আজ রাজনীতি একটা নোংরা শব্দ এবং নেতা শব্দটা একটা গালাগাল। রাজনীতি এখন যদি ক্ষমতার লোভ, সুবিধাবাদ ও দুর্নীতির সমার্থক হয়, তাহলে নেতারা অহংকার, মিথ্যা ও প্রতারণার প্রতীক। এমতাবস্থায় কেউ যদি বলে যে রাজনীতিতে সারল্য, নিষ্ঠা ও ত্যাগ থাকতে পারে, তা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। অথবা মনে হয় অতীতের কোনও কথা। নতুন প্রজন্মের যুবকরা বিশ্বাসই করে না যে কিছুকাল আগে পর্যন্ত, ভারতীয় রাজনীতিতে এমন অনেক নেতা-কর্মী ছিলেন যাঁরা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য নয়, একটি উন্নত দেশ ও পৃথিবী গড়ার জন্য রাজনীতি করতেন। বহু সাংসদ ও বিধায়কের দারিদ্র্যের মধ্যে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। রাজনীতিতে থাকতেও তিনি অলিখিত অনুশাসন মেনে চলতেন। আজও গণআন্দোলনে এমন অনেক নেতা-কর্মী পাওয়া যাবে। কিন্তু তাঁরা আমাদের নজরের বাইরেই থেকে যান।
এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি আমার জীবনে এমন অনেক নেতার সঙ্গ ও আশীর্বাদ পেয়েছি। আমার শৈশবে, আমি আমাদের শহর শ্রীগঙ্গানগরে সমাজতান্ত্রিক নেতা কেদারনাথ শর্মার সারল্য এবং মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখেছি। উচ্চশিক্ষার জন্য জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে, সেখানে অগ্রজ সুনীলজির কাছ থেকে জানতে পারি গান্ধী কেমন ছিলেন। তারপর সেখানে কিষাণ পট্টনায়কের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং রাজনীতিতে আদর্শ এবং চরিত্রের উচ্চতা নিজের চোখে দেখার সুযোগ পাই। তাঁর সংগঠনে থাকাকালীন, সচ্চিদানন্দ সিনহা, অশোক সেকসরিয়া এবং সুরেন্দ্র মোহনের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং আদর্শের শিক্ষার পাশাপাশি অনুশাসনের শিক্ষাও পাই। আমার রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিল গান্ধীবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারায়, কিন্তু আদর্শের রাজনীতি শুধু এই স্রোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রাক-স্বাধীনতাকালে কংগ্রেস এবং পরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং জনসঙ্ঘের অগণিত নেতা সরলতা, নিষ্ঠা এবং ত্যাগের জন্য পরিচিত ছিলেন।
এই ধরণের রাজনীতিবিদ আমাদের জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজও আদর্শবাদী রাজনীতির উদাহরণ দেখা যায়। এমনই একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন শিবপুজন সিং, যিনি এই ৩০ নভেম্বর ৮৪ বছর বয়সে মারা গেলেন। শিবপুজন সিং, বিহারের রোহতাস জেলার দিনারা ব্লকের এক কৃষকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। যুবাবস্থায়ই তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেন। জরুরি অবস্থার সময় জেলে ছিলেন এবং ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির টিকিটে দিনারা এলাকা থেকে বিহার বিধানসভার সদস্য হন।
সেই সময় বিহার শিবপুজনজির সততা দেখেছিল। বিধায়কের আড়ম্বর এবং ঠাট বাট উপেক্ষা করে, শিবপুজনজি তাঁর সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সৎ ছিলেন। সরকার যখন বিধায়কদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছিল, তখন শিবপুজনজিই একমাত্র বিধায়ক ছিলেন যিনি বিধানসভায় এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বর্ধিত বেতন নিতে তিনি অস্বীকার করেন। সরকার অনড় ছিল যে নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক বিধায়ককে বর্ধিত বেতন নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে বেতন ছাড়াই থাকতে হয়েছে তাঁকে। শিবপুজনজি কোনও ধনী পরিবারের ছিলেন না এবং তাই তাঁকে সব ধরনের কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হননি। এমনকি ৬০ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিধায়ক পেনশনও নেননি। সারাজীবন মোটা খাদি কাপড় পরতেন এবং গ্রামের কৃষকদের মধ্যে কৃষকের মতো জীবনযাপন করতেন। তাঁর অতুলনীয় সরলতা ও অনবদ্য সততার গল্প বিহার জুড়ে বিখ্যাত হয়ে আছে।
আমি সবসময় তাঁর জীবনের সরলতা এবং তাঁর চরিত্র দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এসেছি। যাঁরা রাজনীতিতে সরল জীবনযাপন করেন তাঁরা প্রায়শই আত্ম-প্রশংসার প্রলোভনকে জয় করতে পারেন না। ত্যাগের অহংকার প্রায়ই দৃশ্যমান হয়। কিন্তু শিবপুজনজি-র মধ্যে এক বিন্দু অহংকারও খুঁজে পাইনি। তাঁর স্বভাবের মধ্যে শিশুসুলভ সরলতা ছিল যে কারণে তাঁকে রাজনীতিতে বহুবার বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। একই সঙ্গে ওঁর কথাবার্তা ও আচরণে নারীসুলভ সংকোচ ও কোমলতা ছিল যা রাজনীতিতে দেখা যায় না। নিজেকে পিছনে রাখা, সাথী কমরেড এবং সংগঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছিল তাঁর স্বভাব।
কিন্তু কোমলতা মানে নীতির সঙ্গে আপোষ করা নয়। শিবপুজনজি সারা জীবন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বেশ কয়েকবার জেলে গিয়েছিলেন। তিনি আশির দশকে মহেন্দ্র সিং টিকাইতের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন। ১৯৮০ সালে খালে জলের জন্য আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি জামিন চাইবেন না। ফলস্বরূপ, ছাব্বিশ মাস তিনি সাসারাম জেলে ছিলেন। তাঁর মুক্তির জন্য তারই এলাকার কৃষকরা দিনারা থেকে সাসারাম পর্যন্ত চল্লিশ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছিল। একবার বিধায়ক হওয়ার পরে, শিবপুজনজি নিজেকে বড় দলগুলির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি আর কখনও নির্বাচনী রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি। কিন্তু শত প্রলোভন সত্ত্বেও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আপোষ করেননি।
সত্যের উপর অটল থাকা এবং নীতির সঙ্গে আপোষ না করা ছিল তাঁর সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন।
আমি প্রায়ই ভাবি, রাজনীতির চোরাবালির মধ্যেও তাঁর মতো মানুষ কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছেন। স্পষ্টতই এর কারণ ছিল ওঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা তবে এর একটি বড় কারণ ছিলেন তারা, যাঁদের সঙ্গে তিনি তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা করেছিলেন।
১৯৬৭ সালে কিষাণ পট্টনায়কের সংস্পর্শে আসেন এবং সারা জীবন তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিবপুজনজি প্রথমে লোহিয়া চিন্তা মঞ্চ, তারপর জনতা পার্টি এবং সমতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এছাড়াও তিনি সমাজবাদী জন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও একজন ছিলেন। আমি যেমন আগেই বলেছি, কিষাণজি-র সংস্পর্শে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক ‘ঘরানা’-র সর্বাগ্রে ছিল শুদ্ধতা এবং মূল্যবোধ।
আমার জনজীবনের বিগত চার দশক ধরে শিবপুজন সিংজি-র সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সমতা সংগঠন থেকে সমাজবাদী জন পরিষদ হয়ে স্বরাজ ইন্ডিয়ার যাত্রায় আমি সবসময় শিবপুজনজির নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনা পেয়েছি। গত দু’বছর ধরে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলেও, চিঠি দিয়ে পরামর্শ ও উপদেশ দিতেন। তাঁর মৃত্যু শুধু আমার মতো কর্মীদেরই ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, এই ধরণের রাজনীতিবিদদের চলে যাওয়া আমাদের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতির লক্ষণও বটে। আগামী প্রজন্ম বিশ্বাস করবে না যে আমাদের দেশে এমন রাজনীতিবিদ কখনও ছিলেন। আদর্শ রাজনীতির চর্চাকারী এই নেতারা সব সময় সংখ্যায় কম হলেও দেশের রাজনীতির দিশা ও অবস্থা ঠিক রাখতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জনজীবনে এই ধরণের বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিকে রক্ষা করাই হবে শিবপুজনজির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা অর্পণ।