২০২১ সাল গড়িয়ে গড়িয়ে জুন মাস পেরিয়ে গেল। পায়ের তলায় সর্ষে আর গড়াচ্ছে না। জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমরা অল্পস্বল্প উসখুশ করতে থাকি – সামনেই নতুন সেমেস্টার, এদিকে অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হল না। শুচিস্মিতারই প্রধান আপত্তি এইরকম গয়ংগচ্ছ করে পুরো গ্রীষ্মকাল চলে যাওয়ায়। অতএব মরিয়া হয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা খুঁজতে বসলাম, এমন কোন জায়গা আছে, যেখানে গেলে ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা হবে না, আবার মার্কিন মুলুকের একঘেয়েমি থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে। দেখা গেল, ইমিগ্রেশনের সমস্যায় না পড়তে চাইলে এবং খুব একটা দূরে যেতে না চাইলে পুয়ের্তো রিকো যাওয়া যায়। ইউ এস টেরিটরি বলে সেখানে যাওয়া মানে ডোমেস্টিক ট্রাভেল হিসেবেই গণ্য হবে। ভ্যাকসিন নেওয়া থাকায়, এবং মাস্ক ম্যান্ডেট থাকায়, মোটামুটি বেড়ানো যাবে। অবশ্যই ব্যাপারটা সিডিসির ওয়েবসাইটে যেমনটা লেখা আছে, ঠিক সেরকম সোজাসাপ্টা নয়। কিন্তু সে কথা যথাস্থানে বলা যাবে।
জুলাই মাসের একেবারে শেষদিকে রওনা দেওয়া গেল। ডেট্রয়েট থেকে ফিলাডেলফিয়া হয়ে স্যান হুয়ান, পুয়ের্তো রিকোর রাজধানী। দিল্লির মতই স্যান হুয়ানেরও দুই ভাগ – নতুন আর পুরাতন। নতুন শহরে এয়ারপোর্ট আর পুরোনো শহরে যাবতীয় বেড়ানোর জায়গা, দুর্দান্ত সমুদ্রতীর, খাদ্য ও পানীয়। বিশেষ করে ‘রাম’ভক্তদের স্বর্গরাজ্য পুয়ের্তো রিকো, ওয়াইনারি ট্যুরের মত করে এখানে রাম ফ্যাক্টরির ট্যুর হয়।
রাত বারোটা নাগাদ স্যান হুয়ান এয়ারপোর্টে নেমে দুটো জিনিস আবিষ্কার করলাম। এক, আমাদের মোবাইল ফোনের সার্ভিস এখানে নেই, সেইসঙ্গে ইন্টারনেটও নেই, ডেটা কাজ করবেনা বলে। দুই, পর্যটন-নির্ভর জায়গা বলে অসম্ভব কড়াকড়ি কোভিড নিয়ে। আমাদের কোভিড ভ্যাক্সিনের ডকুমেন্ট হার্ড-কপি সঙ্গে থাকলেও, দেখা গেল ইলেকট্রনিক কিউ.আর.কোড থাকতেই হবে এয়ারপোর্ট থেকে বেরনোর জন্য। শুচিস্মিতা মুচকি হাসল, সে তার কিউ.আর.কোডের স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। আমারটা ইমেলে আছে, এবং নেট নেই। কাজেই আমায় পাঠানো হল ফ্রন্ট ডেস্কে, যেখানে বেঞ্চ পেতে বসে আছেন কয়েকজন এয়ারপোর্ট স্টাফ, তাঁদের কাছে ল্যাপটপ আছে, সেখানে নেট আছে। আমায় সেখানে নানাবিধ কেরদানি করে (এবং সামান্য টেনশনে ঘামতে ঘামতে) কিউ.আর.কোড জোগাড় করে রেহাই পেতে হল। এই পুরো সময়টায় এয়ারপোর্টের কর্মচারীরা অসম্ভব সহৃদয় ব্যবহার করলেন; আমি খামোখাই টেনশন করেছি। ঐদিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ দেখলাম পুয়ের্তো রিকোর মানুষ প্রচণ্ড আন্তরিক ও মিশুকে। কখনও মনে হয়নি যে বিপদে পড়ে সাহায্য পাব না।
অত রাতে অজানা শহরে দূরে কোথাও যাব না ভেবে এয়ারপোর্ট হোটেলে রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। রাত একটার কিছু পরে সেখানে পৌঁছনো গেল, তারপর বেশ অনেকক্ষণ ধরে কুস্তির পর রোমিং ডেটা নেওয়া হল, এক একদিন করে। নইলে ম্যাপ দেখা যাবে না, ট্যাক্সি ডাকা যাবে না দরকার পড়লে, ফোনও করা যাবে না কোথাও। এমন নয়, যে এগুলো সবই আমাদের লাগবে, কিন্তু আমাদের এক শহরেই পুরো সময়টা যেহেতু থাকার প্ল্যান নেই, তাই ঘোরাঘুরির জন্য এগুলো হাতের কাছে থাকা দরকার।
পরেরদিন সকালে হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে দেখলাম, একটু উঁকি মারলেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। আকাশ যদিও মেঘলা, তবু জলের রংটা বেশ চমৎকার বলেই মনে হল। পুয়ের্তো রিকো খুবই ছোট দেশ। আমি ইচ্ছা করে দেশ কথাটা ব্যবহার করলাম। দু’ একদিন থাকার পরেই আমাদের মনে হয়েছে জায়গাটা নামেই ইউ এস টেরিটরি। মিল একেবারে নেই এমন নয়, তবে মিলের থেকে অমিলই বেশি। সর্বোপরি, ওখানকার বাসিন্দারা নিজেদের মার্কিন মুলুকের মূল ভূখন্ডের থেকে আলাদা বলেই মনে করেন ও পরিচয় দেন। বরং তাঁদের স্প্যানিশ ঐতিহ্য নিয়ে খানিকটা গর্ব দেখলাম। যাই হোক, পুয়ের্তো রিকো একটা দ্বীপ। জল বাদ দিলে সাড়ে তিন হাজার বর্গ মাইল জায়গা পড়ে থাকে, তুলনার সুবিধার জন্য আমরা মনে রাখতে পারি, সবথেকে ছোট মার্কিন রাজ্যগুলোর শেষ তিনটের নাম কানেকটিকাট (ডাঙার পরিমাণ ৪৮৪২ বর্গ মাইল), ডেলাওয়ার (ডাঙার পরিমাণ ২৪৮৮ বর্গ মাইল), রোড আইল্যান্ড (ডাঙার পরিমাণ ১০৩৩ বর্গ মাইল)।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই ছোট দেশ। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা প্রথম দু’ দিন স্যান হুয়ানের পুরোনো শহরে থাকব। তার পরের দিন অন্যতম প্রধান আকর্ষণ – এল জুঙ্কে রেইনফরেস্ট-এর মধ্যে দিয়ে ইতিউতি ঘুরে নেব। তারপরের দু’ দিন দ্বীপটা বেড় দিয়ে ঘুরে এসে আবার স্যান হুয়ানে ফিরে একটা রাত কাটিয়ে ফিরতি ফ্লাইট ধরব। ওল্ড স্যান হুয়ান চমৎকার পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যায় অনেকটাই। কাজেই গাড়ি চালানোর বালাই নেই। পরের অংশটুকুর জন্য একটা গাড়ি লাগবে, সেইটা আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিতে হবে তৃতীয় দিন থেকে।
পরিকল্পনা মাফিক রাত পোহাতেই পৌঁছনো গেল পুরোনো শহরে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ কেটে গিয়ে চমৎকার রোদ উঠেছে। স্বভাবসিদ্ধ নীলাভ সবুজ জলের সমুদ্র চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে নানা বাঁক থেকে। মেক্সিকোর কানকুনের মত সমুদ্রতট দিয়ে ঘেরা শহর। প্রচুর ট্যুরিস্ট, তাদের মধ্যে অনেকেই স্প্যানিশ-ভাষী। সম্ভবত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা, মেক্সিকো থেকে আসা মানুষও অনেকেই। আর মার্কিন মুলুকের পর্যটক তো আছেই। সেদিনের মূল আকর্ষণ ছিল স্নরকেলিং। মেক্সিকোয় একবার স্নরকেলিং করতে চেয়েছিলাম। আমি সাঁতার জানি না, যে কোম্পানি স্নরকেলিং ট্যুর বুক করছিল, তারা “সাঁতার জানতে হবে না” মর্মে বিজ্ঞাপণ দিয়েই লোকজনকে নিয়ে যাচ্ছিল। কোমরজল বলে শেষে ছ’ ফুট লোকের নাক অবধি ডুবে যাবে এমন জায়গায় দিল ফেলে। যাই হোক, সে গল্প অন্যত্র করা যাবে। কিন্তু সেই ট্রিপে খুব ভালো করে জলের নীচের পৃথিবী দেখা যায়নি বলে শুচিস্মিতা (সে মেক্সিকোতেও বুদ্ধি করে জলে নামেনি) আমার জন্য এখানে আরেকটা স্নরকেলিং ট্যুর বুক করে দেয়। এবারেও আমি একাই যাব, সে তীরে বসে রোদ পোহাবে আর বই পড়বে। আশার কথা, এবারের কোম্পানি অনেক অর্গানাইজড, তাদের নানারকম সার্টিফিকেশন আছে, আছে ফার্স্ট রেসপন্ডার কোর্স পাশ করা ট্রেনার।
সেই ছোট থেকেই একটা রেটরিকাল প্রশ্ন শুনে আসছি - ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক’ বার? এসক্যাম্ব্রিয়ন সমুদ্রতটে পৌঁছে প্রশ্নটা মর্মে এসে বিঁধল। বিশাল সমুদ্রতট, সাদা বালি দিয়ে ঢাকা। সমুদ্র যত নয়নাভিরাম, ততই ভীতিপ্রদ। জায়গায় জায়গায় বেজায় ঢেউ, দুয়েকজন সার্ফিংও করছে দেখা গেল। তার ওপরে দেখলাম বিস্তর লোক, প্রায় কার্নিভ্যালের মত আবহাওয়া। দিনটা শুক্র বা শনিবার নয়, সম্ভবত বুধবার। এত লোকের কি কোনো কাজ নেই, কি জ্বালা! মনটা দমে গেল, মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, আমায় খাবি খাওয়া অবস্থায় জল থেকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে, তীরের লোকেরা হেসে খুন। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দেখলাম স্নরকেলিং-এর বাকি সদস্যদের। মোটামুটি গড় বয়স নিলে হয়তো বাইশ তেইশ হবে, সকলেই সাঁতার জানেন। আমার থেকেও বয়স্ক একজন ভদ্রলোক এসেছেন পুরো পরিবার নিয়ে, তিনি রীতিমত এক্সপার্ট স্কুবা ডাইভার। তা সে যাই হোক, গোঁসাইবাগানের ভূত উপন্যাসের নায়কের অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার মত শহীদের মানসিকতা নিয়েই গুটিগুটি জলের দিকে এগোলাম। ট্রেনার দু’জন, জলে নামছে দশজনের দল।
হাতে বিশাল বিশাল দু’টি প্যাডল, ব্যাঙের পায়ের মত জিনিস, গায়ে লাইফ জ্যাকেট, মাথায় স্নরকেলিং-এর যন্ত্র – যার সাথে গগল লাগানো রয়েছে। স্নরকেলিং-এর যন্ত্রটা একটু অদ্ভুত, জিনিসটা আপনার নাক ঢেকে দেবে, যাতে জল (এবং হাওয়া) নাকে না ঢুকতে পারে। হাওয়া না ঢুকলে তো অক্সিজেনও ঢুকবে না, তাহলে? তাহলে মুখ দিয়ে শ্বাস নেবেন, আবার কি? এই মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া, এবং নাক দিয়ে শ্বাস না নেওয়াই স্নরকেলিং করতে শেখার সবথেকে বড় পাঠ। যে ঐটে জানে, সে বাকি ম্যানেজ করে নেবে। জলের কাছে খুবই আশা নিয়ে গেলাম, আমার বিশ্বাস তীরের কাছাকাছিই তো থাকব, খুব অসুবিধা হলে টুক করে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাবে। ওমা! ট্রেনারেরা জলের ধারে নিয়ে গিয়ে বলে কি, ঐ যে দূরে পাথরের ডুবো পাহাড়গুলো দেখা যায়, আমরা ঐ পর্যন্ত যাব, সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি বর্ডার বরাবর স্নরকেলিং করতে করতে একটা পাক মেরে ঘুরে আসব। আমার প্রচুর প্রশ্ন পেতে শুরু করল, যার মধ্যে জলের গভীরতা যেমন আছে, তেমনি স্রোতের টান, জলের নীচে কী কী থাকতে পারে – সেইসবও আছে। কিন্তু সেসব জিগ্যেস করার আগেই লিবি, আমাদের প্রধান ট্রেনার, বলল, জল খুবই গভীর, ওখানে সাঁতার কাটতে হবে। আরো জানা গেল, জলের নীচে রঙিন মাছ আর নানাবিধ সুদৃশ্য জলজ উদ্ভিদ আছে। সাধারণত ভয়ের কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, পাথরে পা কেটে যেতে পারে, সি আর্চিনে অনেক সময় অ্যালার্জিক র্যাশ হয়। কিন্তু জলের নীচে কেউ তো পৌঁছবেই না, যদি সে না চায়। লাইফ জ্যাকেট আছে কি করতে?
লিবি আর ব্রিটনি পইপই করে বারণ করল, যেন জলের নিচে হাঁটার চেষ্টা না করি। কৃত্রিম লিপ্তপদ নিয়ে মানুষ জলের নীচে হাঁটতে পারবে না, এক দু’ পা এগিয়েই ধপ করে পড়ে যাবে। ডুববে না, কিন্তু নানারকম অপমানজনক ওরিয়েন্টেশনে আধডোবা হয়ে জল খাবে। মোদ্দা কথা হল, জলে নামার আগে মনশ্চক্ষে যা যা দেখেছিলাম, সে সবই সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সলিল সমাধির দিকে ঠেলে দিয়ে বউ তার বই নিয়ে আরাম করে গাছের ছায়ায় বসল, দেখলাম। দশজন গোল হয়ে হাঁটুজলে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখেনে নাকি আমাদের ট্রেনিং হবে। অনেকটা প্রাণায়ামের মত ব্যাপার, শুধু মুখে স্নরকেলিং-এর নল লাগানো, যার অন্য প্রান্ত জলের ওপরে জেগে থাকবে, কাজেই বাতাস আসবে সেইপথে। যে কোনো অবস্থাতেই মুখ এবং নলের মধ্যেকার সিল খুলে গেলে মুখে নোনা জল ঢুকবে। সিলটা কোনো যান্ত্রিক কারিকুরি নয়, দাঁত দিয়ে নলের একটা প্রান্ত কামড়ে ধরে থাকতে হয়। প্রথম প্রথম হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বেশ ভালোই লাগছিল। অ্যাকশন ফিল্মে যেমন দেখায়, সেরকম জলের মধ্যে জেগে আছে একটা রাবারের আপাত নিরীহ নল, অন্যপ্রান্ত কামড়ে হয়তো সশস্ত্র কোনো হিরো খুব সাবধানে সাঁতার কাটছে শত্রুপুরীর দিকে।
কিন্তু বেশিক্ষণ এই চমৎকার ভাবনা মনে স্থায়ী হল না। দেখলাম, প্রাণায়ামের সমস্যা হল, চোখে লাগানো গগলের মধ্যে হাওয়া ঢুকে গিয়ে ঘোলাটে করে দেয়। সেই স্টিমি গগল তখন আপনাকে প্রায় অন্ধ করে দেবে। সে যে কি ভয়ানক, নাকে বাতাস নেই, চোখে অন্ধকার – কয়েক সেকেন্ডেই প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু সেইটা হলেই ব্যস, খেল খতম!
পাঁচজন সুদক্ষ সাঁতারুকে নিয়ে ব্রিটনি গভীর জলের দিকে চলে গেল। আরো তিনজন মাঝারি সাঁতারু, একজন বেসিক স্কিল আছে এমন সাঁতারু ও আমাকে নিয়ে লিবি তখনো ট্রেনিং অঞ্চলে। এর মধ্যেই সেলফি, গ্রুপফি এইসব নেওয়া হচ্ছে। আমার ইচ্ছা না থাকলেও নাকি ডকুমেন্টেশনের জন্য এইগুলো করে রাখতে হয়। তাছাড়া সবাইকেই ফোন নিয়ে জলে নামতে বারণ করা হয়েছে, একটা গো-প্রো দিয়ে ট্রেনারেরাই সব ছবিছাবা ভিডিও তুলে দেবে। এ-ও নাকি প্যাকেজেরই অংশ। ভাবলাম ভালোই হল। আমাদের বাড়ির কেউ কেউ মারা যাওয়ার সময়, তাঁদের ভালো ছবি ছিল না বলে শ্রাদ্ধে খুব গোলমাল হচ্ছিল, আমার ক্ষেত্রে অন্তত সেরকম অসুবিধা হবে না। অবশ্য আমার শ্রাদ্ধ হওয়ারও কথা নয়, তবু দেওয়ালে তো টাঙাতে হবে।
পন্ডিতেরা বলেছেন, বিপদের সময় সঙ্কোচ করলে তার ফল খুব খারাপ হয়। এটাকেই মনে হয় সংস্কৃতে গতস্য শোচনা নাস্তি বলে। ক্লাস সেভেনে সংস্কৃত নিয়েছিলাম, আমাদের স্কুলে সেটাই দস্তুর ছিল। অন্য কোনো কোনো স্কুলে হিন্দি পড়ানো হত, ভেবে দেখলাম তখন হিন্দি নিলে বোধহয় ভালোই হত। হিন্দিতে ‘শোচনা কেয়া, যো ভি হোগা দেখা যায়গা’ বলে একটা প্রবাদ আছে। বলিউডের হিরোরা তাই এত ডাকাবুকো হয়। তা সে এখন আর ভেবে কী হবে। গতস্য ইত্যাদি।
লিবি এদিকে আমাকে অনেকক্ষণ ধরেই দুর্দান্ত চিয়ারলিডিং করছে। আরে এ তো জলভাত, কোনো চাপ নেই ইত্যাদি। আমি শুনছি আর মনে মনে ভাবছি, হুঁ হুঁ বাবা, জলভাত তো না, এ হলো পান্তার তেজ। আমায় জলে ফেল্লেই বুঝতে পারবে কত জলে কত ভাত। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সেলফি তোলা হয়ে গেলে মনে হল, আর কি, এবার হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। সুতরাং সঙ্কোচ কাটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লিবিকে যা বলব বলব করছিলাম, বলেই ফেললাম।
ইলেভেনের কেমিস্ট্রি টিউশনের মেয়েটিকে কিছু বলতে পারিনি, যদিও সেখানে বক্তব্য অন্য ছিল, কিন্তু সংকোচের জায়গাটা সেখানেও ছিল বলে হয়নি, এখানে পারলাম। বললাম, লিবি, এই এতজন স্নরকেলিং করতে এসেছে, তাদেরও তো তোমাকে দরকার হবে গাইড হিসেবে। তুমি বরং আমায় এখানেই রেখে যাও, আমি এদিক ওদিক জলের মধ্যে হেঁটে আর মাঝেমধ্যে অগভীর জলে ডোবার চেষ্টা করে যা দেখার দেখে নি’। লিবি কথাটা উড়িয়ে দিল। বলল, আরে তুমি চিন্তা কোরো না, আধঘন্টার মধ্যে তোমায় সাঁতার শিখিয়ে দেব। বুঝলাম মধ্য কুড়ির পরমা সুন্দরী লিবি আমার মত সংস্কৃত পড়েনি, সম্ভবত ওদেরও হিন্দি ছিল।
অতএব জলের মধ্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একে একে পাখনা পরা হল। পাখনা পরলে আবার দাঁড়ানো যাবে না, সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। তখন লিবি শেখাল কিভাবে চিৎ হয়ে ভেসে থাকা যাবে, পাশাপাশি রোল করা যাবে। বলা বাহুল্য, দুয়েকবার জল খেলাম, কিন্তু বুঝলাম লাইফ জ্যাকেট পরে ডুবে যাওয়া, সাঁতার কাটার চেয়েও কঠিন। এরপর স্নরকেলিং-এর নল লাগিয়ে প্রাণায়াম করতে করতে গভীরতর জলের, এবং সেথায় থাকা মাছেদের সন্ধানে যাত্রা শুরু হল। ঘড়ি নেই, এক একটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে বিশাল লম্বা। অনেকটা ভাঙের নেশার মত অবস্থা। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, সামনে যতদূর চোখ যায় (কয়েকটা মানুষের মাথা ছাড়িয়ে) শুধু সবুজাভ নীল জল। চাঁদের আলো থাকলে ‘মরি যদি সেও ভালো’ গাওয়া যেত। বদলে লিবি আমায় সাঁতার প্র্যাক্টিস করাতে শুরু করল। ব্যাঙের মত পা হয়েছে, সেই দিয়ে। পরবর্তী ঘণ্টা-দুই এই চলবে। সম্মুখে অশান্তির পারাবার।
ছবি - লেখক