লাতিন আমেরিকায় পপুলিস্ট নেতাদের ছড়াছড়ি। সবথেকে দরিদ্র দেশগুলোতে বামপন্থী পপুলিস্ট রাজনীতি সমর্থন পাচ্ছে। দারিদ্র, লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ, এলিটদের মুনাফা আর বিদেশী বিনিয়োগ এই দেশগুলোর অর্থনীতিকে একরকমের কট্টর রক্ষণশীলতায় আক্রান্ত করেছে, যেখানে মানুষ খেতে না পেয়ে মরে গেলেও এলিট পরিচালিত শাসকদলের কিছু এসে যায়না। ফলে অসন্তুষ্ট মানুষ জড়ো হয়েছেন বাম দলগুলির পেছনে। ভেনেজুয়েলার শ্যাভেজের মত বলিভিয়ার হুয়ান মোরালেস, ইকুয়েডরের রাফায়েল কোর্রিয়া, নিকারাগুয়ার ড্যানিয়েল ওর্তেগা বামপন্থী পপুলিজমের পরিচিত মুখ।
এইভাবে বিভিন্ন মহাদেশ ঘুরে ঘুরে আমরা এই তালিকা আরো বাড়াতে পারি। বিশেষ করে এশিয়ায় ঢুকলে আবারো বেশি করে দক্ষিণপন্থী (বা উগ্র দক্ষিণপন্থী) নেতাদের দেখা পাওয়া যাবে। ১৯৯৭ সালে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া যে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়, তারপর থেকেই দক্ষিণপন্থার উত্থান । ভারতের নরেন্দ্র মোদি, তাইওয়ানের চেন শুই বিয়ান, থাইল্যান্ডের থাকসিন সিনাওয়াত্রা, ফিলিপিন্সের জোসেফ এস্ত্রাদা, পাকিস্তানের ইমরান খান এই তালিকায় থাকবেন। আরব দেশগুলো বা সাব সাহারার দেশগুলোতে গেলে সেখানেও কিছু নাম পাওয়া যাবে। আফ্রিকার রাজনীতির যা জটিলতা, তাতে আমরা এই অল্প পরিসরে তার কিছুমাত্র নাগাল পাবোনা। তবে এটা লক্ষনীয় যে পপুলিস্ট রাজনীতির ধরণ স্বৈরাচারী শাসনের থেকে সরে সংসদীয় রাজনীতির দিকে এসেছে। জাম্বিয়ার মাইকেল সাটা, কেনিয়ার রাইলা ওডিঙ্গা বা সেনেগালের আবদুলাই ওয়াডের রাজনীতি বুর্কিনা ফাসোর সামরিক নেতা থমাস সাঙ্কারার থেকে আলাদা। মজার ব্যাপার হলো, যে সমস্ত কারনে জনসমর্থন পপুলিস্ট নেতাদের দিকে তার মধ্যে অন্যতম হলো "dissatisfaction with democratisation, socio-economic grievances, and frustration at the inability of opposition groups to oust incumbent parties"। এর মধ্যে প্রথম আর তৃতীয় কারণ দুটো খুবই চিত্তাকর্ষক।
ইজরায়েলের নেতান্যাহু, রাশিয়ার পুতিন এদের নিয়ে আলোচনার খুব একটা অবকাশ নেই। তুরস্কের এরদোগানের মতই এঁরাও উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মুখ। রাশিয়ার মত আরো কয়েকটি দেশ আছে যারা বিশ্বরাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সব সময় যে কোন একটা খোপে আঁটিয়ে ফেলা যায় এরকমও নয়। একই ভাবে অস্ট্রেলিয়ার একাধিক নিও- নাজি দলগুলো ও তাদের নেতাদের নিয়েও নতুন করে কিছু বলার নেই -- শুধু এইটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে সরকারি তরফে সক্রিয় প্রতিরোধ থাকা সত্ত্বেও এই দলগুলো ব্যাঙের ছাতার মত গজাচ্ছে, কখনও কখনও তারা জঘন্য বর্ণবিদ্বেষমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে (চাইনিজ দোকানপাটে আগুন লাগানো, মসজিদে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে খুন)।
আমরা বরং, এই দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে, পপুলিজম কেন বিপজ্জনক সেটা বোঝার চেষ্টা করি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে পপুলিজম ব্যাপারটা মোটেই খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। হাজার হোক, গণতন্ত্রের তো উদ্দেশ্যই মানুষের কথা আরো বেশি করে তুলে আনা, তাঁদের অভাব অভিযোগ গুরুত্বসহকারে ভাবা। একরকমভাবে এলিট শাসকদলের এইসব অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ঔদাসীন্যই তো পপুলিস্ট বা তোষণের রাজনীতির কারণ। কিন্তু বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট দল বা নেতৃত্বের উত্থান এবং ঘটনাপরম্পরা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বিপদটা কোথায়। আরো স্পষ্ট হয় ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে। সেখানে একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত "How Democracies Die" বইতে স্টিভেন লেভিটস্কি এবং ড্যানিয়েল জিবলাট বলেছেন যে বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সবথেকে ভয়ের জায়গা সামরিক অভ্যুত্থান নয় (আগে যেমনটি হত), বরং অনেক বেশি বিপজ্জনক হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্বাচিত পপুলিস্ট নেতারা যাঁরা পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটাকেই ধীরে ধীরে সরিয়ে দেবেন। এই আলোচনায় প্রায় সর্বত্র হুগো শ্যাভেজের উদাহরণ টানা হয়। শ্যাভেজের শাসনকালে ভেনেজুয়েলা সরকার কুড়ি লাখ নাগরিককে ব্ল্যাকলিস্ট করে, যার অর্থ হলো ঐ লোকেরা কোন সরকারি চাকরি করতে পারবেন না। ঐ নাগরিকদের অপরাধ তাঁরা একটি পিটিশনে সই করেছিলেন যা শ্যাভেজকে সরকার চালানোর অযোগ্য মনে করেছিলো। মজার ব্যাপার হলো, শ্যাভেজের তত্ত্বাবধানেই ভেনেজুয়েলার নতুন সংবিধান লেখা হয়েছে তার আগে, যেখানে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার রূপে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু বিরুদ্ধতা পেয়েই শ্যাভেজ সরকার ঘোষণা করে ঐ নাগরিকবৃন্দ "ফ্যাশিস্ট" [5]। শ্যাভেজ অধীনস্থ রাষ্ট্র আরো বলে, যেহেতু ফ্যাশিজম সমর্থকেরা ভেনেজুয়েলার জন্য বিপজ্জনক ও অবৈধ, তাদের বেকার ও গরীব করে রেখে দেওয়ার মধ্যে কোন অন্যায় নেই [5]।
ভেনেজুয়েলার বামপন্থী সরকারের কাজের সাথে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার বা ভারতের মোদী সরকারের কর্মপন্থা মিলিয়ে দেখুন, প্রচুর মিল পাবেন। ট্রাম্প একের পর এক বিল এনে ঘোষণা করে চলেছেন মার্কিন মুলুকে থাকা কোন কোন অধিবাসী বৈধ আর কারাই বা অবৈধ, কাদের ঢুকতে দেওয়া হবে কাদের হবেনা, কাদের কাজ করতে দেওয়া হবে ইত্যাদি। প্রতিটি চূড়ান্ত অমানবিক সিদ্ধান্ত এক শ্রেণীর মানুষকে ব্রান্ডেড করছে "অবৈধ" বা " দেশের জন্য বিপজ্জনক" হিসেবে। ফলে মানবিক কি অমানবিক, যৌক্তিক কি নয় --এসব প্রশ্ন ধোপেই টিঁকছে না। বরং প্রতিবাদ করলে "এলিটিস্ট", "সোশ্যালিস্ট", বা "কমিউনিস্ট" হিসেবে দাগিয়ে দিচ্ছে জনসাধারণের একটা অংশ। মোদীর ভারতে ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুদের যাবতীয় সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে মুসলমান, দলিত, এলিট, শ্রমিক, কৃষক, ইন্টেলেকচুয়াল, আমিষাশী, কমিউনিস্ট, দেশদ্রোহী --- নানা খোপে পুরে ফেলে বলে দেওয়া গেছে - এরা দেশের জন্য বিপজ্জনক। এরা অবৈধ। ফলে রমরম করে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরী হয়েছে নির্বিঘ্নে। আরেকটু পুরোনো দিনের কথা ভাবলে দেখা যাবে স্বয়ং হিটলারের জার্মানিতেও একই পদ্ধতিতে একদল মানুষকে দেশের জন্য বিপজ্জনক বলে দেগে দেওয়া গেছিলো, এবং একবার সেটা করে ফেলার পর বাকি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে কোন অসুবিধাই হয়নি।
পপুলিজম কীভাবে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করে দিতে পারে সেটা বোঝার জন্য আমাদের পপুলিস্ট রাজনীতির আপাত উহ্য একটা দিক ভাবতে হবে। সাদা বাংলায় যাকে আজকাল "আমরা - ওরা" রাজনীতি বলি, এটা তাইই। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটা ব্যাপারও আছে। পপুলিস্ট রাজনীতি শুধু একদলকে "অপর" ও "বিপজ্জনক ও অবৈধ" হিসেবে দাগিয়েই দেয়না, এটাও ঘোষণা করে যে "ওদের" পক্ষে কখনও "আমাদের মত" হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এও বলে দেয় যে "ওরা পাল্টে গিয়ে আমাদের মত হোক"-- এ আমরা চাইনা। ফলে দুটো জিনিস হয়। এক, ঐ লোকগুলোর দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দুই, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটাকেও আক্রমণ করে ফেলা হয়। পরবর্তীকালে যখন একই অজুহাতে একের পর এক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হবে ---কিছুই বলার থাকবেনা। এই একই ধরণের যুক্তি আমরা বিজেপি নেতৃত্ব ও সমর্থকদের মুখে শুনি, যখন তাঁরা রাহুল গান্ধীকে নির্বাচনের আগেই "নেতা হওয়ার অযোগ্য" বলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতারা তাঁদের বিপক্ষকে বিভিন্ন সময়ে "মহিলা" "সমকামী" "সোশ্যালিস্ট" এইসব অজুহাতে "রাষ্ট্রপতি পদের অযোগ্য" বলে আক্রমণ করেছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো, সমস্ত পপুলিস্ট সরকারই কি এক সময় স্বৈরতন্ত্রের দিকে চলে যাবে? উত্তর হলো, না। গণতন্ত্রের কিছু নিজস্ব আভ্যন্তরীন শক্তি আছে। এক কথায় বলতে গেলে তাকে আমরা রাজনৈতিক সহনশীলতা বলতে পারি। বিরোধীপক্ষকে বৈধ রাজনৈতিক শক্তি বলে মেনে নেওয়া তার উদাহরণ। কিন্তু এই সহনশীলতা রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। সরকারে থাকা দল তার ভান্ডারের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে ফেলবে কিনা সেটা তাদের নিজেদের ওপরেই অনেকটা নির্ভর করে। এবং বিপদটা এখানেই। পপুলিস্ট নেতারা অধিকাংশ সময়েই প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির অচলায়তন ভাঙার জন্যই উঠে আসেন। সহনশীলতার শেষ সীমায় পৌঁছে, হয়ত বা অসহ্য হয়ে গিয়েই মানুষ তাঁদের সমর্থন করে ফেলেন। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির এই অলিখিত নিয়ম পপুলিস্ট নেতাদের মানার দায় নেই। সরকারে এসেই তাই তাঁরা বিপক্ষকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেন --ক্ষেত্রবিশেষে সফল হন (হালের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গোটা ভারত), ক্ষেত্রবিশেষে গণতান্ত্রিক কাঠামো তাঁদের কিছুটা প্রতিহত করেন (হালের ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি বিতর্ক)। সময় থাকতে তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দায় থাকে গণতন্ত্রকে বেলাইন করার পপুলিস্ট আয়োজন যাতে প্রতিহত করা যায়।
উগ্র দক্ষিণপন্থার আলোচনা থেকে আমরা এখন যেখানে এসে পড়েছি সেই পপুলিজমের কোন ডান বা বাম হয়না। এ একরকম আইডেন্টিটি পলিটিক্স। এখানে সাদা কালোয় বিভাজিত দুটি যুযুধান দল, যারা ক্রমশই একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে করতে দূরে সরে যাবে। অর্থনৈতিক সংকটের জন্য আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণগুলোর থেকেও মানুষ নিজের "পার্সেপশন" কে গুরুত্ব দেবে। ফলে দাঙ্গা হবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বাড়বে, এবং দিনের শেষে যাকে বলে "প্রিভিলেজড ক্লাস" তাদের কিছুই এসে যাবেনা, কারণ পয়সার বিনিময়ে অনেক কিছুই কিনে ফেলা যাবে। অন্যদিকে যে অসহায় মানুষ বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে "অন্যরকম লোক" কে ডেকে এনে সিংহাসনে বসাবেন তাঁরা আরোই মরতে থাকবেন। কোভিডে, আমফানে, বন্যায়, নোটবন্দীতে, চিটফান্ডে --- মরতে থাকা মানুষদের অনেকেই নিশ্চয়ই টিএমসি বা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন যাতে তাঁদের জীবন আরেকটু ভালো হয়। হয়নি। তাই মমতা ব্যানার্জ্জির "পরিবর্তনের সরকার", নরেন্দ্র মোদীর "শক্তিশালী হিন্দুরাষ্ট্র", ডোনাল্ড ট্রাম্পের "অ্যামেরিকা ফার্স্ট" সরকার বা হুগো শ্যাভেজের "অন্যরকম বামপন্থী নীতি" কে সমর্থন করার আগে আমাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতি এবং সেখান থেকে তৈরী পপুলিজম নিয়ে সতর্ক হওয়ার দরকার আছে।
বিশ্লেষণে কোন নতুন দৃষ্টিকোণ পাচ্ছি না। খারাপ-ভালর বিবরণ পাচ্ছি। মোটামুটি গতে বাঁধা লেখা।
'সে' আবার এসেছে ফিরিয়া, এবার পাঠক অবতারে ;)