সদ্যপ্রয়াত চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকির কথা লিখতে গিয়ে টের পাচ্ছি, আমাদের সবাইকে যেন ঘিরে আছে দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছেদ ও বিষাদ। এর কারণ শুধু মৃত্যুজনিত শোক নয়, সে তো আছেই। কিন্তু তার পাশাপাশি ছায়া ফেলে আছে এক অন্য মুছে যাওয়া। প্রচন্ড বিস্ফোরণে হঠাৎ নেই হয়ে যাওয়াদের কথা বোঝাতে গিয়ে দানিশ একটি শূন্য ঘরের ছবি তুলেছিলেন। ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সবাই গীর্জায় গেছে, স্বাভাবিক পারিপাট্য ও মৃদু অবিন্যাসের মিশেল নিয়ে অপেক্ষায় ঘরটা। কেউ ফিরে আসেনি। ছবিটার কথা বলতে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে দানিশ বলছিলেন সেইসব দারুণ ভালো, কিন্তু ক্রমশ "নিউ নর্মাল" হয়ে ওঠা অন্য আরো অনেক ছবির কথা - দারুণ ট্র্যাজেডির মুখপাত্র হয়ে ওঠে যেসব ছবি। চিল চিৎকারে সেইসব ছবি বলে, দেখ এখানে কী হচ্ছে! বলে এবং আশা করে, মানুষ বিপর্যস্ত হবে, উদ্বেলিত হবে। সর্বোপরি, কোথাও একটা কিছু একটা নড়েচড়ে উঠবে। কিন্তু নিউ নর্মাল তাতে সাড়া দেওয়ার অবসর পায়না। তাই দানিশদের তুলতে হয় নৈঃশব্দ, খালি ঘর।
পুলিৎজার জয়ী, বিপুল খ্যাতি ও সাফল্যের জন্য দানিশ সিদ্দিকির কথা বহু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশ্বের প্রথম সারির পত্রিকার সেসমস্ত লেখা সহজলভ্য এবং মোটের ওপর দানিশের কাজের বেশ খানিকটা ধারণা তৈরী করে দেয়। কিন্তু গতানুগতিক প্রতিবেদনগুলির কোনটাই সামান্যতম আলোকপাত করতে পারেনা দানিশ সিদ্দিকির ছবি তোলা, খবরের পেছনে হারিয়ে যেতে বসা মানুষের খোঁজ সম্পর্কে। তুলে আনতে পারেনা মানবতার বুকে চারিয়ে যাওয়া বিপর্যয়ের কথা, যার মধ্যে বাস করে কেউ কেউ দানিশ সিদ্দিকির মত হয়ে ওঠেন। এই হয়ে ওঠাকে আমরা পুরষ্কার দি, কিন্তু এর মধ্যে গৌরবের থেকে যন্ত্রণা অনেক বেশি। কারণ দানিশ সিদ্দিকি অসমসাহসী হতে চান নি। তাঁর কর্মক্ষেত্র রয়টার্স সমেত আরো বহু পত্রপত্রিকায় যেভাবে লেখা হচ্ছে, সেই অসমসাহসী, অতিমানবের ছবিতে দানিশ সিদ্দিকিকে ধরা যাবেনা।
২০২০ সালে দানিশ সিদ্দিকির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবের পক্ষ থেকে। সেই সাক্ষাৎকারে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এমিলি শ্মল দানিশের সবথেকে বিখ্যাত ছবিগুলোর প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঐ কথোপকথনে দানিশ বারবার বলেন, জীবন বিপন্ন করে তিনি ছবি তুলতে চান না। এমনকি আহত হওয়ার বিনিময়েও একটা ভালো ছবি তুলতে চান না। বলেন, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাংবাদিক জানেন কীভাবে কনফ্লিক্ট জোন কভার করতে হয় নিজেকে বাঁচিয়ে। বন্দুক তাক করা উগ্র হিন্দুত্ববাদীর সামনে অনভিজ্ঞ সাংবাদিকরা ভুল করে চলে গেলে তিনি তাদের সরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন, অসাধারণ এবং আর এস এস সন্ত্রাসের মুখ হয়ে ওঠা সেই ছবিটি তোলার থেকেও অক্ষত থাকা ও রাখাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি সবসময় নিজেকে ভয় পেতে শেখান, নইলে কখন এমন কিছু করে ফেলবেন যাতে শারীরীক ক্ষতি হবে। বলেছেন, তিনি যে অতিমানব নন, এটা নিজেকে ভুলতে দেননি কোনদিন। তাহলে কি ধরে নেব যে গড়পড়তা স্বার্থপর সংসারী মানুষের থেকে দানিশ সিদ্দিকি আলাদা কেউ নন? কিন্তু তাহলে দানিশের কর্মজীবনের প্রধান অ্যাসাইনমেন্টগুলো হিসেবে আঁটানো যাবেনা, যার মধ্যে মোসুলের যুদ্ধ, রোহিঙ্গা ক্রাইসিস, দিল্লির মব লিঞ্চিং, শ্রীলংকার বিস্ফোরণ এবং আফগানিস্তানের তালিবান আর আফগান সেনা সংঘর্ষ আছে।
আমাদের যেহেতু অলস সময় এবং নিরাপত্তার বিলাসিতা আছে, আমরা আরেকটু ভেবে দেখতে পারি, মূলধারার ছাপা এবং ডিজিটাল মিডিয়ার বাইরে কোন অন্য দানিশ সিদ্দিকি আড়ালে থেকে যাচ্ছেন কিনা। মার্ভেল কমিক্সের দুঃসাহসী অতিমানব আর অল্টার ইগো "সাধারণ মানুষ" এই দুই দলের মাঝামাঝি, ফেলিনির ত্রিশংকুর মত একরত্তি দড়িতে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হয়ত বা দানিশ। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সহপাঠী সালমা সিদ্দিকি যেমন বলেছেন সংখ্যালঘু হিসেবে বেড়ে ওঠা দানিশ, সালমা এবং আরো অন্যদের কথা, কীভাবে আইডেন্টিটি এক ধূসর জগৎ তৈরী করে দেয়, কীভাবে ট্র্যাজেডির উচ্চকিত রূপের ভিড়ে ট্র্যাজেডির মৃদু স্বরগুলো খুঁজে পেতে হয়, যা কেউ করেনা তাই, এবং শুধু তাইই যে দানিশকে করে যেতে হবে এই প্রবল, সময়বিশেষে অসহনীয় দায়িত্ববোধ তৈরী করে দেয়। এগারোই সেপ্টেম্বরের পরের পৃথিবী মুসলিম জনগোষ্ঠিকে কোন কোন দেশে সন্ত্রাসবাদী এবং বাকি দেশগুলিতে অত্যাচারিতের পোডিয়ামে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একই অঙ্গে দুই আইডেন্টিটির দ্বন্দ্ব নিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করা দানিশের একের পর এক বিপজ্জনক সংকট কভার করার কারণ হলেও হতে পারে।
যাঁদের কাজের বিষয় মানুষ, এবং বিশেষ করে নির্যাতিত মানুষ, তাঁদের কাজের মুন্সিয়ানা নির্ভর করে সেই ব্যালেন্সের ওপর যা মানুষকে সম্মানজনক দূরত্ব থেকে দেখায়, আবার একই সঙ্গে তার ওপর ঘটে চলা ট্র্যাজেডিকেও খুব দূরাগত করে ফেলে না। দানিশ এই ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইতেন, সফলভাবে অনেক কাজে করেওছেন। সমুদ্রতীরে নতজানু সদ্য এসে পৌঁছনো এক রোহিঙ্গা মহিলা বালি আঁকড়ে বিহ্বল বসে আছেন --- এই ছবিটা দেখতে দেখতে দানিশের কথাগুলো আমাদের মনে পড়ে। বুন্দেলখন্ডের দয়ারাম, দিল্লির জুবের, একের পর এক নৌকায় আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা --- দূরত্বের ব্যালেন্স আমরা প্রতিটি ছবিতেই খুঁজে পাই। দানিশের একটা উদ্ধৃতি প্রায় সমস্ত খবরের লিংকেই তুলে দেওয়া হয়েছে -- যেখানে তিনি বলেছেন তিনি ছবি তোলেন সাধারণ মানুষের জন্য, তাঁর ক্যামেরা সাধারণ মানুষকে সেইসব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তাঁরা পৌঁছতে পারবেন না।
এতক্ষণে আমরা অবসর পাচ্ছি ফিরে দেখার, দানিশের কাজ এবং কথার ভিত্তিতে, দুটি বিশেষ সমস্যার কথা। প্রথম কথাটি আমরা একেবারে শুরুতেই একবার ছুঁয়ে গেছি শ্রীলংকা বিস্ফোরণের ছবির সূত্রে। কেন সয়ে যাওয়া ভায়োলেন্স আর ট্র্যাজেডির বিপ্রতীপ ছবি তুলতে হয় যেখানে কেউ হাহাকার করছেনা, প্রচন্ড বোমায় উড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি নয়, তুলতে হয় খালি ঘর। স্মার্টফোনের দাপটে, ডিজিটাল মিডিয়ার ভিড়ে, উচ্চকিত চটজলদি ক্লিক জোগাড়ের নেশায় যে তথ্য বিস্ফোরণ ঘটেছে --সেটি হলো প্রথম সমস্যা। আর সমস্যা নম্বর দুই হলো দানিশের এতদিনে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া উক্তিটি। যেখানে মানুষকে কষ্ট করে যেতে হচ্ছেনা, সেখানকার ট্র্যাজেডি কি মানুষ অনুভব করতে পারবেন? রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অবস্থা আমরা অনুমান করতে পারি, গুরুচন্ডালীর পাতায় পড়ে খানিক ভাবতেও পারি সেসব। দানিশ সিদ্দিকির লেন্সে দেখতে পাই ব্যাকগ্রাউন্ডে দেশ পুড়ছে দাঙ্গায়, নৌকায় একদল মানুষ নতুন জমিতে এসে উঠলেন --- সামনেই আরো বড়ো লড়াই অপেক্ষা করে আছে। হ্যাঁ এসব আমাদের কাছে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে পৌঁছয়। এগুলো আমাদের ছোঁয় না।
একজন প্রতিভাবান, হয়ত বা অনিচ্ছায় দুঃসাহসী, সহমর্মী একজন চিত্রসাংবাদিকের চলে যাওয়া থেকে আমরা আর যা মনে রাখতে পারি তাহলো সেই উত্তেজনা, যা কোন কোন মানুষকে প্রভাবিত করে। সালমা সিদ্দিকি বর্ণিত মাথাগরম তার্কিক হুল্লোড়ে বন্ধু দানিশ না, চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভুল আর ট্র্যাজেডি দেখতে দেখতে একসময় ছটফট করে কিছু একটা করতে চাওয়ার উত্তেজিত দানিশ সিদ্দিকি। যে উত্তেজনা একজন অর্থনীতির ছাত্রকে ফিল্মমেকিং শেখায় এবং চিত্রসাংবাদিক করে, যে উত্তেজনা তাকে ছুটিয়ে মোসুলে, কান্দাহারে নিয়ে যায়, যা তাকে উদ্বুদ্ধ করে দেশের মধ্যেও সব সময় প্রোটেক্টিভ গিয়ার নিয়ে ঘুরতে। ফোনে ফোনে ঘুরতে থাকা ফেক ভায়োলেন্সের ছবি দেখে যে উত্তেজনায় মানুষ ঠিক করে, সত্যিকারের গণধোলাই, বিস্ফোরণ, আর্ত মানুষ এবং বিশেষত মানুষের কথা ছবির মাধ্যমে বলে যেতে হবে, সেই উত্তেজনা। গোটা পৃথিবীই যখন কোন না কোনরকম যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠছে, আমরা ক্রমশ বিচ্ছেদ ও বিষাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি - এরকম একটা সময়ে দানিশ সিদ্দিকির জীবনজাত উত্তেজনা ও মানবিকতা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য আশার আলো নেই ।
আশার একটু আলোও কোথাও নেই।
টিমির সিরিজ ফেরত আসায় খুশী হলাম।
দানিশের কাজ ও সাহসিকতা জেনে ভাল লাগলো। তাকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ায় সাধুবাদ।
আরো ভাল হতো, যদি লেখায় তার দু একটি ছবি যোগ করে দিতেন! এইটুকু খেদ থেকে গেল...
দমদি, :)
বিপ্লব রহমান,
ছবি দেওয়ার অসুবিধা হলো কপিরাইট। দানিশের তোলা সমস্ত ছবিই নেটে পাওয়া যায়, কিন্তু রয়টার্স দ্বারা কপিরাইটেড। অতীতে অনেক সময় যা ছবি দেওয়া গেছে তা হয় কপিরাইট মুক্ত, নয়ত ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দেওয়া।
পড়ার জন্য সবাইকে থ্যাংকিউ।
হুমম, গুগল করে কিছু ছবি পেলাম, পুলিথযার প্রাপ্ত ছবিও দেখা হলো।
আপনাকে ধন্যবাদ
মিঠুনের খুঁটিয়ে দেখার দৃষ্টি আর লেখার সসাববলীল চলন আমার মতো সাধারণ পাঠককে পৌঁছে দেয় যেখানে কোনদিন যেতে পারবোনা সেখানে।ঠিক দানিশ সিদ্দিকীর ছবির মতো। বারবার পড়ছি
আগে পড়িনি - এখন শাস্তি পেতে হচ্ছে - পড়ছি। শুরু করলাম।
ওনার ছবি তো দেখেছি। এখানে ক্যামেরার পিছনের মানুষটাকে কিছুটা জানলাম।
অনুভবী বিশ্লেষণ। বাস্তব মূল্যায়ণ।
দানিশ সিদ্দিকি সম্বন্ধে আগ্রহী হই দিল্লি দাঙ্গা ও রোহিঙ্গিয়া সিরিজের ছবিগুলি দেখার পর থেকে। নিজের পথ খুঁজে পাবার পর একজন সহযোদ্ধা বন্ধুর এই অকাল, অপচয়িত মৃত্যু বড়ো বেদনা জাগায় ...
টিম, পড়লাম। ভালো লাগল।
ওনার সব কাজ গুলো নিয়ে অবহিত ছিলাম না। ধন্যবাদ।
খুবই ভাল লাগল। মিঠুনের একটা স্বাভাবিক অ্যানালিটিকাল মন আছে, তার সাথে পরিশ্রমী গবেষণা যুক্ত হবার ফলে এই ধরণের বিশ্লেষণধর্মী লেখায় একটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত লজিক্যাল ফ্লো থাকে। বোঝায়, প্রশ্ন জাগায় এবং ভাবিয়ে তোলে।
তীর্থং, বহুদিন পরে এলেন। আপনার লিমেরিক সিরিজের/ শুক্কুরবারের পদ্য এসবের জন্যে অপেক্ষা করে থাকতাম। আবার লিখুন।
ভাল ও জরুরী লেখা