পুয়ের্তো রিকো ভ্রমণের চতুর্থ দিন। ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে আবার পুবমুখো হাইওয়ে ৩ এ এসে উঠেছি। এই রাস্তাই সমুদ্রের তীর বরাবর এরপর দক্ষিণে যাবে (আয়তক্ষেত্র মনে আছে তো?)। তারপর পশ্চিমে যাবে, তারপর উত্তরে উঠবে ম্যাপে যেমন দেখায়, এবং সবশেষে আবার পুবদিকে খানিক চলে স্যান হুয়ান পৌঁছে যাবে, যেমনটি আগের পর্বে লিখেছি। পুয়ের্তো রিকোর হাইওয়ে অনেকটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিওয়ে সিস্টেমের মতই, তবে ছোট ছোট তফাৎ আছে। প্রথম তফাৎ স্পিড। এখানে স্পিডের একক কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা, মোটামুটি বাকি পৃথিবী যে নিয়মে চলে সেরকম। হাইওয়ের ওপর স্পিড লিমিট ৫৫ থেকে ৬০, অনেকটাই কম। হাইওয়ের সর্বোচ্চ লেনের সংখ্যা চার মনে হলো, তা সে যত জনবহুল শহর দিয়েই যাক না কেন। ভারতের মত এখানেও দুম করে রাস্তায় মানুষ উঠে আসা সম্ভব, হাইওয়েকে রীতিমত পাঁচিল তুলে বেঁধে রাখা হয়নি। সরু একটা গলি শাখার মত বেরিয়েছে হাইওয়ে থেকে, এরকমও দেখলাম। সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আলাদা লাগলো। যাতে রাস্তাটা সুন্দর হয়, এবং ছোট বড় শহর গ্রাম দেখতে পাই, মানুষ দেখতে পাই, তাই আমরা বড়ো, উচ্চ গতির হাইওয়ে থেকে নেমে ছোট হাইওয়ে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাদের স্টেট হাইওয়ে বলে) দিয়ে চলতে লাগলাম। এই রাস্তা ৯০১ নং সড়ক।
একে একে লুকিলো, ফায়ার্দো হয়ে ৯০১ নম্বর হাইওয়ে ধরে চলতে লাগলাম। বলা বাহুল্য বাঁ দিকেই ভয়ংকর সুন্দর রঙের জল নিয়ে সমুদ্র প্রায় সারাক্ষণ রইলো। একের পর এক সমুদ্রসৈকত এলো আর গেল। একদা ইউ এস ন্যাভাল বেস (রুজভেল্ট রোড ন্যাভাল স্টেশন), বর্তমানে পরিত্যক্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি দেখলাম ম্যাপে একবার উঁকি দিলো। এই এলাকা নিয়ে বিস্তারিত লেখা নেটে পাওয়া যাবে, তাই আর এখানে লিখছিনা। বরং সমুদ্রের ধারে ধারে ছোট শহরগুলোর কথা বলা যাক।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ার পর প্রতিদিনই আমরা খুব হালকা কোন ব্রেকফাস্ট করে বেরোচ্ছিলাম। লাঞ্চে প্রায় গ্র্যানোলা বার বা বাদাম জাতীয় কোন স্ন্যাক, আর বিকেলে যেখানে থাকা হবে সেই শহরে রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া হচ্ছিলো। কার্য্যক্ষেত্রে দেখা গেল ঐসব গ্র্যানোলা ইত্যাদি লাগছেই না, কারণ আমরা সমুদ্রের ধার ধরে ধরে চলেছি বলে নানারকম চমৎকার খাবার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় দিনেই রাস্তার ধারে দেখা গেল অস্থায়ী ডাবের দোকান। একটা পিক আপ ট্রাকের ওপর ছাউনি করে, ভেতরে স্তূপাকৃতি ডাব রাখা আছে। ছাউনিরই একটা কোণে বেশ প্রমাণ সাইজের বাক্স, থার্মোকল দিয়ে ইনসুলেট করা। তার ভেতরে বরফজল, সেই জলে কয়েকটা করে ডাব চুবিয়ে রাখা আছে। টনসিলের রুগী নয় এমন খদ্দের এলেই সেখান থেকে ডাব তুলে কেটেকুটে দেশের কায়দায় স্ট্র ভরে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দামও বেশ শস্তা, আর সেই জলও দারুণ মিষ্টি। জল খাওয়া হয়ে গেলেই আপনাকে পুরু শাঁসও পরিবেশন করা হবে। দিব্যি দুপুরের খাওয়া হয়ে যায় এক একটি ডাবে। পরপর দুদিন দুপুরে আমরা শাঁসে জলেই রইলাম, জুলাই শেষের গরমে দিব্য লাগলো।
খানাপিনা বাদে সমুদ্রসৈকতে আছে বাজনা। লোকজন মিউজিক সিস্টেম নিয়ে এসে পিকনিক করছে, আবার কেউ কেউ শুধু বিয়ারের বাক্স নিয়ে গুলতানি। একপাশে গ্রাম থেকে আসা সবজি আর ফলের বেচাকেনা চলছে, সেখানে পেঁপে, আম, কাঁঠাল (এবং এঁচোড় ), পাকা এবং কাঁচা কলা -- কী নেই? এখানে কেউই ইংরিজি বলেন না, খুব একটা বোঝেনও না। কোনক্রমে দু একটা কথা বার্তা হলো, তারপর আবার এগিয়ে চলা।
কথা ছিলো জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা হবে বয়োলুমিনেসেন্ট বে'র কোন ট্যুর হয় কিনা। জানা গেল সেগুলো হয় বেশ রাত করে, ফায়ার্দো বা তার কাছাকাছি অঞ্চলে। সর্বোপরি সেখানে এখন কিছুই তেমন দেখতে পাওয়ার আশা নেই। এবারের মত বায়োলুমিনেসেন্স দেখা হলো না। দেখা হলোনা পুয়ের্তো রিকোর অন্য ছোট দ্বীপগুলো, যেখানে যেতে হলে ফেরি নিতে হয়। একটা দ্বীপের নাম দেখলাম মসকিটো। ঐ নামের একটা বে'ও আছে। মনে পড়লো আমাদেরও মশাগ্রাম আছে। এমনি মশা প্রিফিক্স আছে এমন কত কিছুই না জানি এখন, কিন্তু এই লেখায় সেসব লিখতে গেলে মহাভারত হবে।
এই দিন আমাদের গন্তব্য পন্সে। আয়তক্ষেত্রের দক্ষিণ সীমা নির্ধারণকারী সরলরেখাটির প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত পন্সে। জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট, কাছাকাছি কয়েকটা সমুদ্রতটও আছে। স্যান হুয়ানের পরে সবথেকে জনবহুল শহর। এখানে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ইতিউতি হাঁটা, শহরের কেন্দ্রে একটা স্কোয়ার এবং পার্ক আছে সেই এলাকাটা জরিপ করা। দেখলাম প্রচুর স্থানীয় মানুষ জড়ো হয়েছেন, একেবারেই শীতের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মত আবহাওয়া। পন্সে, বলা বাহুল্য, পন্সে ডি লিয়ঁ র উত্তরপুরুষের নামে রাখা হয়েছে। আমাদের কোনদিনই শহরের, তত পুরনো নয় এমন সৌধ দেখতে ভালো লাগেনা। কয়েক হাজার বছর পুরনো হলে আরো কিছুক্ষণ কোর্ট হাউস আর চার্চ দেখা যেত হয়ত, কিন্তু আঠারো ঊনিশ শতকের স্থাপত্য আমাদের বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারলোনা।
সেদিন রাতে থাকা হবে মায়াগুয়েজে। এও আরেক শহর, এখানেও যথারীতি কোর্ট হাউস, গীর্জা, অমুক আপিস তুসুক আপিস এইসব সম্বলিত একটা প্রকান্ড চৌকো জায়গা আছে। মোটের ওপর তেমন নতুন কিছু নেই। আমাদের প্রিয় মন্দার বোসের ভাষায়, "এরা তো দেখছি যেখানেই পেরেছে একটা করে কেল্লা বানিয়ে রেখেছে "। গাড়ি চলতে শুরু করলে নানা ছোট শহর গ্রাম এবং তাদের জীবন দেখতে যত ভালো লাগে, পর্যটকের স্বর্গরাজ্য বড়ো শহরগুলোয় ততই একঘেয়ে লাগতে থাকে, এটা খেয়াল করলাম। অবশ্য মায়াগুয়েজইপুয়ের্তো রিকোয় আমাদের শেষ নতুন শহর দেখা। একেঘেয়ে লাগবে এবং বিশ্রাম দরকার হবে আন্দাজ করে পরের দিনটা আমাদের আক্ষরিক অর্থেই বসে থাকার দিন।
এইবার আমরা আয়তক্ষেত্রের পশ্চিম সীমারেখা বরাবর উঠছি। উত্তর পশ্চিম কোণের সমুদ্রতট, নাম কেন জানিনা সারভাইভাল বিচ। সেখানে দেখি অল্প দূরত্বের মধ্যেই দুটো সমুদ্রতট, একটায় প্রায় দূর্গাপুজোর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের মত ভিড়, অন্যটা বেশ খালি। কেন সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো। দেখা গেল আধুনিক, কেতাদুরস্ত জলকেলি এবং পার্টির সমস্ত উপাদান প্রথমটায় আছে। এক কথায় দীঘার মত সর্বজনপ্রিয় স্থান। পরিবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেখানে তাই জড়ো হয়েছে সবাই। এদের মধ্যে শুধুই ট্যুরিস্ট নেই, স্থানীয় মানুষও প্রচুর। এটা সপ্তাহান্তের দিন, রবিবার ছিলো বলে মনে হচ্ছে।
আমরা ট্যাঁকখালির জমিদারের মত অন্য সমুদ্রতটে গিয়ে থানা গাড়লাম। দিব্যি ঝলমলে রোদ, পরিষ্কার বালি, র্যাল্ফ ফিনেসের চোখের মত রঙের দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের জল --- হঠাৎ দেখলে মনে হবে এখানেই আসেপাশে একতা জেড পাথরের ঘর দেখতে পাওয়া যেতে পারে। শুয়ে বসে, বই পড়ে, জলের ধার দিয়ে হেঁটে, আবার ডাব খেয়ে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আমরা দুগ্গা বলে গড়িতে উঠলাম। এবার ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরেই অর্থাৎ স্যান হুয়ানে ফিরে যেতে হবে। পরের দিন ফিরতি ফ্লাইট। উত্তর পূব কোণ থেকে স্যান হুয়ান যাওয়া খুবই সোজা। সটান পুব বরাবর গেলেই আয়তক্ষেত্র সম্পূর্ণ হবে। তেমন তাড়াহুড়ো না করেই পুরো দ্বীপটা বেড় দিয়ে ঘুরে আসা গেল।
স্যান হুয়ান পৌঁছলাম যখন তখন সন্ধ্যা। খেয়ে নিয়ে আরেক প্রস্থ হাঁটা হলো সেই চেনা অলি গলি পাকস্থলীর মধ্যে দিয়ে। ওখানেই একটা স্যুভেনিরের দোকানে সেই তিনজন জ্ঞানী বৃদ্ধের পুয়ের্তো রিকান রূপ দেখা গেল। আমাদের মনে পড়লো বড়োদিন যীশুর জন্ম এইসব নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে কেমন সব পরব মিলেমিশে ঘেঁটে গেছে। শেষ দিনটা আমরা ছিলাম এয়ারপোর্টের কাছেই, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। দেখা গেল হোটেলটা প্রায় হোস্টেলের মত, প্রধাণত ছাত্রছাত্রীরাই থাকেন। রিসেপশনেও যে ছেলেটি বসে, সেও সম্ভবত ছাত্রই।
এই পুরো সিরিজে খাবার নিয়ে সেরকম কিছুই লিখিনি। অথচ পুয়ের্তো রিকো খাদ্যরসিকদের জন্য খুবই ভালো জায়গা। এখানে মানুষ যদিও হুঁকোমুখো নন, এবং তাঁদের হ্যাংলা বলেও এমনকি খ্যাতি নেই, কিন্তু তাদের খাবারের অন্যতম উপাদান চটকানো কাঁচকলা বা প্ল্যান্টেন। আমরা খেলাম তোস্তোনে (কাঁচকলা চটকে বেক করে বানানো গোল চাকতির আকারের নিমকি), মোফোঙ্গো (কাঁচকলা চটকে কেকের মত আকার দিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা) আর তার সাথে টাটকা মাছ বা মাংসের কোন একটা পদ। পেয়ারা যেহেতু খুবই সহজলভ্য, চমৎকার চিজকেক, ককটেল, জ্যাম আর পেস্ট্রি পাওয়া যায়। এরকমই আম আনারস এসব দিয়েও ঐ একই জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছিলো।
এরপরেই শেষ হয়ে গেল পুয়ের্তো রিকো বেড়ানো। কেমন যেন একটু হঠাৎ করেই। কয়েকটা দিন কাটলো দেশ থেকে দূরে, অথচ দেশের মত চেনা একটা জায়গায়। এই বেড়ানোর প্রাপ্তি মূলত সেটাই। ঘন ফুলে ছাওয়া কৃষ্ঞচূড়া গাছ, নুয়ে পড়া ডালে আমের ফলন, পথের ধারে অনেকখানি চেনা গ্রাম শহর এবং মানুষ। কোভিডের কল্যাণে ভেস্তে যাওয়া প্ল্যানের মধ্যে পুয়ের্তো রিকো পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা।