ভদ্রলোক কবি। পড়নে ধূসর কান অবধি কলার তোলা লম্বা গরম কোট। বাসে উঠে, মোটা ব্যাগটা কোলে রেখে ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটে বসলেন। কপাল মন্দ নয়, সিটটা পুরোটাই খালি থাকায় জানলাটাই পেয়েছেন।
কত বছর পর গ্রামে ফেরা! নিরানন্দ, ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। শীতকাল, তায় শেষ কয়েকটা সপ্তাহ হলো বেজায় বরফ পড়ছে। পথরেখা দেখা যায়না। রাস্তার দু'পাশে, দূরের পাহাড়ের গায়ে - মোটা বরফের কম্বল। আকাশে কালো মেঘ, মেঘের ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা বরফের ছিটেফোঁটা। শেষ বিকেলে পড়া শুরু হল যখন, তখন সারারাত আর থামবে না।
ভদ্রলোক মনে মনে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। একটা লাইনও ভেবে ফেলেছেন। The silence of the snows। কিন্তু পুরোটা ভাবা হল না। পাহাড় বেয়ে, বরফে ঢাকা দিকনির্দেশের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে বাস চলতে শুরু করেছে। কালো আকাশে সাদা বরফ দেখতে দেখতে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
- - -
বেশ কিছুদিন হলো এক নিকটাত্মীয়ের দাঁতে একটা সমস্যা হচ্ছে। মাংসের হাড় চিবুতে গিয়ে চোয়ালে কোথাও একটা চোট লেগেছে। একজন ডেন্টিস্টকে দেখিয়ে নিলে ভাল হয়।
গ্রামে থাকি। নামে আধা-শহর হলেও, আদপে গ্রাম-ই। ডাক্তার-বদ্যি একেবারেই নেই, তা নয় - তবে যারা বসেন, তারা সপ্তাহে এক-দু'দিন চেম্বার করেন, তাতে বহু লোকের ভিড়। চিকিৎসাও যে খুব উঁচু দরের, তাও নয়।
এখান থেকে সবচেয়ে কাছের শহর বাসে এক ঘন্টা। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। আজ রবিবার। বাসে ভিড় আছে। মাছ, মিষ্টি, সবজি বেচেন এমন অনেক ছোট ব্যবসায়ী আজ শহরে গিয়ে দু'পয়সা লাভ করেন। এখানকার বড় বাজারে তাই বাসটার পনেরো-কুড়ি মিনিট স্টপেজ।
এক মিষ্টি বিক্রেতা দু'হাতে করে তিনটে তিনটে ছ'টা মিষ্টির ডেকচি নিয়ে বাসে উঠে, ঘাম মুছে সিটে বসতে যাবেন - এমন সময় উল্টোদিকের কেবিনের সিটে চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যে দোকান থেকে এই বিক্রেতা মিষ্টি নিয়েছেন, সেখানে আজ মিষ্টির ভ্যারাইটি দেখলে নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চেনা ভদ্রলোকটিকে এ জিনিস দেখাতে না পারলে তার মিষ্টি বেচাই বৃথা। বাস তো দাঁড়িয়েই আছে, এখন দাঁড়াবেও - এই ফাঁকে চট করে দেখে আসা যায়। চূড়ান্ত জোরাজুরি শুরু হলো। চেনা ভদ্রলোক সিট ছেড়ে উঠবেন না, বহু কষ্টে সিট পেয়েছেন। তাছাড়া, খাওয়াবে না যখন - শুধু দেখতে যাওয়ার কি মানে? এদিকে ইনিও ছাড়ার পাত্র নন। বেশ মজার, তাই না?
শহরে পৌঁছে প্রথমে আরেক আত্মীয়ের বাড়ি যাবো। সেখানে জলখাবার খেয়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে। তারপর বোধহয় চশমার দোকানেও একবার যেতে হবে, নিকটাত্মীয়ের একটা চশমা বানানো দরকার।
যে আত্মীয় শহরে থাকেন, তিনি অর্থবান, পরিশ্রমী। শহরের পশ্ এলাকায় ফ্ল্যাট। রোববার ছুটি হলেও ফোনের বিরাম নেই। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার ড্রাইভার সেলাম করে উঠে দাঁড়ালো।
বেলা দশটা। চেম্বারে প্রচন্ড ভিড়। তিন নম্বরে নাম ছিল, কিন্তু আত্মীয়ের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর আলাপ থাকায় দু'জনকে টপকে সুড়সুড় করে প্রথমেই ঢুকে পড়লাম।
ডাক্তারবাবু মাঝবয়েসী। টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন, আর মাঝে মাঝে হেঁচকি তোলার মতন একটা ভঙ্গি করছেন। আলাপ হলো। ওনার এক ছেলে, এক মেয়ে। দু'জনেই ডাক্তারি পড়ছে। ছেলে আসছে বছর বিদেশ যাবে। মেয়েও যাবে বোধহয়, তারপর। উনি বলে দিয়েছেন, এদেশে পড়ে থেকে বুড়ো বাপের সেবা করার কোনো দরকার নেই। তারা রয়াল কলেজে পড়াবে, রিসার্চ করবে, ভালো সোসাইটিতে মিশবে। শুধু এদেশ থেকে মৃত্যুসংবাদ গেলে যেন করপোরেশনে ফোন করে বডিটাকে ডিস্পোজ্ করে ফেলার অনুমতি দিয়ে দেয়।
ডাক্তারবাবু আড্ডাপ্রিয়। তিনি আমাদের সঙ্গে বসে আলাপ করেন, ওদিকে চেম্বার সামলান অন্য আরেকজন। মুশকো চেহারা, চওড়া কব্জিতে বিপত্তারিণীর লাল তাগা, কানে ফোন। ডাক্তারবাবু রোগীর মুখ খুলে টেনে ধরে রেখে আমাদের সঙ্গে দেশের রিজার্ভেশন সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করেন। সহকারী ভদ্রলোক কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে রেখে কাউকে চেম্বারের দিকনির্দেশ দেন, আর দু'হাতে রোগীর দাঁতে কসমেটিক ফিলিং করেন।
- কোথায়? চৌমাথা থেকে সোজা এগিয়ে গেছেন? ডানদিকে ঘুরতে হতো তো!
- ......
- এক কাজ করুন, রাস্তার পাশের ঝুপড়িগুলোতে জিজ্ঞেস করুন কিরীটি মুখার্জির বাড়ি কোনটা -
- ......
- একটা গেরুয়া বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন কি? পাশে জোড়া মন্দির থাকবে। একটা হনুমান, একটা শনি। পাচ্ছেন?
- ......
- কি? কুকুর? কুকুর কোথা থেকে পেলেন? ধ্যার!
চুপ করে শুনি, দেখি। কোনো কথা বলিনা। কোনোরকম রিয়্যাক্ট করিনা, শুধু মাঝেমধ্যে দাঁতক্যালানে হাসি ছাড়া।
সে যাইহোক। চশমার দোকানে ভিড় ছিলনা। বেশি দেরি হয়নি। দুপুরে আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে ফিরে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। বিকেলেই বাড়ি ফিরবো।
এসি চলছে। বাইরে দুর্দান্ত রোদ। নিকটাত্মীয় পাশে শুয়ে, দেখি তার চোখ লেগে গেছে। কম্পিউটার রাখা টেবিলটার ওপরে একটা বুকশেলফ আবিষ্কার করলাম। অধিকাংশই আত্মীয়ের মেয়ের পড়ার, বা প্রাইজ পাওয়া বই। একদম ডানদিকের কোনায় আমি সেই বইটা খুঁজে পেলাম। দু'পাতা পড়লাম। একজন কবির গল্প। বহু বছর রাজনৈতিক বন্দি থাকা, জেল খাটা এক কবি তার গ্রামে ফিরছেন। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কে জানে।
ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছি। চারটে নাগাদ উঠে পড়লাম। এবার বেরোতে হবে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি, বইটা ধার চাইবো। দু'পাতা পরেই পছন্দ হয়েছে।
মুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পড়ে উসখুশ করছি আর ভাবছি - বইটা যে চাইবো, সেই অনুরোধের থ্রো-টা ঠিক কেমন হলে ভালো হয় - এমন সময় আমার নিকটাত্মীয় স্বভাবসিদ্ধ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন - বইটা কোথায় রাখা ছিল?
মনটা দমে যেতে গিয়েও দমল না। বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। এই তো, এইখানে - বলে বইটা তাকের যেখানটায় ছিল, সেখানে রেখে দিলাম। বইটা এখানেই থাক।
বইটা আমি নিয়ে যাবোনা। ও এখানেই থাকবে, এসি ঘরে কাঁচের বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে। ও থাকবে আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে - চুপ করে, শান্ত হয়ে। সবকিছু দেখবে, সবকিছু শুনবে, ব্লটিং পেপারের মতো সমস্ত রকম অভিজ্ঞতা শুষে নেবে, জাজ্ করবে। ও এখানে থাকবে, এতো সব কিছুর মাঝে এক কবির এক পাহাড় বরফ পেরিয়ে বাড়ি ফেরার গল্পের বই হয়ে।
আমি যদি ওকে নিয়ে যাই, তাহলে কি ও এত কিছু হতে পারবে?
ভাল লেগেছে, এ লেখার জাত আলাদা।
একক কে নিয়ে লেখা পড়তে আমার এমনিতেই খুব ভাল্লাগে, কারন একক ভারি ইন্টারেস্টিং একজন ক্যারেক্টার। ওর সাথে দিব্যি বন্ধুত্বও করা যায়।
লেখার নামটা একক বলেই পড়লাম।
মতামতের জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ।
হিমালয়ান্ ব্লুজ লেখাটার শেষ পর্বে রঞ্জনবাবুর মতামত মিস্ করেছি ;)