অন্যত্র কখনও যা বলা হয়ে গেছে, অন্যত্র কখনও যা বলা হয়ে ওঠেনি, সেইসব আবারও বলতে ইচ্ছে করে। অকালপ্রয়াত কবি তুষার রায় রচনা করেছিলেন ভারি মনোরম এক মৃত্যুদৃশ্য, নিজের।
"পাঁচ তারিখে" শীর্ষক সে কবিতায় লেখা হচ্ছে -
"আমি অকস্মাৎ পাঁচ তারিখে মরে যাব ভেবে
এই পশ্চিমের বারান্দায় ঝুঁকে আছি দেখ
দূর বনে খটাখট কুড়ুল চলছে, চিতার কাঠ
ফুল ফুটবে শেষ মালাটার জন্যে, আমি কী ভাবে শোবো
ভাবতে ভাবতে ডান পাশ বাঁ পাশ ওপর নিচ
ব্রিজ নদী খুব চাপা ঘুঘু ডাকলে খোলা আকাশ,
মোষের রঙ মেঘ, কবিতা ও আমার মায়ের কথা
ভাবতে ভাবতে এখন পশ্চিমের বারান্দায়
অকস্মাৎ পাঁচ তারিখে মরে যাব ভেবে....।
আমি আসলে কাঁটা দিয়ে হারানো দিন সুর আর
সুখগুলোকে তুলতে তুলেছি মরণ,
পাঁচ তারিখে তাই অতএব কথা রইল সবান্ধবে
না না বালাই ষাট
একলা পশ্চিমের বারান্দায় ঝুঁকে থাকব দেখো। "
১৯৭৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, অবশেষে, তুষার রায় মারা গেলেন। অবশেষে কথাটা এখানে ব্যবহার করলাম, কারণ মৃত্যুসম্পৃক্ত কবিদের সম্পর্কে মনে হলো এই শব্দটি অপরিহার্য্য। মৃত কবির চোখের নিচে জলের রেখা দেখেননি অন্তরঙ্গ বন্ধু ও কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। ওপরের কবিতাটি, হাসপাতালের বেড থেকে মৃত্যুপথযাত্রী কবির আরো কিছু কবিতার দিকে চোখ রাখলে মনে হয়, দেখার কথাও ছিলোনা।
কবিদের সিসমোগ্রাফের মত বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। জীবনের মৃদু স্পন্দন, বিচ্যুতি, মৃত্যুর ছায়া খুব সন্তর্পণে এলেও ধরা পড়ে যাবে এমন সটান তার ক্যালিব্রেশন। মৃত্যুটি ঠিক কিরকম, আত্মহত্যাই কি, নাকি খুন করে ফেলা হলো --- এইসব জটিল ও কঠিন প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন তিনি, তুষার রায়ের ভাই আরেক অকালপ্রয়াত কবি ফাল্গুনী রায়ের মৃত্যুতে। সততা সম্বলিত এক বিশ্বাসের কথা, হতাশার কথা, অর্থহীন কবিতার কথা উঠে এসেছিলো। পনেরোই আগস্ট, তেমন অবাক না হয়েই দেখছি, সম্ভবত ফাল্গুনী রায়ের মৃত্যুদিন।
সুতরাং স্বাধীনতা দিবসের এই কৃত্রিম ধোঁয়াওঠা উল্লসিত সময়ে, চকচকে নিভাঁজ সাফল্যের দিনে -- যখন একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মৃত্যুযাপন তুঙ্গে - কবিতাই কি নয় আমাদের ফিরে যাওয়ার নরম আলোয় মাখা পথটি? যে পথে তুষার ঝরছে, কিংবা ভেসে আসছে গুম্ফার ঘন্টার আওয়াজ?
পশ্চিমের বারান্দায় সামান্য রোদ এখনও পড়ে আছে। আরেকটু পরে, দিন পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে ভোরের দিকে গেলে --- ভাস্কর চক্রবর্তী আত্মহত্যা করতে বেরোবেন। একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে অপেক্ষা করবেন সেই মুহূর্তটির, যখন মৃত্যু আসবে দয়িতের মত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষে সকাল হয়ে গেলে ফিরে আসবেন মরা মুলতুবি রেখে। ভাস্কর চক্রবর্তী আর তুষার রায়ের বন্ধুত্ব ছিলো। তুষারের মৃত্যুদিনের এন্ট্রিতে ভাস্করের ডায়রিতে লেখা আছে -
“আমরা শিখেছিলাম, ভোরবেলার যে আলো, সেই আলোয় সমস্ত অসুখ সেরে যায় । শেষ পর্যন্ত, আমাদের কোনো অসুখ সারেনি । আমরা, তুষারের, রুগ্ন্, আর অযোগ্য বন্ধু । - অন্তরঙ্গতা সূত্রে , তুষারের কিছু কিছু প্রিয় জিনিসের কথা জানতে পেরেছিলাম ।“
তুষার রায়ের কবিতাগুলির রচনাকাল, আন্তর্জালের যে পাতায় সেগুলি পেয়েছি সেখানে নেই। তবে হাসপাতাল থেকে লেখা কবিতাগুচ্ছ, সম্ভবত কাছাকাছি সময়ে লেখা। তার একটিতে আছে -
“মাঝে মাঝে উদাসীন খুব সারাদিন
মাঝে মাঝে অভিমানী রাগ হয়
মৃত্যুর ওপর
আসছি এখনি বলে চলে গেছে সে ঘুর পথে
বসে বসে বেলা যায় তার রেখে যাওয়া
ছাতার তলায়
একদিন আসবে রাতে
যখন থাকবো গভীর ঘুমে।“
শুধু এই দুটি কবিতা নয়, একের পর এক কবিতায় একটু একটু করে নিঃসঙ্গতা দেখি। কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও কি? অভিমান এবং ফিরে বাঁচার ইচ্ছা। চক্রাকারে এই কটি বিষয় ঘুরে ফিরে আসে জোয়ার ভাঁটার মত। কিন্তু যে কথাটি নিরুচ্চার, তা আমাদের শব্দে ধরা দেয়না, ভাবে দেয়। কবির অকৃত্রিম সততা। যে সততা ও বিশ্বাসে ভর করে শিল্পী সৃজন করবেন দূরাগত মানুষের কথা ভেবে। অন্য দেশেই শুধু নয়, অন্য সময়ে আসবে যে পাঠক, তার জন্যে। মৃত্যুর মুখোমুখি তুষার ক্রমশই আলোর দিকে যেতে চাইতেন, জমাট নিরেট অন্ধকারের থেকে দূরে - নদীর কাছাকাছি, যেখানে অনেক মানুষ আসে। ভয় করতেন, নিঃসঙ্গ তাঁকে অপছন্দ করেন বন্ধুরা। ভয় করতেন, সিনিসিজম গ্রাস করছে কবিতাকে। কবিতা লিখতে ভয় করে - লিখেছিলেন একটি কবিতার প্রথম পংক্তিতে। তেতাল্লিশ বছর হয়ে গেল, মানুষ একরকম ভুলেই গেছে । মৃত্যুর পর ছাই খুঁচিয়ে দেখা হয়নি পাপ ছিলো কিনা- ওঁর কবিতার থেকে ধার করেই বলা যায় - এটুকুই যা ভরসা। বিস্মরণের দ্বারা মব লিঞ্চিং আটকানো গেছে।
আমরা, অতএব, কোথাও পৌঁছতে চাইছিনা। আমরা অতীতে যেখানেই ছিলাম, যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ভেঙে ফেলা খেলাধুলোয় ব্যস্ত ও ত্রস্ত মানুষ -- আমরা কেবল ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে নাড়াচাড়া করে দেখছি। দেখছি, অক্ষরগুলো এখনও বেঁচে আছে কিনা। দেখছি, গনগনে চিতার শিখার থেকে কেউ রুমাল নাড়ে কিনা। চিতাভস্মে সমান হবার যে আবেগপ্রবণ আকাঙ্খা তার লেশমাত্র নাই। এখন কেবল ধানখেতে কালো একটি ছেলে শুয়ে আছে, রক্তাক্ত। কালো কালির ওপর লাল কালির এই কাটাকুটি লিখেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী। ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়।
এইরকম তুচ্ছতায় মুড়ে যাওয়া বাস্তবতাই সিসমোগ্রাফের জন্য এক বিপজ্জনক অভ্যাস। কথাবার্তা অগুন্তি হতে থাকলে, মানুষের আনাগোনায় পায়ের ছাপ পড়ে মনে। যে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি খুঁজে চলে বেড নাম্বার ১৬'র রুগী, নদীর কাছাকাছি যেতে চায় --সেই নিঃসঙ্গতা না থাকলে স্তব্ধতা গ্রাস করে, কখনও। বিখ্যাত কিছু কবিদের আমরা জানি বটে, যাঁরা সমস্যাটাকে কীভাবে যেন সমাধান করে ফেলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা নিয়ম নন - ব্যতিক্রম। তাই অভিমানী, দরিদ্র ভাস্কর কবিতায় চিঠি লেখেন জনৈক দাশবাবুকে। শিল্পময় স্বার্থপর বেঁচে থাকাকে অসহ্য লাগে। ভাস্করের চিঠির ভাষায়, যেন, নিজ নিজ ঘামাচিতে মগ্ন মানবজাতি।
মানুষের যাপনে একদিন কবিতা শ্বাসপ্রশ্বাসের মত বইবে -- আশা করেছিলেন কোন কোন আশাবাদী কবি। ঘুমোতে যাওয়ার আগে, প্রতি রাতেই, অন্তত একটি করে কবিতা পড়তে ইচ্ছা করবে। অ্যালেন গিন্সবার্গের অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া প্রশ্নের জবাবে বলে দেওয়া যাবে তখন, কাল ঘুমোনোর আগে অমুক কবিতাটা পড়েছিলাম। আরো পাঁচটা চমৎকার হাস্যকর আশাবাদের মত, বলা বাহুল্য, এই আশাটিরও পরলোকপ্রাপ্তি ঘটেছে। কবিতা পড়ার মধ্যে দিয়ে দৈনন্দিনকে প্রশ্ন করার যে ক্ষমতা আয়ত্ত হয়, উপরোক্ত সিসমোগ্রাফ ক্যালিব্রেটেড হতে থাকে -- সেকথা আমরা এই আশ্চর্য্য সফল যাপনে অস্বীকার করেছি। সমস্ত কবিতাই তাই অবোধ্য এখন। অস্বস্তিকর, অকারণ অশ্লীল, হিংসায় উন্মত্ত, মাতাল বা ধ্বংসকামী। ভরা কলোসিয়ামে জনতার গর্জনে অভ্যস্ত আমাদের কান। মানুষের বেঁচে থাকা মরে যাওয়া তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হতে হতে সকলেই বাক্সবন্দী হয়ে যাবে – কবির এই কথাটি মিলে গেছে। "আত্মহত্যাপ্রবণতা ছুঁয়ে বসে আছেন সভ্যতা" - লিখেছিলেন উৎকণ্ঠিত ভাস্কর, আত্মঘাতী মানুষের পঙ্গপালের মত ভন্ডামির দিকে ছুটে চলা দেখে।
এই কাব্যময় মড়ক আমাদের ফিরিয়ে এনেছে কি কবিতার কাছে? বলতে পারিনা। শুধু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এক মধ্য তিরিশের কবিকে। পকেটে দুটি কবিতা নিয়ে গল্পকবিতার পথে হাঁটছেন। মৃত্যুপথযাত্রী এক কবির দল, মৃত্যুপথযাত্রী এক ভাষার শহিদবর্গ । যে রসিকতায় এই ইতিহাস লেখা হবে, বিস্মরণের, অবজ্ঞার, ক্রোধ ও ক্ষোভের ইতিহাস -- তার কোন তুলনা নেই। যে শিকল পরা হয়েছে তা তুলনাহীন। অবশেষে, ভাষাটিও মৃত ঘোষণা করে দেওয়া গেছে। কবির মতই।
“প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির কথা ভাবি
প্রতিটি পাতায় যেন আশা করা মহৎ কবিতা
এভাবেই ভালোবাসা প্রতিটি পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে
চালভূঁয়ে এরকমই মেনে যেতে যেতে তুমি
রহস্যের কোন গূঢ় কথা বলেছিলে- তবু দেখি
প্রতিটি শিকল আজও অটুটই আছে, আর
প্রত্যেক বিকেল রোজ নিকেল কে মুছে দিন
ডুবে যায় সন্ধ্যার বাদামি আঁধারে- দেখি
তখন বাঁ ধারে কিংবা ডানদিকে কোনো
দরোজা কি আছে কিনা ভাবতে ভাবতে আমি
প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির কথা ভাবি ।“ (চাবি, তুষার রায়)
কিন্তু মৃত্যু তো খেলা বই কিছু নয়। আদ্যন্ত সৎ বৈপরীত্য রাস্তার দুই পাড়ে দাঁড়ানো কবিকে যেভাবে মাতিয়ে তোলে, তার চেয়ে বড়ো ট্র্যাপিজ আর কই? কাজেই মৃতপ্রায় ভাষার মৃত কবিদের নিয়ে আমাদের বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বরং চাবি কবিতার ট্র্যাপিজটা দেখুন। হেড টেলের মত ছুঁড়ে দিতে দিতেও দেওয়া হলো না, সে জীবনের থেকে আর কীই বা পাওনা কবির - প্রতিটি পাতায় যেখানে মহৎ কবিতা অপেক্ষা করে নেই ? আরো একটি কবিতা লেখার পর ঘুমিয়ে পড়া এবং উঠে আবার কবিতা লিখতে বসার দুরারোগ্য বাসনা ছাড়া - এ নশ্বর এবং পরাধীন জীবন কেনই বা লোভনীয় হবে?
কিন্তু, সেই আপাত অন্ধকার বিষাদেও কবি লিখতে পারবেন -
"সিস্টার সব আলো জ্বেলে রাখুন
এখন আমি ঘুমাব।"
এই ছায়াময় ধূসরতা অনিবার্য্য, আর বড়ো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এখন। সমস্ত মানুষের থেকে কেড়ে নিয়ে বেঁচে ওঠা সমস্ত মানুষ, সমস্ত শিশুর থেকে রক্ত শুষে বড়ো হওয়া সফল যৌবনের যুগে -- কী আশ্চর্য্য , আমাদের নিঃসঙ্গ কবির কথা ভাবতে হচ্ছে। ব্যান্ডমাস্টারের পেডেস্টালে শান্তিতে নিভিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। মিছিলের আগে যে ছিলো, তিনটি বুলেটে মৃত্যুকে কিনে এনে তার নিচে নিঃসঙ্গ লেলিহান শুয়ে আছে সেই কবি। চাঁদোয়ায় ক্রমশঃ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ফার্ণের ছায়া, অস্ফুট জ্যোৎস্না সম্ভবত।
“এইটুকু নিয়ে, ব্যাস্ খুব খুশি হয়ে
জ্যোৎস্নার ফুল আর শ্যাঁওলায় দেখো
ভারী শান্ত ঘুমোবেন কেননা বিনিদ্র তিনি বহুকাল। “
(তুষার রায়ের"মরুভূমির আকাশে তারা" বই থেকে)
অতএব, এই সর্বাত্মক এই মড়কের সময়, আমাদের ফিরে প্রশ্ন করা উচিত, লিভার পচিয়ে অকালে মরে যাওয়া এসকেপ বেশি খারাপ, না সিস্টেম পচিয়ে বেঁচে থাকা। অদ্ভুৎ এই সময় পেরিয়ে যাওয়ার মত গতি, তড়াক লাফ দিতে চাওয়া কবি সম্ভবত নেই। জীবন ফালাফালা করে ঝাঁকিয়ে বেড়ানোর, সে জীবনই পরক্ষণে পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে কবিতা লেখার মত খ্যাপামিই বা কই? মৃত্যু বাজী রেখে লেখা কবিতাই, হয়ত বা, এ সময় আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারত।
লেখাটি ভালো লাগলো - লেখক কি ভাবে বা কোন জায়গা থেকে এই বিষয়টা দেখছেন তারও একটা আঁচ পাওয়া গেল। কিন্তু আমার মনে হয় সমগ্র ব্যাপারটা আরো একটু বড় ক্যানভাস পেলে এবং লেখাটা আরো একটু বড় হলে হয়ত আরো ভালো হত। তবে এটা একান্তই আমার মতামত।