সদ্যসমাপ্ত টোকিও অলিম্পিকে ভারতের খেলোয়াড়েরা কিছু মেডেল জেতার পর ব্যাপক হইচই হয়েছে। যথারীতি এতে জাতীয়তাবাদী রং লেগেছে কোথাও কোথাও। নরেন্দ্র মোদীর আমলেই এখন পর্যন্ত সবথেকে বেশি, সাতটি পদক আসায় কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুন্ন হয়েছেন, কারণ বর্তমান বিজেপি সরকার যে কোন ভাবে অন্যের কৃতিত্ব নিজের গায়ে জড়িয়ে নেওয়ায় বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে এসেছে । যদিও সংখ্যা হিসেবে সাত খুবই কম, বিশেষ করে ভারতের জনসংখ্যা বিচার করলে, এবং এই নিয়ে কোন কোন বিদেশী মিডিয়ায় লেখাপত্রও বেরিয়েছে। এরই মধ্যে ড্যাং ড্যাং করে স্বাধীনতার ৭৫ বছর এসে গেল। সব মিলিয়ে হাইপ তুঙ্গে।
তো, কথা হচ্ছে, যে কোন হইচই এরই কিছু ভালো দিক আছে। তার একটা হলো, হইচই হলে ধুলো ওড়ে, বিস্তর লোকে স্বল্পকালীন খোঁজখবর রাখতে শুরু করে। আমরা অল্প সময়ের জন্য স্বাভাবিকত্বের স্বাদ পাই। এই যেমন গল্ফে অদিতি অশোক অসামান্য খেলে, বেশিরভাগ সময় দুই বা তিন নম্বরে থেকে শেষ পর্যন্ত যখন অল্পের জন্য ব্রোন্জ হারালেন, ধারাভাষ্যকার বললেন, "ভারতে এক বা দুদিনের জন্য গল্ফ ক্রিকেটকে জনপ্রিয়তায় পাল্লা দেবে"। অন্য বহু দেশেই জনপ্রিয়তার এই ওঠানামা সম্বচ্ছর চলে। ভারতে হয় শুধু অলিম্পিকে কেউ পদক জিতলে। হইচইয়ের আরেকটা ভালো দিক হলো, এই সুবাদে কিছু পুরনো পাপ বেরিয়ে পড়ে। ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাস ক্যাকটাসের মত কণ্টকাকীর্ণ, যেখানে আমলাতন্ত্রের অপদার্থতা ও দুর্নীতির কাঁটা বাদ দিলে সেখানে শুধু পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস।
বর্তমান ভারতীয় মিডিয়ার কেঁচো খুঁড়ে ভগবানের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর কোন ইচ্ছা না থাকলেও, বিদেশি মিডিয়ায় এইসব নিয়ে কিঞ্চিৎ লেখালেখি হচ্ছে। আমরা, আর কিছু না, শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যেই সেইসব পোস্টমর্টেম রিপোর্টে চোখ রাখতে পারি। প্রায় সমস্ত প্রতিবেদনেই যেমন দেখা যাচ্ছে সরকারী বিনিয়োগের অভাব একটা বড় কারণ। বিবিসি, ফার্স্ট পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইম্স থেকে চীনের সরকারি (আর কোনরকমই বা আছে) মিডিয়া পর্যন্ত এই একটা বিষয়ে একমত। এর পাশাপাশি অন্য যে কারণগুলো উঠে এসেছে তার মধ্যে একটা হলো ভারতের অবহেলিত ক্রীড়া সংস্কৃতি। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকের পর ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন জানায়, খেলাধুলো ভারতবাসীর কাছে সবথেকে দরকারি জিনিসগুলোর মধ্যে পড়েনা। বেশির ভাগ মানুষের প্রায়োরিটি লিস্টের প্রথম তিনে খেলাধুলোকে কেরিয়ার করা অপশন হিসেবেই অনুপস্থিত। অন্য প্রায় যেকোন পেশা নিয়েই মানুষের আগ্রহ ও স্বপ্ন আছে, ক্রিকেট বাদে অন্য খেলা নিয়ে সেই আগ্রহ অনুপস্থিত। এই ব্যাপারটা এত বেশি পরিমাণে আমাদের চারপাশে দেখা যায়, যে এটা সংবাদপত্রে লেখার আগে থেকেই আমরা জানি। আমাদের অনেকেরই ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে কেউ না কেউ আছে যারা খেলাধুলোয় ভালো ছিলো, কিন্তু একই সঙ্গে পড়াশুনো বা অন্য কোন অর্থকরী জীবিকায় সম্ভাবনা দেখানোয় তাদের আর খেলা নিয়ে এগোনো হয়নি।
এবং এর সঙ্গত কারণ আছে। কয়েক বছর আগে অন্য একটি ধারাবাহিক লেখায় এক সময়ের প্রতিভাবান ফুটবলারদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখেছিলাম। প্রায় পনেরো কুড়ি বছর পর ঐ লেখাটির জন্য আমি পুরনো সহখেলোয়াড়দের সাথে দেখা করে জানতে পারি তাদের সিংহভাগ এখন বেহালা - টালিগন্জ করুণাময়ী - ট্রামডিপো রুটে অটো চালায়। এক সিনিয়ার, তদানীন্তন সুব্রত কাপ চ্যাম্পিয়ান মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলের ডাকসাইটে গোলকীপার একটি স্কুলবাস চালায়, কেউ কেউ স্টুডিওতে ছোটখাট কাজ পেয়েছে। ফুটবল ভারতে যথেষ্টই জনপ্রিয়, সে নিয়ে উন্মাদনাও আছে। কিন্তু ফুটবল কারা খেলবে এই প্রশ্নে ভারতবাসী একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। দুর্দান্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছাড়া খুব গরীবেরা অবশ্যই বেশিদিন খেলতে পারবেনা। ওপরে যাদের কথা বললাম তাদের অনেকেই সেই আর্থসামাজিক স্তরের। আমাদের এক কোচ, কিছুটা হতাশ হয়েই একবার বলেছিলেন আমাদের দেশে নিম্ন মধ্যবিত্তের পক্ষে খেলাধুলো যাও বা সম্ভব, গরীবের পক্ষে সম্ভব নয়। ফুটবলের অবস্থাই যদি এই হয়, অন্যান্য খেলার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
অন্য আরেকটি কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ভারতের মেয়েদের খেলাধুলো করার অসুবিধার কথা। এই অলিম্পিকেই অন্তত তিনটি ইভেন্টে (হকি, আর্চারি, গল্ফ) মেয়েরা পদক জিততে পারতেন। উইমেন্স হকি এবং গল্ফে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো, এবং সেখানে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা যে লড়াই দেখালেন, তা অভাবনীয়। প্রথম বিশ্বের দেশ গ্রেট ব্রিটেন (মহিলা হকিতে গতবারের সোনাজয়ী ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (গল্ফে সোনা ), জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মত দেশের খেলোয়াড়দের সাথে সমানে লড়ে যাওয়ার এবং কখনো কখনো জেতার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা আমাদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার এবং সমাজের তরফে উৎসাহ দেওয়া নেই, বরং নানা অজুহাতে নিরুৎসাহ করার ঐতিহ্য আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোনাজয়ী গল্ফার নেলি কোর্দা ফাইনাল রাউন্ডে নামার আগে বা জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস অলিম্পিকে আসার প্রায় তিন মাস আগে থেকে তাদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিপুল পরিমাণ লেখা বেরোতে থাকে। সেখানে কীভাবে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়েছেন, কোন কোন প্রতিপক্ষের সাথে তাঁদের জোর লড়াই হবে, টেকনিকাল খুঁটিনাটি --- কী নেই ! অন্যদিকে ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে লেখা শুরু হয় তাঁরা পদক জিতলে, বা একেবারে জেতার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে। এখন, সব দেশকেই সব খেলায় আগ্রহী হতে হবে এরকম কোন মাথার দিব্যি নেই, কিন্তু পদক তালিকায় সেই দৈন্য প্রকাশিত হলে হাহাকারেরও কোন মানে হয়না। বরং এই সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে কেউ কেউ ভালো ফল করছেন এতে ভারতবাসী হিসেবে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকার কথা। আমরা এঁদের একজনের কথাও কয়েক সপ্তাহ পরে মনে রাখবো না।
অলিম্পিক নিয়ে হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে উঠে হইচইয়ের খারাপ দিকও আছে। অমুক দিবস তমুক ডে'র মত প্রতি অলিম্পিকেই ভারতীয় জনতা হঠাৎ একদিন পদক জেতার খবর পেয়ে প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই সমস্ত উত্তেজনাই কতিপয় পদকজয়ী ঘিরে। কয়েকদিনের জন্য খেলোয়াড়েরা সেলিব্রিটি হয়ে যান। খবরের কাগজে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা কথাবার্তা লেখা হতে থাকে। শুধু যে খেলাটা ঘিরে এতকিছু, সেই বিষয়ে কোন আগ্রহ তৈরি হওয়ার বা করার চেষ্টা দেখা যায়না। এবং অবধারিতভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই উৎসাহের পারা নেমে যায়। এর ফলে আমার আপনার পরিচিত বৃত্তের বাচ্চাদের সেই খেলাটিতে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা তলানিতেই থেকে যায়। আমার মনে আছে, আশির মধ্যভাগ থেকে নব্বইয়ের শেষ অবধি ক্রিকেট ফুটবল বাদেও অন্য খেলা আলোড়ন তুলতো। ন্যাশনাল গেমসের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড তো আমরাই টিভিতে দেখেছি। পাড়ার মাঠে কোন কোনদিন খুব ভোরের দিকে একজন জ্যাভলিন থ্রোয়ার আসতেন প্র্যাক্টিস করতে, দৌড়োতে গিয়ে দেখেছি। খেলাধুলোর খবর, টেকনিকাল আলোচনা সমেত দৈনিক সংবাদপত্রেই থাকত, এবং সেসব পড়ে আমরা পাড়ার মাঠে সেসবের ব্যর্থ অনুকরণ করার চেষ্টাও করতাম। এই সংস্কৃতিটা অনেকটা পাল্টে গিয়েছে।
যাই হোক, যে কথা হচ্ছিলো। অন্যবারের মত টোকিও অলিম্পিকেও যেসব খেলোয়াড়েরা পদক পেলেন, তাদের নিয়ে হইচইয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন অন্যরা। এই টোকিও অলিম্পিকেই যেমন বহু ইভেন্টের ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নেওয়া, পদক তালিকার বেশ কিছুটা নিচে থাকা ভারতীয় খেলোয়াড়দের নাম আমরা জানিনা। মিডিয়ার মত প্রশাসকদেরও যাবতীয় নজর জিতে আসাদের নিয়ে। জয় শাহ (বিসিসিআই ) ঘোষণা করেছেন পদকজয়ীদের টাকা দেওয়া হবে। ভালো খেলিয়া, নিজেদের সেরা দিয়েও পরাজিতদের জন্য কোন ইনসেনটিভ শোনা যায়নি।
প্রাক্তন অলিম্পিয়ান অঞ্জু ববি জর্জ সম্ভবত রিও অলিম্পিকের খারাপ ফল নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, পদক জেতা পরের কথা, অলিম্পিকে ফাইনাল রাউন্ডের যোগ্যতা অর্জন করা, এবং সেখানে নিজের সেরা পারফরম্যান্স করে আসাটাই প্রচণ্ড কৃতিত্বের ব্যাপার। সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারলে পদক আপনিই আসবে।
সুতরাং আমরা এই লেখায় অন্তত কয়েকজন এমন ক্রীড়াবিদের নাম লিখে রাখি যাঁদের কথা শোনা যাচ্ছেনা। ধরা যাক দীক্ষা ডগরের কথা। গল্ফে অদিতি অশোকের পাশাপাশি ইনিও ফাইনাল রাউন্ডে খেলছিলেন। গল্ফেই উদয়ন মানে, অনির্বাণ লাহিড়ী পুরুষদের ইভেন্টে ছিলেন। ২০ কিমি রেসওয়াক ইভেন্টে ফাইনাল রাউন্ডে ছিলেন সন্দীপ কুমার, রাহুল রোহিলা, ইরফান থোরি (পুরুষ ), প্রিয়াংকা গোস্বামী এবং ভাবনা জাট (মহিলা )। মহিলাদের ডিসকাস থ্রো তে কমলপ্রীত ক'র । রোইং এ অর্জুন লাল এবং অরভিন্দ সিং। সেইলিং এ পুরুষদের ইভেন্টে বিষ্ঞু সার্ভানন, কে সি গণপতি, বরুণ ঠক্কর, এবং মহিলাদের ইভেন্টে নেত্রা কুমানন। শুটিং এ সৌরভ চৌধুরি। কুস্তির দীপক পুনিয়ার কথা আমরা তাও একটু আধটু শুনতে পেয়েছি, পঞ্চম স্থানে শেষ করায়। হাতে গোনা যে কয়েকজনের নাম এখানে লেখা হলো, এঁরা সবাই স্ব স্ব বিভাগে ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছিলেন। এর বাইরে রয়ে গেলেন বহু ক্রীড়াবিদ, যাঁদের অনেকের নাম আর কোনদিনই প্রচারের আলো পাবেনা। প্রসঙ্গত ভারত এবার মোট ১২০ জনের দল পাঠিয়েছিলো, দেশের ইতিহাসে এর থেকে বেশি খেলোয়াড় আগে কখনো অলিম্পিকে অংশ নেন নি।
টোকিও অলিম্পিক চলাকালীন যেসব ইভেন্টের খেলা দেখতে পাইনি, সেগুলো পরে খুঁজে দেখতে চাইছিলাম। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অন্তত ফোনে তোলা ভিডিও ক্লিপ তুলে দেন কেউ না কেউ। সেইসব ভিডিও খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, পদকজয়ী সমস্ত ভারতীয় ক্রীড়াবিদের সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কলে কথা বলছেন --- এরকম অসংখ্য রেকর্ডিং আছে। শুধু টোকিও অলিম্পিক না, আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে বলার মত কোন সাফল্য এলেই কনফারেন্স কল করে সেই খেলোয়াড়কে পিএম অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অবস্থা এমন, যে আপনি দীপিকা কুমারীর তীরন্দাজী দেখতে চাইলে আপনাকে প্রধান মন্ত্রীর ভিডিও কলের ক্লিপ স্ক্রল করে দেখতে হবে।খুব পরিষ্কার ভাবেই প্রধান মন্ত্রীর দপ্তর এটা প্রচার করতে চায় যে দেশের ক্রীড়াবিদের পাশেই মোদিজী আছেন। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনও সাংঘাতিকরকম অপ্রতুল, রিও অলিম্পিকের খারাপ ফলের (১১৭ জনের দল, পদক ২ ) পরে কেন্দ্র সরকার ক্রীড়াখাতে আগের থেকে বেশি বিনিয়োগ করছে। এবং সেইসব খবরও যাতে ভাইরাল হয় তার সব ব্যবস্থাই হয়েছে। এক সেন্টিমিটার রাজনৈতিক মাইলেজও ছাড়া হয়নি।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে অলিম্পিক নিয়ে হইচইয়ের সাথে খেলাধূলা ভালোবাসার সম্পর্ক কম, কিছুটা টাইম পাস, কিছুটা রাজনীতি, কিছুটা জিঙ্গোইজম, বেশিটাই চুরি এবং পড়ে পাওয়া বাকি দুআনা খেলোয়াড়ের কেরিয়ার নিয়ে জুয়া। পরের অলিম্পিকে ভারত এবারের থেকে এক আধটা বেশি বা কম পদক পাবে, এবং আগে পরে চক্রবৎ সেই সেই ঘটনাই ঘটতে থাকবে যা এতদিন ধরে ঘটছে। প্রশাসনের অশ্লীল সুবিধাবাদ, দিনের পর দিন মিডিয়ার জঞ্জাল প্রতিবেদন, ক্রিকেটের নামে উদ্বাহু দর্শকের অন্য খেলার প্রতি হিমশীতল উপেক্ষা যদি আমাদের উত্তেজিত না করতে পারে, অলিম্পিকের পদক নিয়ে সাময়িক হইচই নিরর্থক।
হ্যাঁ আবার কি! তা না তো কি সত্যি সত্যি চীনের মত লেগে থেকে পদক আনার চেষ্টা করবে নাকি? এহ!