১
‘আমাদের দেশে গরমকালটাই বেশ, জানেন বাবু। এই দ্যাকেন না, সাড়ে ছটা পার হয়ে গেল, একনো আকাশে আলো বাজতিচে। সু্য্যি ডুবে গ্যাচে ঠিকই, কিন্তু আলোর রং আর জুলুসে কেমন মাকামাকি হয়ে গিয়েচে আকাশখান। দিব্যি একখান বেনিয়ান গায়ে লদির ধারে হাওয়ার মজা লিচ্ছি আমরা। আর এ যদি হত শীতকাল? বাসরে – এতক্ষণ চারদিক আঁধার। লদির বুক থেকে গুঁড়ি মেরে উঠে আসত চাপ চাপ কুয়াশা। আর এদিকে মানুষগুলান কোতায় পিরেন, কোতায় চাদর, মাথা মুড়ো ঢেকে, কাঠের আগুন জ্বেলে জবুথবু – লদির ধারে বসার সাহস হত কারো? বলেন না, হতো’?
ধীরেন এভাবেই কথা বলে। ওর সব কথাতেই থাকে দর্শনের ছোঁয়া আর জীবনের অদ্ভূত আস্বাদ। এই চায়ের দোকানটা ধীরেনের আর আমি রোজই সন্ধের ঝোঁকে আসি, এখানে চা খেতে। নদীর পাথুরে কিনারায় একটা বেঞ্চি পেতে দেয় ধীরেন, কাঁচের গ্লাস ভরা ঘন দুধের চা খাই আর ওর কথা শুনি। নদীর আওয়াজ শুনি। বাঁদিকে খানিকটা নীচেয় আছে শ্মশান – সেখান থেকে মাঝে মধ্যে শ্মশানযাত্রীদের হরিধ্বনি - তাও শুনি। আর চিন্তার জাল বুনি। সব মিলিয়ে বেশ লাগে। ধীরেনের ভাষায় বললে, বলতে হয় “জেবনের রসে জ্যাবজ্যাবে”। ধীরেন এমনই সব কথা বলে আর সুন্দর হাসে। হাসলে তার চোখ ছোট হয়ে যায়, চোখের কোণের চামড়া কুঁচকে গিয়ে, চামড়ার ভাঁজ থেকে ঝরে পড়ে অভিজ্ঞতার রেণু।
ওর এই কথা, আন্তরিক হাসি ছাড়াও, ওর আছে এক অদ্ভূত মায়ার সম্পর্ক। ওর কাছে একটি মেয়ে থাকে, তার নাম ফুলি। বছর চোদ্দ বয়েস হবে বড় জোর। শামলা রংয়ের ডাগর চোখের মেয়ে। ছটফটে, চঞ্চল আর বাপের মতোই হাসিমুখি। বাপের সবকাজেই সে হাত লাগায় সমান তালে, আর আমি এসে দোকানে বসলে, যদি সে সময় খদ্দেরের চাপ কম থাকে, মেয়ে তার বাপকে আমার কাছে গল্প করার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। ফুলি জানে, ওর বাবা কথা বলতে ভালোবাসে আর আমার মতো ভালো শ্রোতা, তার আর কে আছে?
বাবা বললাম বটে। ধীরেন কিন্তু ফুলির জনক বাবা নয়। ফুলির বাবা হয়ে ওঠার পিছনে আছে এক অদ্ভূত ঘটনা। ধীরেনের মুখে সে বৃত্তান্ত শুনে যতটা অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম ধীরেনের প্রতি।
‘সেদিন সকাল থিকে টানা ঝড় আর বিষ্টি। মনে হতেচিল বাতাসের ঝাপটে এই বুঝি খুলে গেল মাথার ওপর এ দোকানের চাল। বাঁশের খাঁচায় বারবার মচ মচ শব্দ উঠতেছেল হাওয়ার দাপটে। দোকানে খদ্দের নেই – বিক্রিবাটা নেই সারাটা দিন, একটু বেলার দিকে বিষ্টির ঝাপটে নিভে গেল উনুনটাও – আর জ্বালি নাই। রাধামা্দবের ইচ্চে নয় যখন, তখন তোলাই থাক না আজ, আমার বিকিকিনি। আমার বুকের খাঁচাটাও বাবু, নড়বড় করে উঠেতেচেল সেদিন। এমন দিনেই বাবু, উথাল পাথাল করে মনটা। সঙ্গী নাই সাথি নাই, মনের কথা কইবার লোক নাই, কার সাথে দুটা কথা কয়ে মনটারে হাল্কা করব, কন দেকি? ওই বেঞ্চে বসে বসেই সারাটা দিন কেটে গেল। কেউ আসে না। মনের মানুষ না আসু্ক, একজন খদ্দেরও এদিক মাড়ায় নাই সেদিন। খদ্দেরও তো মানুষ, নাকি বলেন। তার সাথে মনের কথা না হোক, কিছু কথা তো কওয়া যায়। চুলার আগুন মরে গেচে, মনের আগুন তো নেভে না বাবু – সে তো জ্বলতেই থাকে। সেদিন বাবু আমি ক্রাসিনের ইস্টোভও রেডি রেকেচিলাম – যদি কেউ আসে তার জন্যি চা বানাবো বলে। কিন্তু কেউ এল না। আমার বিকল মনের পরীক্ষা লিতেই কিনা কে জানে, রাধামাদব সেদিন দিনটা্রেই করে দিলেন ছোট্ট। সন্ধ্যে হবার অনেক আগেই আঁধার ঘনিয়ে এল অসময়ে। আমি দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ঘরের ভেতর যেয়ে বসলাম। বাসরে, তাতে পকিতি আরো যেন রেগে উঠল। সে কি ঝড় তুফান, আর কি বিষ্টি। আমার দোকানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণীও নাই, কিন্তু টিনের চালে, টিনের দেওয়ালে সে কি দাপাদাপি – মনে হয় একশ’ মানুষ হামলে পড়ে ঝাঁকাচ্চে তারে – তাদের গায়ে খ্যাপা হাতির বল। মুখে তাদের বাক্যি নাই, শুধু গর্জন – কিসের আক্রোশ, সে তারাই জানে আর জানেন রাধামাদব।
রাত তখন কত কে জানে। ঘড়ি তো নাই। ক্রাসিনের স্টোভে ভাত চড়ায়েচেলাম, সঙ্গে দুটা আলু পটল। দেওয়ালের ফাঁক ফোকরে আসা হাওয়ায় সে ইস্টোভের আগুনও সেদিন নির্জীবের মতো ভিতু ভিতু। তবু ফুটতেচিল – চাল ফুটে ভাত হওয়ার সময় বাবু – হাঁড়িও খুব কথা কয়। লক্ষ্য করেচেন কি বাবু। সে অনেক কথা। খিদের কথা। তৃপ্তির কথা। ভালোবাসার কথা। খিদের মুখে দুটো অন্নর মতো ভালোবাসা জীবকে আর কে দেয়, কন তো বাবু? আমি বেশ বুঝতে পারি – ওদের কথা। ওদের ঘ্রাণ। আমি খাটিয়ায় বসে, একমনে তাদের কথা শুনতেচিলাম আর দেখতেচেলাম ইস্টোভে নীল আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা। মনের অন্দরে ছিলেন রাধামাদব আর তাঁর অনন্ত লীলা। বাইরে তখন অশৈলী তাণ্ডব আর ঘরে চলতিচে অন্নের যোগাড়, এ কি রাধামাদবের লীলা নয়, কি বলেন বাবু?
সেই সময়ে ঝাঁপ পড়া দরজায় আওয়াজ উঠল ঝমঝমিয়ে। প্রথমটায় বুজিনি বাবু ভেবেচেলাম ঝড়ের বাতাসে অমন হচ্চে। বেশ অনেকক্ষণ পর কান করে যেন শুনতে পেলাম এক মেয়েমানুষের গলা – কেউ আচো, খোল না – দোরটা খোলো না একটিবার। আর তার সঙ্গে ঝমঝম দরজা ঝাঁকানোর আওয়াজ। মনে হল ভুল শোনলাম। এই দুর্যোগের রাত্রে কে আমার এই দোকানে আসতে যাবে। ভয় হল। অশরীরি কেউ নয়তো – শুনেচি এমনি রাতেই তাঁদের আনাগোনা বাড়ে। আবার মনে হল তেনাদের কাছে আমার ওই পলকা দোর কিসেরই বা বাধা? তেনাদের ইচ্চে হলে, অমনিই তো আসতে পারেন। রাধামাদব শক্তি দিলেন, বিবেক দিলেন। দোরটা খুললাম। দামাল ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বিষ্টির ঝাপটার সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকে পড়ল একজন মেয়েমানুষ। এক ঝলক দেখার পর সব অন্ধকার – ঝোড়ো হাওয়ায় আমার ঘরে জ্বলতে থাকা কুপিটা তখন নিভে গেচে।
ঝাঁপ বন্ধ করে, দেশলাই খুঁজে আবার কুপিটা জ্বালালাম আর তার আলোয় দেখলাম সেই মেয়েরে। মাথা থেকে পা অব্দি ভিজে সপসপ করচে, পরনের কাপড় চুপ্পুরি ভেজা আর কাদামাখা। মাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্চে সেই মেয়ে – তার পায়ের তলার মাটি ভেসে যাচ্চে জলে আর রক্তে। মেয়েটি বাবু ভরা পোয়াতি। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ইস্টোভে জল চাপায়ে দিলাম। এই অসময়ে কার কাচে যাবো, এ অবস্থার মেয়েটারে নিয়েই বা এখন কি করব ভাবতেচেলাম, আর অপেক্ষা করতেচেলাম জল গরমের, ততক্ষণে শুনতে পেলাম বাবু কচি শিশুর কান্না। সেকি জোর বাবু তার গলার। বাইরের এত ঝড়ের গর্জন, বিষ্টির মাতন - সব ছাপিয়ে জেগে উঠল তার কান্না। এ নতুন জেবনের কান্না, তাকে আটকায় এমন সাধ্যি কার। কোনদিন, বাবু, সংসার ধর্ম করি নাই, রাধামাদবের নাম নিয়েই দিব্বি কাল কাটাইতেচেলাম, সেই আমার কাচেই কিনা এসে জুটল এমন ঝক্কি? এমন খেলা রাধামাদব ছাড়া, আর কেই বা খেলতে পারেন বলেন দিকি।
পেথমেই বাচ্চাটার নাড়ি কেটে মুক্ত করে দেলাম তার মায়ের বাঁধন। তারপর গরমজলে সাফসুতরো করে আমার পুরোনো ধুতির পুঁটলিতে জড়িয়ে ফেললাম তাকে। এতক্ষণ তার মাকে লক্ষ্য করি নাই, এখন মায়ের কোলে বাচ্চারে তুলে দিতে গিয়ে দেখি মায়ের অবস্থা সঙ্গীণ। বাচ্চারে কোলে নিতে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে্চিল একবার – কিন্তু পারল না। তার চোখের দৃষ্টি তখন থির, চোকের কোলে জমে উঠেচে জল, কিন্তু তার ফ্যাকাসে ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ বুজে এল বাবু, আর সে চোখ মেলল না।
আচ্ছা, রাধামাদবের এ কেমন লীলা আপনি আমারে বোজান দেকি। আমি কথা বলার জন্যি মানুষ খুঁজতেচিলাম, তা না হয় সত্যি, তাই বলে এমন মানুষ। চেনা নাই, জানা নাই। কোথায় বাড়ি, কাদের মেয়ে। না আমি জানি তার কিছু, না সে আমারে জানে। অথচ দেখেন, সে চলে গেল আমার হাতে এই টুকুন এক জেবন গচ্ছিত রেখে? আমার চাল নাই চুলা নাই, রাধামাদবের ইচ্চেয় আমার দিন চলে যায় কোনমতে, সেখানে একি বিপদ কন দিকি। আজ রাতটুকুন হয়তো কোন পেকারে চলে যাবে – কিন্তু কাল সকালে? লোক আচে, জন আচে, থানা আচে, পুলিশ আচে – তা্রা কি আমারে ছেড়ে দিবে? কি করব কিছুই যখন ভেবে কূল করতে পারতেচি না, আমার কোলের পুঁটলিতে ওই মেয়ে কথা কয়ে উঠল। কি কথা কে জানে – শিশুর ভাষা বোঝার সাধ্যি তো আমার নাই বাবু। আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম – দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আচে টালুক টালুক চোখে – সে দৃষ্টিতে কি যে ছেল বাবু, বলতে পারব নি। ভরসা ছেল। বিশ্বাস ছেল। সদ্যজাত শিশু আরেকজন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের সন্ধান করে? বাঁচার পেত্যয় ছাড়া? বড়ো মায়া হল বাবু, অর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, অরে আরো জোরে চেপে ধরলাম বুকে। অর ওই ছোট্ট বুকের ধুকধুকুনি আমার বুকে এসে বাজতে থাকল, বাবু। আমি রাধামাদবকে বললাম, এ আমার কি করলে ঠাকুর, আমারে এ কি মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিলে অচেনা অজানা কার এক শিশুর সঙ্গে?
দিনকতক বাবু এ ঘটনা নিয়ে খুব টানাপোড়েন, দৌড়ঝাঁপ, কথা চালাচালি চলল। আস্তে আস্তে একদিন থিতিয়ে গেল, মিটেও গেল সব। ও মেয়ে আমার কোলেই বড় হতে লাগল দিন কে দিন। আজ পর্যন্ত কেউ আসে নি বাবু, অর মায়ের কিংবা অর খোঁজ নিতে। ওর মায়ের কোতায় বাড়ি, কাদের মেয়ে, কাদের বউ – কিছুই জানা গেল নি বাবু। মাঝের থিকে আমার সঙ্গে জুড়ে গেল ওর নিবিড় সম্পর্ক। রাধামাদবের এ বিচিত্র লীলা নয়, কি বলেন, বাবু’?
ধীরেনের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি, কিন্তু সেদিন খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করেছিলাম মেয়েটিকে। সপ্রতিভ সুন্দর তার ব্যবহার। একা হাতেই দোকানের প্রায় সব কাজ সামলায়, আবার বাপেরও খেয়াল রাখে পুরোদস্তুর। তার চোখের আলোয় ধরা পড়ে তার পড়ে পাওয়া বাবার প্রতি, তার এই ছোট্ট দোকানদারি দুনিয়ার প্রতি, অসীম মায়া আর ভালোবাসা।
২
মাঝখানে চাকরি সূত্রে আমায় অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। প্রায় বছর পাঁচেক পরে আবার এই মফস্বল শহরে যেদিন ফিরে এলাম, দেখলাম অনেক পাল্টে গেছে জায়গাটা। সব জায়গাতেই নিজস্ব নিয়মে লোক সংখ্যা বাড়ে, উন্নতি হয় – যুগের হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তার সনাতন ভাবগতিক। সেটাই স্বাভাবিক।
ধীরেন আর তার মেয়ে ফুলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, এই শহরে ফিরে এসে আবার মনে পড়ল। কাজের অবসরে একদিন সন্ধ্যেবেলা সেই নদীর ধারে ধীরেনের দোকানে গেলাম। হদিসই পেলাম না সে দোকানের। অনেক দোকান আর ঝুপড়ি গজিয়ে উঠেছে আশে পাশে। তাদের চারপাঁচজনকে জিগ্যেস করলাম ধীরেনের কথা, তার মেয়ে ফুলির কথা। কেউই জানে না ওদের সম্পর্কে, শুধু একজন আমাকে খুব সন্দেহভরে জিগ্যেস করল, আমি কে? ধীরেনের খোঁজে আমার কি দরকার? আরো সাতপাঁচ অবান্তর প্রশ্ন। আমি নির্বিবাদি ভদ্রলোক, আমি বেশি দূর আর ঘাঁটালাম না, সরে এলাম সেখান থেকে। শ্মশানের কাছেও একবার গেলাম। সিমেন্টের বাঁধানো পরিচ্ছন্ন চাতাল, নদীর ঘাটে নামার জন্যে সুন্দর বাঁধানো সিঁড়ি। আর নীচে নামার পথের ডানদিকে গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট নতুন কালীমন্দির। এসবই নতুন হয়েছে, আর ধীরেনের দোকানটা এই খানেই কোথাও ছিল – প্রগতির ধাক্কায় সে দোকান আজ বিলুপ্ত। মনে রেখেই বা কি লাভ? তাই ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের কথা।
সামান্য ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়াতে সেদিন অফিসে বের হই নি, বাড়িতেই ছিলাম। শুয়েছিলাম আমার একলা বাসাবাড়ির বিছানায়। আধো ঘুমে আচ্ছন্ন আমার চেতনায় হঠাৎ যেন শুনলাম খুব চেনা কণ্ঠস্বর। ‘জয় গুরু। জয় রাধামাদবের জয়, কিচু ভিক্ষে পাই মা’। এ স্বর আর ওই বাচন ভঙ্গী আমার খুব চেনা – এ ধীরেন ছাড়া কেউ নয়। আমি বারান্দায় দৌড়ে গেলাম, নীচে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ধীরেনকে। জোড় হাতে খুব সংকুচিত ভঙ্গীতে দরজার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি ডাকলাম তাকে ‘ধীরেন, না’? সে মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। আমায় চিনতে পারল কিনা বুঝতে পারলাম না। বললাম,
‘ভেতরে এসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে’। আমি নেমে গেলাম, নীচের বসার ঘরে। ধীরেন এসে দাঁড়াল দরজায়।
‘দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। আমাকে চিনতে পারছ না’?
‘পারচি বাবু, চিনতে পারচি’।
‘তবে? ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছ কেন, তোমার দোকান কি হল? তোমার সেই মেয়ে ফুলি কি করছে? জান, তোমার দোকানের খোঁজে একদিন গিয়েছিলাম নদীর ধারে, কেউ বলতেই পারল না তোমার খবর’? আমার কৌতূহলে আর আগ্রহে ধীরেন হাসল। তার হাসি আর আগের মতো নেই, এ হাসিতে সেই আগেকার ধীরেনকে আর পেলাম না। এ হাসি ভীষণ করুণ আর কষ্টের হাসি।
ধীরেন বলল, ‘সে অনেক কথা, বাবু। যদি অনুমতি করেন, সন্ধ্যের পর এসে আপনারে শোনাতে পারি’।
‘আচ্ছা, তাই এসো’। আমিও এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম তার ভেঙে যাওয়া শরীরি ভাষা। যাবার সময় সে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কিচু দেবেন নি, বাবু’? সে ছিল এক দোকানের মালিক, সে দোকান যত ছোটই হোক না কেন। আজ তার এই হাত পেতে ভিক্ষে করার প্রবৃত্তিতে আমি একটু বিরক্তই হলাম, তবুও পার্স খুলে তার হাতে তুলে দিলাম একটা দশ টাকার নোট। উত্তরে সে বলল – ‘জয় রাধামাদবের জয়’।
৩
‘আমার সে দোকান দেকতে আপনি গেচলেন, বাবু? কেমন দেকলেন জায়গাটা? আমি অনেকদিন যাই না, ওদিকে। গেলে ওরা ধমকায়, চড় থাপ্পড় মারে। আর কেনই বা যাব বলেন তো, গেলেই তো সব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় সব কথা।
ভয় জিনিষটা বাবু মানুষকে কুরে কুরে খায়। ওপর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা একদম ফোঁপরা হয়ে যায়। সারাদিনে সব কাজই করবেন, কিন্তু মনের ভেতরটাতে সারাক্ষণ টিক টিক করতে থাকবে ভয়। খেয়ে শুয়ে আপনি শান্তি পাবেন নি। আমাদের সেই ভয়টাই ধরিয়ে দিয়েচেল কটা লোক। আমাদের দোকানে আসত। তাদের কুনজর পড়ল ফুলির পরে। পেথম পেথম আজে বাজে কথা বলত, আমরা গায়ে মাকতাম না। তারপর শুরু হল বাবু ওর হাত ধরে টানাটানি আর এমন সব কথা বার্তা, বাপ হয়ে সে কথা কানে তোলা যায় না। প্রতিবাদ করলাম একদিন, আমাকেও যাচ্ছেতাই বললে বাবু, বললে আমি ওর কিসের বাপ? বাপ মায়ের ঠিক নেই যে মেয়ের, সে মেয়েকে নিয়ে আমার এত পীরিত কিসের? এ পীরিত কিসের পীরিত - তারা যে ইঙ্গিত করল বাবু, সে আমি মুখে আনতে পারব নি। তারপর খুব হাসলে বাবু ওই লোকগুলো, হ্যা হ্যা করে – আমাদের ভয় পাওয়া মুখ দেখে। অপমানে আর লজ্জায় ঝলসে যাওয়া আমাদের মুখ দেখে, ওরা খুব হাসলে। দোকানে আরও অনেক লোক ছেল বাবু - কেউ চা খাচ্চিল, কেউ খাবার খাচ্চিল, তারা যেন কেউ শুনতেই পেল না, এমন ভাবে মুখ নামিয়ে রইল। সেই শুরু হল বাবু, আমাদের কোনরকমে বেঁচে থাকা – ভয়কে সঙ্গী করে টিকে থাকা।
দুর্যোগ কি শুধু পকিতি আনতে পারে, বাবু? মানুষও পারে। পকিতির চেয়েও সে দুর্যোগ অনেক নিষ্ঠুর। পকিতি আমাদের শুধু ধ্বংসই করতে পারে, মৃত্যু এনে দিতে পারে, কিন্তু চরম লজ্জা দেয় না কিংবা বীভৎস অপমানও করতে পারে না। মানুষ পারে। এই জন্যেই মানুষ অনেক বড়ো, পকিতির চেয়েও বড়ো। একদিন সেই দুর্যোগ, বাবু, এসেই গেল আমাদের ওপর।
হুলির দিনে মানুষজন বড় বেহিসেবী হয়ে যায়, রংযের নেশায়, মদের নেশায় – আরো নানান নেশায়। আমরা এমনিতেই ভয়ে খুব সিঁটিয়ে থাকতাম, সেদিন তাই সাততাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে আমরা ঢুকে পড়েচেলাম দোকানের ঘরে। বাপ মেয়েতে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে, শুয়েও পড়েচেলাম তাড়াতাড়ি। রাত কত হবে বাবু, জানি না, দোর ভেঙে ঢুকে পড়ল ওরা পাঁচজন। সকলেই নেশায় মত্ত। গায়ে তাদের অসম্ভব শক্তি। আমার ফুলিকে তুলে নে যাচ্চিল ওরা। আমি আটকাতে গেলাম, আমাকে খুব মারল – মেঝেয় ফেলে সে কি ভীষণ মার। পাল্টা মার দেবার শক্তি তো আমার নাই, সহ্য করার শক্তিই বা কতটুকু আমার? ওদের মার খেতে খেতে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
জ্ঞান যখন ফিরল, সব চুপচাপ - নিস্তব্ধ। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কি মনে হয়েচেল বাবু, জানেন? কিচুই যেন হয় নি, সব বুঝি দুঃস্বপ্ন। মানুষের মন কি আশ্চর্য, তাই না বাবু। মেঝেয় উঠে বসে, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম – নাঃ, স্বপ্ন তো নয়, সব কিছু তছনছ, এলোমেলো, ভেঙে চুরে সর্বনাশ। ফুলি কোথায়? এ কথা মনে হতেই আমার শরীলে শেতল স্রোত বয়ে গেল। মাথার ভেতরটা বেবাক শূণ্য। নিজের আড়ষ্ট শরীলের যন্ত্রণা ভুলে, উঠে দাঁড়ালাম। দোকানের একধারে দুটো বেঞ্চ জুড়ে এক করে রাখা - তার ওপরে শুয়ে আচে ফুলি। হাত পা ছড়িয়ে উদাসীন উলঙ্গ - আমার ফুলি মা শুয়ে আছে। কি বীভৎস সে দৃশ্য – একখান শাড়ি দিয়ে তারে ঢেকে দিলাম আর তুলে নিলাম বুকে – তকনো তার প্রাণ ছেল বাবু, আমার বুকের সঙ্গে তার বুকের ধুকধুক তকনো বাজতেচেল।
দোকানের ভাঙা ঝাঁপ সরিয়ে বের হলাম বাইরে। একখান ভ্যান চাই – ফুলিরে হাসপাতাল নে যেতে হবে। তকন শেষ রাত। আমার ডাকাডাকিতে বেরিয়ে আসতেচেল, কিন্তু আমাদের অবস্থা দেখে কেউ রাজি হচ্চিল না। সকলেই জানে কিনা, কে আর বিপদের মধ্যে জড়াতে চায় নিজেরে? অনেক কাকুতি মিনতির পর একজন রাজি হল – তার ভ্যানে যখন তুললাম ফুলিরে, আর কোন সাড়া পেলাম না ফুলির। আর এই প্রথম লক্ষ্য করলাম বাবু, ফুলির দুটো হাতই ভাঙা, ফুলির দুটো হাত যেন ফুলির নয় – এমত ঝুলছেল দুপাশে।
শেষ রাতের হাসপাতালে ঘুম থেকে উঠে এসে ডাক্তার, নার্স খুব বিরক্ত হয়ে চেক করল, ফুলিরে। তারপর খুব নিশ্চিন্তে তারা বলে দিলে ফুলি মারা গেচে – আর কিচু করার নেই। নিয়ম কানুন যা হবে, সকালের বড়ো ডাক্তাররা না এলে হবে না। বসেই রইলাম ফুলির মড়া শরীর কোলে আগলে। সকাল হল। ডাক্তারবাবুরা সব এলেন। তেনারা থানায় খবর দিলেন। পুলিশ এল। আমার বয়ান নিল। ওরা ফুলিরে নিয়ে গেল কাঁটা ছেঁড়া করে রিপোর্ট বানাতে – আরও বাকি ছিল, বাবু, আমার ফুলিরে কাটতে, ছিঁড়তে, ভাঙতে। সারা জেবনে এত টিপ ছাপ দিই নি বাবু – সেদিন আমার ফুলির মড়া শরীরটা ফিরে পেতে এত জায়গায় টিপ লাগাতে হল – বাস্ রে, দেশের আইন বাবু এত্ত কড়া? কোত্থাও একটু এদিক সেদিক হবার যেন জো নাই, বলেন? ওই শ্মশানেই বাবু আমার ফুলিরে দাহ করে দোকানে যখন ফিরলাম, সেও রাত প্রায় শেষ।
তারপর আর কি হবে বাবু, খুব কদিন থানায় হাজরি, দৌড়ঝাঁপ - টানাপোড়েন চলল। খদ্দেররাও তেমন আর দোকানমুখো হচ্ছিল না, সারাটাদিন বসে বসে অনর্থক চিন্তা করতাম আর আমি চমকে চমকে উলুকভুলুক তাকাতাম – মনে হত ফুলি যেন ডাকল, বলল – “বাবা, চারটে চায়ের দাম নাও”। দোকানে মন বসছেল না। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যে বেলা সেই চারজন আবার এল, খুব গালাগাল, ধমক আর সঙ্গে চড় থাপ্পড় দিয়ে শাসিয়ে গেল আমায়। সেই সন্ধ্যেতেই, বাবু আমি বের হয়ে পড়লাম, সামান্য কিছু টাকা পয়সা ছেল আর সঙ্গে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে। দোকান পড়ে রইল দোকানের মতো।
সরকারি রেল স্টেশনের একধারে থাকার জায়গা জুটে গেল। আর হাতের জমানো পয়সা শেষ হতে, শুরু করে দিলাম ভিক্ষে। এখন বেশ আচি বাবু। যেদিন পয়সা জোটে খাই, যেদিন জোটে না – সেদিন হরিমটর। কমাস আগে, একদিন হোটেলে বসে খাচ্চিলাম। টিভিতে খবর দেকতেচিলাম, শহরের বাবুরা রাস্তায় নেমে মোমবাতি জ্বালাইতেচেন, সক্কলের হাতে জ্বলচে মোমবাতি – কোন এক মেয়েকে অনেকে মিলে রেপ করেচে - তার প্রতিবাদে। আপনিও দেখেচেন নিশ্চয়ই – আপনি জ্বালাননি, বাবু? সেদিন থেকে আমিও আমার ভিক্ষের পয়সা থেকে দুটো তিনটে টাকা বাঁচিয়ে ফেলি, বাবু, আর ওই টাকায় আমিও রোজ একটা করে মোমবাতি কিনে জ্বালিয়ে রাখি শিয়রে। জ্বলন্ত শিখার দিকে তাকিয়ে থাকি – বেশ লাগে, একদম আমার ফুলির মতো, বাবু। একটু ভীতু আর অসহায় - হাল্কা বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে – দমকা বাতাসে নিভে যায়। কিন্তু আমার ফুলিরা যার ঘরে থাকে - সে ঘর ভরে তোলে স্নিগ্ধ আলোয়। আচ্ছা বাবু, আমার ফুলিরেও তো ওরা রেপই করেছেল, না’?
ধীরেন মাথা নীচু করে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। ধীরেনের মনে এখনও অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোন প্রশ্নেরই উত্তরের জন্যে আর ওর মাথাব্যথা নেই। আর সত্যি বলতে আমি কি উত্তর দেব? এতদিন এ সমস্ত কথা ও কাউকে বলতে পারে নি, মনের মধ্যে গুমরে মরছিল। আজ আমাকে বলে কিছুটা ভারমুক্ত হল। আমার কাছে কিচ্ছু প্রত্যাশা করে না ও। কারণ ও জানে - সাত চড়েও রা কাড়ার সাধ্য না থাকা নিখুঁত ভদ্রলোক আমি।
যে রাধামাধবের লীলা্রসে ধীরেন আগে মজে থাকত, তাঁর নাম আজ মাত্র একবারই শুনলাম ওর মুখে – সকালবেলায় ভিক্ষের উপকরণ হিসেবে। যেখানে রাধামা্ধবের ওপরই আর ওর ভরসা নেই, সেখানে আমার কি অধিকার আছে ওকে সান্ত্বনা দেবার! আমিও মাথা হেঁট করে বসে রইলাম চেয়ারে।
অনেকক্ষণ পর, ধীরেন উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘অনেক রাত হল, বাবু, আজ আমি চলি। তবে যাবার আগে বাবু একখান কথা কবো’?
‘বলো’। কাঁধের ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধীরেন একখানা মোমবাতি বের করল, বলল, ‘আপনার দেওয়া সকালের টাকা থেকে একখান মোমবাতি কিনেচিলাম বাবু, যদি জ্বালতে দেন, কে জানে, মেয়েটা হয়তো একটু শান্তি পাবে। ও আপনারেও খুব মান্যি করত, বাবু’।
ধীরেন বসার ঘরের টেবিলে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে রাখল, আর নিভিয়ে দিল ঘরের বিজলি আলো। তারপর ধীরেন অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আজ তবে আসি, বাবু’।
ও চলে যাবার পরও আমি একলা নির্বাক বসেই রইলাম বহুক্ষণ। আমার ঘরে তখন মোমবাতির স্নিগ্ধ আলো। এ আলো ধীরেনের প্রতিবাদের আলো।
--**--
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।