লেখক অষ্টম অধ্যায়ে বিদ্যাসাগরের দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছিল তা নিয়ে মূল্যবান তথা তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। প্রথমে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন যে ঠিক কী কারণে তিনি এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং পরে বিচার করেছেন যে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন।[1]
এই অধ্যায়ে লেখক তুলনামূলক আলোচনা করেছেন চারটি সমান্তরাল মডেলের — টোমাসনের হলকাবন্দি মডেল, হার্ডিঞ্জের মডেল, জেমস লং-এর মডেল এবং বিদ্যাসাগরের নর্মাল ও মডেল স্কুল প্রজেক্ট। এবং শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে টোমাসনের (অ্যাডাম সমর্থিত) হলকাবন্দি মডেল, যার প্রয়োগ উত্তর ভারতে হয়েছিল, ছাত্রভর্তি কোয়ালিটি এবং ব্যয় সঙ্কোচের দিক থেকে সবচেয়ে সফল মডেল এবং বিদ্যাসাগরের মডেলটি সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য এবং ব্যর্থ মডেল। এর একমাত্র সাফল্য বিদ্যাসাগরের নিজের লেখা ১৮টি বই পাঠক্রমে ঢুকিয়ে পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসাটির লাভ বাড়িয়ে তোলায়। আমরা এক এক করে এগুলো খুঁটিয়ে দেখব।
লেখক বলছেন, ‘এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে থাকে, সরকারি শিক্ষার আঙিনা থেকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে পাঠশালার পড়ুয়ারা ক্রমেই প্রান্তিক হতে শুরু করে। প্রধানত চাকরি পাওয়ার সুবিধার্থে বিত্তবান মানুষেরা সেই শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে’। [2] (মোটা হরফ আমার)।
শেষ লাইনটি যথাযথ; এব্যাপারে হিন্দু কলেজে বাংলা শিক্ষায় অবহেলা নিয়ে রাজনারায়ণ বসুর সাক্ষ্যটিও তাই বলছে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য আজকের স্বাধীন হওয়ার প্রায় পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত ভারতেও সমান ভাবে বর্তমান। কিন্তু প্রথম বাক্যটিতে কতখানি বাস্তবের প্রতিফলন হয়েছে?
শিবনাথ শাস্ত্রী বলছেন, “একদিকে ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের সাহায্যে পরোক্ষভাবে দেশে বাঙ্গালা ভাষার চর্চা চলিতে লাগিল এবং সেই সঙ্গে বাঙ্গালা শিক্ষার জন্য পাঠশালা স্থাপিত হইতে লাগিল”। অবশ্যই শিবনাথ লেখকের বক্তব্যের শেষভাগকে সমর্থন করে জানাচ্ছেন যে “কলিকাতা সহরের সম্ভ্রান্ত গৃহস্থদিগের মধ্যে নিজ সন্তানদিগকে ইংরাজি শিক্ষা দিবার প্রবৃত্তি প্রবল হইতে লাগিল”।[3]
আগের অধ্যায়েও এই কথাটি বলার চেষ্টা করেছি — কোম্পানি আমলে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা ও প্রসার প্রধানত কলকাতার উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমিত ছিল। কিন্তু ইংরেজের ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের সাহায্যে ‘দেশে বাঙ্গালা ভাষার চর্চা’ এবং ‘বাঙ্গালা শিক্ষার জন্য পাঠশালা' স্থাপন? তাহলে বিশাল গ্রামীণ সমাজ ও পাঠশালার স্ট্রাকচার যা কিনা প্রাচীন সময়েও রাজানুগ্রহের অপেক্ষায় থাকত না, আজ কীভাবে ‘প্রান্তিক’ হয়ে পড়ল? এখানে লেখকের দেয়া সাক্ষ্য লেখকের প্রেমিসের বিরুদ্ধে যাচ্ছে না কি? দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির সরকার এদেশে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারে আগ্রহী। এই প্রেমিসটি না মানলে সরকারি পয়সায় ভার্নাকুলার মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারে টোমাসন, হার্ডিঞ্জ মডেল এবং বিদ্যাসাগর মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়ে ।
উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের গভর্নর টোমাসনের মডেল - প্রত্যেক তহশিলে একটি করে মডেল স্কুল হবে যা চারদিকের দেশি পাঠশালাগুলোর আদর্শ হবে। পাঠশালার শিক্ষকেরা এর থেকে উন্নত শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করবেন। হিন্দি ও উর্দু শিক্ষার বাহন হবে। তদারকির জন্যে জেলা পরিদর্শক, তাঁর অধীনে দুটো তহশিলের জন্য একজন পরগনা পরিদর্শক এবং তাঁর অধীনে শিক্ষকেরা। খরচ - ১ জন জেলা পরিদর্শক, ৩ জন পরগনা পরিদর্শক ও ৬ জন শিক্ষকের জন্যে মোট বার্ষিক খরচ ৪৫০০ টাকা। বর্তমান উত্তর প্রদেশের আটটি জেলায় এই ব্যবস্থা চালু হল — নাম দেয়া হোল 'হলকাবন্দি বিদ্যালয়'।
টোমাসনের স্কুলগুলি পরিদর্শন করে ১৮৫৩ সালের ৪ঠা জুন শিক্ষা সংসদের সম্পাদক ডঃ মোয়াট তাঁর রিপোর্টে বাংলা ও বিহারে এই শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের সওয়াল করেন।[4]
বড়লাট লর্ড ডালহৌসি ২৫ অক্টোবর, ১৮৫৩ তারিখে কোর্ট অফ ডিরেক্টরদের জানালেন যে বাংলা এবং বিহারে টোমাসন প্রণালী প্রবর্তন করা উচিত। সংসদ সদস্য হ্যালিডে’র উৎসাহে বিদ্যাসাগর ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪ তারিখে ১৯টি অনুচ্ছেদ সংবলিত একটি শিক্ষাপরিকল্পনা পেশ করেন।
সে বছর ৯ সেপ্টেম্বর মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংসদ সরকারকে যত রিপোর্ট পাঠিয়েছিল তাতে অ্যাডাম ও বিদ্যাসাগরের রিপোর্ট সবই ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে কোম্পানির সনদের নবীকরণ হয়ে বাংলা ভারতের প্রদেশ হয়ে গেছে এবং ১ মে, ১৯৫৪ সালে বাংলার প্রথম ছোটলাট হয়েছেন হ্যালিডে। তিনি বিদ্যাসাগর রচিত প্রস্তাবটিকে সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচনা করে কেবল সেই প্রস্তাবটিই ১৬ নভেম্বরে বড়লাটকে পাঠালেন যার ৫ম ও ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মডেলের প্রশংসা করে লেখেন, “সকলেই জানেন, বাংলা শিক্ষার প্রচারকার্যে বিদ্যাসাগর বহুদিন থেকেই বিশেষ উৎসাহী। সংস্কৃত কলেজে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং বিদ্যালয়ের পাঠোপযোগী অনেক পাঠ্যবই রচনা করে তিনি এক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করেছেন"’।[5] (বড় হরফ আমার)।
আমার দুটো প্রশ্ন:
১) এখানে কি হ্যালিডে তাঁর অধিকারের সীমা অতিক্রম করে কিছু করেছেন? আমার মনে হয় না। ‘ডিস্ক্রিশনারি পাওয়ার’-এর প্রয়োগ মানেই নিজের বোধবুদ্ধি অনুসারে কোন একটি প্রস্তাবকে স্পষ্ট কারণ দেখিয়ে রেকমেন্ড করা। আমরা তাঁর নির্ণয়ের সঙ্গে সহমত হব কিনা সেটা সাব্জেক্টিভ ব্যাপার। কিন্তু তিনি যদি সবগুলো প্রস্তাবকে বড়লাটের কাছে পাঠিয়ে দিতেন তাহলে তিনি পোস্টমাস্টার হতেন, ছোটলাট নয়।
২) বাংলায় পাঠ্যবই রচনার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্যে কোন তথ্যগত অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি আছে কি? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না। এখনও অন্য কোন বিকল্প বাংলা প্রাইমারের অস্তিত্ব আমাদের সামনে লেখক আনেননি। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে সিরিজের শেষ কিস্তিতে।
বিদ্যাসাগরের মডেলে পাঠ্যক্রমে বিষয়গুলো কী কী?
“মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে লিখন-পঠন-সরল-অংক ছাড়াও ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ও শারীরবিজ্ঞান"।
লেখকের আপত্তি:
ক) তখন ইংল্যান্ডের ইটনের মত নামি স্কুলের ক্লাস ফাইভেও লিখন, পাটিগণিত, ভূগোল, অথবা অ্যালজেব্রা বা একটু ইউক্লিড ছাড়া কিছু পড়ানো হত না। ১৮৫১ সালের আগে ম্যাথমেটিক্স নিয়মিত বিষয় ছিল না। সেখানে বিদ্যাসাগর এতসব বিষয় কেন পড়াতে চান? আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঢোকাচ্ছেন – ভারতবর্ষ, গ্রিস, রোম ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস![6]
-- এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! এতদিন তো শুনলাম – বিদ্যাসাগর ইংরেজের মোসায়েব, কলোনিয়াল ব্যবস্থার নাটবল্টু। এখন দেখছি উনি কেন ইটনের থেকে বাংলার ছাত্রদের জ্ঞান চর্চায় এগিয়ে রাখতে চান? আমি কি কিছু ভুল বুঝেছি?
খ) বিদ্যাসাগর তাঁর প্রস্তাবে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষকে (নিজেকে) মডেল স্কুলগুলির এক্স-অফিসিও হেড সুপারিন্টেডেন্ট মনোনীত করার কথা বলেন। কিন্তু বললেন যে এর জন্যে আলাদা কোন পারিশ্রমিক চাইনে, খালি যাতায়াত ভাতা, বছরে ৩০০ টাকার বেশি নয়, দিলেই হবে। কিন্তু কিছু নিয়ম বদলে যাওয়ায় উনি শুধু দক্ষিণবঙ্গের সহকারী ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পেলেন এবং ওই দায়িত্বের জন্য রাহা খরচ ছাড়াও অতিরিক্ত ২০০ টাকা মাসিক ভাতা পেতে শুরু করলেন।
লেখকের মন্তব্য: উনি এটা নিতে অস্বীকার করেন নি।
আমার প্রশ্ন: কেন করবেন? চাকরি করছি, সরকার যদি নিজের থেকে কোন ভাতা নির্ধারণ করেন কেন নেব না? আমার হিসেবের চেয়ে কম দিলে অবশ্যই চেঁচাব।
গ) গ্রন্থরচনা, পুস্তক ও শিক্ষক নির্বাচনের ভার ওই হেড সুপারিন্টেডেন্টের উপর থাকবে।[7]
লেখকের দৃষ্টি সঠিক ভাবেই এর মধ্যে আজকের ভাষায় ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’ দেখছে এবং তা এককথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। এর বিবেচনার জন্যে দরকার সেই স্ট্যাটিসটিক্সের ‘বেইজ থিওরেম’ অনুযায়ী দেখা — অন্য প্রতিযোগী পাঠ্যপুস্তক কী কী ছিল, তাদের রচয়িতা কারা এবং তাদের মার্কেটিংয়ের হাল কী ছিল। সেসব নিয়ে কথা হবে শেষ কিস্তিতে।
ঘ) বিদ্যাসাগর যে চারজন সাব ইন্সপেক্টর বেছে নেন তাঁদের মধ্যে একজন হলেন তাঁর ছোটভা ই— দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। আমার কথাঃ বিদ্যাসাগরের ভাই হওয়া যেমন এই পদের জন্য বিশেষ যোগ্যতা হতে পারে না, তেমনই বিশেষ অযোগ্যতাও না। বিবেচ্য বিষয়, দীনবন্ধু এরজন্যে শিক্ষাগত বা অন্য কোন মাপকাঠিতে অনুপযুক্ত ছিলেন কিনা এবং অন্য কোন যোগ্যতর লোককে ডিঙিয়ে কেবল বিদ্যাসাগরের ভাই হবার সুবাদে নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা। সেই ডেটা কোথায়? আজ থেকে ১৭০ বছর আগের পরিস্থিতিতে?
বলা হয় নি, লেখক জানিয়েছেন যে এর আগে বড়লাট হার্ডিঞ্জ মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য, ১৮৪৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলা, বিহার এবং ওড়িশার নানা জায়গায় মাসিক ১৮৯৫ টাকা ব্যয়ে ১০১ টি পাঠশালা স্থাপন করেন। কিন্তু চাকরিতে ইংরেজি জানা লোকদের অগ্রাধিকারের ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক প্রভৃতির অভাব — এই যুগ্ম কারণে হার্ডিঞ্জের পাঠশালাগুলি মাত্র চার বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।[8] (বড় অক্ষর আমার)।
দেখা যাচ্ছে – এক, কলোনিয়াল প্রভুরা ইংরেজি চাপাতে গিয়ে পুরনো পাঠশালা ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিচ্ছিলেন এই ছবিটি ঠিক নয়। সরকারি চাকরির প্রলোভন এবং ইংরেজি স্কুল এসব শহরের বা শুধু কোলকাতার উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমিত ছিল। বরং এরা পাঠশালা ব্যবস্থাকে জীর্ণতা থেকে উদ্ধারের জন্য নানান পরীক্ষা ও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
দুই, মাতৃভাষায় ‘প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব’ এই সত্যটি খেয়াল রাখলে বিদ্যাসাগরের বাংলায় লেখা বইগুলির - সে দুটো হোক কি কুড়িটা - তাৎপর্য বুঝতে পারব, তার বাণিজ্যিক দিকটি খেয়াল করার পরেও।
জেমস লঙ প্রায় বিদ্যাসাগরের সময়েই, ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৪ সালে একটি নোট পেশ করে স্কুল প্রতি মাসিক মাত্র ২৫ টাকা গ্র্যান্ট চেয়েছিলেন, তাতে তাঁর তিনটি স্কুলের জায়গায় ৬টি স্কুল স্থাপনের আশ্বাস ছিল। লেখকের বক্তব্য: “তবুও লং নন, মুরুব্বির জোরে এবং হ্যালিডের নির্দেশে বিদ্যাসাগরই” দায়িত্ব পেলেন।
লঙের প্রস্তাবিত কোর্সে ছিল: বাংলা ও ভারতের বিশেষ সন্দর্ভে রচিত ভূগোল, ইতিহাস, জীবনী, পাটিগণিত, শ্রুতিলিখন, প্রকৃতির ইতিহাস, ব্যাকরণ ও শব্দকোষ। অথচ বিদ্যাসাগর যা তখনো ইংল্যান্ডে অপ্রচলিত সেসব কেন পাঠ্যক্রমে ঢোকালেন এবং তার সঙ্গে লম্বা বইয়ের লিস্টি!
বাংলায় পড়াতে হলে পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারে লঙের কী প্রস্তাব তা লেখক জানান নি, কাজেই এখানে তুল্যমূল্য বিচার কেমন করে হবে? শুধু সরকারের খরচ কম হবে এটাই কি বিবেচ্য? আগে তো আমরা বিদ্যাসাগরকেই দায়ী করেছি কলোনিয়াল প্রভুদের শিক্ষায় ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে জো-হুজুরি করার কথিত অভিযোগে।
বিদ্যাসাগর ৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৩ সালের চিঠিতে দাবি করেছিলেন যে তাঁকে নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা দিলে সংস্কৃত কলেজ শিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান হবে, উন্নত দেশিয় সাহিত্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র হবে, এবং “এখান থেকে এমন একদল ভবিষ্যতের শিক্ষক তৈরি হবে, যাঁরা দেশের জনসাধারণের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারের পথ সুগম করবেন”। [9]
কিন্তু কাজে কী হল?
লেখক জানাচ্ছেন ১৮৫৫ সালের ১ মে তারিখে ক্ষমতা পেয়ে বিদ্যাসাগর ওই মাসেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচনের জন্যে সংস্কৃত কলেজে একটি পরীক্ষা নেন। তাতে ২০০ জনের মধ্যে মাত্র ৯২ জন উত্তীর্ণ হন। আর সেই ৯২ জনের মধ্যে একজনও স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন নি।[10]
এবার লেখক বললেন, “সংস্কৃত কলেজের পরীক্ষার্থীরা যদি সামান্য প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্য না হতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বিদ্যাসাগরের ব্যর্থতা”।
প্রথম নজরে মনে হবে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমার মন খুঁতখুঁত করছে। যদি ৯২ জন লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে থাকেন তাহলে প্রাইমারি স্কুলে পড়াবার জন্যে কোন মাপকাঠিতে এঁরা অযোগ্য হলেন? কোন ইন্টারভিউ বা অন্য কোন ইস্যুতে আপাতত নিয়োগ স্থগিত হয়েছিল? লেখক অনেক জায়গায় মূল দস্তাবেজ থেকে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, কিন্তু এখানে খালি ডকুমেন্টের উল্লেখ করে ছেড়ে দিয়েছেন। আশা করব, যথাসময়ে উনি ওই রেকর্ডের প্রাসংগিক অংশ উদ্ধৃত করবেন যাতে ৯২ জনকে নিযুক্ত না করার কারণ স্পষ্ট হয়। কারণ লেখক দেখাচ্ছেন তিন মাস পরে ২২ অগস্ট থেকে মডেল স্কুল খোলা শুরু হয়।
আমার প্রশ্ন:
১) স্কুল খোলার আগে নিযুক্তি হবে কেমন করে?
২) যখন ৯২ জনের মধ্যে একজনও শিক্ষকতার যোগ্য পাওয়া যায়নি, তখন তিনমাস বাদে শিক্ষক কোথা থেকে জোগাড় হল?
শিক্ষাবিদ হিসেবে বিদ্যাসাগরকে ব্যর্থ বলে রায় দেবার আগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা আবশ্যক বলে মনে হয়।
কিন্তু ২ জুলাই বিদ্যাসাগর শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে জানালেন যে সরকার মাসিক ৫০০ টাকা খরচ করতে রাজি হলে মাতৃভাষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল খুলতে হবে। তাতে ৬ মাস অন্তর ৬০ জন করে শিক্ষক পাওয়া যাবে। তাহলে সংস্কৃত কলেজ থেকেই মাতৃভাষায় পড়ানোর জন্য যোগ্য শিক্ষক তৈরি হবে -বিদ্যাসাগরের এই আশা ভুল প্রমাণিত হল?
অবশ্যই; যদি না টিচার্স ট্রেনিং স্কুল ও বিটি কলেজ খোলার দরকার থেকে এটা সিদ্ধ হয় যে গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়েরা কিস্যু শেখে নি বা স্কুলে পড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করে নি।
তবে লেখকের এই কথাটা ঠিক যে টিচার্স ট্রেনিংয়ের জন্যে নর্মাল স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে আবার বিদ্যাসাগরের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কার প্রকট হয়ে উঠল। নর্মাল স্কুল সংক্রান্ত রিপোর্টে শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ংকে লিখলেন, ‘নীচুজাতের লোকজনকে আপাতত বাদ দেয়া হয়েছে’।[11]
এই অধ্যায়ের শেষে লেখক দেখিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর তাঁর মডেল স্কুলের সাফল্যের বিষয়ে যতই বড় মুখ করে সাফল্যের দাবি করুন না কেন পরবর্তী কালে সরকারি রিপোর্টে এই দাবি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
যেমন, ১৯৬২ সালের ২৫ জুন ইন্সপেক্টর উড্রো অধিকর্তা ইয়ংকে লেখেন যে হার্ডিঞ্জের ভার্নাকুলার স্কুলের খরচার চেয়ে বিদ্যাসাগরের মডেল স্কুলের প্রতি ছাত্র সরকারি ব্যয় কেন বেশি? [12]
আবার কেন্দ্রীয় সরকারের ১৮৫৯-৭১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে “The efforts to improve the indigenous village schools of the country had failed;” এতে আরও বলা হয়েছে সামান্য যে ক’টি মডেল স্কুল সরকার বাহাদুর খুলেছেন তাতে সমাজের উচ্চবর্গীয় অল্পসংখ্যক ছাত্র মাতৃভাষায় ভাল শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু তার প্রভাবে দেশি বিদ্যালয়গুলোর কোন উন্নতি হয়নি[13]।
লেখক অষ্টম অধ্যায়ে দাঁড়ি টেনেছেন এই বলে যে সরকারের থেকে চাহিদা অনুযায়ী ক্ষমতা এবং অর্থ সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও ছাত্র ভর্তির নিরিখে (বিদ্যাসাগর মডেলের তুলনায় উত্তর পশ্চিম ভারতের টোমাসন মডেলে ছাত্রসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি হয়েছে), দেশজ পাঠশালাগুলির উন্নয়নের বিষয়ে, ‘এক বিরাট ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এই গোটা প্রকল্পটি’।
আমি বলব: ‘বাবুজি ধীরে চল না। প্যার মেঁ জরা সমহালনা’।
কারণ, ইন্সপেক্টর উড্রোর রিপোর্টে স্কুলের গুণমান নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে খরচের কথা, সেটাও হার্ডিঞ্জের মডেলের সঙ্গে তুলনায়। যেখানে লেখকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী হার্ডিঞ্জের পাঠশালাগুলো ১৮৪৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৮৪৮ সালেই বন্ধ হয়ে যায়। তাদের না ছিল শিক্ষক, না পরিদর্শক না বইপত্তর। সেই আপেল আর কমলালেবুর গল্প!
আর পরেরটি আদৌ বিদ্যাসাগরের বা বঙ্গের মডেল স্কুল নিয়ে বলা নয়। বরং কেন্দ্রীয় সরকারের ওই রিপোর্টে গোটাভারতে শিক্ষাসংস্কারের যে উদ্দেশ্য তা’ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছে।
আমার বক্তব্য: তখন মহারানির রাজত্ব শুরু হয়েছে মাত্র। কলোনিয়াল শাসকের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ওই সংস্কার ব্যর্থ হয়ে থাকে তাহলে তো লেখকের পছন্দের টোমাসন, জেমস লং, অ্যাডাম সবাই ব্যর্থ। কারণ বাংলার বাইরে তো বিদ্যাসাগরের নয়, এঁদের মডেল চলছিল। খালি বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরলে হবে?
কিন্তু লেখকের আক্ষেপ কেন বিদ্যাসাগর অ্যাডামের রিপোর্টকে গুরুত্ব দেননি? এমনকি বড়লাটের কথাও না শুনে ‘বিদ্যাসাগর নিজের মতো গোটা পরিকল্পনাটিকে সাজান!’
তাহলে লেখক মেনে নিচ্ছেন যে ১) বিদ্যাসাগরের শিক্ষাসংস্কারের ব্যাপারে নিজের মতো করে ভাবার ক্ষমতা (ঠিক হোক বা ভুল) ছিল? ২) ‘মোসাহেব’ বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় শিক্ষা সংস্কারের ব্যাপারে কলোনিয়াল প্রভুদের নির্দেশ ও দরকারমত অমান্য করার মেরুদন্ড রাখতেন?
নবম অধ্যায়ে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিচার করেছেন - নারীশিক্ষা। সঠিক ভাবে আমাদের মনে করিয়েছেন যে আমাদের দেশে বিদ্যাসাগরের জন্মের আগে থেকেই নারীশিক্ষার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিদ্যাসাগর ঠিক কোন মেয়েদের জন্য কী ধরণের নারীশিক্ষাকে সমর্থন করেছেন তা নিয়ে লেখক বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং সেই সূত্রে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীশিক্ষার জন্যে বিশিষ্ট নারীদের সংগ্রামের ঝলক। এটি এই অধ্যায়ের দামি পাওনা, যার জন্যে লেখক আমাদের সবার ধন্যবাদার্হ।
কারা বঙ্গে নারীশক্ষা প্রসারের অগ্রদূত? নিঃসন্দেহে খ্রিস্টান মিশনারিরা, বিশেষ করে ব্যাপটিস্ট মিশন। লেখকের উদ্ধৃত কৈলাসবাসিনী দেবীর বক্তব্যেও সেটাই স্পষ্ট হয়।[14]
ওই বিশেষ উদ্দেশ্যে ১৮২১ সালে ইংল্যান্ড থেকে কোলকাতায় এসে মেরি অ্যান কুক, পরে বিবাহসূত্রে উইলসন, কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল খুলতে লাগলেন। ১৮২৪ নাগাদ স্কুলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০, ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৬০০।
১৮২৮ নাগাদ উনি স্থাপন করলেন কেন্দ্রীয় বালিকা বিদ্যালয় এবং দু’বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রী হয় ২০০।
পাঠ্যক্রম কী ছিল? মাতৃভাষা, ভূগোল, অল্প গণিত, সেলাই এবং খ্রিস্টিয় নীতিকথা।
ছাত্রী কারা? মূলত নিম্নবিত্ত হিন্দু ও মুসলমান পরিবারের মেয়েরা। [15]
কিন্ত্য সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের অভিভাবকেরা নিজের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে নিরুৎসাহী এবং সরকারি শিক্ষা দপ্তর এ নিয়ে কোন উদ্যোগ নেওয়া তো দূর, দেশীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলিকে সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেননি। “ফলত ১৮৩০ নাগাদ এই সব বিদ্যালয়ের অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়”।[16]
লেখক গৌরমোহন বিদ্যালংকারের লেখা ‘স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক’ বইটি -- উপরোক্ত স্কুলগুলিতে পাঠ্য – থেকে তৎকালীন হিন্দু ভদ্রসমাজের স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে গড়পড়তা চিন্তার একটি চমৎকার ছবি তুলে ধরেছেন।
মেয়েদের ধীশক্তি নিয়ে প্রচলিত তাচ্ছিল্যের সমালোচনা করে গৌরমোহন লিখছেন “নীতিশাস্ত্রে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর বুদ্ধি চতুর্গুণ ও ব্যবসায় ছয়গুণ কহিয়াছেন। -------- তাঁহাদের মধ্যে যদি কেহ বিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করে তবে তাঁহাকে মিথ্যা জনরব মাত্র সিদ্ধ নানা অশাস্ত্রীয় প্রতিবন্ধক দেখাইয়া ও ব্যবহার দুষ্ট বলিয়া মানা করাণ”।[17]
তবে ১৮৪৭ সালে নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ মিত্র এবং প্যারীচরণ সরকারের উদ্যোগে বারাসতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লেখকের মতে এটিই ‘সম্ভ্রান্ত’ বাঙালিদের উদ্যোগে বাংলার প্রথম প্রকাশ্য বালিকা বিদ্যালয়।
১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেব তিন বাঙালি রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও মদনমোহন তর্কালংকারের সহযোগিতায় চালু করেন ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’। পড়বে কারা? কেবল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের চার থেকে দশ বছর বয়সী মেয়েরা, শিক্ষা অবৈতনিক এবং ঘর থেকে স্কুল অবধি যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকবে।
পড়ানো হবে বাংলা এবং সূচিশিল্প, অঙ্কন ইত্যাদি। ইংরেজির পাঠ -- অভিভাবকেরা অনুমতি দিলে তবেই। উদ্বোধনী ভাষণে বেথুন স্পষ্ট করেন যে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য গার্হস্থ্য সুখের বহুগুণ বৃদ্ধি করা এবং ঘরের কোনায় বদ্ধ জীবন থেকে মেয়েদের মুক্তি দেয়া। কিন্তু বেথুন এও বলেন যে মেয়েদের এই অবস্থা প্রাচীন ভারতে ছিল না; এসব হয়েছে মুসলিম আক্রমণকারীদের দরবারি সংস্কৃতির অনুকরণে।[18] (অনুবাদ আমার)।
এ তো গেল সাহেবদের কথা। কিন্তু মদনমোহন তর্কালংকারের মতন স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী বুদ্ধিজীবি তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে স্ত্রীজাতির দক্ষতা, শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার আধিক্য স্বীকার করেও নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে লেখেন অর্ধাঙ্গিনী মূর্খ হলে পুরুষের কষ্ট, শিক্ষিত হলে ঘরের ভেতর স্বামীর সেক্রেটারি। মানে সেই কালিদাসের “গৃহিণী সচিবঃ সখী, প্রিয়শিষ্যা ললিতেকলাবিধৌ” ধারণাটি তখনও খাপে খাপ আদর্শ!
তারপর উনি স্ত্রী শিক্ষার অভাবের কারণ হিসেবে বেথুনের প্রতিধ্বনি করে একমাত্র মুসলমানদের দায়ী করে লিখলেন — “ দুশ্চরিত্র যবনজাতির ভয়ে স্ত্রীলোকদিগের প্রকাশ্য স্থানে গমনাগমন ও বিদ্যানুশীলন সম্পূর্ণরূপে স্থগিত হইয়া গেল। --- তদবধি স্ত্রীদিগের অন্তঃপুরনিবাস ও বিদ্যাভ্যাস নিরাশ হইয়া গিয়াছে”।[19]
আরও আছে।
“এদেশ মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা অথবা বিধবাবিবাহ প্রভৃতি যে কিছু মহৎকার্য যখন ঘটিবে, তাহা বিদেশীয় লোকের অর্থাৎ ইউরোপীয় জাতির হস্ত দ্বারাই সম্পাদিত হইবে, দেশের লোক কেবল হা’ করিয়া চাহিয়া রহিবেন"। [20]
লেখক এর মধ্যে দেখছেন "যুগপৎ নির্ভেজাল বৃটিশবন্দনা ও তীব্র মুসলমান বিদ্বেষের চরম নিদর্শন”।
আমার সামান্য ভিন্নমত - মুসলমান বিদ্বেষ? অবশ্যই। কিন্তু বৃটিশ বন্দনার জায়গায় আমি দেখছি হতাশা ও আত্মকরুণা — কারণ, মদনমোহন স্ত্রীশিক্ষার প্রসার কামনায় আন্তরিক ছিলেন।
বেথুনের অনুরোধে বিদ্যাসাগর ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে অবৈতনিক সম্পাদক রূপে ‘বেথুন স্কুল’ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। ১২ অগস্ট, ১৯৫১ তে বেথুন মারা গেলে স্কুল পরিচালনার সরকারি পরিচালন সমিতির সম্পাদক হন বিদ্যাসাগর।
লেখক সঠিকভাবে দেখিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের ভর্তির শর্ত (সম্ভান্ত বংশীয় হিন্দুপরিবারের মেয়ে), কোর্স, উদ্দেশ্য ইত্যাদিতে কোন সংস্কার বা কোন পরিবর্তন করেননি।
একটি উদাহরণ, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৫৬তে বিদ্যাসাগর স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তির অংশ:
“হিন্দু জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের যথোপযুক্ত শিক্ষা হইলে হিন্দু সমাজের ও এতদ্দেশের যে কত উপকার হইবে — যাঁহার সহিত যাবজ্জীবন সহবাস করিতে হয় তাঁহারা সুশিক্ষিত ও জ্ঞানাপন্ন হন এবং শিশুসন্তানদিগকে শিক্ষা দিতে পারেন — [21]
“ ক) ইংরেজি শিক্ষার মতো নারীশিক্ষার আঙিনা থেকেও নিম্নবর্গের হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমানদের অপাংক্তেয় করে রাখা হবে, খ) এই শিক্ষা সংরক্ষিত থাকবে কেবল ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দু পরিবারের মেয়েদের জন্য, গ) মেয়েরা বিবাহযোগ্যা গণ্য হওয়া মাত্র তাদের শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং ঘ) এই মেয়েদের আদর্শ স্ত্রী ও জননী হিসেবে গড়ে তোলার কারণে, কোনও অবস্থাতেই তাদের পাঠ্ক্রম ছেলেদের মতো হবে না।[22]
দ্বারকানাথ রায় তাঁর ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত “স্ত্রীশিক্ষা বিধান” নামের বইয়ে যতই বলুন “পুত্র ও কন্যাতে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই”, বাস্তবের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রভেদ প্রকট এবং বিদ্যাসাগর তাঁর সমসাময়িক ধ্যানধারণা থেকে, অন্তত স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপার্ বেরিয়ে আসতে পারেনি। লেখকের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
কাজেই এতদিন ধরে যদি বিদ্যাসাগরকে “নারীশিক্ষার কাণ্ডারী” বলা হয়ে থাকে তবে তা’ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
অন্তিম রায় দেবার আগে আর একটু দেখা যাক।
লেখক এবার সরকারের কথা ছেড়ে সেইসময় বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে আমাদের নজর টেনেছেন।
লেখক বলছেন যে ১৮৫৪ সালে উডের নির্দেশনামায় নারীশিক্ষার পক্ষে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেওয়ার পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একের পর এক বালিকা বিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৫৪ সালে বালিকা বিদ্যালয় ছিল ৬২৬টি ( বেঙ্গল ২৮৮, মাদ্রাজ ২৫৬, বোম্বে ৬৫, নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স এবং অবধ ১৭), তার ছাত্রীসংখ্যা ২১, ৭৫৫। এই দেশজোড়া কর্মযজ্ঞে বিদ্যাসাগরের কোন ভূমিকা ছিল না। কারণ তিনি স্ত্রীশিক্ষার আঙিনায় এলেন ১৮৫৫ সালে শুধু বেথুন স্কুল পরিচালক কমিটির সম্পাদক হয়ে।
তারপর বিদ্যাসাগরের বিশ্বাস হল যে তিনি যদি মডেল স্কুলের মত বালিকা বিদ্যালয় খোলেন তাহলে ছোটলাট হ্যালিডের আনুকূল্যে সেগুলো সরকারি সাহায্য পেয়ে যাবে। তখন, লেখকের কথানুযায়ী, তিনি ‘সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা না করে’ চারটে জেলায় মাত্র সাতমাসের মধ্যে মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাতে ছাত্রী সংখ্যা ১৩০০ এবং মাসিক খরচ ৮৪৫ টাকা। কিন্তু শিক্ষা অধিকর্তা উড্রো সায়েব জানাচ্ছেন যে তিনি অনুদান পেলেন না, ফলে তাঁর ঘাড়ে তিন থেকে চারহাজার টাকার বোঝা চাপল।[23]
বিদ্যাসাগরের হয়ে ছোটলাট হ্যালিডে অনুদানের জন্যে ভারত সরকারের সঙ্গে চিঠিচাপাটি করেন, কেননা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই বিদ্যাসাগর স্কুলগুলো খুলেছিলেন। তিনি তখন দক্ষিণ বঙ্গের সহকারী স্কুল পরিদর্শকও বটেন। কিন্তু ভারত সরকার ২২ ডিসেম্বর, ১৮৫৮ সালে বকেয়া ৩৪৩৯ টাকার আর্থিক দায়ভার গ্রহণ করে জানায় যে “এই বিদ্যালয়গুলোকে কোনও অবস্থাতেই অনুমোদন দেওয়া যাবেনা। এটা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বা সরকারি বিদ্যালয়-উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য”।[24] তাঁরা আগেই, ৭ মে তারিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে জনগণের নিজস্ব ব্যয় এবং সহযোগিতা ছাড়া চালাতে না পারলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হোক।
এবার লেখক জানাচ্ছেন, ‘বালিকা বিদ্যালয়গুলোর অকালমৃত্যুর পরে বেথুন স্কুলের সম্পাদকরূপে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাংলার নারীশিক্ষার ক্ষীণ যোগসূত্রটি অবশিষ্ট থাকে’ কিন্তু স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রায় দু’দশক পরেও বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের মেয়েদের পাঠ্যক্রমের এবং ছাত্রীদের ভর্তির যোগ্যতা বিষয়ক ব্রাহ্মণ্যবাদী শর্তের কোন পরিবর্তন করেননি। বিদ্যাসাগর ১৮৬২ সালের ১৫ ডিসেম্বর এবং ১৮৬৫ সালের ২৯ জুলাই সরকারের কাছে এই দুটি বিষয়ে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে সেই ‘ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রুমাল তৈরি ও আসন বুনন’ এবং ‘হিন্দু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা’।[25]
এই অধ্যায়ের শেষে লেখক উল্লেখ করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার।
১৮৭৯ সালে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ছাত্রী কাদম্বিনী বসু বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তারপর তিনি বেথুন স্কুলে নতুন শুরু হওয়া ফার্স্ট আর্টস (এফ এ) ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু দেরাদুন থেকে আসা চন্দ্রমুখী বসু খ্রিস্টান হওয়ার ‘অপরাধে’ বেথুন স্কুলে এফ এ ক্লাসে ভর্তির সুযোগ পেলেন না। তারপর ১৮৮১ সালে দুজনেই এফ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; অবশ্য চন্দ্রমুখী ফ্রি চার্চ নর্মাল স্কুল থেকে। পরবর্তী কালে কাদম্বিনী বসু মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন। চন্দ্রমুখী ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করলেন। বিদ্যাসাগর চন্দ্রমুখীর এম এ পাশের সংবাদ পেয়ে তাঁকে শেক্সপিয়র রচনাবলী পাঠিয়েছিলেন।[26]
লেখকের আপত্তি:
১) বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষার প্রকল্পটি অকালে মুখ থুবড়ে পড়লো ন্যূনতম পরিকল্পনার অভাবে।
২) ব্রাহ্মণ্যবাদী পূর্বাগ্রহের ফলে বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা কেবল রক্ষণশীল হিন্দু উচ্চবর্গের মধ্যে সীমিত রইল।
৩) চন্দ্রমুখীকে এম এ পাশের খবরে শেক্সপিয়র রচনাবলী উপহারের পেছনে বিদ্যাসাগরের অপরাধ বোধ কাজ করেছে।
আমার বক্তব্য:
১) বিদ্যাসাগর অবশ্যই দেশে নারীশিক্ষার কাণ্ডারী নন, কিন্তু অন্যতম পথিকৃৎ; এবং পরাজিত ট্র্যাজিক নায়ক।
২) তিনি যে জাতিবাদী পিতৃতান্ত্রিক পূর্বাগ্রহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে কে পেরেছিলেন? বিবেকানন্দ? তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ? সন্দেহ আছে।
৩) বেথুন স্কুলের কোর্সে যদি আরও পরে পরিবর্তন না হয়ে থাকে তাহলে ১৯৭৯- ৮১ সালে এফ এ ক্লাসে কী পড়ানো হত যার জোরে কাদম্বিনী বসু ১৮৮৩ সালে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারলেন? এবিষয়ে লেখক কোন আলোকপাত করেননি।
পরবর্তী কিস্তিতে আলোচিত হবে জনশিক্ষা ও সিপাহী বিদ্রোহে বিদ্যাসাগর ও তাঁর পদত্যাগ বিতর্ক।
এই আলোচনাটা 'পড়াবই' বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করাটা অত্যন্ত ভাল কাজ হয়েছে।
"লেখকের আপত্তি:
১ বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষার প্রকল্পটি অকালে মুখ থুবড়ে পড়লো ন্যূনতম পরিকল্পনার অভাবে।
২ ব্রাহ্মণ্যবাদী পূর্বাগ্রহের ফলে বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা কেবল রক্ষণশীল হিন্দু উচ্চবর্গের মধ্যে সীমিত রইল।
আমার বক্তব্য:
১ বিদ্যাসাগর অবশ্যই দেশে নারীশিক্ষার কাণ্ডারী নন, কিন্তু অন্যতম পথিকৃৎ; এবং পরাজিত ট্র্যাজিক নায়ক।
২ তিনি যে জাতিবাদী পিতৃতান্ত্রিক পূর্বাগ্রহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে কে পেরেছিলেন? বিবেকানন্দ? তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ? সন্দেহ আছে।"
#২ পড়ে আশির আর নব্বুই এর দশকের সিপিএমের কথা মনে পরে গেল। সমালোচনা করলেই শুনতে হতো, "ওরা, মানে কং, যে করেছিল তার বেলা? কং এর গুন্ডামি ভুলে গেলেন? ইত্যাদি, ইত্যাদি!!
বিবেকানন্দ আর বিদ্যাসাগর সমসাময়িক নয় তো!!! তবে বিবেকানন্দ বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইস্কুলে কিছুকাল ছাত্র ছিলেন!!
ar
আপনার আপত্তি সঠিক। বিবেকনন্দ ও বিদ্যাসাগর ঠিক সমসাময়িক নন।
কিন্তু আমার পয়েন্ট অন্য। বৃটিশ ভারতে বাংলার কথিত নবজাগরণের আইকনদের মধ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর মননে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। বলতে চেয়েছি যে সেই সময়ে পিতৃতন্ত্র ও জাতিবাদ বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বাভাবিক ছিল। এর প্রভাবের বাইরে এসে চিন্তা করা ও অবস্থান নেয়া ছিল ব্যতিক্রম। সেই ব্যতিক্রমীদের একজন হলেন রবীন্দ্রনাথ। সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন।
বাকিদের মেয়েদের নিয়ে চিন্তা 'অবলা দুঃখিনী নারীদের জন্য কিছু করা' টাইপের। এমনকি মেয়েরা নিজের জীবনের নির্ণয় বা যাত্রাপথের লাগাম নিজের হাতে নিজে নিয়ত্রণ করবে এটাও কয়েক দশক আগের ব্যাপার। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গে এমনকি সহর কোলকাতায়ও এগুলো ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখা হত।
আমার আক্ষেপ, লেখক দু'শো বছর আগে যে মূল্যবোধের প্রত্যাশা বিদ্যাসাগরের থেকে করছেন তা' কালাতিক্রমণ দোষে (অ্যানাক্রনিজম) দোষে দুষ্ট; হোয়াট অ্যাবাউট্রি' করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
রঞ্জনবাবু, আপনার এই পাঠ প্রতিক্রিয়া একই সঙ্গে অতুলনীয় ও অভাবনীয়। অতুলনীয় এই কারণে যে এর আগে সম্ভবত গুরুতে কোনও বই নিয়ে ধারাবাহিক রিভিউ প্রকাশিত হয়নি। অভাবনীয় আমার কাছে কারণ আপনি যে নিষ্ঠা ও উদ্যম নিয়ে লেখাটির নানা ফাঁকফোকর নিয়ে আলোচনা করছেন, পাল্টা ভাষ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছেন - সেটা সত্যিই আমার ভাবনার বৃত্তে ছিল না।
আমার মনে হচ্ছে আপনি কেবল শিক্ষাসংস্কার নিয়ে যে বিস্তারিত আকারে আলোচনা করছেন, তাতে গোটা পাঠ প্রতিক্রিয়া শেষ হতে হয়তো আরও একমাস লাগতে পারে। আপনি আপত্তি না করলে একজন সামান্য পাঠক হিসেবে আমি পর্বগুলো ধরে ধরে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তাতে মূল আলোচনার ফ্লো অব্যাহত থাকবে বলে আমার ধারণা। পাল্টা তর্কের প্রশ্নই নেই, বরং ওপেন এন্ডেড ডিসকাশন হিসেবে গোটা বিষয়টিকে বিবেচনা করতে পারেন।
গুরুর টেক টিম বিশেষত এলসিএম ও হুতোকে অনুরোধ, এই পর্বের মতো আগের পর্বগুলো যদি একই বিভাগের অন্তর্গত করেন, তথ্যসূত্রগুলো এটার মতো ইন্টারলিঙ্কড করেন এবং বিশেষত নজরটান (যেটা রঞ্জনবাবু দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি না)-এর ব্যাপারে মনোযোগী হন, তাহলে সব মিলিয়ে হয়তো লেখাটা আরও বেশি প্রেজেন্টেবল হতে পারে। এটা নিছকই অনুরোধ এবং এই বিষয়ে গুরুর সম্পাদকীয় দফতরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
এলেবেলে,
মোস্ট ওয়েলকাম! এটাই ভাল হবে। আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি যে অ্যাডমিনরা আগেই সব পর্বগুলোকে একই সঙ্গে করে দিয়েছেন। যাতে আপনি স্বচ্ছন্দে একেকটি পর্বে ক্লিক করে খুলে তার নীচে আপনার ব্যাখ্যা রাখতে পারেন এবং অন্যরাও সেই আলোচনায় ভাগ নিতে পারে।
আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার কাজ আপনার মূল্যবান পরিশ্রমকে আদৌ নস্যাৎ করার চেষ্টা না করে উপলব্ধ তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে একটি সম্ভবপর বিকল্প ব্যাখ্যা পেশ করা।
এভাবেই 'জমবে তখন জমবে ভাল মধুবংশীর গলি"!
লিংকড তো আছে, নেভিগেশনের জায়গায় দেখুন, আগের তিনটে পর্বে যাওয়া যাবে।
কিন্তু ওয়েব ঠিকানা এক রেখে বিভাগ (হরিদাসপাল -> বুবুভা ) পাল্টানো বোধহয় সম্ভব না।
ওহ, ফুটনোট ইত্যাদি, হ্যাঁ, এটা করা সম্ভব।
হুতো, আমি বোধহয় আপনাকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনি।
১. রঞ্জনবাবুর লেখাটার প্রথম তিনটে পর্ব আছে 'বিবিধ'-তে, চতুর্থ পর্বটি আছে 'পড়াবই' বিভাগে। আমি চাইছি পুরোটাই 'পড়াবই' বিভাগে স্থানান্তরিত করা যায় কি না।
২. এই পর্বে যেমন ২৬টি রেফারেন্স ইন্টারলিঙ্কড, সেরকম বাকি পর্বের রেফারেন্সগুলোও ইন্টারলিঙ্কড করা যায় কি না।
৩. এই পর্বে যেমন বোল্ড হরফগুলো বোল্ডই দেখা যাচ্ছে, বাকি পর্বগুলোতে ইট্যালিকসগুলো বঙ্কিম হরফে দেখা যাচ্ছে না। এটা কি নতুন করে এডিট করা যায়?
আপাতত এই তিনটে পরিবর্তন করা সম্ভব হলে এবং সে ব্যাপারে রঞ্জনবাবুর আপত্তি না থাকলে আপনারা ভেবে দেখতে পারেন।
রঞ্জনের পাঠ প্রতিক্রিয়ার (নাকি এলেবেলের ভাষায় পাল্টা ভাষ্য) চারটে পর্ব এক নাগাড়ে পড়লাম। ব যে ভাবে এলেবেলের লেখার ফাঁকফোকড় রন্জন খুঁজে বার করছে তাতে প্যেরতীয়মান হচ্ছে যে ওকালতির পেশায় লেগে থাকলে রঞ্জনের আর্থিক সাফল্যের সম্ভাবনা অনিবার্য ছিল।
যাইহোক এবার এলেবেলের রিজয়েন্ডার শুরু হলে আরও ঋদ্ধ হবো।
শেখর,
তুই আমার প্রথম যৌবনের স্বপ্নদেখার দিনের বন্ধু । এসব তুই না বললে কে বলবে?
মজার ব্যাপার হচ্ছে ৫৮ বছর বয়সে ল' এর ডিগ্রি নিলাম। পরীক্ষার সময় ওয়াশ রুমে একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল -- আংকল, পরীক্ষা দিতে এসেছেন নাকি নিতে? পরে মানহানি (ক্রিমিনাল) কেসে নিজে জেরা ও আর্গু করেছি, যেহেতু আমি পিটিশনার ছিলাম, তেমনই রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্টের গিন্নির অ্যাপীলে।
এসব ছেঁদো কথা। আপাতত মজে আছি ভারতীয় দর্শনে 'প্রমাণ' বলতে বিভিন্ন স্কুল কী বোঝে( যেমন বৌদ্ধ দিঙনাগ+ ধর্মকীর্তি+ নাগার্জুন বনাম ন্যায় দর্শনের উদয়ন, জয়ন্ত ভট্ট ইত্যাদি) এবং শংকরের অদ্বৈত বেদান্ত কতটা বা আদৌ লজিক্যাল কীনা?
লক ডাউনে সময় কেটে যাচ্ছে আরকি!
এসব নিয়ে গুরুর পাতায় সবাইকে বোর করব, অন্ততঃ তিনমাস পরে।
রঞ্জন,
বাই দা বাই, দেবোত্তম বাবুর বই নিয়ে তোর পাঠ- প্রতিক্রিয়া কি চতুর্থ পর্বেই শেষ হলো? তাহলে এবার এলেবেলের রিজয়েন্ডারের অপেক্ষায় রইলাম।
আর একটা কথা- ' প্রমাণ' বলতে ভারতীয় দর্শনে জ্ঞান ( প্রমা) লাভের পদ্ধতিকেই তো বোঋায় বলে জানি ( যদিও এ বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও আমার নেই)। গুরুর পাতায় আগামীদিনে তুই কি সেই ' প্রমাণ' নিয়ে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন স্কুল কী বলছে তাই নিয়েই আলোচনা করবি? অতিমারির তৃতীয় তরঙ্গে সলিলসমাধি না হলে অবশ্যই পড়ব।
এখনো কি গুরুগ্রামেই আছিস? আগস্টে দিল্লি যাওয়ার টিকিট কাটা আছে। তৃতীয় তরঙ্গে ডুবে না গেলে একদিন জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে।
শেখর
না, এখন থেকে পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রতি রবিবার বুলবুল্ভাজায় গুরু অ্যাডমিনরা বের করছেন।
আরও চারটে কিস্তি লাগবে মনে হয়।
প্রমা ও প্রমাণ নিয়ে তোর বক্তব্য একদম সঠিক।
আমি প্রধানতঃ প্রমাণ নিয়ে ন্যায় দর্শনের গৌতম, উদয়ন ও জয়ন্ত ভট্ট বনাম বৌদ্ধ মাধ্যমিক দর্শনের নাগার্জুন, দিঙনাগ ও ধর্মকীর্তির ডিবেট নিয়ে কথা বোলব, অবশ্য প্রসঙ্গে এসে যাবেন পূর্ব মীমাংসার কুমারিল ভট্ট।
তবে তার আগে আগামী মাসে একটা লেখায় শংকরাচার্য্যের মায়াবাদ কতটা লজিকের উপর দাঁড়িয়ে বা শুধু ধারে কাটছে ভারে নয় --সেটা দেখাবার চেষ্টা করব।
হ্যাঁ, গুরুগ্রামে এ'বছর অব্দি থাকব। তারপর আগামীতে টিকে থাকলে কোলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আড্ডা হবে, আয়।