দীর্ঘশ্বাস নাকি আমৃত্যু নিষ্ফলা ঘুরে ফেরে - গালিব এমনটাই লিখেছিলেন। সে দুনিয়া আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। এখন পিযূষ মিশ্রর দুনিয়া, যা পুড়ে খাক হয়ে গেলেও মায়া জাগেনা, উল্টে মানুষ শীতল ও নিস্পৃহ হয়। একটি মেয়ে তার কোঁকড়ানো চুল সোজা করতে করতে এ দুনিয়া হেজেমজে জাহান্নামে যাবে।
পুরোনো চাট্টি বাজে গল্পের গরু সেই যে আশির দশকে ল্যাগব্যাগ করে বসে পড়েছে, সে এখনও যাকে বলে সেখানেই অ্যাঙ্করড। আই গো আপ মানে গরু কান্দিতেছে একথা এখন সবাই জানে। কিন্তু কেন কান্দিতেছে সে বিষয়ে আপনারা জানেন না। গোডাউনে উই নাই, গোডাউনই নাই, বেচা হয়ে গিয়েছে তো উই কোথা থেকে আসবে ? এখন গোয়ের চক্ষে আপ কেন শুনুন। এটি একটি বন্ধুত্বের গল্প। পার্থ আর অচিন্ত্য দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু, একই মহল্লার। দুজনেই হাড়কেপ্পন, দুজনেরই কৃষ্টি ও সংস্কৃতিচর্চায় খুব মন। টেনিদার ভাষায় যাকে বলে আঁফাঁ তেরিবল -সেইরকম ঘোর সিরিয়াস সংস্কৃতি। পার্থ যদি আইরিশ বিপ্লবের ওপর লেখা দ্য রাইজিং অফ দ্য মুনের বাংলা নাট্যরূপ লিখে ফেলেন তো অচিন্ত্য তার সঙ্গীতায়োজন করে ফেলেন --এবং দুজনের নেতৃত্বে পাড়ার অর্বাচীন বালক বালিকাদের নিয়ে সে নাটক মফস্বলে মঞ্চস্থ হয়ে যায় ---এইরকম সিরিয়াস। দুজনেই চাকরি করেন। এখন হয়েছে কি, কিপটে হলেও মানবচরিত্রের অমোঘ নিয়মে দুজনেই অন্যের কিপটেমির হাঁড়ি হাটে ভেঙে দিতে ভালোবাসেন। এই নিয়ে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান সুলভ বালখিল্য চাপল্য ও প্রতিযোগিতা আছে। এরকমই এক মাহেন্দ্রক্ষণে পার্থ ঠিক করলেন যে অচিন্ত্যের ঘাড় ভেঙে সিনেমা দেখতে হবে, সদ্য চাকরি পাওয়া উপলক্ষে। কিন্তু সোজা পথে তো তা হবেনা। তাই অচিন্ত্যকে বলা হলো সিনেমার টিকিট কাটতে, আর পার্থর খরচে সন্ধ্যেবেলার সামান্য জলযোগ হবে। দুপক্ষের খরচে আমোদপ্রমোদ হবে -- কাজেই অচিন্ত্যের তেমন আপত্তি হয়না। যথানিয়মে দুই বন্ধুতে দেখা হয়। অবিশ্বাসী পার্থ আগে দেখে নেয় সত্যিই টিকিট কাটা হয়েছে, এমনকি সে নিজেরটা পকেটস্থ করে নেয় মিষ্টি কোন ছুতোয়। পারস্পরিক পরিচয় খুবই গভীর ছিলো, তাই অচিন্ত্য এতে অবাক হয়্না। অতঃপর চপকাটলেট সহযোগে পিত্তরক্ষার পালা শুরু হয়। কল্পতরুর মত সেদিন অচিন্ত্যকে খাওয়ায় পার্থ। শুধু বিল মেটানোর আগে হাত ধুতে যাওয়ার নাম করে অলক্ষ্যে রেস্তোঁরা থেকে বেরিয়ে সোজা সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে অচিন্ত্যও, গাঁটের আরো কড়ি খরচ করে খাবারের বিল মিটিয়ে হলে এসে সিনেমা দেখে। এরপর অল্পদিনের ছেদ সত্ত্বেও এঁদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট।
বন্ধুর মাথায় কাঁঠাল ভাঙার এই প্রকৃষ্ট অথচ নিরীহ উদাহরণটি আশির দশকের সিগনেচার। আশির দশকে গোড়ার দিকে, যখন সিপিএম কংগ্রেস ও নানা ফ্যাকশনের মধ্যে প্রায়ই পেটো চালাচালি হত, তখন টালিগঞ্জে আমাদের পাড়ায় নাগরিক কমিটি রাতপাহারার ব্যবস্থা করে। এরই পরবর্তী সংস্করণ আমি নব্বইয়ের দশকে আবারো দেখেছি, তখন অবশ্য প্রোমোটার এবং তোলাবাজদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে লোকেরা এই ব্যবস্থা করে। যাই হোক, আশির দশকে, আগেই বলেছি, মানুষ অনেক সরল ছিলো। রাতপাহারা শুরু হতে না হতেই সমস্ত গোলমাল বন্ধ হয়ে গেল। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সবাই শান্তিতে ঘুমোয়, শুধু কয়েকজন করে ইয়ারদোস্ত আড্ডার অছিলায় রাত জাগে -- এইরকম একটা ব্যবস্থা দাঁড়ালো। গল্পে উপন্যাসে যাঁরা অতিরঞ্জিত করে মানুষের গলার জোর বর্ণনা করেছেন -- তাঁরা নমস্য কিন্তু ডাহা মিথ্যেবাদী। কোন মানুষের পক্ষে চেঁচিয়ে কাক চিল ওড়ানো ---বিশ্বাস করুন সম্ভব না। হলে আমাদের পাড়ায় সেটা অনেকেই হাতেকলমে করে দেখাতেন। এরকমই একটি বাড়ির এক দোর্দন্ডপ্রতাপ বৃদ্ধা এই গল্পের অন্যতম চরিত্র। ঐ বাড়ির আম কাঁঠালের গাছে অল্প কিছু সংখ্যক কাক সারাদিনই বসত। তবে হ্যাঁ প্রায় দুই প্রজন্মের বন্ধুবান্ধব কেউ ত্রিসীমানায় আসতে পারতো না। অন্যসময় তাও একরকম, ফলের মরসুমে হাতের কাছেই ফলন্ত গাছ দেখে পাড়ার ছেলেপিলেদের খুবই সমস্যা হত। সেবার অবশ্য রাতপাহারার সময় একটু সুবিধে হয়ে গেছিলো। আমাদের পাড়ায় জয় ও বাপ্পার মত অত বেশি সংখ্যায় না হলেও, বেশ কয়েকশত বাবু ছিলো। আপনারা সব সময় প্রমাণ চান, তাই সত্যের খাতিরে মুর্গি বাবু (বাজারে মাংস কাটে), লাল বাবু (সিপিএমের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই, বাড়ির রং লাল) ইত্যাদি নাম বলে রাখছি। এরকমই এক বাবু, আমকাঁঠালের বাড়ির ছোটছেলে। তার যেদিন পাহারা দেওয়ার কথা, সেদিন তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অল্পক্ষণের জন্য অকুস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রাতপাহারার ভরসায় নিশ্চিন্তে নিদ্রাগত বাড়ি থেকে কাঁঠাল পেড়ে নিষ্ঠুর জিঘাংসায় সবাই চড়ুইভাতি করে। অজান্তে বাবুও সেই আনন্দ আয়োজনে যোগ দেয়।
এই মুহূর্তে গোটা ভারতবর্ষ বাবুর মত অবোধ আনন্দে নিজের মাথায় ভাঙা কাঁঠালে মশগুল। ভাঙা কাঁঠালটি পঞ্চধাতুর। নেপালের গণপতি দেখেছেন? বেসে পান্না অউর চুনি, সেইরকম কাঁঠালের বেসেও পাঁচটি রত্ন। অযোধ্যার অতাশ্চর্য্য কাঁঠাল দীর্ঘজীবি হোক, কাঁঠালের মালিক ক্রমশ দুঃস্থ ও নির্বীর্য্য হোন, আমরা পরের গল্পে যাই।
শেষ বাক্যটি লিখেই মনে পড়ে গেল -- একবার একটি রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে কী বিষম বিপদই না হয়েছিলো। মধ্য এশিয়ার যে অঞ্চল থেকে শাহেনশাহ বাবর এসে হিন্দুস্তানের দখল নিলেন, সেই বীররসসিক্ত ফরগনার আসেপাশে কোথাও একটি পরিবারের গল্প। বাড়ির ছেলেটি ছোট থেকেই রুগ্ন, প্রায় নানা অসুখ বিসুখে ভোগে। মধ্য এশিয়ার মানুষদের সাথে যাঁরা মিশেছেন তাঁরা জানবেন --- শারীরিক দুর্বলতা ওখানে একটা ভীষণরকম লজ্জার ব্যাপার। গল্পের রুগ্ন ছেলেটি, বাংলায় হলে হ্য়ত তার নাম হত অমল, সোভিয়েত আজ্ঞাধীন বর্তমান উজবেকিস্তানে তারই নাম হলো স্পার্টাক। তো, স্পার্টাক ছোট থেকেই বাড়িসুদ্ধ সবার আলোচ্য বস্তু। আমাদের দেশে হলে মা ঠাকুমা আজ এই মন্দির কাল সেই পীরের থানে মানত করত -- হেই বাবা রোগ ভালো করে দাও। কিন্তু স্থানমাহাত্ম্য এমনই, স্পার্টাককে নিয়ে বাড়ির লোকের আলোচনা --এর বোধহয় স্পার্মকাউন্ট খুব একটা ভালো হবেনা। বংশরক্ষার আর কোন উপায়ই রইলোনা -- এই আশঙ্কায় কোন মানতটানত হয়েছিলো কিনা জানা যায়না। তবে ছোট থেকে একই কথা শুনতে শুনতে কৈশোর অতিক্রম করার আগেই স্পার্টাকের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে সে রুগ্ন, অতএব বীর্য্যহীন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আরো একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার অনুমান করে ফেলে। বিজ্ঞান জন্মনিরোধক বলে যে ঝলমলে খুড়োর কল বানিয়ে ফেলেছে --স্পার্টাক অনুমান করে যে সেসব তার কোনদিন দরকার হবেনা। অবশ্য ষোলো বছরেই একটি পুত্রসন্তানের পিতা হয়ে তার (এবং গোটা এলাকার) এইসব ভুল ধারণা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। এই পর্যন্ত পড়ে যাঁরা ভাবছেন এরকম তো কতই হয়, একটা দুর্ঘটনা বই তো নয়, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, মা ষষ্ঠীর কৃপায় তিরিশ অতিক্রম করার আগেই স্পার্টাকের আরো চারটি সন্তান হয়েছে। বাড়ির পরিস্থিতি খুবই গম্ভীর, তেমন বয়স হয়নি এবং দিব্যি হাইহিল পরে নাচতে পারেন এমন একজন মহিলা অকালে ঠাকুমা হওয়ায় খুবই শোকগ্রস্ত। স্পার্টাকের পুত্রকন্যা তাঁকে বাবুশ্কা বললেই তিনি তেড়েফুঁড়ে উঠে "বাবুশ্কা না বাবুশ্কা না, বানু বলো" --ইত্যাদি অসৈরণ করছেন।
এসব কোন তামাশার কথা নয়। আদপেই, এইসব খুব ঘোর বিষন্নতার কথা। প্রেমের পরিণতি, তা সে সাধারণ দুখী কবির প্রেমই হোক বা সুফি সাধকের মিলনবাসনা -- মানুষকে বিষন্ন করে। আগর জিতে রহেঁ ইয়েহি ইন্তেজার হোতা -- গালিব লিখেছিলেন। এই অপেক্ষার কোন এশিয়া ইউরোপ হয়না, শুধু অনন্ত কুয়োর মত অনন্ত প্রতীক্ষার কিছু গল্প জেগে থাকে পৃথিবী বেড় দিয়ে অমৃতধারার মত দুই নদীর মত। সে নদী মহাসমুদ্রে মেশে, আবার ফিরে এসে গাছে ফুল ফোটায়, আকাশে মেঘসঞ্চার করে।
তবে সেই নদী সুরসঞ্চার করে কিনা বলতে পারিনা। গান বাজনা জিনিসটা খুবই গোলমেলে জিনিস। খুবই রুচিসম্মত একটা ব্যাপার, অর্থাৎ জনে জনে রুচি ও ভালোমন্দ পাল্টায়। খাওয়া ও পোষাক সম্পর্কে বিধান থাকলেও গানবাজনার রুচি সম্পর্কে কবিরা নীরব। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন পড়ালেখার পাশাপাশি দুচারজন ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করার প্রজেক্টে টিউশনি করতাম, তখন এই গানবাজনা নিয়ে একটা মুশকিল হয়েছিলো। প্রতিবেশি একটি বাড়ি থেকে কিন্নরীকণ্ঠে রোজ ভোরে ও সন্ধ্যেবেলা সঙ্গীতসাধনা হত। গানের ছাত্রীটি সম্ভবত শাক্তমতের, তার একতলায় বসার ঘরে বসে করা আলাপ আমাদের তিনতলার জানলা বেয়ে এসে ব্রহ্মাস্ত্রের মত ধাক্কা দেয়। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও কয়েকদিনেই অভ্যেস হয়ে গেছিলো। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আপিসের বস পর্যন্ত মানুষের অভ্যাস হয়ে যায়, তাই এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। কিন্তু বিদ্রোহের বীজ এমনি বেয়াক্কেলে জিনিস, সে যে কোথায় কী ফুল ফোটাবে বোঝা কঠিন। একদিন দেখি প্রতিবেশীরা দলবল নিয়ে এসে পাড়ারই একটি নিরীহ কিশোরকে, অন্তত আমি যাকে নিরীহ বলেই জানতাম, প্রায় এই মারে কি সেই মারে। জানা গেল, বিগত কয়েকদিন যাবৎ সে নাকি সঙ্গীতসাধনায় ব্যস্ত কিন্নরীর বাড়ির কলিং বেল বাজিয়ে একতলার জানলার বাইরে থেকে "সাবাশ! সাবাশ! খুব ভালো হচ্ছে! খুব ভালো হচ্ছে!" এইসব বলে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো। আজ হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।এখনকার দিন হলে হয়ত মানুষ পিটিয়েই দিত, তখনও সম্ভবত বাঙালীর মাত্রাজ্ঞানে টান পড়েনি, তাই বকাঝকা করে ও ক্ষমাপ্রার্থনার পরে মিটমাট হয়ে যায়। সঙ্গীতসাধনাও পুরোদমে চলতে থাকে, বহুদিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে বলে মনে মনে যা সামান্য গজগজ করেছিলাম, সেই অপরাধবোধ গিলে ফেলে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তাই বলছিলাম, গানবাজনা খুবই অনিশ্চয়তায় ভরা একটা ব্যাপার।
গানবাজনা নিয়েও, আসলে আমাদের অনেকের অবস্থাই হাস্যকর রকমের করুণ। পারশে আর ট্যাঙরা মাছের প্রভেদ না জানলে মৎস্যপ্রেমীর যেমন হাল হওয়ার কথা, আমার মত যাদের গানবাজনায় কোন শিক্ষা নেই তাদের জন্য আপনাদের বিষণ্ণ হওয়া উচিত। ইলিশ আর পমফ্রেটে গুলিয়ে ফেললে যেমন মরমে মরে যেতে হয়, সেরকম চোরা অম্বলের মত বিষাদ আমাদের গানবাজনার অদীক্ষা জুড়ে। সূর্যমুখী ও চন্দ্রমল্লিকা, মৃগেল ও বাটামাছ, ওলকপি ও শালগম গুলিয়ে ফেলে তারাপদ রায় খুব আক্ষেপে একটি বিষণ্ণ কবিতা লিখেছিলেন। সেখানে কবিতা নিয়েও একটা গোলমেলে কথা ছিলো, কিন্তু সেকথা যথাসময়ে হবে। এখন কিনা খুব নিরামিষ খাওয়ার ধুম পড়েছে, তাই শাকসব্জি নিয়েও একটা অপশন দিয়ে রাখলাম, শুনেছি দেশে ভেজ বিরিয়ানির বাজার ভালো যাচ্ছে।
অতিকথন বয়সের দোষ। এই জায়গাটায় কায়দা করে "জীবনের সায়াহ্নে এসে..." ইত্যাদি করে একটা আবেগমথিত প্যারাগ্রাফ লিখে ফেলা যেত। কিন্তু কতটা বয়স হলে সায়াহ্ন বলা যায় সেটা খুব পরিষ্কার ধারণা না থাকায় আটকে গেলাম। বরং জীবনের সায়াহ্নে একজন পদার্থবিজ্ঞানী আমাকে যে গল্প বলেছিলেন সেটাই শুনুন। এর থেকে আপনি বুঝবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা কবি'র ছাত্রদেরই শুধু না, শিক্ষকদেরও কী প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে হত (এখনও কি হয়?)।
দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের ফিজিক্স অনার্সের ক্লাস, যাকে একদা বাজে রসিকতায় হনার্স বলা হত। দিনশেষের রাঙা মুকুল, অর্থাৎ রুটিনের শেষ ক্লাস। ম্যাথেম্যাটিকাল মেথডসের ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছেন। পড়াচ্ছেন আর ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কারণ ছাত্ররা কেউ কিছু পড়াশুনো করে এসেছে বলে মনে হচ্ছেনা। ভেক্টর ক্যালকুলাসের অসম্ভব প্রাঞ্জল সব জিনিসপত্র বোর্ডে আঁকা হচ্ছে, তিনটে ইন্টিগ্রেশন সাইন দিয়ে একটা বড়ো এক্সপ্রেশন লিখে স্যার ঘুরে দেখলেন সারি সারি নির্বোধ দৃষ্টি। এইসব সময় শিক্ষকদের মনে হতাশা, অপরাধবোধ, বৈরাগ্য আর রাগের অদ্ভুত অসমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি হয়। এর ফলেই সম্ভবত, হঠাৎ একটা লুপ আঁকতে আঁকতে স্যার হামদর্দের টনিক সিংকারা বিজ্ঞাপণের রোগা জাভেদ জাফ্রির মত ঢলে পড়ে গেলেন। অজ্ঞান। ছাত্ররা চোখেমুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে স্যারকে শোভাযাত্রা করে টিচার্স রুমের টেবিলে শুইয়ে দিয়ে সবে মহানন্দে বেরোতে যাচ্ছে ---- প্রায় হাহাকার করতে করতে স্যার টেবিল থেকে ছুটে এলেন " দাঁড়াও দাঁড়াও, আর একটা ডেরিভেশন করে দিই....সিলেবাস শেষ হবেনা !" অনেকদিন পরে এই গল্প বলতে বলতে সেদিনের দুর্দান্ত ছাত্রদের একজনের চোখ একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলো।
তবে বয়স হলেই মানুষ খুব বিবেচক হয়ে ওঠে, এরকম নয়, বস্তুত চারপাশে যাসব ঘটতে দেখি। এজ ইস জাস্ট আ নাম্বার -- কথাটা খুবই সত্যি। বয়স নির্বিশেষে মানুষ একইরকম অবিবেচক কাজ করেন, কথা বলেন। এই নিয়েই এই পর্বটি শেষ করব।
কোন এক অজ্ঞাত কারণে একজন মানুষ অন্য মানুষকে প্রজনন সম্পর্কিত প্রশ্ন করে। বাচ্চা কবে হচ্ছে, এইটাই প্রশ্ন। সহজ ও সরাসরি। বন্ধুবান্ধবদের কাছেও শুনেছি, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সেই এগারো বারো ক্লাসে জুলজি পড়েছি, বেশি জানিনা। তবে আমার ধারণা অন্য কোন জন্তু পরস্পরকে দেখা হলেই বা ফোনে কথা হলেই "কবে আনপ্রোটেক্টেড সেক্স করছো?" প্রশ্নের অবতারণা সম্ভবত করে না। অথচ জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, কুশল, করোনা, নৈরাজ্য, মোদিরাজ্য, সামরিক অভ্যুত্থান বা বিপ্লব, যে উপলক্ষেই কথা হোকনা কেন, এই প্রশ্নটা উঠবেই। বুঝতে পারি অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহলই এর জন্য দায়ী। সদ্য আরেকবার সম্মুখীন হওয়ার পরে ভেবে দেখলাম একটা প্রশ্নোত্তরের টেমপ্লেট করে রাখি। এরপর থেকে কাজে লাগবে। আপনারাও করে দেখতে পারেন।
মধ্য পঞ্চাশের জনৈক ব্যক্তি ফোনে বাচ্চা কবে হবে জিগ্যেস করার পরবর্তী কাল্পনিক সংলাপ
আমিঃ বলছি। আপনার শরীর কেমন আছে? ঘুম হয়?
তিনিঃ না, কই আর হয়। রোজ শুই, শুয়েই থাকি
- তো শুয়ে কী করেন? সেক্স?
- (হিরণ্ময় নীরবতা)
- জন্মনিরোধক ব্যবহার করলেন? দেশে কিন্তু বিজেপি বেড়েছে খুব
ওপাশে ফোন কাটার আগে কেমন সব শব্দ হতে থাকে, নেটওয়ার্কের সমস্যা ও হতে পারে। আমি জানিনা এরপর কী হতে পারে। ফোন কেটে দেওয়ার থেকে বেশি আর কিই বা হতে পারে?
এই দুই পর্ব ধরে যেসব অতি সাধারণ ব্যক্তিগত কিস্যা আপনারা শুনলেন তা পৃথিবী বেড় দিয়ে আসা সেই দুটি নদীর জলের মত। ঐ জলে অমৃত ও বিষ আছে, কিন্তু এতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অতীতে যেমন, ভবিষ্যতেও কয়েকটি নতুন ফুল ফুটবে এই সামান্য প্রত্যাশা আমাদের থাকা উচিত।