জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু, কেউ বলছেন নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে পুরোনো আন্দোলন। অন্যদিকে কোভিড-১৯ ও তার সহকারী আর্থিক মন্দা, কেউ কেউ বলছেন, প্রশ্ন করছে বিশ্বব্যাপী ক্যাপিটালিজমকে। রাজনৈতিক সার্কাস আর কোভিড-১৯ সংক্রমণ, দুয়েরই প্রকোপ চরমে। আমরা আপাতত মোল্লা নাসিরুদ্দীনের মত বিহ্বল হয়ে বেড়াল আর মাংসের ওজনের কারচুপি ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঘোর দুঃসময়। এই দুঃসময় থেকে মুক্তি এখন আমাদের অনেকের মনের কথা। দুর্ধর্ষ অল্ট রাইট থেকে মুক্তি, বর্ণবিদ্বেষ থেকে মুক্তি, বিশ্বজুড়ে জমাট হয়ে থাকা অলিগার্কি থেকে মুক্তি। উল্টোদিকে আবার কেউ কেউ নির্ঘাৎ লিবেরালিজম থেকে, সেকুলারিজম থেকে, ইন্টেলেকচুয়ালিজম থেকে, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে মুক্তি খুঁজছেন। স্পষ্টতই, মুক্তির ব্যাপারটা সহজসরল নয়। কিন্তু সেকথা পরে। আগে, ফোর্থ জুলাই এসে গেছে, একটু আনন্দ করুন। সব জিনিস নিয়ে রাজনীতি করবেন না। রাজনীতি নিয়েও, প্লিজ, রাজনীতি করবেন না। বি পজিটিভ (পান অনিচ্ছাকৃত)।
সেদিন দেখলাম একজন জর্জ ডব্লিউ বুশ আর মোল্লা নাসিরুদ্দীনের দেখা হলে কী কী হত সেই নিয়ে একটা ব্লগ লিখে ফেলেছেন। দিব্যি লেখাটি, যদিও এই অদ্ভুত সময়ে এসব ক্রিয়েটিভিটির থেকে জল যে কোথায় গড়াবে বোঝা মুশকিল, বিশেষতঃ শ্রোতা ও বক্তার পারস্পরিক বোঝাপড়া যদি ধূসর হয়। নাসিরুদ্দীনের একটা গল্পই আছে এই গোলমাল নিয়ে।
হয়েছে কী, মোল্লা নাসিরুদ্দীনের প্রচুর নামডাক শুনে একবার জনৈক ভক্ত তাঁর শাগরেদি করবেন ঠিক করলেন। নাসিরুদ্দীন তখন একটা উঁচু টিলার মাথায় কুঁড়ে বানিয়ে থাকেন। তো ভক্ত বহু কষ্টে টিলায় চড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কুঁড়েঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, ভেতরে একটা চেয়ারে বসে নাসিরুদ্দীন দুহাত জড়ো করে তার মধ্যে ফুঁ দিচ্ছেন। কৌতূহলী ভক্ত জিগ্যেস করায় মোল্লা উত্তর দেন "হাত গরম করছি"। ভক্তের আবির্ভাবের কারণ জেনে তাঁকে সাদরে ভেতরে ডেকে নেন নাসিরুদ্দীন, এবং চা পরিবেশন করেন। চায়ের কাপে নাসিরুদ্দীন ফুঁ দিচ্ছেন দেখে ভক্ত পুনরায় কৌতূহলী হয়ে ফের জিগ্যেস করেন এমতাচরণের কারণ। এবার মোল্লা বলেন "চা ঠাণ্ডা করছি"।
"আচ্ছা জালিয়াত যাহোক। ফুঁ দিয়েই গরম, ফুঁ দিয়েই ঠাণ্ডা, ইয়ার্কি হচ্ছে?” বলতে বলতে ভক্তটি কালবিলম্ব না করে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন, এবং সিদ্ধান্ত করেন, মোল্লার শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই।
ইদ্রিস শাহের অনুবাদে [1,2] নাসিরুদ্দীনের গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে হলো দুনিয়াজুড়ে হাজার হাজার নাসিরুদ্দীন আর তাঁদের লক্ষ কোটি ভক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কারোর কথা বোঝেনা, ভাবেওনা, কিন্তু অপমানিত হওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমবংগালের আদরণীয় রাজ্যপালের মত চৌকশ। কিন্তু এর বাইরেও, আপনারা বরং ভেবে দেখুন এই গপ্পের সাথে ছাত্র-শিক্ষক, বক্তা-শ্রোতা ইত্যাদি সম্পর্কের মিল পান কিনা।
এইবেলা ঝট করে ইদ্রিস শাহের কথা বলে রাখি। সদ্য জন্মদিন গেল ভদ্রলোকের। জন্ম অবিভক্ত ভারতের সিমলায়, ১৯২৪ সালের ১৬ই জুন। মৃত্যু ১৯৯৬ সালের ২৩শে নভেম্বর [1]। পূর্বপুরুষ উত্তরপ্রদেশের নবাব ছিলেন। এক কথায় প্রিভিলেজড বংশ বলতে যা বোঝায় তাই। সুফি দর্শনকে কেন্দ্র করে পড়াশোনা, গবেষণা ও অধ্যাপনা। তিন ডজন বই লিখেছেন, বেশিরভাগই উচ্চপ্রশংসিত ও বহুলবিক্রীত। অন্যদিকে তাঁর করা ওমর খৈয়ামের রুবাইয়ের অনুবাদ নিয়ে তীব্র বিতর্ক -- এইসব মিলিয়ে মনে রাখার মত লোক। নাসিরুদ্দীনের গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। তিনটি রোগা ও একটি মোটাসোটা বইতে গল্পগুলো পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায় নাসিরুদ্দীনের বাংলা অনুবাদ যেমন করেছেন, সেরকম ঝরঝরে ও সরেস। সমস্ত গল্পই সম্ভবত নাসিরুদ্দীনের নয়, বেশ কিছু পরবর্তীকালে সংযোজিত বলে মনে হয়।
তুরস্ক, অর্থাৎ ইংরেজি পিন্ডিজাতীয় অনুবাদে যাকে বিশ্ব টার্কি বলে চেনে, সেই দেশের মাথায় এখন এমন এক লোক, যাঁকে আর যাই হোক, ঠিক সুফি বলা যায়না। বরং সুফি আদর্শের বেশ কিছুটা বিপরীতেই তাঁর অবস্থান। ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বামপন্থীদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মত একদল যুবকর্মী তৈরীর উদ্দেশ্যে যে জাতীয়তাবাদী কর্মসূচী নেওয়া হয় ছাত্র রাজনীতির সেই ধারা থেকে উঠে আসেন এরদোগান। কট্টর দক্ষিণপন্থী এরদোগানের "রাজত্বে" কী কী হয়ে চলেছে তা এই লেখার বিষয় নয়, শুধু এটুকু বললে অত্যুক্তি হবেনা যে ম্যানড্রেকের ভিলেন গোখরোর আটের অধিবেশনের আদলে যদি আটজন জ্বালাময়ী অল্ট-রাইট রাষ্ট্রনেতাকে বেছে নিতে হয়, এরদোগান সেখানে যাকে বলে উইথ ডিস্টিংশন জায়গা পাবেন। [2]
২০১৪ সালের অক্টোবর নাগাদ তুরস্কে যখন যাই তখনও ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেনি। যদিও দক্ষিণ পূর্ব সীমায় অবস্থিত নিমরুত পাহাড় থেকে পাঁচ ছ ঘন্টার মধ্যে এসে পড়েছে আইসিস, সীমান্তে জোর যুদ্ধ চলছে। আমাদের শেষ পর্যন্ত আর নিমরুত অবধি যাওয়া হয়নি, যুদ্ধ কাঁটাতার টপকে এদিকে চলে আসতে পারে এই আশঙ্কায়।
উষ্ণ প্রস্রব্ণ আর চোখ ধাঁধানো পুরাতত্ত্বের পামুক্কালে থেকে দিনভর গাড়িতে মৌলানা জালালুদ্দীন রুমির স্মৃতিবিজড়িত কোনিয়া যাওয়ার পথে এক গ্রামে গাড়ি দাঁড়ালে হঠাৎ করেই চোখে পড়েছিলো পথের পাশে বইয়ের দোকান। সেখানে মোল্লা নাসিরুদ্দীন (তূর্কীতে নাসিরুদ্দীন হোজা) তাঁর প্রিয় গাধার পিঠে চেপে বইয়ের মলাটে হাজির। আকসাহির বলে যে ছোট শহরে তাঁর মৃত্যু হয় ও সমাধি, তার খুব কাছে এসে পড়েছি আমরা। নাসিরুদ্দীন এমন এক চরিত্র, যাঁর মধ্যে ইতিহাস ও কিংবদন্তী মিলেমিশে এমনভাবে জট পাকিয়ে আছে যে একটার থেকে অন্যটা আলাদা করা যায়্না। মোঙ্গল আক্রমণে যখন পারস্য থেকে আফগানিস্তান, রাশিয়া থেকে চীন ব্যতিব্যস্ত, তখনই নাসিরুদ্দীনের আনাতোলিয়ায় আবির্ভাব পারস্যের খলিফার নির্দেশে। কাছেই কোনিয়ায় আরেক সুফি পিঠ। সেখানকার মৌলানা জালালুদ্দীন রুমির মসনভি'তে নাসিরুদ্দীনের উল্লেখ আছে। বলা হচ্ছে এই যুযুধান দুই ব্যক্তি নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন। আবারো, এর মধ্যে সত্যি কোনটা, কোনটাই বা বানানো খোদায় মালুম।
তুরস্কের দোকানে মোল্লা নাসিরুদ্দীনের গল্প
মসনভি'র কথা উঠলে সৈয়দ মুজতবা আলির কথা না উঠে পারেনা। কোরান যদি ফার্সিতে লেখা হত, তাহলে নাকি সে আর লেখবার দরকার হতনা, আস্ত মসনভী'টাই হাতে ধরিয়ে দিয়ে পয়গম্বর ল্যাটা চুকিয়ে দিতেন। এমনটা আমি না মুজতবা আলি লিখেছেন। পঞ্চতন্ত্রে আলিসাহেব মসনভি থেকে তোতাকাহিনী যা অনুবাদ করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয় গোটা কেতাবখানাই যদি ওঁকে দিয়ে তর্জমা করিয়ে নেওয়া যেত! গল্পটা সংক্ষেপে অনেকটা এরকম। এক সওদাগরের একটি বুদ্ধিমান তোতা আছে। একবার বাণিজ্যে যাওয়ার সময় বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারবর্গের কাছে সওদাগর জানতে চাইলেন তাদের জন্য কী উপহার হিসেবে কী আনবেন। তাতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ খুশিমত জিনিসপত্র অর্ডার দিলো। তখনো চায়্নার ম্যানুফ্যাকচারিং এর এত বাড়বাড়ন্ত হয়নি, আর বয়কট করারও দিনকাল ছিলোনা, কাজেই বিদেশ থেকে লোকে জিনিস টিনিস এনে দিত। তা সে যাই হোক, প্রাণপ্রিয় তোতাটিকে জিগ্যেস করায় সে বললো সওদাগর যেন "তার মুক্তির উপায়" জেনে আসেন উপহার হিসেবে। বুঝতেই পারছেন, খুবই জাঁহাবাজ তোতা। তারপর যাহয়, সওদাগর তো ব্যবসা করে টরে ম্যালা টাকা করেছেন, সবার জন্য উপহার কিনে দেশে ফেরার জাহাজে ওঠার আগেরদিন হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে! তোতার ব্যাপারটা তো এখনও দেখা হলোনা! তখ্ন তিনি খুবই দুঃখিত মনে একটা বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানেই (এরকম অলস সওদাগর ঐযুগ বলেই পার পেয়েছিলেন, এখন হলে চীন দুদিনে ব্যবসা লাটে তুলে দিত) এক ঝাঁক তোতা দেখে তাদের কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করলেন। শুনে প্রায় কেউই ট্যাঁফোঁ করলে না, কিন্তু একটি তোতা ফস করে ডাল থেকে পড়ে মরে গেল। হায় হায়! একী করলাম! পাখিটাকে বেমক্কা শোক (না শক?) দিয়ে মেরে ফেললাম? এইবলে, বিস্তর বিলাপ করতে করতে সওদাগর দেশে ফিরে এলেন। এসে ইস্তক সবার সঙ্গে দেখা করেন কিন্তু পোষা তোতার দিকটি মাড়ান না। শেষে একদিন কী মনে করে (কী আবার মনে করবেন, গল্পটা তো শেষ করতে হবে, এত লেখা যায়?) ভুলে তোতার ঘরে ঢুকে পড়ায় বাধ্য হয়ে সমস্ত ঘটনা তাকে বলতে হলো। শোনবামাত্র তোতা দাঁড় থেকে পড়ে চোখ উল্টে মরে গেল। দ্বিগুণ বিলাপ করতে করতে সওদাগর তখন পাখিটাকে তুলে বাইরে ফেলে দিলেন। আর অমনি তোতা হুশ করে উড়ে গিয়ে উঁচু গাছের ডালে বসলো। এতক্ষণে বোঝা গেল আগের তোতাটিও আসলে মরে নি, দেশোয়ালিকে মুক্তির উপায় বাতলে দেবার জন্য তার মৃতের অভিনয়।
পরিচিত এই গল্পটা বলে বউকে জিগ্যেস করলাম, এর মরাল কী বল তো? আমি ভাবলাম সে বলবে বেঁচে থেকেই মরার মত থাকার উপযোগিতা, যা কিনা কেতাবে লিখেছে। তার বদলে সে বললে, ছলনা ভিন্ন মুক্তি হয়না। এরপরেও যদি আপনারা শুরুতে দেওয়া মোল্লা নাসিরুদ্দীনের গল্পটার প্রয়োজনীয়তা না বোঝেন তো আমি নাচার।
বরং তোতার উপদেশমত নিজে কাটা সৈনিকের ভূমিকায় থেকে এই প্রসঙ্গে আরো দুই হুজুরের অভিমত ব্যক্ত করে যবনিকা টানি। একেবারে আলিসাহেবের প্রবন্ধ থেকেই টুকে দিচ্ছি (বানান অপরিবর্তিত)। [4]
"এই গল্প (তোতা কাহিনী) ভারতবর্ষে বহু পূর্বে এসেছিল। কবীর বলেছেন,
'ত্যজো অভিমানা শিখো জ্ঞানা
সৎগুরু সঙ্গত তরতা হৈ
কহৈঁ কবীর কৈ বিরল হংসা
জীবতহী জো মরতা হৈ
(অভিমান ত্যাগ করে জ্ঞান শেখো, সৎগুরুর সঙ্গ নিলেই ত্রাণ। কবীর বলেন, 'জীবনেই মৃত্যুলাভ করেছেন সেরকম হংসসাধক বিরল')।
আর বাঙলা দেশের লালন ফকিরও বলেছেন,
মরার আগে মলে শমন-জ্বালা ঘুচে যায়।
জানগে সে মরা কেমন, মুরশীদ ধরে জানতে হয়।। "
তাই বলছিলাম, নানাবিধ সার্কাসে ছোটবড়ো কারচুপি নিয়ে না ঘাবড়ে বেঁচে থাকতে গেলে জীবন্মৃতের ভূমিকা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। মহাজনদের সেকথা তো আপনারা শুনবেন না, রাজনীতিই করুন।
এই "৮ এর বৈঠক" ব্যপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং - এরদোগান না হয় হল - আর সাতজন কে কে একটা লিস্টি করে ফেললেই হয়
হ্যাঁ, কাশি - মানে কাশি-বেনারস, নট কাশি-খুকখুক - আরেকটু চললে পারত। তবে তুর্কিস্তানও ভাল। সেখানে "সকলেই লুঙ্গি পরে ও উর্দু বলে"।
দারুণ রোমাঞ্চকর। লেখায় আরও ছবি থাকলে ভালোর চেয়েও ভাল হতো। উড়ুক
বেণারস পর্ব শেষ হয়ে গেল !!!
ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট মিস হয়ে গেছে অষ্ট বসুর বৈঠকে।
জর্জ বুশ আর নাসিরউদ্দিন এর গল্পটা কি ?
রমিত, ঠিকই। এরপরে ইচ্ছে ছিলো একে একে এদের সম্পর্কে পড়বো ও এখানে লিখব। সে আর হয়নি।
বুশ এবং নাসিরুদ্দিনের দেখা হলে কী হত এই নিয়ে সম্ভবত একটি কাল্পনিক ব্লগ। ডিটেলটা আর মনে নেই এখন, তবে পরে খুঁজে পেলে দিয়ে যাব।
তবে এরকম হাল্কা লেখাপত্রে যেমন হয়, এসবই কথার টানে আসা অন্য কথা।