% অফ এর জামাকাপড়, ৪০% অফ এর জুয়েলারি, ৩০% অফ এর রেস্তোরাঁ অফার, সব মিলিয়ে এক্কেরে 'অফ' এর অফার। নতুন শাড়ীতে - গয়নাতে বেশ একখান নিজেকে গদগদ করার প্রাক ব্যবস্থা না করেই যদি সপাৎ লাইক পাওয়া পোস্ট ঢেলে দিই নীল-সাদা দেওয়ালে তাহলে তো নারীদিবসের জৌলুসে চায়ের দাগ, পায়ের ওপর পা তুলে ফিচকে হাসবেন, বলি মান-ইজ্জত নেই নাকি হে বাপু আমার! সেই কোন ১৯০৮ সালে না'হয় নিউ ইয়র্কে মহিলাকর্মীরা কাজকম্মের রুলস-রেগুলেশনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছিল তাতে কী! ওরা ছিল গার্মেন্টস ওয়ার্কার আর আমরা হলাম ডিফল্ট এর ফাঁদ পাতা দুনিয়ার ঘরমেড ওয়ার-কার( মানে ডিফল্ট রান্না জানা, ডিফল্ট ময়দা মেখে কুচি-পু মুখ করা, 'ভদ্র' জামা পরা, মুখের ওপর তক্ক না করা, ঘাঁটা জিনিসে প্রশ্ন না করা, ফেসবুকে পিরিয়েডের প্যাড দেখে 'ইস ম্যা গো! কী ঘেন্না!' জাতীয় এক্সপ্রেশন দেওয়া....এ লিস্টি নেভারএন্ডিং... এমন ডিফল্টের দুনিয়াঘরে ওরা কারা যারা বিপক্ষে বলে?! ইয়ে মানে এ তো রীতিমত রণাঙ্গন!)
কিন্তু ঘটা করে এই একটা দিন কীসের উদযাপন? কেন উদযাপন? গত এক বছরে প্রায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সকালটা তেতো হয়েছে এক বা একাধিক ধর্ষণের খবরে। চার থেকে আশি - কেউ তো বাদ নেই 'ধর্ষিতা' পরিচয়ে শিরোনাম হতে। হিসেব বলছে নাকি এক দিল্লিতেই গড়ে দিনে পাঁচটা ধর্ষণের 'কেস' পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়। তাহলে 'কিন্তু-তবু-যদি-লোকে কী বলবে'র গেরোয় হাঁসফাঁস করা বাকি 'কেস'গুলোর খতিয়ান কেমন, ভাবুন তো! ধর্ষণ- শারীরিক নিগ্রহ আর ভারতীয় উপমহাদেশের যা বিয়ের কনসেপ্ট অর্থাৎ সম্পূর্ণ অচেনা (হালে অবিশ্যি ফোনে দু'দন্ড বাক্য বিনিময়ের পর বাপ-মায়ের দ্বারা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক এর একখান গালভরা নাম দেওয়া গেছে : 'অ্যারেন্জ্ঞড কাম লাভ ম্যারেজ', এক্কেরে আচ্ছেদিন মার্কা ব্যাপারস্যাপার আর কী। রাজা বলেছেন দিন এসছে, উহাকে তোমরা, নালায়ক প্রজাগণ, সোচ্চারে বল 'আচ্ছে দিন' এবং ভাব, ভাবা প্র্যাকটিস কর যে এর থেকে আচ্ছেদিন তুমি জীবনেও দেখনি, দেখবে ঠিক love হবে, লাভ এই লাভ তো এটাও সেরকমই একখান ব্যাপার) একজনের গলায় সোনা-দানা-খাট-পালঙ্ক (ইহাদের পণ বলে না, ইহারা হল গিয়ে 'আপনার মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবেন' এর কড়ি আঙুলে ফেলা ক্যারিকেচার)নিয়ে ঝুলে পড়ার পর শারীরিক-মানসিক ট্রমার রুটিনে এই একদিন আলতো শো-পিস পরানোর নামই কি উদযাপন?প্রথম মহিলা মহাকাশচারী, মহিলা রাষ্ট্রপতি, মহিলা পর্বতারোহী...এসব সাধারণ জ্ঞানের অসাধারণ মেয়েদের কথা তো সবার অল্পবিস্তর জানা অতএব অজানা কয়েকজন অতি সাধারণ মেয়ের কথাই না'হয় এখন বললাম ।
সালমা: পাশের পাড়ার মেয়ে। মাটির দালান, বেড়ার দরমা আর টালির ছাউনি দিয়ে ঘেরা দু'কামরার ঘর। একটিতে রান্না-খাওয়া-সংসারের জিনিসপত্তর রাখা আর অন্যটি তিন বাচ্চা-স্বামী নিয়ে শোবার ঘর। স্বামী ভ্যান চালায় বটে তবে তা নামেই। সারাদিন চায়ের দোকানে আড্ডা মারার পর ফুরসৎ পেলে পরে দু'-এক ট্রিপ মারে কিন্তু সেটাও ফিরতি পথে ভোঁ-ভাঁ, পৃথিবীটা গোল সূত্র প্রমাণের দায়ে মানে সেই চা আর বিড়ির চক্করে। চার বাড়ির কাজ সামলানো সালমাই কিন্তু সে ঘরের হোতা, তারই আয়ে বড় ছেলেমেয়ে দু'টোর স্কুল যাওয়ার সদগতি হয়েছে।
রোকেয়া: কোলে একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা, সাথে মায়ের কড়ি আঙুল ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বছর পাঁচেকের এক মেয়ে, চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক - খুব ছোটবেলায় এ দৃশ্য দেখেছিলাম, মনে পড়ে। কাজের খোঁজে এসেছিল আমাদের বাড়ি। বাড়ি ওখান থেকে অন্তত কিলোমিটার চল্লিশেক দূর। পরপর দু'বার মেয়ে হওয়ার 'অপরাধে' তাকে বর বাড়ী ছাড়া করেছে। বছর চারেক ছিল আমাদের কাছে। আশে পাশে আরও কয়েক বাড়ীর কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে। বেশ কিছু সময় পর নিজের একখানা ছোট্ট টালির ঘর বানিয়েছিল সাথে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সাকুল্যখানার জোগাড়পাতির ব্যবস্থাও।
সুলতানা: মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর পি.এইচ.ডির তোড়জোড় করতেই বাবা কাঁচুমাঁচু মুখে জানিয়েছিল আপত্তির কথা , "এরপর আর ছেলে পাব না তোর বিয়ের জন্য। মুসলমান ঘরে এমনিই যোগ্য পাত্রের অভাব, তার ওপর তুই আরও ডিগ্রি নিলে বিয়ে দেব কার সাথে? বি.এ পাশ কেউ তোকে ঘরে নিতে চাইবে?" বর্তমানে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ সুলতানা রিজিয়া সেদিন উত্তর দিতে পেরেছিল, শুধু বিয়ের জন্যই মেয়েকে লেখাপড়া শেখানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে শুরুতেই সে কাজের 'মধুরেণ সমাপয়েৎ' হতে পারত আর বিয়ে, দু'টো ডিগ্রি নয়, মানুষের মধ্যে হওয়া উচিৎ।
গত বছর আজকের দিনে অফিসে গিয়ে পাশের ওডিসিতে একটা অদ্ভুত (কিম্ভুতকিমাকার বললেও হয়) ঘটনার কথা জেনেছিলাম। এইচ.আর. থেকে কতগুলো মেয়ে দায়িত্ব নিয়ে মেকআপ এর সরঞ্জাম, নেলপলিশ, চুলে কারিকুরি করার গুচ্ছের জিনিসপত্তর নিয়ে মিলিটারি মার্চ( প্লিজ! মিলিটারি শুনেই ভরা মার্চে, মরচে, মরছে... এসব অজুহাতে খামোকা সিয়াচেন নিয়ে টানাটানি করবেন না, এই গরমে হেব্বি দুঃখু হয়) করতে করতে হাজির হয়েছিলেন, 'উইম্যানস ডে সেলিব্রেশন' এ। তেনাদিগের কথামতো, খেলা হবে: নারীবাহিনীর মধ্যে যে যত তাড়াতাড়ি ময়দা মেখে নখ রাঙিয়ে চুলটি বেঁধে হাসি হাসি মুখ করে 'প্রেজেন্ট প্লিজ' বলতে পারবেন, তিনিই হবেন হনু - 'সেলিব্রেটিং উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট উইথ ফর্টি আদার্স' এর ঝান্ডাধারী এবং কোনো উচ্চবাচ্য না করে ওডিসির সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলাবাহিনী কোমর দুলিয়ে চলেও এলেন এম(ফর মহিলা) এর ওপর পাওয়ার থুড়ি পাউডার থুপে 'সেলিব্রেশন' এ নিজেদেরকে ব্রেস করতে। এসব দিবসরজনী ঝাঁপকাহিনীতে তাই আরও বেশি মনে পড়ে সালমা, রোকেয়া, সুলতানাদের কথা, মনে পড়ে রেশমা-সুফিয়া-লতার কথাও যাদের মার খেতে হয় প্রতি পদে, কখনও পরিবারে, কখনও সমাজে, অদৃশ্য লড়াই আটকে থাকে জন্মপরিচয়ের মতন, না চাইলেও বয়ে বেড়ানোর মতন । সেলিব্রেশনের সেল্ফিতে মুখ ঢুকিয়ে 'মি'টু'র হ্যাশট্যাগে না মাতলেও যদি জাতীয় গণ্ডির গদি থেকে ধুলো ঝেড়ে মাথা তোলা 'আন্তর্জাতিক' তকমা রোজকার দিবসনামার গ্যারান্টি দেয় সাধারণ মেয়েদের রোজনামচায়, তবে সেই হোক আমার নারীদিবস, সালমা-রোকেয়া- সুলতানা প্রতিটা মেয়ের সাথে, কারণ তারাই যে নারী 'দি' বস।
h | unkwn.***.*** | ০৯ মার্চ ২০১৮ ০২:১১85035
h | unkwn.***.*** | ০৯ মার্চ ২০১৮ ০২:২৭85036
সুব্রত মণ্ডল | unkwn.***.*** | ০৯ মার্চ ২০১৮ ১১:০৭85033
de | unkwn.***.*** | ০৯ মার্চ ২০১৮ ১১:১২85034
জারিফা | unkwn.***.*** | ১২ মার্চ ২০১৮ ০৩:৫৪85037
অর্জুন অভিষেক | unkwn.***.*** | ১২ মার্চ ২০১৮ ০৮:০২85038
Du | unkwn.***.*** | ১২ মার্চ ২০১৮ ০৯:২৬85039
S | unkwn.***.*** | ১২ মার্চ ২০১৮ ১০:৪৯85040
দ | unkwn.***.*** | ১৩ মার্চ ২০১৮ ০৪:১৫85041
অর্জুন অভিষেক | unkwn.***.*** | ১৩ মার্চ ২০১৮ ০৬:২০85042
জারিফা | unkwn.***.*** | ১৩ মার্চ ২০১৮ ০৭:০২85043