এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চলে গেলেন অরণ্যের জীবন্ত বিশ্বকোষ তুলসী গৌড়া 

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২১৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • চলে গেলেন অরণ্যের জীবন্ত বিশ্বকোষ তুলসী গৌড়া

    কিংবদন্তি শ্রীমতী তুলসী গৌড়া - অরণ্যের জীবন্ত বিশ্বকোষ বার্ধক্য জনিত অসুস্থতার কারণে প্রয়াত হলেন ৮৬ বছর বয়সে। এইতো মাত্র সেদিনের কথা। ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কৃতীদের বার্ষিক রাষ্ট্রীয় পদ্ম পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। ঘোষক ঘোষণা করলেন পদ্মশ্রী তুলসী গৌড়ার নাম। দরবার হলে উপস্থিত নামীদামী অতিথি অভ্যাগতদের পোষাকের খসখসানি, ফিসফিসিয়ে কথা বলাকে এক লহমায় থামিয়ে দিয়ে নগ্নপদে দৃঢ় অথচ বিনম্র পদক্ষেপে প্রথাগত হালাক্কি উপজাতীয় রমণীর শালীন পোশাকে রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক অসাধারণ মানুষী – তুলসী গৌড়া দেবী। দরবার হল তখন মুখরিত হয়ে ওঠে অতিথি অভ্যাগতদের সম্মিলিত করতালির শব্দে। পরেরদিন দৈনিক সংবাদপত্রে তাঁর ছবি সহ প্রতিবেদনের শিরোনামে লেখা হলো “দরবার হলে হাজির প্রকৃত ভারতবর্ষের প্রতিমূর্তি তুলসী গৌড়া– অরণ্যের জীবন্ত বিশ্বকোষ।”

    ঘটা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে একদিনের জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন নয়, বনবালা তুলসীর কাছে বৃক্ষরোপণ ছিল এক নিত্যদিনের অভ্যাস, বেঁচে থাকার এক আনন্দময় উৎসব। তুলসীর জন্ম ১৯৩৮ সালে, অরণ্যময় কর্ণাটক রাজ্যের উত্তর কন্নড় জেলার এক স্থানীয় হতদরিদ্র হালাক্কি উপজাতীয় পরিবারে। বাবা নারায়ণা এবং মা নীলি। দিনে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা, তাই পাঠশালার পথে পা বাড়ানোর সুযোগ আর পাননি। কিন্তু তাতে কি! চারপাশে ঘিরে থাকা গহন বনপথে চলতে চলতেই তুলসী একদিন জেনে শিখে বুঝে নিলেন গাছগাছালির পরিচয়, তাদের সমবেত অবস্থানের অপার সৌন্দর্য আর উপযোগিতার আশ্চর্য আখ্যান।

    অবশ্য একাজে তাঁকে প্রাণিত করেছেন তাঁর মা নীলি দেবী। মা কাজ করতেন বনবিভাগ পরিচালিত স্থানীয় সরকারি নার্সারিতে। সকালেই তাঁকে কাজে বেরিয়ে যেতে হতো। মেয়েকে একলা কোথায় রেখে যাবেন? তাই তুলসীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। মায়ের সঙ্গে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে বনের গাছপালা, লতা গুল্ম, ভেষজগুণ সম্পন্ন গাছগাছালির সাথে এক নিগূঢ় সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয় তাঁর। আমৃত্যু সেই বন্ধনেই বাঁধা পড়েছিলেন তুলসী গৌড়া দেবী। মায়ের হাতেই বনের পাঠ পড়ার হাতেখড়ি। প্রায় সাত দশক ধরে সেই পাঠেই নিজেকে নিবদ্ধ রেখে গেলেন তিনি। আমার পড়া শেষ বা আমার কোর্স খতম বলে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য‌ করার কথা ভাবেননি কখনও, বরং অতি পরিচিত, প্রতিদিনের জানার মধ্যেও তিনি অজানার সন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন। উত্তর কানাড়া জেলার সুবিস্তির্ণ বনভূমির বৃক্ষ পরিচিতি ছিল তাঁর নখদর্পণে। একাজে একেবারে মজে ছিলেন। তাই কোনো অপূর্ণতা তাঁকে কখনও স্পর্শ করেনি। আর হয়তো সেই জন্যই জানার পথের একাকী পথচারিণী হয়েই তাঁর একান্ত ব্রত সাধনা। একা হাতেই প্রায় সামলে নিয়েছিলেন একটা গোটা বনমহলের ভালোমন্দের সব কিছু।

    মায়ের মৃত্যুর পর বনদফতরেই অস্থায়ী বন সহায়িকার কাজে যোগদান করেন তুলসী দেবী। আসলে বন সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে হাতছাড়া করতে চায়নি সরকারের বনবিভাগ। কেতাবি শিক্ষা ছাড়াই তিনি হয়ে ওঠেন “উদ্ভিদবিজ্ঞানের জীবন্ত বিশ্বকোষ / The Living Encyclopaedia.” । দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিক ভালোবাসায় পরিবেশ পরিমন্ডলের সেবা করে গেলেন কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা না করেই। যখন তুলসীর বয়স মাত্র দুই তখন তিনি তাঁর বাবাকে হারান। সেই থেকেই মায়ে ঝিয়ের লড়াই শুরু। পরবর্তীতে পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে একাই লড়াই করে গেলেন কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ না করেই। বনের যে কোনো গাছের মাতৃ প্রজাতির শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে তুলসী দেবীর ছিল প্রশ্নাতীত দক্ষতা। অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই মাতৃ বৃক্ষের ভূমিকা অনন্য। এদের রক্ষণাবেক্ষণ করার ওপর‌ই নির্ভর করে অরণ্যের অস্তিত্ব,সবার সাথে এক হয়ে টিকে থাকার রসায়ন। তুলসী দেবী নিজের এই ভালোবাসা, জ্ঞান অকৃপণভাবে ভাগ করে নিয়েছেন সবার সঙ্গে। নিজে শিখেছেন, শিখিয়েছেন অন্যদের যাতে অরণ্য অনন্য হয়ে উঠতে পারে সবার জন্য।
    হালাক্কি জনগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন, “বনদেবী, অরণ্যের জননী, কাদিনা দেবাতে।” সেই দেবী হয়েই রয়ে যাবেন তিনি অগণিত মানুষের কাছে।

    তুলসী গৌড়াদের মৃত্যু নেই। কারণ তুলসী গৌড়াতো কেবল একজন দেহাতি মানবী নন, তুলসী গৌড়া হলো এক ধারণার নাম, এক বিশ্বাসের নাম, এক সুগভীর ভালোবাসার নাম, এক নিরলস কর্মময় জীবনের নাম। সবার হৃদয়ে লেখা এ নাম রয়ে যাবে।

    ভালো থাকবেন তুলসী, ভালো থাকবেন। প্রণাম।

    ঋণ স্বীকার

    সদ্য প্রয়াত তুলসী গৌড়া কে নিয়ে গুরুর পাতায় আগেও লিখেছি আরও চার কন্যার সঙ্গে পঞ্চ কন্যা কথা শীর্ষক নিবন্ধে। আজ হঠাৎ করে তাঁর প্রয়াণ সংবাদ শুনে গভীরভাবে মর্মাহত হলাম। এই নিবন্ধের প্রায় সমস্ত তথ্য আমার পূর্বের লেখা থেকেই সংগৃহীত। ছবি জুড়ে দেবার কাজটি বেশ জটিল হয়ে পড়ায় একটি ভিডিও ফুটেজ যুক্ত করেছি। উৎসের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

    পাঠকদের কাছে অনুরোধ নিবন্ধটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার। তুলসী দেবীর প্রতি এটাই হবে সেরা শ্রদ্ধাঞ্জলি।

    এখানে ক্লিক করুন

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শর্মিষ্ঠা লাহিড়ী। | 2405:201:8016:6b:ec03:1a65:fd37:***:*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৪৫540188
  • চলে গেলেন তিনি যথেষ্ট পরিনত বয়সেই। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্তির দৌলতেই তার নাম ও কর্মকান্ডের সাথে পরিচয় হয়েছিল।আজ তার চলে  যাওয়ার   পরে  পড়ে র ইলো    সুবিশাল বনরাজি যারা  এই মায়ের স্নেহ স্পর্শের অভাব বোধ করবে। এই মহীয়সী নারী কে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
  • #:+ | 2405:201:8000:b11b:6178:23fc:4c2c:***:*** | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:১৮540192
  • She was truly the Banadebi.Salute to her.
  • সৌমেন রায় | 202.142.***.*** | ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:১১540193
  • প্রণাম জানাই বনদেবীকে।প্রণাম জানালেই অবশ্য কাজ শেষ হয় না।কিছু কাজ সবার করা উচিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন