ইউরোপ নিয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার আলোচনায় ইতি টেনে, এবার আমরা খুব সংক্ষেপে অন্য মহাদেশগুলো দেখে নেবো। উত্তর আমেরিকা দিয়ে শুরু করি। ক্যানাডার জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে আমাদের বেশি সময় নষ্ট করার দরকার নেই। স্বঘোষিত ফেমিনিস্ট, উচ্চশিক্ষিত, লিবেরাল, চমৎকার বক্তা ট্রুডো ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়, তাকে ভিলেন বললে লোকে হাসবে। ২০২০ সালের একটা দূর্নীতি, যাতে তাঁর পরিবার যুক্ত ছিলো বলে অভিযোগ, সে বাদে তেমন কোন বড়ো কেলেঙ্কারি তাঁর বিরুদ্ধে নেই। ক্যানাডার মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েও আমাদের খুব বেশি আলোচনার অবকাশ নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত অপরিসীম অপদার্থতা, দূর্নীতি আর নার্সিসিজম নিয়ে আর কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন নি। গাদা গাদা পেপার, বই, ব্লগ ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদন হয়েছে, হয়ে চলেছে ট্রাম্পকে বিষয় করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৈনন্দিন বিক্রয়যোগ্য খবরের মধ্যে ট্রাম্প ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কান্ডকারখানা প্রথমদিকে থাকে, তা সে যে তরফেরই চ্যানেল হোক। আটের চেয়ারে ট্রাম্পের জন্য ইঁট পাতা থাকুক, আমরা বরং আমেরিকার অন্যদিকে যাই।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করাকালীন সেখানকার এক রসায়নের ছাত্রের সাথে আমার প্রায়ই গল্প হতো। ছেলেটি ব্রাজিলের, তখন সে ডক্টরেট করছে। ব্রাজিল বললেই আমার মন চিরকাল উচাটন হয়। রিও বা সাও পাওলোর ছবি, টিভির পর্দায় বা নেটে যেমন দেখেছি, ভেসে ওঠে। সিটি অফ গডের দৃশ্যাবলী, ফুটবল মাঠের ম্যাজিক স্টিলগুলো, অসংখ্য খেলোয়াড়ের নাম, তাদের নিয়ে মাতামাতি, বিশ্বকাপে কলকাতার চালচিত্র ---এইসব অজস্র ছবির কোলাজ। কিন্তু সেই ছেলের কাছে আমি অন্য এক ব্রাজিলের আঁখো দেখি গল্প শুনতাম। ছেলেটির বাবা একজন নামকরা সার্জেন, অগাধ পয়সা। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ ছাড়া পড়া খুবই খরচসাপেক্ষ। সেই ছেলে খুবই অপরাধবোধ নিয়ে বলেছিলো, তার বাবার কাছে ঐসব খরচ গায়েই লাগেনি। একেবারে হাইস্কুল থেকে ছেলেটি তাই মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা। স্কুল কলেজের পড়াশুনোয় তাকে কোনদিন কোন কাজ করতে হয়নি, অথচ তার বেশিরভাগ বন্ধুরাই নানারকম ছোটখাটো কাজ করতে বাধ্য হয়েছে পড়ার পাশাপাশি। ব্যক্তিগত প্রিভিলেজ, পারিবারিক বৈভব, ব্রাজিলের আর্থিক বৈষম্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (পৃথিবীর অন্যত্রও) ক্রমশ বেড়ে চলা "ট্রাম্পিয়ানা" তাকে বিষন্ন করতো। বিপুল অপরাধবোধের জন্য সে সমস্ত বিষয়েই প্রবলভাবে অ্যান্টি-এলিট ছিলো। এরপর সে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে। সাতাশ বছর বয়সেই তাকে আমরা হারাতে পারতাম, যদিনা তার কাছের দুই বন্ধু তার পাশের থাকতো। ডক্টরেট শেষ করে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিদায় নিয়েছে, কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি।
এই ছেলেটির কথা আমি গত প্রায় তিনবছর ধরেই মাঝে মাঝে ভাবি। দূর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, কোটিপতির সর্বগ্রাসী লোভ, কোটি কোটি দেশহীন মানুষ আর সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা মৃত শিশুর মত এই ছেলেটির কথাও বারবার ফিরে আসে। আরো বেশি করে ফিরে আসে, যখন ব্রাজিলের কথা ওঠে। ব্রাজিলের "সিংহাসনে" এখন বোলসোনারো। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময় যাঁর বিরুদ্ধে রিও'র সেনা ছাউনিতে বিস্ফোরণ ঘটানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছিলো, এবং তদন্তে বলা হয় " (he has) serious personality deviation and a professional deformation", "lack of moral courage to leave the Army", " (he) lied throughout the process", পরে নির্বাচনী প্রচারে যাঁর তলপেটে ছুরি বসিয়ে দেয় এক উন্মাদ এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনই শহরের পথে নামে হাজারো মানুষের মিছিল -- যাঁদের প্রধান স্লোগান ""Ele não" ("Not him") -- তাঁকে আমরা কোনভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারিনা। জাতীয়তাবাদী পপুলিস্ট নেতা হিসেবে বোলসোনারোকে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু এটুকু বললে তেমন কিছুই বলা হয় না। কট্টর দক্ষিণপন্থার যদি কোন চেকলিস্ট থাকে, যা থেকে মিলিয়ে মিলিয়ে কুমোরটুলীতে অর্ডার দিয়ে আমরা যদি কোন নেতা বানিয়ে আনি --- বোলসোনারো সেই অর্ডারি নেতার খুব কাছাকাছি যাবেন। গর্ভপাত বিরোধী, প্রো-গান, সনাতন লিবেরাল অ্যাজেন্ডাগুলোতে প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বামপন্থা বিরোধী, সমলিঙ্গের বিবাহ বিরোধী, সেকুলারিজম বিরোধী, বর্ণবিদ্বেষী, ইমিগ্রেশনবিরোধী, মিসোজিনিস্টিক --- বোলসোনারো এইসমস্ত চেকবাক্সেই টিক দিতে পেরেছেন। কোভিড-১৯ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চড়চড় করে বাড়তে থাকা করোনার সময়েও বিভিন্ন জমায়েতে অংশ নিয়েছেন। বোলসোনারোর মত নেতারা রাজনৈতিক মঞ্চে আসীন না থাকলে আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন হতো উগ্র দক্ষিণপন্থা কতদূর বিষধর হতে পারে।
ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থার চিৎকৃত লম্ফঝম্পের পাশাপাশি ভেনেজুয়েলার বামপন্থী সরকারের দীর্ঘদিনের কার্যকলাপ কিছুটা ফিকে লাগতে পারে, যদিও প্রকৃত প্রস্তাবে ভেনেজুয়েলার বর্তমান সংকট ও তার অভিঘাত গুরুত্বে কিছুমাত্র কম না। ২০১৩ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে থাকা মাদুরো দ্বিতীয়বারের জন্য "নির্বাচিত" হলেন, যখন বেশিরভাগ বিরোধী হয় ভয়ে দেশের বাইরে, নয়ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। নির্বাচন বৈধ নয় বলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তে সিদ্ধান্ত হলো, এবং বিশেষ সাংবিধানিক ধারায় হুয়ান গুয়াইডো নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকতে থাকা ভেনেজুয়েলা সেই থেকে আগ্নেয়গিরির ওপর বসে। একদিকে বাম-বিরোধী রাষ্ট্রগুলির একজোট হয়ে গুয়াইডোকে সমর্থন (ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভরা সভায় তাঁকে ডেকে এনে "ওয়ান ট্রু প্রেসিডেন্ট" ঘোষণা করা যার মধ্যে অন্যতম মজার ঘটনা), অন্যদিকে রাশিয়া বা চীনের মত দেশের মাদুরোর সমর্থনে দাঁড়িয়ে যাওয়া --- সব মিলিয়ে প্রহসন খুবই জমে উঠেছে। ট্রাম্প গুয়াইডোকে "জনগণের নেতা, তাদের স্বপ্নের নেতা" ইত্যাদি বলেছেন, আর মাদুরোকে বলেছেন "স্বৈরাচারী প্রজাপীড়ক"। আপাতত অবশ্য কোন পন্থা, কোন ক্যারিশমাই ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে পারছেনা। লাগামছাড়া পপুলিজম ভেনেজুয়েলার বর্তমান সমস্যার শিকড় কিনা সেকথা বিশেষজ্ঞরা বলবেন। কিন্তু কন্ট্রোলের বাজারে খাদ্য সংকটে পড়লে কেমন লাগে সেকথা জানার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। সরকারি পরিচালনায় তৈরী, শ্যাভেজের ছবি সাঁটা ভর্তুকির দোকানের বাইরে লাইন দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন -- এই দৃশ্য ভারতবাসী হিসেবে আমার চেনা। রেশন আর কেরোসিন তেলের লাইন, একেবারে হালে নোটবন্দীর সময় এটিএম আর ব্যাঙ্কের লাইন তো আমি দেখেইছি। ভেনেজুয়েলার সরকারি বাজারের ফাঁকা তাকের চেহারা ও গল্প পড়ছিলাম। সোভিয়েত শাসনের অভিজ্ঞতা যা শুনেছি তার সাথে ভেনেজুয়েলার Mercal এ মাংস দুধ ও চিনি ফুরিয়ে যাওয়ার গল্প ও অপেক্ষা খুব মিলে যায়। সে যাই হোক, আমার বন্ধু ইগরের গল্পটা শুনুন। ইগর ভ্লাদিমির আর্তেম --- তিন ভাই। পাড়ার কন্ট্রোলের দোকানে চিজ এসেছে, খুবই সামান্য সাপ্লাই। দোকানের বাইরে বিশাল লাইন। ইগরদের বাড়িতে সব মিলিয়ে জনা সাতেক মুখ। কোটার চিজে তো হবেনা। অতএব ইগর একটা বার কিনে আনে দোকান থেকে, আর একটা তাকের পেছনে লোকে দেখতে পাবেনা এমন জায়গায় সরিয়ে রেখে আসে আরো কয়েকটা বার। পরের ভাই যায়, সেও পায় একটাই বার। তারপর সবাই যখন জিনিস কিনেটিনে বাড়ি চলে গিয়েছে, পরেরদিন হাজির হয় আর্তেম। সে তো জানে কোথায় লুকোনো আছে চিজ। সেও একটা কিনে আনতে পারে। মধ্য এশিয়ায় শীতকালের কয়েক মাস কেটে গেলে আমরা দেখতাম গরীবের জন্য খাবার নেই। বড়োলোকের জন্য কি ক্যাপিটালিস্ট কি সোশ্যালিস্ট -- কোন দেশেই খাবারের অভাব হয়না।
ভেনেজুয়েলা আমাদের আলোচনায় বারবার আসবে। এর অন্যতম কারণ হলো, যে সমস্যাগুলো থেকে উদ্ধার পেতে মানুষ হুগো শ্যাভেজকে ঢেলে সমর্থন করেছিলেন, সেই সেই সমস্যাগুলো ভারতের মত দেশেও আমরা প্রবলভাবে অনুভব করি। ১৯৯৮ সালে শ্যাভেজ যখন ক্ষমতায় এলেন তখন ভেনেজুয়েলার বিচার ব্যবস্থার ওপর এক শতাংশ মানুষেরও আস্থা নেই। শ্যাভেজ এসেই নানাবিধ সংস্কার আনলেন, জুডিশিয়ারি সিস্টেমে বেশ কিছু ভালো সংস্কার এসে তাদের দায়বদ্ধতা বাড়ালো দূর্নীতি কমালো। এটা ১৯৯৯ সালের কথা। এর জন্যে রাষ্ট্রসংঘে শ্যাভেজ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা হয়। এরপরেই একটা মজার ব্যাপার হলো। শ্যাভেজ তাঁর চারজন জেনারেলের বিরুদ্ধে ক্যুয়ের অভিযোগ আনলেন কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট তাঁদের অপরাধী হিসেবে বিচার করতে অসম্মত হল। এরপর থেকে শ্যাভেজ বিচারব্যবস্থাকে দূর্নীতিগ্রস্ত এলিটদের সহযোগী হিসেবে দেখতে শুরু করলেন। আরো পরে, ২০০৪ সালে যখন সুপ্রীম কোর্ট শ্যাভেজবিরোধী একটা অনাস্থা পিটিশনকে বৈধতা দেয় ---শ্যাভেজ বিশেষ ক্ষমতাবলে অপছন্দের বিচারকদের সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় পছন্দের লোক নিয়োগ করা শুরু করেন। ২০০৮ সালের ইউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে পছন্দের লোক দিয়ে সাজানো ভেনেজুয়েলার সুপ্রীম কোর্ট ততদিনে কয়েকশো বিচারককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে ফেলেছে, সেই জায়গায় এসেছে কয়েকশো নতুন লোক।
শ্যাভেজ নিজে নতুন বিচারব্যবস্থাকে "জনগণের ইচ্ছা ও প্রয়োজনের প্রতি যত্নশীল" বলে উল্লেখ করেছিলেন, এবং সেইটাই তাঁর নিজের সংস্কারের দ্বারা তৈরী গণতন্ত্রের প্রহরীটিকে মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় কেন ডাচ বিশেষজ্ঞ Mudde তাঁর ২০১৫ সালের প্রবন্ধে লিখেছিলেন “populism is an illiberal democratic response to undemocratic liberalism.”