যৌনতা যাদের জরুরি নয়...
দু’-পায়ের মাঝে ভালোবাসা কৌটো করে রোদে দেয়নি ওরা। শিহরণ জাগেনি যখন কাছাকাছি এসে গেছিল নিঃশ্বাস। টিকালো নাক, কোমরে তিল, সুতির নীল শাড়ির গন্ধ – সবাই বলল, এ কেমন প্রেম, যাতে জড়িয়ে ধরার তীব্র টান নেই? সারা রাত কী করবে ওরা? তিন রাত বৃষ্টির গল্প, দু’-রাত পাহাড়ের, একরাত তারাদের, কিন্তু তারপর! কোলবালিশের পাঁচিল ভেঙে পায়ে পা লেগে গেলে!
সম্পর্ক ছোট হয় বা সারাজীবনের হয়, কিন্তু অসফল হয় না। একে অপরকে মন দিয়ে, তোমায় কত গল্প বলার ছিল দিয়ে, ফার্নের পাতা দিয়ে, অপেক্ষার শেষে আবার আরেকটা অপেক্ষা দিয়ে ছোঁয়া যায়। যৌনতা সবার কাছে জরুরি নয়। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসলে সব সময় লেবু গাছে জল দিতে লাগে না। সবার যখন ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁলো, ওদের তখন আগের ছোট ছোট ভেঙে পড়াগুলো আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে, কাঁধের ওপর মাথা রাখা। দাগগুলো বোঝা যাচ্ছে দু’জনেরই। এক রাত টানা বৃষ্টি হলে আলগা হয়ে যাবে। সবার যখন শরীরের একটা করে অন্তর্বাস বিছানার আশেপাশে হারিয়ে গেল, ওরা তখন খুঁজে পেল এত টুকরো হওয়ার কারণ; যারাই এসেছে, তারা নাভির ওপর নির্ভরতার কান্নার জল জমিয়ে, মাঝরাতে ঘুম ভাঙার ছলে হাতটা আরেকটু নীচে নামাতে চেয়েছে। সবার সেই মুহূর্তে শরীরের ওপর শরীর উঠল, নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু, তালে তালে। ওরা বলল, এমনি থাকতে পারবি তো?! রাস্তা চলার হাতে আঙুল থাকবে, মন খারাপের কাঁধ থাকবে, ভুল ভাঙাবার রাত থাকবে। আমি কিন্তু এটুকুতেই স্বচ্ছন্দ। সবার তখন শেষ বর্ষণের ক্লান্তি। ওরা তখন একে অপরের হাতে উত্তর না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
শাপলা
আলো নেভা আয়োজন থাকুক দিনের শেষে। ট্রেন গেলে যাদের বাড়ি লাইনের দুইধারে কাঁপে, তারাও তো রাতে ঘুমায়, তোর চোখে ঘুম নেই কেন? মানুষের কথা ধরিস? ওরা তো নালা দেখলে ঘেন্না পায়, তারপর এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলে, পুকুরের জল এসে নালায় মিশলে, নালায় নেমে মাছ ধরে খায়। আলুসেদ্ধ আর রেশন-এর চাল খেয়ে হলেও পয়সা-ক’টা জমা। যে শরীর তোর নয়, তাতে থাকবি না। ইনজেকশান-এর ব্যথা, “ছেলের মত ছেলে হতে পারিসনা”-র থেকে বেশি হয় না। যখন তোর নতুন জন্ম হবে, নাম রাখিস শাপলা। রঙিন কিন্তু নরম – মাথা উঁচু করে বাঁচবি কিন্তু শিকড় থাকবে মাটিতে। মরে যাওয়ার তিন ঘণ্টা আগেও রুক্সানা মাসি বলেছিল, আমার আর মেয়ে হওয়া হল না। কেউ আমার ব্রা খুলবি না চিতায়। এবার মরলে মেয়ে হব। অল্প বয়সে নিজেই কাঁচি দিয়ে কী সব করতে গেছিল।
আর শোভাকে চিনতি’ তো, কাকার কাছ থেকে কোনোভাবে পালিয়ে অষ্টমীর দিন আমাদের এখানে এসে উঠেছিল। ভোগের প্রসাদের মতই স্নিগ্ধ। শান্ত। খবরের কাগজে এক দৃষ্টিতে নায়িকাদের দেখত। একদিন সাবানের বিজ্ঞাপনের মত চারিপাশ আয়োজন করল। বড় চৌবাচ্চায় সার্ফ ঢেলে ফ্যানা। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। মোমবাতি জ্বালানো। আমরা যখন ঢুকলাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছিল, আয়নায় ওর প্রিয় লিপস্টিকটা দিয়ে লেখা – এবার মরলে নায়িকা হব।
কৃষ্ণাকে তুই চিনবি না। শুকনো বুক উঁচু করে হাটত। বলত, আমার যেদিন বুকে মাংস লাগবে, ছেলেদের লাইন লেগে যাবে দেখিস। একটা হাতুড়ে ডাক্তারের সাথে ক’দিন ফোনে কথা বলেই চলে গেল। কথা দিয়েছিল ওর বুকের অপমানের ঢেউয়ে নাকি দুটো স্থায়ী দ্বীপপুঞ্জ হবে, তারপর একটা জলপ্রপাত। তারপর একটা সন্তান। R. G. Kar-এ যখন বেডে দিল, জানতে পারলাম, ওর ‘সে’ নাকি একটা কিডনি বেচে দিয়ে পালিয়েছে। বালিশের নীচে প্রেসক্রিপশন-এর ওষুধটা বাইরে থেকে আনতে হবে। পিছন দিকে লিখে রেখেছে, এবার মরলে একটা সংসার পাব।
শাপলা, ভোর রাতে ফুটিস তুই। যখন সবাই ঘুমে, যন্ত্রণারা লঘু – গোলাপী আভা ছড়িয়ে দিয়ে শান্ত হোস।
বলিস, আমাদের চাওয়াগুলো সবসময় ঠিক ছিল, পাওয়াগুলো শুধু ছিল ভুল।
জামা
এক জানালা বৃষ্টির সামনে সেদিন অনুষ্ঠান হবে। যারা মোটা করে কাজল পরে আসবে, সকলে কাঁদবার সুযোগ পাবে। এক-এক করে গিয়ে দাঁড়াতে হবে জানালায়। চোখের কালো জল মিশে যাবে কার্নিশে। সম্পূর্ণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার আগে অবধি পড়া হবে জয় গোস্বামী। তারপর ব্যথাগুলোকে একটা কাচের প্লেটে করে কিছুক্ষণ রাখা হবে শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার স্টিক-এর পাশে। সমান করে দু’দিক কেটে সেলাই করা হবে। সাইকেল থেকে পড়ে গেলে, ওটাই শুধু ব্যথা হলে, কত ভালো হত। ‘ওর সাথে আর কোনোদিন কথা হবেনা’-র সাথে ‘বাড়ি থেকে কোনোদিন মেনে নেবে না’-কে সমান করে সেলাই করবি। দু’দিকের দুটো হাতা হয়ে যাবে। বোতামের ঘাট রাখিস। দুটো করে বোতাম দিবি, ভিতরের দিকে ‘পাড়ার লোক কী বলবে’, আর বাইরের দিকে ‘বড়রা যা বলে ভালর জন্য’।
হাতা দুটো হলে দেরি করবি না। রাত থাকতেই যে করে ফেলতে হবে সবটা। সামনের দিকে দিস নিজেকে নিজের মত করে মেনে নিতে না পাড়ার আঠাশ বছর। একটা পকেট দিস নাচ শিখতে না পারার আফসোস দিয়ে, গোলাপী সুতো দিয়ে নকশা করিস মেয়েলি। কলারটা কিন্তু সময় নিয়ে যত্ন করে করবি, ‘ছেলে – ছেলের মত থাকবি’ থেকে ঘুরিয়ে এনে দাগ কেটে দিবি চওড়া করে, কোমর বেঁকে না যেন। পিছনের দিকটা সাদা রাখিস নতুন ব্যথাদের জন্য। এক নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বোধহয় আর থামবে না। আচারের কৌটোগুলো ছাদ থেকে নামিয়েছিলি? জানিস একবার বলেছিলাম, মায়ের মত বড় হয়ে আমিও আচার বানাব। বাবা খুব মেরেছিল, কিন্তু এইটুকু ব্যথা দিয়ে প্যান্ট কি হবে! হবে না, না? তাহলে ছোটমাসির ওই ডাক্তারের কাছে জোর করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা জুড়ে দেখ না, হয় কিনা। আমি এবার একটু হেলান দেব, পিঠের নীচে একটা বালিশ দিয়ে দে। এঁটো ভাতটুকু ভুলোকে দিয়ে সদর দরজা দিবি। বাইরে গল্প করতে দাঁড়াবি না। কালকে একটা নতুন মালা এনে দিবি তো, বাজার থেকে – বাবার ফটোর মালাটা পাল্টে দেব। আর উদয়ন সঙ্ঘ থেকে সরস্বতী পূজার চাঁদা চাইতে এলে বলবি – এই বাড়িতে কেউ পড়াশুনো করে না।