১
এ বাড়িতে আসা ইস্তক খুব খিদে পায় খগেনের। না খেতেপাওয়া সারা জীবনের সমস্ত খিদে যেন জমা হয়েছে তার উদরে। পুবের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার ঘুম ভেঙে যায় রোজ। আজও ভেঙেছিল। গাঁয়ে ঘরে সকালে উঠেই মুখ ধোয়ার তেমন কোন কারণ ছিল না। ধুতোও না। একে তো তার একটাও দাঁত নেই, তার ওপর কখন কী খাবার জুটবে তারও ঠিকানা ছিল না। মুখ ধুয়ে, চোখের পিচুটি মুছে তার আর কোন্ রাজ-কাজ ছিল, যে রোজ নিয়মিত মুখ ধোবে? এ বাড়িতে ওসব চলবে না। কড়া হুকুম। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে, ফিটফাট বাবুটি হয়ে বসে থাকতে হবে তবে না মিলবে খাবার!
গুঁড়ো মাজন বাঁহাতের তালুতে নিয়ে, লালায় ভেজানো ডানহাতের তর্জনিতে তুলে, সে এখন রোজ মাড়ি মালিশ করে। মিষ্টি স্বাদ আর সুন্দর গন্ধে ভরে ওঠে তার মুখ। অনেকক্ষণ, বেশ অনেকক্ষণ সে মুখের মধ্যে আঙুল পুরে বসে থাকে, পুব আকাশের দিকে চেয়ে। পুবের আকাশ আরো উজ্জ্বল হয়। পাকপাখালিরা বাসা থেকে বেরিয়ে, গাছের খোলা ডালে বসে শরীরের আড় ভাঙে। তাদের যতরকমের ডাক আছে সবগুলি ডেকেডুকে গলাটাও সাফ সুতরো করে নেয়। তারপর উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। তাদের দিকে তাকিয়ে খগেনের মনে করুণা হয়। ছিঃ কী অসভ্য ওরা! সভ্য সমাজে বাস করতে হলে, রোজ সকালে উঠে যে দাঁত মাজতে হয়, মুখ ধুতে হয়, চোখের পিচুটি সাফ করতে হয়, সেই সহবতটুকুও কি ওরা শেখে না, ওদের বাপ-মার থেকে? কিংবা ওদের ছেলেদের থেকে? যেমন খগেন শিখেছে তার উপযুক্ত ছেলের থেকে। শেখার কি কোন বয়েস আছে রে, পাগল? চিতার চড়ার আগেও তাই শিখতে হয়। শেখার ছাই শেষও নেই, ছাই হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
এই কাকভোরে বাড়ির লোক কেউ ওঠে না। তবু আড়চোখে ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে, মাজন গোলা লালা দু একবার ঢোঁক গিলে নেয়, খগেন। খেতে খারাপ নয় মোটেই, মুখ থেকে উদর পর্যন্ত মিষ্টি স্বাদ আর সুবাসে শরীরটা বেশ মজে ওঠে। তারপর অনেকটা সময় মুখের মধ্যে আঙুল নাড়াচাড়া করে, খগেন কুয়োতলায় যায়। দড়ি বাঁধা দুধ দোয়ার ছোট বালতিটা পাড় থেকে ঝপাং করে জলে ফেলে, দড়ির অন্য প্রান্তটা টানতে থাকে, লোহার আংটায় ঝোলানো পুলিতে আওয়াজ ওঠে কিঁচ, কিঁচ কিঁচ–-ছুঁচোর ডাকের মতো। দড়ির টানে, ভরা বালতির কিছুটা জল ছলাৎ ছলাৎ ফিরে যায় কুয়োর গর্তেই। আর এইসময়েই খগেন যে খগেন, সেও কিছুটা দার্শনিক হয়ে ওঠে। জলই জীবের জেবন, সে কথাটা খগেন জানে। আর জেবন যেমন অনেক কিছু দেবার জন্যে এগিয়ে এসেও, সবটা দেয় না। কিছুটা ফিরিয়ে রেখে দেয় নিজের জন্যে। কুয়ো থেকে দুলে দুলে উঠে আসা ওই বালতি ভরা জলের মতো, অনেকটা উঠে আসে ঠিকই কিন্তু বেশ কিছুটা সে ফিরিয়ে নেয় কুয়োর মধ্যে!
আঁজলা ভরে জল নিয়ে সে মুখ ধোয়, চোখ সাফ করে। ঘাড়ে কানের পেছনে জলো হাত ঘষে। তারপর প্রায় গলা অব্দি আঙুল চালিয়ে জিভ সাফ করে, গলা সাফ করে। চিৎকার করে ওঠে অ্যা অ্যা অ্যা অ্যা...হ্যা অ্যাক ...থুঃ। বিড়ির ধোঁয়া মাখা কালচে গয়ের তুলে বার বার ছুঁড়ে দেয় নর্দমায়। বড়ো আনন্দ পায় খগেন, শরীরের ভেতরের জমে থাকা যত কাচড়া-আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে, সে যেন ফিরে পাচ্ছে লতুন জেবন। আর ঠিক এই সময়েই তার কানে বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর। আজ বাদে কাল তার ছেলের বিয়ে!। সকাল থেকে পাড়া মাতায় করে, বক্সে সানাই বাজছে। হুঁ হুঁ, খগেনের ব্যাটার বে’। কাল রাত পোয়ালেই সে তার বেটার বউয়ের শ্বশুর... দেখলে হবে? খরচা আছে!
নিজের ঘরে গিয়ে হাতপামুখ মাথা মুছে, কাচা লুঙ্গি পরে, গায়ে দেয় সাদা ফটফটে বেনিয়ান। কে বলবে, আজকের এই খগেন এই সেদিনও খগা ছিল? বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে, খগেন মন দিয়ে শুনতে লাগল সানাইয়ের সুর। তার উদরেও বাজতে থাকে খিদের মুদারা। একটা লেড়ো দিয়ে এক গেলাস দুধ চা পেটে পড়লে, খিদেটা অনেকটা মেটে। নিজের জায়গায় হলে, খগেন টুকটুক করে বেরিয়ে পড়ত ইদ্রিশের চায়ের দোকানে। ইদ্রিশ মিয়া, কড়া লিকারে ঘন দুধ আর ভরপুর চিনিতে যা চা বানায় না, আঃ জিভের আড় ভেঙে মগজ অব্দি চানকে ওঠে। চাটা শেষ করে লালসুতোর একটা বিড়ি ধরালেই, ব্যস - শরীরে টগবগিয়ে জান ফিরে আসে। ইদ্রিশ মিয়া বলে, এক এক কাপ চায়ে এক কাপ রক্ত। তা সে চা রক্তই বটে, গতর টসটসে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এ পাড়ায় সে সুযোগ নেই। ছোট্ট মফস্বল শহরের এই পাড়ায় তার ছেলের খুব নামডাক। প্রথম দিনই তার ছেলে তাকে বলে দিয়েছিল, দেখ, যখন তখন আলফাল কোথাও ঢুকে পড়বে না। তোমার যা পেয়োজন আমাদের বলবে, পেয়ে যাবে। মনে রেখো, এখানে তোমার এই ব্যাটার একটা সুখ্যাত আছে, পাড়ার লোক মান্যিগণ্যি করে। তার বাপ হয়ে, তুমি আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, এ চলবে না। খগেন তার ছেলে মোহিতকে যেমন সমীহ করে, তেমনি ভয়ও পায়। ছেলের মতো ছেলে বটে একখান। গর্বে বুকের খাঁচাটা ফুলে ওঠে, সে খাঁচার পেরাণপাকিটা আনন্দে ঝটপট করে। গাঁয়ে ঘরে, খগেন আর তার ব্যাটা মোহিতকে কেউ পুঁছতো? কেউ ঘরে ডেকে এক কাপ চা খাইয়েছে, কোনদিন? আর এখানে? তার ব্যাটা মোহিত এখন মোহিতদা, আদর করে সবাই ডাকে মদ্দা। এক ডাকে সবাই চেনে। তার ভটভটির আওয়াজ কানে এলে, দুঁদে হাড়বজ্জাত লোকেরাও সমঝে সিধে হয়ে যায়। কুচুটে ধান্দাবাজ লোকেদের মুখেও তখন অমায়িক হাসি, হেহে হেহে, মদ্দা, খপর ভালো তো?
সাতসকালে খগেন সেদিন ঘরেই ছিল। ঘরের সামনে এসে ভটভটির আওয়াজটা থামতে সে বেশ ভয় পেয়েছিল। সক্কালসক্কাল তার কাছে কে আবার এল রে, বাবা? এই সব ভার ভারিক্কি আওয়াজ, গম্ভীর গণ্যিমান্যি কাজের লোকজন, তার কাছে কেউ এলে, খগেনের পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। বাহ্যে পায়। সে যখন দেখল, ভটভটি থামিয়ে একটা লোক, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে, তার ঘরের দিকেই আসছে, সে আর থাকতে পারল না। বাড়ির পিছন দিকে বাঁশঝাড়ের দিকে খগেন প্রায় দৌড়ে চলল। আর নাছোড় লোকটাও দৌড়ে এসে, শক্ত হাতে খপ করে ধরল তার হাতটা,
‘বলি চললে কোতায়?’
‘কোতাও যাইনি, আজ্ঞে। পেটে বড্ডো মোচড় মারল, তাই বাজ্জে যেতেছিলাম।’
‘আমায় চিনতি পারলে নি, বাবা? আমি মোহিত। তুমি সেই আজও একই রকম মেনিমুখোই রয়ে গেলে? বাইরের লোক দেকলেই হাগতে ছুটতেচো?’
‘হে হে হে হে, মোহিত? হঠাৎ কোতা থিকে এলি বাপ? চোখে ভালো ঠাওর করতে পারি না কী না? তাই চিনতে পারি না।’ মোহিত বাপের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলল,
‘বেশ বুড়ো হয়ে গেচো, দেখতিচি? একটাও দাঁত নাই, ফোগলা। চোখে কি ছানিও পড়েচে নাকি? এই কবচরে এত বুড়ো হয়ে গেলে কী করে?’ তার গলায় মায়া। পরিচয়ে এই লোকটা তার বাপ। ভিতু, দুব্বল, খুবই অসহায় টাইপ। সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি, কিছু অন্যায় হয়ে গেল। খগেনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মোহিত ঘরের দাওয়ায় বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বলল,
‘ঘর দোরের কী হাল করে রেকেচো? এই ঘরে কুকুর বেড়ালও থাকতে পারবেনি, একেনে মানুষ থাকে?’ মোহিতের সুন্দর জামা-প্যান্ট, জুতো, চুলের কায়দা। গলায় চিকচিকে চেন, হাতে ইস্টিলের বালা। এসব দেখে মুগ্ধ হতে থাকল খগেন। তার ওপরে মোহিতের গায়ের সুবাস? আহা। দাওয়ায় বসে বাবুদের ছেলের মতো দেখতে ওই লোকটা তার ব্যাটা, মোহিত? পেত্যয় হয় কই? খগেন ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল,
‘গলার ওটা কি সোনার?’
‘লয় তো কি, পেতলের? হা হা হা হা।’ মোহিতের দমফাটা হাসির আওয়াজেও খগেন বড়ো আনন্দ পেল। এমন হাসি সে জীবনে কোনদিন হাসতে পারেনি। খুকখুকে হালকা হাসি হাসতে গিয়েও তার বুকে হাঁফ ধরে, কাশি চলে আসে। আশেপাশের লোকজন কেউ কিছু মনে করল কী না! তার দিকে কেউ তাকিয়ে রয়েছে কী না! দশজনকে শুনিয়ে এমন হা হা হাসি তো সে চিন্তা করতেই পারে না। ছেলের প্রতি শ্রদ্ধায় আর সমীহে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বাপের এই দৃষ্টিটা মোহিত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল কিছুক্ষণ, তারপর হেসে জিগ্যেস করল,
‘কাজ কম্ম কিছু করচো? নাকি ফোপরদালালি করেই দিন কাটাচ্চো?’ লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল খগেন,
‘হে হে হে ওই আর কী? চলে যাচ্ছে কোনরকমে।’
‘বুজে গেচি। তোমার ঘরে কী মালপত্র আচে, তল্পিতল্পা বাঁধো। তা’পরে আমার সঙ্গে চলো।’
‘ক্যা্নে? কোতায় যাবো তোর সঙ্গে?’ খগেনের অবাক জিজ্ঞাসায়, মোহিত হেসে উত্তর দিল,
‘আমার বাড়ি যাবে। সামনের শনিবার আমার বে, সোমবার বৌভাত। ছেলের বাপ না গেলে বে’-বাড়ি মানাবে ক্যানে? তবে এ চেহারায় তোমার যাওয়া চলবে নি। মাথায় ফুলেল তেল মেকে, গায়ে সাবান মেকে পুকুরে দুটো ডুব মেরে এসো। ধুতি জামাও সঙ্গে এনেচি। চামড়ার চটিও আচে। বলি মোহিতের বাপ কী যে সে মানুষ বটে? এমন অখদ্দে চেহারা লিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালে হব্যে? ছেলের বউ শ্বশুর বলে মান্যি করবে ক্যানে?’
পুরো গম্পটি পড়তে হলে,ক্লিক করুন এই লিংকেঃ-
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।