আমি বারাসতের মেয়ে। তাই প্রতিবার কালীপুজো আসলেই, হপ্তা দুয়েক আগে থেকেই নিজেকে অঘোষিত সরাইখানার মালিক মনে হয়। চেনা জানা লোকজনের কান মাথা চেবাতে থাকি, বারাসতের গুণগান শুরু হয় বহাল তবিয়তে আর ন্যানোতোম উৎসাহে ভাঁটা না পড়া আমার 'আসুন-বসুন-এলাকা ঘুরুন' মোড অন।
ব্রহ্মযামল তন্ত্রমতে, দেবী কালী হলেন বাংলার অধিষ্ঠাত্রী। তবে বাংলার বাকি জায়গাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই অঞ্চলে কালীপুজোর এমন রমরমার আসল কারণ হিসেবে বরাবরই খিল্লি করি, 'বারাসত আদতে ডাকাতের জায়গা'।
বারাসতের প্রথম বিখ্যাত মন্দির হল করুনাময়ী কালীমন্দির। মোগল সম্রাট আকবরের রাজপুত সেনাপতি মানসিংহ বারাসাতের আমডাঙায় সূক্ষ্মাবতী নদীর তীরে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের প্রথম পুরোহিত ছিলেন, রামানন্দ গিরি গোস্বামী যাঁর নামানুসারে জায়গাটার নাম হয় 'রামডাঙা'। পরে অবশ্য রামডাঙা লোকমুখে চালু হয় 'আমডাঙা' নামে। তবে আমডাঙা-জাগুলিয়া পেরোলেই যে নদীয়া, সেখানকার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সৌজন্যে শুরু হওয়া কালীপুজো ধীরে ধীরে এই অঞ্চলেও প্রভাব বিস্তার করে। অবশ্য বাড়ি বাড়ি শক্তির আরাধ্যা কীভাবে ক্লাবথিমের মোড়কে পর্যুদস্ত; সে ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন পুজো রেজিমেন্ট ক্লাবের। কিছু ট্রাক ড্রাইভার মিলে ছোট্ট একটা ঘরে যে পুজোর শুরুয়াৎ করেছিল অনাড়ম্বর, মূলত দূরপাল্লার যাতায়াতে যেকোন অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে, সে অবশ্য এখন ব্যারাকপুর-কলোনী মোড় চত্বর, হরিতলা-বাজার ছাড়িয়ে চাঁপাডালিতেও হুড়মুড়িয়ে এসে পৌঁছেছে।
মনে আছে, ছোটবেলায়, এসব গল্প শুনতাম খুব উৎসাহ নিয়ে, কোনটা হয়ত লোকমুখে প্রচলিত, কোনটা হয়ত সত্যি। নিজের এলাকা যে এত পুরোনো, হঠাৎ হঠাৎ গল্প-উপন্যাসের বইয়ের পাতায় বারাসত নামটা দেখলে আলগা যে আনন্দ-জাফরি আঁকিবুঁকি কাটত মনে, এও যেন সে আহ্লাদী দোসর।
প্রাক-টিউশন পর্বে অবশ্য আমাদের, মানে আমি, আব্বু আর আম্মির দৌড় ছিল চাঁপাডালি অব্দি। পরে পরিধি বেড়ে হল বাজার; তবে লাইটিং দেখেই ফেরত আসতাম। পুজোর দিনের লম্বা ভিড় আর আমার গোঁড়া দাদুর 'কালীপুজোর ঠাকুর দেখা'র মত ঘোর না-পাক কাজ করার জবাবদিহির ভয়ে আব্বুর আর প্যান্ডেলে ঢোকার মত সাহস হয়নি কখনও। এরপরে এল আমার টিউশনকাল। কালীপুজোর দিন সব ক্লাসই ছুটি থাকত। অতএব পরের দিন থেকে ভাই-ফোঁটা অব্দি ফিরতি পথে চলত আমাদের টো-টো সফর। তবে সমস্যা হল, বারাসত আজও যে কারণে বি(?)খ্যাত, উন্নয়নের মত যেখানে সেখানে দাঁড়ানো মাতাল আর কন্যাশ্রী হারে উড়ে আসা ইভটিজিং, এসবের কল্যাণে মায়ের টেনশন এবং সে চক্করে রাতে প্যান্ডেল ঘোরা প্ল্যান ছিল এক্কেরে নট অ্যালাউড। অতএব আগে যা ছিল লাইটিং দেখা - প্যান্ডেল নয়, এখন ব্যাপারটা ঠেকল প্যান্ডেল দেখা - লাইটিং নয়। তবে কলেজে পদার্পণ হলে পরে আমার পুজো দেখার এমন কাটাকুটি খেলার প্রমোশন হয়; প্যান্ডেল-লাইটিং দু'টোরই দর্শন হয়, কিন্তু শো-টাইমের গন্ডি ছিল রাত ৯ টার ঘন্টা।
প্রথম কালীমূর্তি দেখার কথা বলতে মনে পড়ে, চাঁপাডালির বড় মা কালী মন্দিরের কথা। ওমন হাত-দশেক লম্বা মিশমিশে কালো রঙের মধ্যে টকটকে জবা রঙের এক হাত লম্বা জিভ, সত্যি বলতে কি মূর্তির বদলে সেটাকে ওই বয়সে স্ট্যাচু ভেবেছিলাম (তখন থেকেই স্ট্যাচুর ওপর আমার অকার্পণ্য পক্ষপাতিত্ব এবং বহুল দূরদর্শিতার জন্য সরকার তো আমাজে 'স্ট্যাচু অফ প্রুডেন্স' ও ঘোষণা করতে পারে;))। পরে দেখেছি নীল-কালো সবই দেবীর রং; যেভাবে এ উপমহাদেশে 'মেম' রঙের বাইরে সব মেয়ের গায়ের রংই কোনও না কোনও ভাবে কালো, সবাই কম বেশি সে সূত্রে 'কালী'। আজন্ম ফেয়ার এন্ড লাভলি না মাখা, আর জন্মের আগে থেকে মা হলুদ-দুধ না খাওয়াতেই যে আমার এ ঘোর দুর্ভাগ্য, সেসব শুনেই আমার বড় হওয়া। মা কালীকে হয়ত ঠিক এই কারণেই কখনও 'ভয়ঙ্কর' ভাবে গ্রহণ করতে পারিনি।
ছোট থেকে গান শিখতাম। একদিন মনে আছে, হারমোনিয়ামের আলাপী সুর, আমি গাইছি-
"শ্যামা মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন...।"
পরেরদিন মসজিদে আব্বুর তলব, ইমাম সাহেবের। একে তো 'মুসলমান' ঘরের মেয়ে, তার ওপর 'মেয়ে'দের গান 'শেরেক', এসব ছাপিয়েও আমি কিনা গেছি আরও এক কাঠি ওপরে, 'শ্যমাসঙ্গীত'এর বিষফোঁড়া! এলাকার সমস্ত 'নাম-ইজ্জত' তো এক নিমেষেই গুঁড়িয়ে যেতে যথেষ্ট।
আদতে পোড়া মানসিকতার দেশে 'কালী'রা বরাবরই অচ্ছুৎ। তাদের লুকিয়ে-বাঁচিয়ে রাখতে হয় যাতে বছরের একটা সময় 'কালো জগতের আলো' মার্কা বিপ্লবী ঝড় ওঠানো যায়। পুরাণ এবং ইতিহাস বাদ দিলেও, থিমের হুজুগে আদিখ্যেতা দেখানো পুজোকে একালেও খিল্লির অজুহাতে 'ডাকাত-ড্রাইভারের পুজো' বলার মধ্যে যে অস্পৃশ্য-উন্নাসিকতার শ্লেষ মিশে থাকে, তাহাই 'উন্নতি'র পরিচায়ক; সেই উন্নতি যাতে ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে একটি সাত-আট বছরের মুসলমান মাঝি-কন্যাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেছিলেন সাধক স্বামী বিবেকানন্দ, সেই উন্নতি যাতে একইদেশ ২০১৮ য় আমরা-ওরা-ফর্সা-কালো-সুজাত-বেজাতের গেরোয় হাঁসফাঁস।