করোনার দিনগুলি #৪১
রানীর গল্প
আমার ছোটো মেয়ে রানীর কল্যাণে লকডাউনের সময়টা বর্ণময় হয়ে উঠেছে।
রানী সবে পড়াশুনো করতে শুরু করেছিল। পাড়াতেই একটা স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ছিল। কটা দিন স্কুলে যাওয়ার পর মহামারীর দাক্ষিণ্যে তার পড়াশুনো শিকেয় উঠেছে।
তবে অল্প কয়েকদিনের স্কুলের পরিবেশ তার মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর জন্ম দিয়েছে। এখন সে সব কিছুই শিখতে চায়।
তাতে আপত্তি করার কিছু ছিল না। বস্তুত এই অবসরে রানীকে ১,২,৩ এবং অ, আ, ক, খ লেখা শেখানোর জন্য আমরা উঠে পড়ে লেগেছিলাম। কিন্তু সে ওই সামান্য শিক্ষায় সন্তুষ্ট হতে চায় না।
পড়াশুনো করার জন্য খাতা পেন্সিল আনতে বললেই বলে, 'বাবা, পড়াশোনা মানে তো পড়া আর শোনা। তুমি পড়বে, আমি শুনব। খাতা পেন্সিল লাগবে কেন?'
আমি বলি, 'তাহলে একটু লেখাপড়া করা যাক।'
'নাহ, লেখাপড়া আমার ভালো লাগে না। পড়াশুনোই ভালো।'
অতি কষ্টে যদিবা তাকে খাতা পেন্সিল দিয়ে বসানো যায়, সে বায়না ধরে, 'পেন্সিলে লিখব না বাবা, দিদির মতো পেন দিয়ে লিখব।'
রানী বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা খুব দ্রুতই শিখে নিচ্ছে। কিন্তু এক আশ্চর্য উপায়ে সে প্রায় প্রতিটি বর্ণ উল্টো লেখে। ১ কে 6, b কে d। যতবারই সোজা করে দি, উল্টোটাই লিখবে। ওকে পড়াতে পড়াতে ইদানীং আমার বর্ণ বিপর্যয় শুরু হয়েছে।
নিজের বই পত্র রানীর ভালো লাগে না। ওর নজর সানাই দিদির বই পত্রের দিকে। দিদি যখন পড়ে, ও দিদির দিকে নজর রাখে। মাঝে মাঝেই উঠে এসে নালিশ করে, ‘বাবা, দিদি পড়তে পড়তে নাক খুঁটছে, পেট চুলকাচ্ছে।'
ইদানীং ও কয়েকটি গুরু গম্ভীর বাংলা শব্দ শিখেছে। মাঝে মাঝেই প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে।
আমি বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, পেছন থেকে রানী এসে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপর ফ্লাশ টানার শব্দ। বললাম, 'কিরে, কি হল?’
ও বলল, 'একটু আগে পটিতে গেছিলাম, জলাঞ্জলি দিতে ভুলে গেছি।'
ক অক্ষর গো মাংস হলেও রানীর প্রতিভা কিন্তু কম নয়। লক ডাউনের আগে ওকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সুইমিংপুলে বাচ্চারা সাঁতার কাটছিল, বসে বসে তাই দেখছিলাম। ঘটি গরম ঘন ঘন ঘন্টা বাজাচ্ছে। রানী বলল, ‘বাবা, ঘটি গরম খাব।'
পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, মানিব্যাগ বাড়িতে ফেলে এসেছি। বললাম, 'পকেটে নেই মানিব্যাগ।'
রানী গম্ভীর মুখে বলল, 'বসে বসে তবে পানি দ্যাখ।'
ওর সবচেয়ে পছন্দ দিদির বইয়ের সমার্থক শব্দ। একেকটা শব্দের দুটো তিনটে করে সমার্থক শব্দ মুখস্থ করেছে। তাই দিয়ে মাঝে মাঝেই আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
লকডাউনের বাজারে চেম্বার করতে বেরোচ্ছি, বলল, 'বাবা, ফেরার সময় গন্ডার নিয়ে এস। আমি খাব।'
গন্ডার!! গন্ডার কোথায় পাব? বললাম, 'গন্ডার খাবি কিরে। হেব্বি মোটা চামড়া। দাঁতই ফোটাতে পারবি না।'
বলতেই ঘ্যাঁক করে আমায় কামড়ে দিল। বলল, 'এই দেখো বাবা, আমার দাঁতে কি জোর।'
আমি কামড়ের জায়গায় হাত বোলাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করছিল এক চড়ে রানীর দুধের দাঁতগুলো ফেলে দিতে।
কিন্তু রানীর ঠাকুর্দা উপস্থিত। ওকে চড় কষালে আমাকে দ্বিগুণ সিক্কার চড় খেতে হবে।
রানী হাসি মুখে জানাল, 'এই দাঁত দিয়েই আমি খোসা ছাড়িয়ে গন্ডার খাব। কালকেও খেয়েছি।'
আমি বললাম, 'বাবার মতো গুরুজনের সাথে মস্করা হচ্ছে।'
'মস্করা নয়। দাড়াও দেখাচ্ছি।' ও একটা আখ নিয়ে এসে দেখাল।
আমি বললাম, 'এতো আখ!'
রানী বলল, 'হ্যাঁ। আখ, ইক্ষু, গন্ডার...'
সানাই পাশেই ছিল। বলল, 'গন্ডার নয় মূর্খ, ওটা গেন্ডারি।'
অল্প বয়সে মাথায় বেশি চাপ নেওয়ায় ইদানিং রানী কথা বার্তাতেও গণ্ডগোল করে ফেলছে। পাড়ায় তপন'দার মুদির দোকান। লক ডাউনের সময় পাড়ার লোকের ভরসা।
রানী মাঝে মাঝেই তপন নামটা গোলাচ্ছে। কখনও বলছে দিবাকর জেঠুর দোকান, কখনও বলছে ভাস্কর জেঠুর দোকান।
বর্তমানে ওর প্রিয় খেলা সব কিছুর মধ্যে জল ভরে রাখা। সবকটা হ্যান্ড ওয়াশের ঢাকনা খুলে যেটুকু জায়গা ফাঁকা আছে, জল ভরেছে। টুথ পেস্টের টিউবেও জল ভরেছে।
যে ঠাকুর্দা রানীকে কেউ বকলে তার সাথে তিন দিন কথা বলত না, সেই ঠাকুর্দাও আজকে রানীর উপর ক্ষেপে গেছে। রানী আটার কৌটো জলে ভর্তি করে রেখেছে।
বকা খেয়ে রানী বিবেকানন্দ হয়ে হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। আর বিড়বিড় করছে, 'ফটিক জল, ফটিক জল, ফটিক জল, ফটিক জল....'
ফটিক জলের কেসটা কি আমি জানি না। সানাই হয়তো বলতে পারবে।
এতো কিছু সত্ত্বেও রানীকে আমার বড্ড ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন ও ঘুমিয়ে পড়ে।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৪২
সেলিব্রিটি
সেলিব্রিটি না হলে খবরে আসা যায় না। সারা জীবন খবর শুনেই কাটিয়ে দিতে হয়। নেতা-মন্ত্রী, ফিল্ম আর্টিস্ট, খেলোয়াড়দের বাণী সহ খবরের কাগজে পাতা জোড়া ছবি বেরোয়। আমরা মনোযোগ দিয়ে সেই খবর পড়ি।
যখন খবরের অভাব ঘটে তখন সাধারণ মানুষকেও সেলিব্রিটি করার চেষ্টা হয়। তবে তার জন্য সাধারণ মানুষদের বড় বেশি মূল্য দিতে হয়।
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হলে সর্বভারতীয় খবর হয়। তবে তা দিন দুয়েকের জন্য।
একজন অভিনেতার আত্মহত্যার ঘটনায় ঘন্টার পর ঘন্টা টিভিতে আলোচনা চলে। সঞ্চালক নিজেই রীতিমতো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে আঠাশ জন কৃষক আত্মহত্যা করলেও তাঁদের পরিবার ছাড়া কেউই চোখের জল ফেলেন না।
তবে ইদানিং আমাদের মতো অতি সাধারণ চিকিৎসকদেরও মাঝারি মাপের সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সৌজন্যে করোনা মহামারী ও ফেসবুক।
লকডাউনের মরশুমে রোগীর চাপ কম থাকায় নিয়মিত 'করোনার দিনগুলি' লিখছিলাম। কোনো কোনো লেখা হাজারখানেক লাইক পাচ্ছিল। দুশো- তিনশো শেয়ার। ফেসবুকের ছোটখাটো সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছিলাম। সরকার হঠাৎ করে লকডাউন তুলে নেওয়ায় রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। লেখালেখি মাথায় উঠেছে।
আজ থেকে কয়েক বছর আগে হলেও পুরো বিষয়টাকে বেশ উপভোগ করতে পারতাম। ইনবক্সে অনেক অচেনা মানুষ মহামারীর সাথে লড়াইয়ের জন্য এই পাতি চিকিৎসককে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বয়সটা বছর দশেক কম হলে হয়তো এই অভিনন্দনে খুশিই হতাম।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু ঠেকে শিখেছি। সেসব প্রকাশ করে অস্বস্তির কারণ হতে চাইনা। তবে প্রশংসায় যে গলে যেতে নেই, এটাই সেই শিক্ষার মধ্যে প্রধান শিক্ষা।
আর কিসের লড়াই। আমি রোগী দেখছি যথেষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে এবং পয়সার বিনিময়ে। এই লকডাউন আমার অর্থনৈতিক অবস্থার উপর আদৌ বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বরঞ্চ বহু মানুষ কোনো রকম প্রতিরক্ষা ছাড়াই সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য মহামারীর সময়েও মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন। চিরকাল সোনার কাজ করা যুবক সাইকেলে আলু, পেঁয়াজ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করেছেন। যিনি পাড়ায় পাড়ায় মাছ বিক্রি করছেন, তাঁর মাছ কাটার মরিয়া চেষ্টা দেখে বোঝা গেছে তিনি এ ব্যাপারে এখনো শিক্ষানবিশ।
প্রতিদিনই শূন্য দৃষ্টি নিয়ে একাধিক মানুষ বাড়ি এসে বলেছেন, 'কোন কাজ আছে? যে কোন কাজ। যা ইচ্ছে দেবেন।'
লকডাউন ওঠার পরও মানুষের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। সাইকেলে করেই বহু মানুষ রোজ কলকাতা যাচ্ছেন। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রতিদিন পঞ্চাশ কিলোমিটার সাইকেল চালাচ্ছেন।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের নাইট ডিউটি। নিজেকে বঞ্চিতের, হতভাগ্যের দলে মনে করে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলাম।
মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগী কম। এমারজেন্সিতে গিয়ে ইন্টার্নদের সাথে গল্প করছিলাম। গল্পের বিষয়বস্তু বারবার ঘুরে যাচ্ছিল ডাক্তার হওয়ার কুফলগুলির দিকে। অষ্টমীর রাত্রে কলকাতার রাস্তায় জন সমুদ্র। আর আমরা গুটিকতক লোক প্রিয়জনদের থেকে দূরে হাসপাতাল সামলাচ্ছি।
আমার দুঃখ আরও বেশি। কারণ দশমীতে রোটেশনাল এডমিশন ডে। সেদিনও হাসপাতালে কাটবে।
একজন বলল, 'এর থেকে স্কুল শিক্ষক বা অফিসের কেরানি হলে ভালো হতো। অন্তত লাইফ বলে কিছু থাকতো।'
গল্পে গল্পে রাত দেড়টা বেজে গেছে। একটি বছর-দশেকের ছেলে এমার্জেন্সিতে ঢুকলো। সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক লোক।
মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি বললেন, 'ডাক্তারবাবু, একে একটু দেখে দিন। গরম জল পড়ে পা পুড়ে গেছে।'
দেখলাম ডান পায়ে বড় বড় ফোস্কা। ধূলি ধূসরিত খালি পা। বললাম, 'গরম জল পড়ল কি করে?'
'আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার চায়ের দোকান। ওখানে পুজোর সময়ে ভিড় সামলানোর জন্য নিয়েছি। কিন্তু এমন ক্যাবলা ছেলে জানবো কি করে?’
'আপনি এইটুকু বাচ্চাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন?'
লোকটি বিরক্ত ভাবে বললেন, 'করাতে চাইনি ডাক্তারবাবু। কিন্তু ওর বাপ এসে এমন ভাবে ধরলো! মুর্শিদাবাদে বাড়ি। বাপটা কলেজ স্কোয়ারের পুজোর ঢাক বাজাতে এসেছে। ছেলেকে নিয়ে এসেছে সঙ্গে। হাতে পায়ে ধরে পাঁচ দিনের জন্য দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে।'
'কখন পুড়েছে?’
'হয়েছে তো সন্ধ্যায়। কিন্তু তখন এতো ভিড়, আসবো কি করে! দোকানে একটু ভিড় কমতেই নিয়ে এসেছি।'
এমার্জেন্সির আলমারি থেকে সিলভার এক্স আর একটা নরমাল স্যালাইন এর বোতল বের করলাম। নিজেই ড্রেসিং করতে শুরু করলাম। কিছুটা সময় কাটবে।
ছেলেটি কাঁদছে। মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি বললেন, 'কাঁদিস নে। তোকে আমি গ্যাস বেলুন কিনে দেবো।'
এভাবে গ্যাস বেলুনের লোভ দেখিয়ে কত কান্না যে বন্ধ করা হয়েছে জানিনা। শুধু এটুকু জানি গ্যাস বেলুন সামান্য আঘাতেই ফাটতে সময় লাগে না। আর এটাও জানি আমরা ডাক্তাররাও পুরোপুরি সেলিব্রিটি না হলেও আধা সেলিব্রিটি।
তবে অধিকাংশ মানুষ যারা সেলিব্রিটি নন, তাদের মহামারী নেই। লকডাউন নেই। পুজো নেই। মৃত্যুভয় নেই। আছে শুধু জীবন যুদ্ধ।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৪৩
ওষ্ঠে নিঃসরে ভাষ
টিভিতে অখাদ্য সিরিয়াল দেখার সময় লোকজনের ধৈর্যের অভাব দেখা যায় না। ধৈর্যের অভাব ঘটে ডাক্তারের চেম্বারে এলেই।
রোজকার মতোই চেম্বার চলছে। বাইরে সঞ্জয়দার সাথে রোগীদের বাক্য বিনিময়ের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমি ঘাড় গুঁজে ঝটপট রোগী দেখছি। এটাই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
একজন মহিলা মাস্ক পরে আসেন নি। সঞ্জয়দা নাক মুখ ঢাকতে বলায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকেছেন। সঞ্জয়দা প্রতিবাদ করায় তিনি রীতিমতো ঝগড়া শুরু করেছেন। তাঁর বক্তব্য, তার জ্বর কাশি কিছুই নেই। কোমরে ব্যথা। ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলেই যথেষ্ট।
সঞ্জয়দা ছাড়ার পাত্র নয়। তার বক্তব্য, 'আপনার ওই মশারীর মতো ওড়নার ফুটো দিয়ে মশাও গলে যাবে। ভাইরাস তো নাচতে নাচতে ঢুকবে।'
একটি বছর পনেরোর মেয়ে বাবা- মায়ের সাথে ঘরে ঢুকল। বাবা- মায়ের বয়স প্রায় আমারই মতো। কলম বাগিয়ে বললাম, 'কি হয়েছে বলুন।'
মেয়েটি যেন পাকা গিন্নী। মাথার ঝুঁটি- টুটি নেড়ে বলল, 'আর কি হয়েছে! দিয়েছে বাইকে গুঁতো।'
বুঝলাম ওর মা গুঁতোটা খেয়েছেন। কারণ তিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢুকেছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, 'কোথায় লেগেছে?'
মহিলা ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটির ঝুঁটি আবার নড়ল। বলল, 'মাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই ডাক্তারবাবু। মা- বাবা কেউ কানেও শোনেনা। কথাও বলতে পারে না।'
তারপর মেয়েটি হাত পা নেড়ে মাকে বুঝিয়ে দিল। মহিলা কোমরে হাত দিয়ে ব্যথার ভঙ্গি করলেন।
মেয়েটি বলল, 'মাকে এতো বলি, তবু রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটবে। গাড়ির হর্ণ শুনতে পায় না। মাঝে মাঝেই গুঁতো খায়। আগে তবু লোকজনের ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝতে পারতো। বাজার ঘাট সবই করতো। এখন সবার মুখই মাস্কে ঢাকা।'
ইতস্তত করে মাস্ক নামালাম। রোগীর সাথে সরাসরি সংযোগ না করতে পারলে রোগী দেখা মুশকিল।
মহিলার চোখ উজ্জ্বল হলো। তিনি একাগ্র ভাবে চেয়ে রইলেন আমার ঠোঁটের দিকে।
এরপর আর সমস্যা হয়নি। ওনারা দিব্যি আমার কথা বুঝতে পারলেন। আমিও বুঝতে পারলাম ওনাদের সমস্যা।
ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করেন। বেশ কিছুদিন আগে আমাকে দেখিয়ে গেছিলেন। ডায়াবেটিস আছে। এখন ভালো আছেন।
মেয়েটি বলল, 'বাবাকে মনে না করিয়ে দিলে ওষুধ খেতে ভুলে যায়। দুপুরের ওষুধ অফিসে থাকলে আমি ভিডিও কল করে মনে করিয়ে দিই।'
যাওয়ার সময় মেয়েটি বলল, 'মহামারীতে মা বাবার খুব সমস্যা হচ্ছে। সকলেই মাস্ক পরে থাকায় কারো কথাই বুঝতে পারছে না। সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে বাবার অফিসে। বাবা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। এই ঝামেলা যে কবে কাটবে? আমি অনেক বোঝাচ্ছি।'
মহিলা আমার হাতে একটা চিরকুট দিলেন। “ডাক্তারবাবু, মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন। ও যেন আপনার মতো চিকিৎসক হতে পারে।”
চিকিৎসক হওয়ার কুফল নিয়ে অনেক কিছু বলার ছিল। সেসব কিছুই বলতে পারলাম না। মাস্কটা নিচে নামিয়ে বললাম, 'নিশ্চয়ই ডাক্তার হবে। অনেক বড়ো হৃদয়বান ডাক্তার।'
একটাই আক্ষেপ রইলো। ওই পাকা বুড়ির ঝুঁটিটা নেড়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। করোনা ভাইরাসের ভয়ে পারলাম না। উফ- এই করোনা যে কবে বিদায় নেবে!
রানীর গল্পে এই কঠিন সময়েও মনটা খুব খুশী হয়ে উঠেছিল। শেষে সেই চোখের জলে ...
নেবে, করোনাও বিদায় নেবে, ডাক্তার ...