দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এলো। এইরকম সময় স্কুল কলেজে পড়াকালীন ধীরে ধীরে ছুটির হাওয়া বইতে শুরু করতো। কোথাও ছুটির নামগন্ধ হয়ত নেই, হয়ত পরীক্ষাই সামনে -- তবু হঠাৎ হঠাৎ করে মনে হতে থাকতো ছুটির কথা। যে ভাবের কথা বহু বাঙালীর কলমে ফুটেছে দীর্ঘদিন, মেঘ রোদ আকাশ হাওয়া গাছপালা মিলিয়ে সেই ছুটির কথা মনে হতো। এসব কোন মজার গল্প নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, বৈচিত্র্যের কষ্টিপাথরে বাজিয়ে দেখলে নেহাতই ফ্যালনা কথা। ব্যক্তিগত উঠোনটির বাইরে এর তেমন কোন দাম নেই। তবে কবিতার কাছে হয়ত বা সামান্য দাবি আছে। সেইসব কবিতায়, যেখানে মানুষ একা জ্যোৎস্নার ভেতরে হেঁটে চলে।
একে একে মানুষ চলে গেলে খবর পাই। সকলেই যে চেনা, এমন তো নয়। বস্তুত কেই বা চেনা? তবু এসব খবর শোকাবহ। এক একটা পথের রেখা এঁকে বেঁকে সামনে চলে গেছে। সরু, পায়েচলা, অস্পষ্ট হয়ে আসা রেখা। সে পথের কোন অচেনা বাঁকে রহস্য থাকে কি থাকেনা। কোথাও কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়। কোথাও বৃষ্টিতে জ্বলে ওঠে শাদা নুড়ি। কোথাও আরো মানুষ।
এক একটি মৃত্যু, তা কি আসলে উদযাপন? বহুবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হেঁটে একসঙ্গে বেঁচে থাকতে শিখতে হবে, লিখেছিলেন কবি। তবেই জীবনের কাছে ফিরে আসতে ভালোও লাগবে। এ যেন এক দিগন্তবিস্তৃত বনভোজন চলছে। রান্না খাওয়া গল্প আহ্লাদ শেষে যে যার মত পাড়ি দেবে। সময়টা বিকেল সন্ধ্যার ঠিক মাঝামাঝি।
আমাদের চারপাশে ভালোবাসার মানুষেরা ছড়িয়ে থাকেন। তাঁদের হয়ত স্পষ্ট করে বলা হয়না সেকথা। অস্বস্তি কাজ করে, সূর্যকে ডেকে বলা যায়, এই প্রাণ, এই চলাফেরা কথাবলা, এই সবুজ, জ্বলে ওঠা আর নিভে আসা বিকেল --- এই সমস্ত, সবই আপনার জন্যই ? সেরকম। ব্যাপারটা সেই পাগলটির মত অবাস্তব হবে, যিনি পাগলা গারদ থেকে সেরে উঠে চলে আসতে চেয়েছিলেন --- কারণ সেখানে বড় পাগলের উপদ্রব। জানলার ফ্রেমে বিবিধ শেডের সবুজ পাতায় রোদের চলকে ওঠার মধ্যে সেইসব অকাতর ও সাবলীল ভালোবাসা, নাকি স্নেহ, গুণে গেঁথে রাখা ছাড়া ভালোলাগা ফিরিয়ে দেওয়ার অন্য উপায় নেই।
অনেকদিন আগে, এই পাতাতেই কোথাও লিখেছিলাম আমাদের জমানো মানুষের কথা। সদ্য অন্যত্র, অন্য কোন আলোচনায় একজন মনে করালেন। সেই পাতায় লেখা হিসেবের অনেকদিন কেটে গেছে, এখন নতুন করে ফিরে দেখতে গিয়ে দেখি, শুধুই জমানোর কথা বললে অন্যায় হবে, আমাদের খরচও তো হয়ে চলেছে প্রচুর। জাগতিক আসা যাওয়া তো আছেই, কিন্তু থেকেও নেই হয়ে যাওয়া --- এইই কি কম?
অন্য প্রসঙ্গে, বা হয়ত ততটাও দূরাগত কিছু নয়, সুবিনয় রায়ের গান শুনতে গিয়ে দেখলাম সেখানে বিভূতিভূষণ উপস্থিত। " কী অচেনা কুসুমের গন্ধে" জেগে উঠছে ছবি, আর আমি ভাবছি একের পর এক মৃত্যুমিছিলের কথা। যে মানুষ চলে গেলেন, তাঁদের যাওয়া নয়, তাঁদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা, দেখা, কয়েকটি মুহূর্ত। ছোটবেলার বন্ধু, বন্ধুদের বাড়ির লোক চলে গেলেন খুবই অলক্ষ্যে। আরো এমন অনেক মানুষ যাঁদের চিনিনা। কিন্তু শোক ছাপিয়ে এই ভাবনা প্রবল যে এই এঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে সেইসব জমানো মুহূর্তেরা থেকে গেল। এইসব যখন হয়েছে, তখন ভাবিনি কোন কোন পথের বাঁকে আনন্দময় স্মৃতি জমে উঠছে। হেলায় কুড়িয়ে বইয়ের ভাঁজে রাখা সেসব ফুলই অপূর্ব রূপ নিয়েছে এখন।
আমাদের ইতিহাসে, গবেষণায় সাধারণ মানুষ আসেন দল বেঁধে, নায়কেরা আসেন একা, তাঁদের মনে রাখতে সুবিধা হয়। সেখানে আমার পাড়ার সিন্টাই বা ব্যারাকপুরের পিন্টুদার কথা নেই, বজবজের সেন্টুদার কথা নেই, ইস্ত্রির দোকান চালানোর বটুয়ার কথা তো দূর অস্ত। ব্যক্তিগত সামান্য গন্ডির আন্তরিক সম্পর্কের মোহমায়া সেখানে অবান্তর। কোন এক নবনীতা বা তারাপদ সেইসব অবান্তর কথাকে লিখে রাখলে তবে মহাকালের গায়ে তার আঁচড় পড়ে কি পড়েনা। নইলে মানুষের মনের কোণে জমে ওঠে যে রসমাধুর্য্য, তার খবর কে রাখে? বজবজের জোগাড়ে সেন্টুদা পথঘাট থেকে ফুল কুড়িয়ে আনত, আমাদের বাড়ির সদ্য হওয়া খোকাটির জন্য। খোকা হাতে মাটির গুঁড়ো মাখা ফুল নিয়ে হাসলে সেন্টুদারও প্রত্যুত্তরে হাসি পেত, সে স্বর্গীয় মুহূর্ত কখনও মৃত্যুর আঁধারে ফুরোবার নয়। সেন্টুদা মধ্য তিরিশেই অপঘাতে চলে গেছে একযুগ আগে। সেদিনের খোকা এখন নিজেই খোকার বাপ। এই নতুন পৃথিবীতে সম্ভবত সেন্টুদাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু অন্য কিছু, অন্য কেউ আসতেই থাকবে। হলই বা সে কোটিতে গুটিক।
মাঝে মাঝে বিষাদ গ্রাস করে। কয়েক দশক পেরিয়ে দেখছি, জমানো মানুষ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। শেষের কদিন কেমন গেল, আরো কী কী কথা হওয়ার ছিল-- সেসব জানা হলোনা। কোন অজ্ঞাত কারণে আমার হলুদ রঙের এরোপ্লেন ভালো লাগে। মনে হয় ছোটবেলায় আকাশে দেখেছি, তবে সেটা সত্যি নাও হতে পারে। এরকমই আরো কোন আজব কারণে সেই হলুদ প্লেনের সাথে ব্যারাকপুরের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। তো, সেইসব জড়িয়ে মড়িয়ে আমি পিন্টুদার কথা শুনলেই ভাবতাম, ব্যারাকপুর এবং হলুদ এরোপ্লেন। প্রচন্ড লম্বা, চওড়া হাসিওয়ালা, লাজুক, ছাপোষা এবং সংবেদনশীল একজন মানুষের জীবন, বিদ্রোহ বিপ্লব নয়, অ্যাডভেঞ্চারহীন একটি জীবন। কিন্তু রোমান্স, দৈনন্দিন ছুঁয়ে থাকা ও ভেসে যাওয়ার মাঝের জায়গাটুকু যেন অক্ষত ছিলো। আমি যখন ছোট, কোন দুষ্টুমি করলেই আমায় বলা হত বোর্ডিং এ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর বোর্ডিং স্কুল মানেই রামকৃষঞ মিশন। পিন্টুদার সাথে দেখা হলেই হেসে আমায় জিগ্যেস করত, ভর্তি চলছে শুনলাম, কি গো ফর্মটা তুলি? সে এমন বয়স, যখন কেউ তুমি সম্বোধনে কথা বললে একটু ঘাবড়েই যেতাম। এই ঘাবড়ে যাওয়ায় পিন্টুদা ঘুবই মজা পেত। ছ ফুট কয়েক ইঞ্চির মানুষটা কেঁপে কেঁপে হেসে উঠত অনেকক্ষণ। আমিও স্বস্তি পেয়ে ভাবতাম যাক এসবই ঠাট্টা হচ্ছিলো, আসলেই আমায় মিশনে যেতে হচ্ছেনা। পিন্টুদা জমা আছে আমার জমানো মানুষদের কৌটোয় অনেককাল। এর কোন যুক্তি না থাকলেও ব্যাপারটা আশ্চর্য্যের নয়। স্নেহশীল, বিষয়কর্মে অনিচ্ছুক, সচেতন মনের মানুষদের প্রতি আমার সামান্য পক্ষপাত আছে। তো, এইসব কথা বলা হলোনা, যেসব প্রশংসার মত শুনতে ভালোবাসার কথা আমাদের হয়নি কখনও।
বলা হয়নি কুমুদির কথাও। কুমুদি যদিও বাকিদের মত ছিলেন না। আমি কুমুদিকে কখনও বিষন্ন বা হতাশ দেখিনি। অবশ্য দেখা মানে আন্তর্জালে, গুরুচন্ডালীর মায়াপাতায়। ছমাস আগে কুমুদি চলে গেছেন, আসলে রয়ে গেছেন তাঁর স্মৃতি নিয়ে। কুমুদিকে নিয়ে স্মরণ সংখ্যায় কিছু লিখতে পারিনি। দেখলাম কুমুদির অনুষঙ্গে কিছু স্মৃতি আছে, অথচ ঠিক কীভাবে যে সেসব লেখা যাবে বুঝিনি। বেশিরভাগই গুরুচন্ডালীর ভাট বা টইতে নানাবিধ কথোপকথন। বিশেষ এমন কিছুই আমি লিখতে পারবোনা যা অন্যেরা লিখবেন না। শেষে সাতপাঁচ ভেবে দেখলাম আমাদের বিয়ের কথাটা হয়ত অন্য কেউ লিখবেন না। আমাদের বিয়ের সময় এই পাতার বন্ধুদের সে খবর দেওয়া হয়েছিলো, এবং সবাই খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। সুদূর দিল্লি থেকে কুমুদি আসতে পারেননি, কিন্তু ফোন করেছিলেন । বিয়ের দিন নানা গোলযোগে সে ফোন দেখতে পাইনি, পরে আমি আর শুচিস্মিতা একসাথে ফোন করেছিলাম, কথা হয়েছিলো। যাঁরা কুমুদির সাথে পরিচিত তাঁরা জানেন বয়সে ছোটদের কাছে কি প্রচন্ড আন্তরিক দিদির মত ছিলো তাঁর ব্যবহার। সেই প্রথম ফোনে কথা বলা। এরপর মনে হয় আরো এক দুবার কথা হয়েছে। কোনদিন দেখা হলোনা, কিন্তু কুমুদি খুব উজ্জ্বল হয়ে স্মৃতিতে থেকে যাবেন । বইমেলা উপলক্ষে বা অন্যত্র কোন আড্ডায় তোলা ছবিতে ধরা পড়েছেন কুমুদি, দেখা বলতে এই। অনেকদিন পরে হয়ত মনে করতে পারবোনা কুমুদিকে কোথায় দেখেছি, ছবিতে না সত্যি করে। কুমুদিকেও আমাদের ভালোলাগার কথা জানানো হলো কি? অথচ মাটি থেকে অনেক ওপরে, অজস্র অলীক পাতার মধ্যে জেগে থাকা পাটকিলে রঙের গাছের ডালে একটা কাঠবেড়ালী নিশ্চিন্তে শুয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।
লেখার কথা ছিলো ছুটির অনুষঙ্গে আসা উদাসীন কিছু মুহূর্তের কথা, আনন্দের, উদযাপনের কথাই। লেখার কথা ছিলো ঢেউখেলানো সবুজ মাঠ, অজস্র মহীরুহের মাঝে বহু মানুষের পিকনিকের গল্প। লিখতে চেয়েছিলাম সুবিনয় রায়ের গাওয়া গানটির কথা, মাঝখান থেকে নানা অন্য কথা এসে গেল। যে অদ্ভুৎ কণ্ঠে সুবিনয় "পথে চলে যেতে যেতে" গাইছেন, সে গায়কী এই মত্যুমিছিলে খুব দাগ কাটে। আমার জানলার বাইরের পাতাগুলোর মত, যাদের ফলকের কোথায় কখন রোদের ছোঁয়া লাগবে কেউ জানেনা। রোদ হাওয়া জলের কোন অলৌকিক চক্রান্তে সে ঘটনা ঘটে। যে বেদনাময়, স্তিমিত, শোকাবহ, পরাজিত কণ্ঠে সুবিনয় গাইছেন, সে গান সেখানেই থেমে না থেকে জনৈক হরিহর বা অপূর্বকুমার রায়ের মত যেন পথের ধারে হঠাৎ ফুটে ওঠা জংলী ফুল খুঁজে পায়। যে কথা হওয়ার ছিলো কিন্তু সময় হয়নি বলার, ঠিক যেন তা-ই বুঝে ফেলা গেল। সে গায়কীতে রোজকার আটপৌরে ভাবের অনেক ওপরে উঠে কোন অচেনা ভাব ফোটে, অবিশ্বাসী আমি এতে কোন অদেখা ঈশ্বর পাইনা, কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হই যে ছন্নছাড়া এই অবিচারের পৃথিবীতে অনবরত ঘটে চলে নানা অঘটন। আমার পুরনো হয়ে যাওয়া প্রায় অকেজো হার্ড ড্রাইভে স্ক্যান করে রাখা ছবির মত সেসব অঘটন জমা হয়ে রয়েছে। অবিরত ঝরতে থাকা বালির মত সময় আর মানুষ খরচ হয়ে যাওয়ার সময় সেই হলদেটে স্ক্যানের কথা ভেবে সামান্য হলেও শান্তি পাই। নীল আকাশে হলুদ এরোপ্লেনের মত।