আর-একটা ব্যাপার প্রায়ই ঘটে। অতি দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের সমালোচনায় আমরা তাঁদের অ্যাকাডেমিক ব্যর্থতাগুলো নিয়ে সরব হই। এটা করার সময় আমরা ভুলে যাই, এই নেতারা খুব ভালোভাবে এলিটিজমকে প্রগতিশীলতা আর জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সমার্থক করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা এত মসৃণভাবে হয়েছে যে তাঁদের ফাঁকিবাজি নিয়ে সমর্থকেরা গা করছেন না। কিন্তু ব্যাপারটা এত মসৃণভাবে যে হতে পেরেছে তার একটা বড়ো কারণ—কথাটা আংশিক সত্যি।
অ্যাকেসনকে ওই একই সাক্ষাৎকারে13 জিজ্ঞেস করা হয়, দেশের নাগরিককে ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে—এই কথা তিনি বলেছেন কি না। উত্তরে তিনি বলেন যে, হ্যাঁ, এরকম তিনি মনে করেন। তখন তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে তিনি নিজেই তার এক সপ্তাহ আগে অন্য একটি সাক্ষাৎকারে ইতিহাসের কুইজে ডাহা ফেল করেছেন, কিন্তু তিনি এতে বিচলিত হননি। বরং একরকম করে নিজেরই মাপকাঠির পরীক্ষায় ফেল করার পরে অ্যাকেসন বলেন যে, উচ্চশিক্ষিত এলিটদের হাত থেকে সুইডেনকে রক্ষা করার দরকার হয়ে পড়েছে। এবং আমরা দেখতে পাই কীভাবে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান দিয়ে অ্যাকাডেমিক ব্যর্থতা ঢাকলেন।একই সঙ্গে বিতর্কের মুখটি ঘুরিয়ে দিলেন একটি পুরোনো প্রসঙ্গের দিকে, যাকে সমালোচকেরা লিবেরাল এলিটিজম বলে থাকেন। আর, একবার প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে নিজেদের দাগিয়ে নিতে পারলে খুব সহজেই স্ববিরোধিতা বা একরকম করে দেখতে গেলে আদর্শগত ফাঁকফোকরগুলো উপেক্ষা করা যায়। এমনকি সেই ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি তাঁদের সমর্থককুলের কাছে আরোই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। বিশেষ করে লিবেরাল এলিটদের খেটে-খাওয়া মানুষ খুবই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে আজকাল, ফলে অ্যাকেসনের এলিটিজম-বিরোধী কথা (কার্যক্ষেত্রে তিনি যাই হোন) তাঁকে ‘জনতা’র কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তাঁর সমস্ত ভুল, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যায় রাষ্ট্রনীতি—সবই ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত মানুষ ক্ষমা করে ফেলে।
ব্যক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত থাকলেই মানুষের অসহিষ্ণু হয়ে যাওয়াকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে, এরকম নয়। আর সবাই যে দাঙ্গার জিগিরে প্রভাবিত হয়ে রয়েছেন, বা অতি দক্ষিণপন্থীর রাজনৈতিক চাল বুঝতে পারছেন না এমনটা নয়। এই নেতাদের সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার ফাঁকি, এলিট অবস্থানে থেকে এলিটিজম বিরোধিতা—এসব অসততা সমর্থকদের কাছে ধরা পড়ছে না এমন নয়। এখন প্রশ্ন হল, এই অসততা কি এতই মূল্যহীন যে অতি দক্ষিণপন্থার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া সমর্থকেরা সেসব বুঝলেও উপেক্ষা করছেন?
এর উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের ভেবে দেখতে হবে লিবেরালিজমের অসংগতিগুলো। অনেকদিন ধরেই ডান ও বাম দুই শিবির থেকে লেখালেখি হচ্ছে সেগুলো নিয়ে15-16। এক কথায় এর উত্তর হয় না, তবে ইঙ্গিত দেওয়া যায়। বলা যায়, তর্কযোগ্যভাবে যে সাধারণ স্তম্ভগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ফ্লেভারের লিবেরালিজমের প্রতিষ্ঠা, সেই গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ও সাম্য15—সেই স্তম্ভগুলি লিবেরাল সরকারের নানাবিধ কর্মসূচিতেই অল্পদিনে ভেঙে পড়ে। বলা যায়, কার্যক্ষেত্রে সরকার গঠনের পরে অনেক সময়েই লিবেরাল (সত্তরের দশক থেকে নিও-লিবেরাল) দলগুলি যেনতেনপ্রকারেণ স্ট্যাটাস কো রেখে দেওয়ার চেষ্টা করে এসেছে, সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে তারা কোনো সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেনি। হালের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উদ্বাস্তু সমস্যায় ইউরোপ যখন জেরবার এবং অর্থনৈতিক সংকট তারও আগে থেকে চলতে থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন অসন্তোষ দানা বাঁধছে, লিবেরাল এলিট নেতৃত্ব তখনও কপিবুক কথা বলে চলেছেন। সংখ্যালঘু মরছে দেখেও নিরুত্তাপ থাকা যদি সংবেদনশীলতার অভাব হয়, অপরাধ হয়, তাহলে চাকরি খোয়ানো/খিদে পেটে নিয়ে শুতে যাওয়া মানুষের অসন্তোষে তত্ত্বকথা বলাও একই জিনিস।
এসব আমার মনগড়া কথা না। রাষ্ট্রপ্রধানদের এই মতানৈক্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারবার ফুটে উঠেছে। একদিকে নিও-লিবেরাল স্ট্যাটাস কো থেকে তৈরি হওয়া মানবতার সংকট17, অন্যদিকে সেই মানবতার দোহাই দিয়েই স্ট্যাটাস কো রেখে দেওয়ার চেষ্টা18 লিবেরাল নেতৃত্বকে বারবার সমস্যার মুখে ফেলে দিচ্ছে। জার্মানির চ্যান্সেলর মের্কেল এবং হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ওর্বান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একই মঞ্চে যখন ইউরোপের সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখেন, দেখা যায় সমাধান তো দূর অস্ত্—সমস্যাটার সংজ্ঞা নিয়েই প্রবল মতবিরোধ আছে। মের্কেল যাকে ইউরোপের সমস্যা বলে মনে করছেন, ওর্বান তাকে শুধুই জার্মানির সমস্যা বলে মনে করেন18। ওর্বান বলেন, যারা আসছে তারা সকলেই জার্মানি পৌঁছতে চায়, তারা হাঙ্গেরি বা অস্ট্রিয়ায় থাকতে চায় না। হাঙ্গেরি কঠোরভাবে অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে আসলে জার্মানির সমস্যার সমাধান করছে, কারণ না হলে দিনপ্রতি ৪-৫ হাজার উদ্বাস্তু জার্মানি পৌঁছে যাবে, যা সামলানোর মতো ক্ষমতা সেদেশের নেই18। মানবতাবাদী বক্তৃতা দেওয়া আর বহুদেশ মিলে তৈরি করা একটা সমস্যার সমাধান করা এক নয়। সমস্যার সমাধানে যেটা প্রয়োজন ছিল, তা হল দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। এই জায়গাটায় শুধু উদ্বাস্তুবিরোধী রেটোরিকে বিশ্বাস করা সাধারণ মানুষই শুধু ক্ষুব্ধ নন, উদ্বাস্তুদের নিজেদেরও ক্ষোভ রয়েছে।
সাধারণভাবে বর্তমান উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই তেল-সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলির কথা না এসে পারে না। গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের উপসাগরীয় দেশগুলো কেন আশ্রয় দিচ্ছে না, এই বিষয়ে বহুদিনের বিতর্ক রয়েছে19-22। তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডন বাদে অন্যান্য আরব দেশ সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জায়গা দেয়নি। কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি—বিশেষ করে এই দেশগুলোর নাম আলোচনায় উঠে আসছে তাদের অগাধ বিত্তের জন্য, সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিলের জন্য, সর্বোপরি যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই মানুষগুলো ঘরছাড়া হলেন, তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনদাতাদের তালিকায় এই দেশগুলোর নাম থাকার জন্য। টাইম পত্রিকার প্রতিবেদন21 থেকে:
“The missing linkage in this tragic drama is the role of Arab countries, specifically the Gulf countries,” says Fadi al-Qadi, a regional human rights expert in Jordan. “These states have invested money, supported political parties and factions, funded with guns, weapons et cetera, and engaged in a larger political discourse around the crisis.”
উপসাগরীয় দেশগুলির উদ্বাস্তু সমস্যায় এখনও পর্যন্ত অবদান হল ১) নগদ অর্থ, ২) আগে থেকেই সেই দেশে থাকা সিরিয়ার লোকেদের ভিসা মেয়াদ বাড়ানো, ৩) সিরিয়া আগত উদ্বাস্তুরা ওই দেশগুলিতে যে স্বাগত সেই মৌখিক প্রতিশ্রুতি। যদিও কার্যক্ষেত্রে তিন নম্বর প্রতিশ্রুতি ফলপ্রসূ যে হবে না, তাও আগে থেকেই ডকুমেন্টেশন পদ্ধতি দিয়ে ছকে রাখা। উদাহরণ দেওয়া যাক। সৌদি আরব অতীতে দাবি করেছে যে ২০১১ থেকে ২০১৫-র টাইমের প্রতিবেদন লেখা অবধি তারা নাকি ৫ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে, এবং তারা নাকি চাইলেই আসতে পারে, যদিও তারা উদ্বাস্তু হিসেবে নথিভুক্ত হতে পারবে না। বলা বাহুল্য, নথিভুক্তি না হলে সংখ্যাটা কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয় এই কূট প্রশ্নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, নথিভুক্ত না হওয়া উদ্বাস্তু পরিবার কীভাবে তার প্রাপ্য সুবিধাগুলি নেবে? এরপর আছে ভিসা সমস্যা। চারটে দেশ বাদে (ইয়েমেন, মরিটানিয়া, সুদান, আলজিরিয়া) বাকি আরব দেশগুলোর জন্য সিরিয়ানদের ভিসা লাগে। ভিসা প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল, বেশিরভাগ সময় বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে পাওয়াও যায় না19। যদি বা কোনোভাবে ভিসা মঞ্জুর হয়, অনেক ক্ষেত্রেই চাকরি বা কাজের পারমিট মেলে না21। কাতার বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশে বহুদিন ধরেই মানুষ বহিরাগতদের প্রতি বিরূপ (টাইম পত্রিকা ‘জেনোফোবিক’ বলেছে), কারণ সেখানে আগে থেকেই অভিবাসীরা সংখ্যায় ভারী। কুয়েত এমনকি ২০১২ সালে সরকারি ভাবে ঘোষণা করে যে পরবর্তী দশ বছরে (অর্থাৎ ২০২২-এর মধ্যে) তারা দশ লাখ অভিবাসী কমিয়ে ফেলবে19।
একথা অনস্বীকার্য্ যে উদ্বাস্তুদের যে সংকট, এবং তাঁদের নিয়ে যে সংকট—এই দুইই জটিল। কুয়েত বা কাতারকে (৪২ জন শরণার্থীকে তারা আশ্রয় দিয়েছে, আর ৫৪ হাজার আগে থেকেই কাতারবাসী সিরিয়া নাগরিকের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোকেও তারা "আশ্রয়" হিসেবে দেখিয়েছে23) সমালোচনা করার সময় এই কথাটা যদি মনে রাখতে পারি যে সেই দেশগুলোতে নাগরিক ও অভিবাসীর অনুপাত নিয়ে আগে থেকেই একটা সমস্যা রয়েছে, হাঙ্গেরি বা অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। অস্ট্রিয়ার সিবাস্টিয়ান কার্জ সমুদ্রতীরের মৃত শিশু আয়লান কুর্দি সম্পর্কে একটি মন্তব্য করে বিতর্ক ও ক্ষোভের সম্মুখীন হন। সেই ন্যায্য ক্ষোভ আমরা উপসাগরের অচলায়তনগুলির ওপর ঝরে পড়তে দেখি না কেন?