
খুব ছোটবেলায় যখন দাদু-দিদা বেঁচে ছিল, আমরা ঈদে দেশের বাড়ি যেতাম। আমরা মানে আমি, আব্বু আর আম্মি। বেঁড়াচাপার পর বেশ খানিকটা গেলে যদুরহাটি বাসস্টপেজ, সেখান থেকে ভ্যানে চেপে ৭-৮ কিমি আর তারও পর ছোট্ট নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটে ৫ কিমি। সে রুগ্ন নদী ক্ষীণতোয়া, তাতে সব্জে বাতাসিয়া কচুরিপানা, ওপরে হাল্কা বেগুনি ফুলে বসা ফড়িং দেখতে দেখতে গুনতাম এক...দুই...তিন। ধান-পাট-লঙ্কার ক্ষেত পেরিয়ে ওইতো ধনে চারার সারি, কোথাও লাইনের হেরফের নেই যেন, ক'টা ধনের ক্ষেত এভাবে পাশ কাটালাম তারই হিসেব চলত বাড়ি ঢোকা অব্দি। কচি পাতার সুবাস, কখনও কাঁচা লঙ্কার ঝাঁঝে ঝিমঝিম আহ্লাদী মান্দাস যেন চাঁদরাতের প্রাক-কালীন সোহাগ আবহকাল। হাঁটতে হাঁটতে অপু কাকুর বাড়ি এলেই দৌড় লাগাতাম সোজা। সামনে মাঠ, লাগোয়া দাদুর করা প্রাইমারি স্কুল আর পেছনে কেয়ারি বাগানের ঝাড় পেরোলেই আমাদের বাড়ি। স্কুলের পেছন থেকে উঠোনের সদর দরজা অব্দি গাছগুলোকে বলতাম 'গেট গাছ'। গেট অব্দি বসানো তাই অমন নাম। বাবার করা শখের এই মনোহরী পথ পেছনে ফেললেই ঘিরে ধরত ছায়াটে আমড়া-সবেদা প্রলেপ।
এরপর উঠোনে পা রাখলে দিদা হৈ হৈ করে বাকিদের ডাকবে, চাচা, চাচি এসে বারান্দায় দাঁড়াবে, ভাই-বোনেরা সব হুড়মুড় করে ঘিরে ধরবে আর আকস্মিক এমন আতিথেয়তায় আমি পূর্ণচ্ছেদহীন দীর্ঘ বাক্যের মত স্থাণু হয়ে থাকব বেশ কিছুক্ষন।
ঈদ পরেরদিন কি তারও পরেরদিন তার অপেক্ষা শুরু হত আমাদের, ভাই-বোনেদের উঠোনের বাঁ পাশে পুরোনো গোয়ালঘরের ঠিক পাশটাতে থাকা বড় চৌবাচ্চায় স্টিম ভুটভুটি ছেড়ে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়াতাম আর প্রত্যেকের একবার করে টার্ন। ইফতার শেষ করে বড়রা মসজিদ থেকে ফিরছে কিনা সে অপেক্ষার মধ্যে এক একবার ভুটভুটির চক্কর ফুরিয়ে আসত। সন্ধের আলো তখন সিপিয়ারঙা হয়তো বা। ঈদ পরেরদিন হলে আমরা ছুট লাগাব মেহেন্দি গাছের পাতা তুলতে আর না'হলে সোজা দৌড় স্কুল মাঠের বলাই মুন্সির দোকানে। তখন দিদার কাছ থেকে পাওয়া মাথা পিছু পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে কে কত ভাল খাবার কিনতে পারে, চলত তার কম্পিটিশন। কেউ সবুজ বুট ভাজা, কেউ বাদাম, কেউ মদন (আমরা লালু-ভুলুর ভাজা চৌকোগুলোর নাম কোথা থেকে মদন শিখেছিলাম তা অবশ্য জানিনা) আর কেউ কিনতাম হলদে রঙের লম্বা লম্বা বেসন-ফোঁপর। প্যাকেট ছিঁড়েই সেই ফোঁপরগুলো টপাটপ আঙুলে বসিয়ে খাওয়ার যে তুরীয় আনন্দ, তাতেই ঈদের একদিন পেছানোর অভিমান অজ্ঞাতবাসে হারিয়ে যেত ধৈবত সমারোহে। বড়দা কখনও কখনও খাবার কিনত না আমাদের সাথে। বদলে টিপ বোম নিত। তারপর বন্দুকে পুরে এক এক করে ফাটানো...উৎসবের আর মাত্র একদিন।
শেষ রোজার দিন বাজারে ভিড় হত দেখার মতন। গ্রামের বাড়ির আশেপাশে কোন বাজার ছিলনা। আমার জন্য কিনে রাখা দাদুর দেওয়া জামা হয়তো সাইজে ছোট, কিংবা আমাকে পরিয়ে দেখে দাদুর পছন্দ হয়নি তখন, বদলাতে হবে। এদিকে বেঁড়াচাপায় বাজার, বাড়ি থেকে তা অন্তত কিলোমিটার পনেরো। বাইকে কিংবা সাইকেলে বসিয়ে টুহি ভাইয়া (মেজদা) নিয়ে যেত দোকানে। তারপর সেই ভিড় ঠেলে পছন্দ করা জামা নিয়ে দু'জনে মিলে বাড়ি, সাথে আমার জন্য একটা কমলা বরফ-আইসক্রিম।
মেহেন্দির তখন এই টিউবের চল ছিলনা।
বাড়ির পেছনে পুকুরের রাস্তার দিকে উঠোনে একটা মেহেন্দি গাছ ছিল। চাঁদরাতে আম্মি, চাচি, আরও পাড়ার সব চাচিমারা, আমার মিনি মহিলা দলের আচ্চা-বাচ্চারা মিলে গোল হয়ে বসে পড়তাম উঠোনে। বাচ্চা-বাহিনীর কাজ ছিল পাতা তোলা, নারকেলের মুচি, সুপুরি কুড়িয়ে আনা আর বড়রা শিল পাটায় সেগুলো বেটে দিলে আমরা তাতে আরেকটু চিনি-চা'পাতা মিশিয়ে বানাতাম নকশা যজ্ঞের টইটম্বুর উপকরণ।
ঈদের দিন প্রথম নতুন জামা পরে বড়দের সালাম করলেই ঈদি হিসেবে কার কত টাকা জমল, তার কাউন্টডাউন হত শুরু। সবার সাজগোজ শেষ হয়ে গেলে সব ভাই-বোনেরা বড় থেকে ছোট একদম হিসেবের স্বরলিপি মেনে হাত ধরাধরি করে বেরোতাম পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি। তারপর সেমাই-লাচ্ছার গুণিতক সেবা আর জমানো টাকা থেকে কিঞ্চিৎ খসিয়ে ঘুগনি-চানাচুর খাওয়া শেষ হলে দুপুরে বাড়ি ফিরে আসতাম মাংস-ভাতের লোভে। বিকেলে এবার আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া পালা, অতএব আবার মিষ্টি, ঈদি এবং কোলাকুলি।
একটু বড় হলে যখন দাদু-দিদা বেঁচে নেই, ভাই-বোনেদের সংখ্যাও যখন পড়াশোনা আর কাজের চক্করে রোগা তখন আমরাও শুরু করলাম বারাসতের বাড়িতে ঈদ করা। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ করত, সেই হট্টগোলের ভিড়টা কেমন গুটিগুটি সরে যাচ্ছে শেষদুপুরের পড়ন্ত সিঁদুরে রোদ মেখে...এটা ভাবলেই যে অনুযোগগুলো ধরা দিত গলার কাছে, ঈদের দিনে আরও বেশি করে বাবার দাদু-দিদাকে মনে পড়া ছেলেবেলার স্মৃতির সাথে দড়ি টানাটানিতে তারা শেষমেশ হার মানত মেঘ ছাড়া দূতের আবহে। তারপর ১৮ বছর এই বাড়িই আমার ঈদ-বন্দিশসাক্ষী। কিছু বছর আগে পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি ঘুরতাম কী কী মিষ্টির স্বাদ আলগা চাখা যায়, অজুহাতে-আলগোছে, তবে ঈদ যখন থেকে ধীরে ধীরে তল্পিতল্পা নিয়ে রেনেশাঁসের অলিভ পাতার মালায় সল্লু ভাইয়ের সিনেমা রিলিজ ডের দিনে নিজের পায়রার বাসা সুলভ মেকওভার করাল তবে থেকেই আমিও আস্তে আস্তে আমিও ঈদকে পেট-পুজোর খুপরিতে পুরে ফেলেছি। পেটপুজো বলতে বাড়িতে আগত বন্ধু-বান্ধব-স্বজনকে নামমাত্র ভাগ দিয়ে কী করে হালিম, সেমাই, ঘুগনির হাঁড়ি খালি করা যায় জাস্ট একদিনে...তার কম্পিটিশন চলে 'দ্য গ্রেট শোম্যান' আব্বুর সাথে। তিনিই আমার গুরু, কারণ দিব্যি মনে আছে, ক্লাস ফাইভে অ্যানুয়াল টার্মে ইতিহাস পরীক্ষার বইটা একটুও না ছুঁয়ে দেখার জন্য আম্মি যখন বেশ কয়েক ঘা পিঠে দিয়েছে, তখন চোখ মুখে ভৈরবের জল বইয়ে উত্তর দিয়েছিলাম - " দু'টো পেটের জন্য এত অত্যাচার সহ্য করা যায়না"।
গত বছরের পাশাপাশি এ বছরও ঈদ কাটিয়েছি মুর্শিদাবাদে। একটা একটা করে বছর আব্বুলিশ বলতে যখন ব্যস্ত, আড়ম্বরের কাছে সরলতা কোটোয় বন্দী বোকা-জীবন তখন রকমফেরের পরখ পেতেই ঈদ সে যাপনমুখী। এখানে হলে সলমন থাকে, গুজরাটে - কেরালায় কাজ করা আজিজুল- মোক্তার এরা থাকে সপ্তাহ খানেকের ছুটির আনন্দে। এখানে মাঠে সার্কাস বসে, বিকেলে চপ-রোল-চাউমিন-জিলিপি-বাদামের মেলা থাকে। ঈদগাহ সাজানোর রঙিন কাগজী বেলাভূমিতে মিতায়ু সুর্মা উদ্বেল থাকে আনন্দে - তিতিক্ষায়। এখানে লালবাগে প্রেম থাকে ফুরফুরে, ইতিহাস মেখে উথালপাতাল অধুনা থাকে বেমিশাল....।
আদতে তো একটাই দিন। সমস্ত কুশল সংবাদ, ভালবাসা, খুশি, মুহূর্ত সময় আগলে অহেতুক প্রশ্রয় দেওয়ার দিন...এমন গচ্ছিত মায়াদিন -
'তবু একবারও তুমি আজ কেঁপে উঠবে না!
ছেড়ে যেতে হবে যাব,
এতদিন তবু তো ছিলাম।'
প্রতিভা | unkwn.***.*** | ২৩ জুন ২০১৮ ০৮:৩২84331
মারিয়া | unkwn.***.*** | ২৪ জুন ২০১৮ ০৬:৪১84332
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ২৭ জুন ২০১৮ ০৪:১৪84333
Du | unkwn.***.*** | ২৭ জুন ২০১৮ ০৯:৫৯84334