আগের পর্বেই লিখেছিলাম যে বারাণসী আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক ইমারতগুলোর মধ্যে জ্ঞানবাপি দেখে নেওয়া, যেহেতু তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিশ্বনাথ মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে আগ্রহ ছিল, কিন্তু পুজোর ঘটা, পান্ডা ও পুরোহিতদের দৌরাত্ম্য - এইসব দেখে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করেনি, কাঁহাতক আর মিথ্যে কথা বলা যায়!
কিন্তু জ্ঞানবাপি নিয়ে সেসব অসুবিধা হওয়ার কথা না। এর আগে আমরা চুনার দুর্গ দেখতে যাওয়ার পথে অনামি পুরোনো মন্দির দেখে ঢুকে পড়েছি, থাম ও খিলানের কারুকার্য দেখে আশ্চর্য হয়েছি এবং ভগ্নদশা দেখে কষ্ট হয়েছে। চুনার দুর্গের কাছেই হজরত কাসিম শাহ সুলেমানি বলে এক সুফিসাধকের দরগা আছে, যেখানে ধর্মনির্বিশেষে মানুষ জমা হয়ে থাকে বলে পড়েছিলাম। এইরকম রাস্তার ধারে ধারে হঠাৎ পাওয়া বা ম্যাপ দেখে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে যেসব জায়গায় যাওয়া হল, কোথাও কোনো অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়নি। চুনার দুর্গে দেখলাম একটা অংশকে মন্দির বানিয়ে ফেলা হয়েছে, স্পষ্টই খুবই সাম্প্রতিক নির্মাণ। উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যর বড়োভাই ভর্তৃহরি নাকি ওই অংশে থাকতেন। বলাবাহুল্য এটি একটি কিংবদন্তি, এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। যাই হোক, কিংবদন্তি নির্ভর সেই ‘মন্দির’-এ ঢুকে দেখে আসা গেল সেখানে কী হচ্ছে। কমলা সিঁদুরের প্রলেপ দেওয়া দেবদেবীর ছবি (ক্যালেন্ডারে যেমন থাকে), জরিওয়ালা কাপড়ের টুকরো, একটা পলিথিনের মতো জিনিসে ভর্তৃহরির নাম ও তিনি যে সেখানেই থাকতেন সেকথা টাঙিয়ে দেওয়া আছে। যাই হোক, খানিকটা জোর করে ভর্তৃহরির গুহা এবং সমাধি দেখতে হলেও মন্দিরের যে দুজন সেবক, তাদের আচরণে কোনোরকম অপ্রীতিকর কিছু পাইনি। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এতগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পীঠস্থান, ভক্তি-আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো - সব মিলিয়ে খুবই শান্তিপূর্ণ, ঘটনাবিহীন কেটে গেল মাঝে খানিকটা সময়। উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে যন্তরমন্তরে গিয়ে দেখলাম মিউজিয়ামের নামে জঘন্য একটা ব্যাপার খোলা হয়েছে। সেখানে গঙ্গা নিয়ে একটা নিরন্তর চলা ডিসপ্লেতে পৌরাণিক কাহিনির পিণ্ডি পাকিয়ে, কতগুলো লোককে খেলনার মতো পোশাক ও প্রপ দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছে। আরও একতলা উঠলে একটা ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ নামে প্রহসন পাওয়া যায়। চলতে শুরু করার পর বোঝা গেল সেও ওই একই জিনিস, বেরিয়ে যেতে হল। এই নতুন সার্কাসগুলি বর্তমান কেন্দ্র সরকারের কীর্তি, অন্তত প্রবেশপথের ফ্লেক্স সেই কথাই বলে।
এবার জ্ঞানবাপি যাওয়ার দিন কী হল বলি। গুগল ম্যাপ দেখেই এতদিন আমরা সমস্ত জায়গা চলে যেতে পারছিলাম। বিশেষ করে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় এমন জায়গাগুলো দিব্যি খুঁজে নেওয়া যাচ্ছিল ম্যাপ দেখেই। প্রথম আটকানো জ্ঞানবাপি যাওয়ার দিন। বিশ্বনাথের মন্দিরের একেবারে পেছনেই জ্ঞানবাপি। কাজেই জায়গাটা খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যাপারটা বেশ জটিল। ম্যাপ ধরে একটা করে গলিতে ঢুকি, তারপর কিছুদূর এগিয়েই দেখি সেটি ব্যারিকেড, কারণ কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। প্রথম দু-একবার এরকম হওয়ার পর আমরা একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি একটু অদ্ভুত ভাবে তাকালেন, তারপর বললেন, রাস্তার বন্ধ আছে, ঘুরে যেতে হবে। হোটেলের ছেলেটির মতো তিনিও একটা জটিল পথনির্দেশ দিলেন। সেই পথও গিয়ে মিলে গেল আর-একটি চট-ঢাকা বাড়ি, লোহার ব্যারিকেডে, সামনে পাহারাওয়ালা। অগত্যা পাহারাওয়ালাকেই জিজ্ঞেস করতে হল। সেই খাকি উর্দি আমাদের বেশ করে মেপে নিয়ে উলটে প্রশ্ন করলেন মসজিদে কেন যেতে চাই? দেখতে যেতে চাই বলায় বললেন ওখানে কিছু নেই। তারপর, কেন, মন্দির যাবেন? পুজো দেবেন তো, ওইদিক দিয়ে চলে যান বিশ্বনাথ মন্দির। তারপর একটু থেমে বললেন, ওই একই রাস্তার দিয়েই জ্ঞানবাপিও যাওয়া যাবে।
এইবারের নির্দেশিকা আগেরগুলোর থেকে ভালো ছিল। আমরা এ-গলি সে-গলি করে হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি বিশ্বনাথ মন্দিরের পেছন দিকটায় চলে এসেছি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জ্ঞানবাপি এবং বিশ্বনাথ মন্দির গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। মসজিদের দিকটায় কড়া নিরাপত্তা, রীতিমতো বাংকার বানিয়ে এ কে ফর্টিসেভেন নিয়ে পাহারা। মোবাইল বের করে একটা ছবি তোলার উপক্রম করতেই রে রে করে তেড়ে এল। এসেই জিজ্ঞাসাবাদ, ওখানে কী করছি ইত্যাদি। তারপর ট্যুরিস্ট শুনে একটু নরম হয়ে মন্দিরের দিকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। বুঝলাম রাস্তাটা পথ চলাচলের জন্য খুলে রাখতে হয়েছে, ওখানে দাঁড়িয়ে বিতর্কিত ইমারতের শোভা দেখার জন্য না। একটু চোখ চালিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলাম অমুক তারিখ থেকে সেখানেও কনস্ট্রাকশন বা ডিকস্ট্রাকশন যাই বলুন, শুরু হতে চলেছে, এবং অনতিবিলম্বেই ওই গলিটাও ব্যারিকেড করে দেওয়া হবে।
এরপর আমরা আর সোজাসুজি পথনির্দেশ জানতে চাইনি জ্ঞানবাপির। এক হাতে-টানা রিকশাওয়ালার কাছ থেকে কোথায় পরাঠেওয়ালা গলি পড়বে জেনে নিয়ে, তারপর বিশ্বনাথ মন্দিরের কত নম্বর একটা গেট মসজিদের প্রবেশপথের কাছে সেটা আন্দাজ করে করে শেষে একসময় একটা বড়ো মোড় এসে যায়, সামনেই দেখতে পাওয়া যায় জ্ঞানবাপি, পাশেই মন্দিরও দেখা যায়। মসজিদ ঘিরে সেন্ট্রি টাওয়ার বসেছে, পুলিশ/সিপাহি-ব্যারাকও হয়েছে। মোড় থেকেই বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার লোহার রেলিং-ঘেরা হাঁটার রাস্তা, লোকে ডালি-ফালি নিয়ে লাইন দিয়ে চলেছে। এদিকে একইরকম আরও একটা রাস্তার মসজিদে ঢোকার মুখে, যদিও সেখানে কেউ নেই। পাশে কয়েকজন পুলিশ জটলা করছে। পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তাই হেলতে দুলতে ওই রেলিং-ঘেরা জায়গাটা দিয়ে চলতে শুরু করলাম। কয়েকপা এগোতেই জটলাকারী পুলিশের দল ছুটে এসে জেরা শুরু করে দিল। ততক্ষণে বেশ রাগ হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন এসবের উত্তরে বললাম আর্কিওলজিকাল সাইট, তাই দেখতে এসেছি। খুব বিশ্রীরকম সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে, যাওয়ার নিয়ম নেই, বলে ভাগিয়ে দিল ওখান থেকে আমাদের। চলে আসছি, এমন সময় মন্দিরের প্রবেশপথে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ধরলেন। তাঁর ধারণা হয়েছে আমরা মন্দিরের রাস্তার ভেবে মসজিদে ঢুকে যাচ্ছিলাম। ওই যে ওখানে ডালা পাওয়া যাচ্ছে, এখান দিয়ে চলে যান, কাছেই—এইসব বললেন। মসজিদটা তো আর্কিওলজিকাল সাইট, বন্ধ কেন জিজ্ঞেস করায় বলেন, “কন্ট্রোভার্সি হ্যায়, ইস লিয়ে সরকার বনধ করকে রকখা হ্যায়।”
কাজেই দূর থেকে দেখতে হল জ্ঞানবাপির অবয়ব। যে জলের কুয়োর নামে জ্ঞানবাপি, প্রাচীন মন্দিরের যে অপূর্ব কারুকার্য করা থাম আর ভিতের অংশ মসজিদের একটা অংশে এখনও দেখতে পাওয়া যায় - সেসব এবং আরও হয়তো অনেক কিছুই না দেখে ফিরে আসতে হল। ফেরার পথে একটা টোটোরিকশা ধরলাম। চালকের সঙ্গে কথোপথনে জানা গেল আদিত্যনাথের রাজ্যসরকার বিশ্বনাথের মন্দিরসংলগ্ন এলাকা জুড়ে পর্যটন করিডোর তৈরি করতে চায়। তাই বহু পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, ইতিমধ্যেই অনেকখানি জায়গা খালি হয়েছে, আরও হচ্ছে। সেসবই আমরা গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে দেখে এসেছি। বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে নানারকম মজার হিসেব চলছে। এর ফলে কোনো না কোনো কারণে ভাঙা হচ্ছে এমন বাড়ির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই মুসলমান জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর। কখনও বাড়ির ‘কন্ডিশন খারাপ’, কখনও ‘বিতর্কিত জমির নৈকট্য’ কারণ হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। এর আগে একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম যে বাবরি মসজিদের মতোই ছক কষে জ্ঞানবাপি নিয়ে পরিকল্পনা চলছে1। আর-একটি প্রতিবেদনে এই কাশীবিশ্বনাথ করিডোর নিয়ে বেরিয়েছিল2:
‘Cut to 2018: Modi launched the Kashi Vishwanath corridor, a pet project that will cost the government Rs 600 crore ($84 million) to build a pathway from the temple premises to the banks of the Ganga, which flows through the city and is held sacred in Hinduism. Most of the buildings surrounding the temple and the mosque have been demolished by official order, creating a fear among Muslims that the mosque is now vulnerable.
“Before the Babri masjid was demolished, the area around it was cleared. Everything around it was brought down till the mosque stood alone and exposed. And because the area was cleared, it meant that lakhs could gather. They did, and eventually demolished the (Babri) mosque,” Sayid Yasin, general secretary of the Gyanvapi mosque’s caretaker body told The Wire in March this year.’
জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বহুদিনের বিতর্ক আছে। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব স্থানীয় বিদ্রোহী জমিদারদের জব্দ করার জন্য একটা হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। কেউ কেউ বলেন, ওই মন্দিরটিই নাকি আদি বিশ্বনাথ মন্দির ছিল। বিশ্বহিন্দুপরিষদের মাঠে নামারও আগে থেকেই এই নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে। এই মন্দির-মসজিদ বিতর্ক এইমুহূর্তে খুবই সরু সুতোয় দাঁড়িয়ে। যাইহোক, সেই ইতিহাসের বিস্তৃত বিবরণ এখানে প্রয়োজন নেই, অন্য কোনো লেখায় সেসব খুঁড়ে দেখা যেতে পারে।
জ্ঞানবাপি থেকে ফেরার পথে হোটেলের সেই ছেলেটির কথাগুলো আবার মনে করার চেষ্টা করলাম। ওর নাম নীরজ, ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছে। ঠিক ছিল ফিরে এসে মদনপুরার দিকে যাব, সেখানে তাঁতিদের কাজ দেখব।
যথারীতি নীরজের সঙ্গে আমরা হেঁটে রওনা হলাম। যেতে যেতে নানারকম টুকটাক কথা হচ্ছিল। বলল ওর বাড়ি থেকে যে-কোনো কাজে বড়ো শহর আসতে হলে ইউপিতেই আসতে হয়, তাই একেবারে কাজ খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। বাড়ি থেকে লোকজন এলে সুবিধে হয়।
দেখতে দেখতে মদনপুরা চলে এল। সারি সারি শাড়ির দোকান, হোলসেলারই বেশি। একটা মাঝারিমাপের গলির দিকে ইশারা করে নীরজ আমাদের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলল, ওটা মুসলমান মহল্লা তা আমরা যেন সাবধানে চলি। কী সাবধানতা দরকার সেসব জিজ্ঞেস করে একটা এড়িয়ে যাওয়া উত্তর পেলাম। অদ্ভুত লাগছিল, কারণ এই পাড়া নীরজের অচেনা নয়। যে রাস্তার দিয়ে আমরা যাচ্ছি, সেখানকার দুপাশের দোকানপাট যাঁদের, তাঁরা ব্যাবসায়িক সূত্রেই নীরজের হোটেলের সঙ্গে জড়িত অনেকদিন। ট্যুরিস্ট এলে, বেনারসি শাড়ি কিনতে হলে ওঁদের এখানেই আনা হয়। কেউ যদি দেখতে চায় কীভাবে এইসব শাড়ি বানানো হয়, তাহলে যে কারিগরদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের সঙ্গে, সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নীরজের হোটেলের সম্পর্ক গভীর।
কিন্তু তবু নীরজ এদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকে সাবধান করে দিচ্ছে, যেন আমরা কোনো বিপজ্জনক এলাকায় ঢুকে পড়ছি।
দোকানের গিয়ে জানা গেল সেদিন ওঁদের এক আত্মীয় মারা গেছেন, তাই সেদিন ব্যাবসা একরকম বন্ধ। ফেরার পথে নীরজের সঙ্গে গল্প জুড়লাম।
—তুমি ঝাড়খণ্ড থেকে এখানে এসেছ কতদিন হল?
-—ছ-সাত বছর হল।
—বাড়ির লোক কি এখানে, না ঝাড়খণ্ডে?
—ওখানেই, এখানে কোথায় থাকবে?
—তুমি ছুটি নিয়ে যাও?
—আমি যাই কম। হোটেলের কাজ থাকে। ওরাই আসে মাঝে মাঝে। কাশী হাসপাতালে দেখাতে আসে, আরও নানা কাজে আসে। হাজারিবাগ দূর পড়ে যায়, তাই কাশী আসে। একেবারে দেখাও করে যায়।
ততক্ষণে আমরা ঢুকে পড়েছি বাঙালিটোলার গলির মধ্যে, ডানদিকে মুসলমান কারিগরদের সার সার দোকান চলছে, দরজির দোকান, ফার্নিচার আর হরেক ব্যাবসা, ঠিক যেমন তার আগেই হিন্দুদের পর পর দোকান গেছে পান, মিষ্টির, জেরক্সের। এইখান দিয়ে যেতে যেতে নীরজ হঠাৎ নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করল।
—এইসব জায়গা দিয়ে আজানের সময় যদি যান, মনে হবে পাকিস্তানে চলে এসেছেন।
—তাই?
—হ্যাঁ।
বলেই নীরজ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসল।
বুঝলাম নীরজ এখন বেশ সহজ হয়ে এসেছে, কথা বলবে। এরপর যা কথাবার্তা হল সেগুলো এরকম:
—এখন কাশীর অবস্থা কেমন? কদিন আগে ঝামেলা হল না?
—আরে ও কিছু না। সেরকম কিছু হয়নি।
—আমরা যখন আসছিলাম, অনেকে বারণ করছিল। আপনাদের হোটেলে কি বুকিং ক্যানসেল হয়েছে?
—হ্যাঁ। লোকে বোঝে না। বেকার ভয় খায়। কিছু অশিক্ষিত লোক বেরিয়েছিলো প্রোটেস্ট করতে। শিক্ষিতরা কেউ যায়নি। পুলিশ গিয়ে পিটিয়ে সব শান্ত করে দিয়েছে।
—আচ্ছা? আর কেউ বেরোয়নি?
—না। বললাম না, পিটিয়ে দিয়েছে। তারপর যোগীজির লোক সিসি টিভি ক্যামেরা থেকে ছবি বের করে পোস্টারে ছেপে দিয়েছে। পুলিশ ওয়ারেন্ট বের করেছে।
—আচ্ছা? তারপর?
—তারপর আর কী? এখন তো সবার ফোটো আইডি আছে। একটু খুঁজে খুঁজে ওদের যে যেখানে চাকরি করে বা পড়ে সেখানে চলে গেছে। অ্যারেস্ট করেছে। সরকারি সম্পত্তি যা নষ্ট হয়েছে সব এখন ওদের থেকে নেবে।
—অনেক সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে?
—তা জানি না। তবে ১-৫ লাখ টাকা নেবে বলেছে যাদের আইডেন্টিফাই করেছে তাদের থেকে।
—আপনাদের এখান থেকে তাহলে যোগীজির দলই জিতবে, না?
—হ্যাঁ বিলকুল। এত ভালো ভালো কাজ করছে, জেতারই কথা। তবে এই তো খামোখা ঝাড়খণ্ডে হেরে গেল। আজকাল অনেকসময় কিছুই বলা যায় না। তবে কাশীতে হারবে না আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি।
আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি, কিন্তু নীরজ বলেই চললেন যে এতদিনে হিন্দুদের জন্য ভালো সময় এসেছে। এর আগের কোনো সরকার হিন্দুদের জন্য, জেনারেল কাস্টের জন্য কিছু করেনি। এবার তাদের ১০% সংরক্ষণ হবে।
এবার ওঁকে জ্ঞানবাপির কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এত হইচই করার কী আছে? যখন তোমাদের (মুসলমানদের) সময় ছিল তোমরা ভেঙেছিলে, নতুন জিনিস বানিয়েছিলে। এখন আমাদের সময় এসেছে এখন আমরা যা করার করব।
নীরজের সঙ্গে আমার কথোপথনের সঙ্গে খবরের কাগজের প্রতিবেদনের কোনো কোনো অংশের অদ্ভুত মিল আছে। এবং জ্ঞানবাপি ভেঙে ফেলা হতে পারে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তা যে গালগল্প না সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। আপাতশান্ত বারাণসী মূলত একটি বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছে। কারফিউ, ব্যারিকেড, গাদা গাদা পুলিশ, গেরুয়া ফেট্টি ক্যাডার—এইসব নিয়ে তৈরি আছে বারাণসী। একথা একরকম বলেই দেওয়া যায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে ফায়দা লোটার জন্য দুদলই তৈরি। যদিও আবার একটা গুজরাত কাণ্ড ঘটে গেলে যোগী আদিত্যনাথের সরকারই দায়ী থাকবে সেটা সময়ে না ঠেকানোর জন্য। তা সে আদালতের রায় যাই বলুক।
এই মোটের ওপর বাঙালির বারাণসীদর্শন।বাঙালির সেকেন্ড হোম আপাতত অবিশ্বাস আর দাঙ্গার আশঙ্কা বুকে নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষায়।
এক দিক দিয়ে যুক্তি খারাপ নয় , এখন আমাদের সময় ইত্যাদি
জোট তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো
খুব ভাল ফিচার হচ্ছে টিম।
মিঠুনের লেখা বরাবরের মতোই ভালো লাগলো আবার কুটিল পরিস্থিতি আন্দাজ করে খারাপ ও লাগছে ।এই মূল্যবান লেখা গুলোর জন্য আমার মতো অনেকেই উন্মুখ হয়ে থাকবেন ।
এখানে একটু অপ্রাসঙ্গিক তবুও একটা অভিজ্ঞতা বলি। আমার বাইকের ইনস্যুরেন্সের কাগজ আনতে গেছিলাম শো রুমে। গেটের বাইরে বাইক রেখে হেলমেট খুলেছি, আমি হেলমেটের নোচে করোনার সতর্কতা হিসাবে টুপি পরেছিলাম - টুপিটি ঘটনাচক্রে গোল, মাথায় চাপা এবংং ঘিয়ে রঙের। গেটে দারোয়ানজি খুব রুক্ষভাবে গাড়িটাকে সাইডে রাখতে বললেন, তারপর দূর থেকে আমার হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করলেন, থার্মাল বন্দুক তাক করে তাপনাত্রা মাপলেন। তারপর বললেন "নাম বোলিয়ে"। আমি নাম বললাম। নামটা শুনেই কেমন আশ্চর্যজনকভাবে ওনার চোখমুখ কথার সুর সব বদলে গেল - " এদিকে স্যার, এদিকে। আপনি ব্যানার্জী বলবেন তো। আমি ভেবেছিলাম অন্য কমিউনিটির"
আমি বললাম "অন্য কমিউনিটির হলেই বা কী হত? তারা কী আপনার কাস্টমার নয়?"
"স্যার ওরা আমার কাকার যা অবস্থা করেছে বাংলাদেশে, ওই জাতকে আমার চেনা হয়ে গেছে"
আমিঃ "তাহলে এদেশে ওদেরও কি সেই অবস্থাই করতে চান?"
"স্যার এখন আমেরিকা পর্যন্ত ওদের ভালভাবে দেখে না। ওরা নিশ্চই ততটাই খারাপ"
আমিঃ "একজনের অপরাধে পুরো কমিউনিটি খারাপ হয়ে যায়? এই যে ধরুন ঝাড়খন্ডে একজনকে পিটিয়ে মারল জয় শ্রী রাম বলে নি বলে --"
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে "সুয়ার আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে এসব বলবেন না। ওরা বদমাশ জাত"
আমি তখন আর কথা বাড়াইনি। কী বলতাম তাও জানিনা - কারণ ইনি নিজে একজন নিম্নবিত্ত, সম্ভবত নিম্নবর্ণ, খেড়ে খাওয়া শোষিত মানুষ। এর বিরুদ্ধে তো আমার যুদ্ধ নয়। কী করব জানিনা। অসহায় লাগে
"নোচে" > নীচে
"সুয়ার" > স্যার
না সেরকম নয়। ব্যপারটা ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবার মতন
মিঠুনের লেখা তথ্য নির্ভর এবং সাবলীল।আগেও পড়েছি।বেনারস আমার খুব মনের কাছাকাছি একটা জায়গা।কারণ আমার ছোট পিসি ৪০ বছর ওখানে ই আছেন। বর্তমান এও কাশীর মন্দির এর কাছাকাছি নিজ বাসস্থান।বার তিনেক গেছি তাও মধ্য আশির দশকে। ফলতঃ স্মৃতি বেশ ঝাপসা। আপাতত যা কিছু শুনি পিসি এবং তাদের ছেলে মেয়ে দের মুখে ই।তারা কিন্তু যোগী কিংবা মোদী তে বেশ নিরাপত্তা বোধ করেন।
জ্ঞানবাপি গিয়েছি ২০০৯ সালে। তখনও একই পরিস্থিতি ছিল। মিলিটারি পাহারা, দেখতে চাইলে নানা প্রশ্ন। দাঁড়াতেই দেয় না তো তার ছবি তোলা। যে পূজারীকে নিয়ে পুজো দিতে যাচ্ছিলাম মন্দিরে, সে রীতিমতো বিরক্ত। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির দর্শনে এসে মসজিদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ কেন!
একই জিনিস দেখলাম ২০১৮ সালে আহমেদাবাদে। সেখানে লোকে ভিড় করে অক্ষরধামের খাজা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখার জন্য। অথচ ড্রাইভার যখন আমাদের জামা মসজিদ-ঝুলতা মিনার-রানি সিপরি মসজিদ নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গান শোনাতে শোনাতে (দারুণ গান আর মিমিক্রি জানেন তিনি), তখন দেখেছি সেসব জায়গায় ট্যুরিস্ট বলতে গেলে নেই। সব জায়গাগুলো জুড়েই একটা হতশ্রী চেহারা। তার ছাপ লেগে রয়েছে স্থাপত্যগুলোতেও।
ভীষণ ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগল পড়ে৷ :-(
মগজধোলাই কীভাবে হয় নীরজ তার আদর্শ উদাহরণ৷
মিঠুনের লেখা ভঙ্গিতে সরলতা কিন্তু অভিনিবিশের গভীরতা দাবি করে, এই লেখাটা পড়ে একটু যেন দুশ্চিন্তা ও হচ্ছে, তবু আশা করি বারাণসী তার মহান ঐতিহ্য ভুলবে না ।মিঠুনের কলমেই সে আশ্বাস পাবো