'দেশপ্রেমী হবার সহজ উপায়', পাঁচ বছর আগে মোড়ক উন্মোচিত হওয়া আইটি সেল প্রণীত একটি ভরা মুখোশে ঢাকা মাগ্গিরবাজারে 'সেলিং লাইক হট কচুরিজ' মার্কা গাইড বুক। কোন এক্সট্রা খরচা নেই, সময়ের 'ফালতু' ইনভেস্টমেন্ট নেই...জরুরি বলতে ডিগ্রি-বেডিগ্রি-পেডিগ্রিসমূহ গোবর-মগজীদের 'হর হর মোদীদেব' বলে 'মিত্রোঁওওও' হুঙ্কারে 'রণক্ষেত্রে' অবতরণ ও গালিবিতরণ। যদিও তথাকথিত 'শিক্ষিত/বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন আঁতেল' জনগণ, যারা এতদিন কেন্দ্রে মধ্যপন্থা- পরিধিতে বামপন্থার চক্করে নিজেদের মধ্যে লালায়িত তীব্র 'আমরা-ওরা/মানুষ বনাম কাটার বাচ্চা/শুধুমাত্র দু'টি সন্তান হওয়া ভদ্র প্রজাতি ভার্সেস তিনটে বিয়ে-পনেরোটা বাচ্চা কালো জাম্বুবান বোরখায় চেপে কবুল-তালাক তিনবার বলতে বলতে চু-কিতকিত খেলা কুক্কুট প্রজাতির দু'পেয়ে ভার্সন/এপার বাংলা হিন্দুদের বাপের সম্পত্তি- আরবি নাম নিয়ে এখানে উড়ে এসে আবার বাঙালিয়ানা ছিঁড়ছে' কনফিউশনটি মুখ ফস্কে স্রেফ 'লোকে কী ভাববে'র চাপে আটকে রাখতেন, তাদের হয়েছে পোয়া-বারো। আর মুখোশ পরার ভয় নেই, তক্কে-তক্কে সত্যরূপ বেরিয়ে আসা সামলে রাস্তা-ঘাটে কথা বলার চাপ নেই ইনফ্যাক্ট এহেন উঁচুতলার নাকউঁচু ধ্বজাধারীদের বাড়ফট্টাই মারা নেটপ্যাক ভরা বাতেলা এখন পরম শিরোধার্য, চায়ের কাপে তুফান তোলা 'মন-কি-বাত'। এনারা দু'পেগ ঢেলে পাকোড়াটায় মিশমিশে কাঁচালঙ্কা ফ্লেভারটা পাক্কা তিনমিনিট দশ সেকেন্ড ম্যারিনেশন হবার ফল ঘোষণা করে আঙুল চাটতে চাটতে যে 'শাইনিং ইন্ডিয়া'র হুব্বা টানেন তা আদতে বর্ডারে সেনা মরছে টু মুসলমান খেদাও দেশ বাঁচাও রুটের স্ক্রিপ্টেড কচকচি, মধ্যিখানে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও জওয়ানদের 'শহিদ' ট্যাগিয়েই স্রেফ দায় তথ্যচিত্র শুটিংয়কালীন ব্যস্ত ছাপ্পান্ন-ইঞ্চির ছাতিতে রাখা যায় না সদলবলে ক্যামেরাম্যানের খিঁচিকসহযোগে কুম্ভমেলায় পা-ধোয়াধুয়ি কেসে মহান সাজা যায়...সেসব অবশ্যি জিপিএসের 'অ্যাড স্টপেজ' জিরোনো টাইমপাস। এখানে ফিসফাস চলে তবে গলা তোলা বারণ। যাবতীয় প্রশ্ন যা মোদীবিরোধী তাই দেশবিরোধী...এই সহজ ইকুয়েশনটুকু না বুঝলে সিঁড়িভাঙা অব্দি পৌঁছবেন কীভাবে!
অতএব কী বোঝা গেল প্রশ্ন = দ্বেষপ্রেমী এবং হেঁ হেঁ = দেশপ্রেমী।
এর মধ্যে আরবি নামধারী হলে ডাবল মুশকিল। এই যেমন ধরুন, সে সারাবছর বাংলায় লেখে বলে বাংলাদেশি নাকি বাকিদের মতন পাবজি খেলতে খেলতে কর্নেলবাবুর কথায় কাশ্মীরি শাল বয়কটের মেসেজ ফরোয়ার্ড না করেই কাশ্মীরি আলুরদম খেয়েছে বলে বিনা টিকিটের পাকিস্তানযাত্রী; সেই নিয়ে এইসব সময়ে বড্ড আতান্তরে পড়তে হয়। তাই এমন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর একটাই উপায়-সবক শেখাও। এযাবৎকাল যত ফ্রাস্ট্রেশন, নিজেদের অকর্মণ্যতা, অঢেল সময়, বীরত্ব যা আছে উজাড় করে হাজির হও 'মোল্লা' বাড়ির চাতালে আর তারপর "দ্যাখাচ্ছি শালা, কত ধানে কত চাল! দু'টো থাকার জায়গা দিয়েছি (গোটা দেশ নিজের বাপের সম্পত্তি যখন) তাতে কোথায় চুপচাপ পা চেটে কৃতার্থ হবে তা না বড় বড় কথা, আরবের না'হয় তেল আছে তাই আমাগো দ্যাবতা দাঁত খিঁচিয়ে তার গাল টেপে তোর বাল আছেটা কী আবার বাকস্বাধীনতা মারাচ্ছিস!" অবশ্য এসবক্ষেত্রে 'মোল্লা' শুধুমাত্র আরবি নামধারীই নয়, বাম-মধ্য-'শখের আঁতেল সাজা' ছুপা ডান যে কেউ প্রশ্ন করা পাব্লিকই 'মুসলমান দরদী মোল্লা' দাগানো 'আরবান নকশাল'।
ক্ষমতায় সোস্যালিস্ট এর বদলে ক্যাপিটালিস্ট প্লাস উদাত্ত চরমপন্থী মানসিকতা জায়েজ থাকার সুবিধা হল এই যে আপামর 'সাধারণ লোক'কেও রেখে-ঢেকে দেখনদারির ঠমকে 'শিক্ষিত' ট্যাগের আড়ালে গুছিয়ে-বিছিয়ে কথা বলতে হয়না আর। দুনিয়া আদতে সংখ্যাগুরুর আস্ফালনের ক্রীড়াঙ্গন, তা সে ধর্ম-ভাষা-জাতি-বর্ণ... যে কাঠামোতেই বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হোকনা কেন। সমস্ত ক্যাটাগরিকে একেকটা সেটের গোল্লায় ফেললে দিনের শেষে সেই সবচেয়ে সিকিওর্ড, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যায়, যে সমস্ত সেটের ইন্টারসেকশনের গণ্ডিটুকুতে আরামসে বন্দী। বাকিদের মধ্যে কোথাও না কোথাও ধুকপুক। হরিণের যেমন বাঘের ভয়, মাছের ভয় মাছরাঙার...মানুষ উন্নত প্রাণী; 'সামাজিক জীব' এর মোড়কে তাই মানুষের ভয় অন্য মানুষে...।
সবশেষে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে বক্তব্যটুকুই তুলে ধরি, সারসংক্ষেপ হিসেবে,"কিছু স্বার্থান্বেষী লোক, চিরকালই যারা সংখ্যায় কম, তারাই পৃথিবীর শান্ত বাতাবরণকে চঞ্চল করে তোলে। এখানে যুদ্ধ, ওখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে বসে থাকে। জোর করে বিশাল সংখ্যক মানুষের ঘরে চাপিয়ে দেওয়া হয় ভয়, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। জঙ্গী শাসকরা পছন্দ করেন যুদ্ধ। নিজের দেশকে সবসময় যুদ্ধে লিপ্ত রেখে দেশের সাধারণ মানুষের নানা অভাব-অভিযোগ ধামা চাপা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দিতে ধর্মান্ধ মানুষদের কাজে লাগলেন। একই সঙ্গে শুরু হল সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও শোষণ। আমদানি করা হল বিদেশি টেরোরিজম। রাজনীতির বৃত্ত ছেড়ে পালাতে লাগলেন ভদ্রলোক। নির্বাচন হয়ে দাঁড়াল প্রহসন...সীমান্ত হয়ে উঠল অশান্ত।সংবিধান রইল, সাংবিধানিক অপরাধীদের কোনও সাজা দেবার ব্যবস্থা রইল না।রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল খুনের নীতি।"