আমার বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ আছে।
সে নিয়ে কথা হবে, তবে পরে। আগে একটা খবর দিই।
ছ'মাস হলো একটা চাকরি করছিলাম। সে চাকরি নিয়ে কথা বলা নিরর্থক। শুধু এটুকু বলি, যে অফিসের পরিবেশ-লোকজন-গাছপালা-বিল্ডিং সয়ে সয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম একেবারে। একটা ছুটির দিন দুপুরে একটা সিনেমা দেখলাম। খুব পপুলার সিনেমা - Walter Salles-এর The Motorcycle Diaries। সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন, বিষয়বস্তু প্রায় সকলেরই জানা। সিনেমা দেখে যা হবার তাই হলো।
ঠিক করে ফেললাম, রেজিগনেশন দেবো।
এরপর একটা ইলাবোরেট প্ল্যান, লম্বা-লম্বা ফোনাফুনি, এইসব হলো। একদিন সকাল সকাল চান-নাস্তা করে যেমন করে অফিস যেতাম, সেরকম করে একটা ফাইলে সমস্ত ডকুমেন্ট নিয়ে অফিসের জন্যে বেরিয়ে পড়লাম। চোখ চে-র মতন অর্ধেক আকাশপানে, বুকে বিপ্লবের বারুদ।
মেন গেট পেরিয়ে বেশ খানিকটা জঙ্গুলে রাস্তায় হেঁটে মেন বিল্ডিং। গটগট করে হেঁটে যাচ্ছি, এমন সময় রাস্তার বাঁয়ে একটু ঢালু মতন একটা জায়গা থেকে একটা কুকুরের কান্নার আওয়াজ পেলাম। কৌতূহল হলো। থেমে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম।
একটা বাচ্ছা কুকুর। কোমর থেকে লেজ অবধি ছালচামড়া উঠে মাংস বেরিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কোনো গাড়ি মেরেছে। কে জানে। এখানে বেশ গরম পড়েছে, তাই মাছি ভিনভিন করছে কুকুরটার ওপর। চিৎকার থামছে না কুকুরটার।
আমার এখন কি করা উচিত? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। অফিসে টাইম দেওয়া আছে। আমার চোখে, আগেই বলেছি - বিপ্লবের স্বপ্ন।
আমি আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম। যেমন করে ছোট থেকে ভিখারিদের দেখেও না দেখার ভান করার প্র্যাকটিস করেছি, ঠিক সেভাবে।
ইস্তফা দিয়ে কাজ গুছিয়ে বিকেলে যখন ফিরছি, তখন জঙ্গুলে রাস্তাটায় খানিক অন্ধকার নেমেছে। সে জায়গাটায় পৌঁছতেই মনে পড়ে গেল। থেমে উঁকি মেরে দেখলাম। কুকুরটা নেই। যাক।
উল্টোদিকে ঘুরে দেখি রাস্তার অন্য পাড়ে আরেকটা কুকুর। এটা পূর্ণবয়স্ক। থাবার ওপর মুখ রেখে চুপ করে শুয়ে আছে। আমায় দেখতে পেয়ে একবার মুখ তুলে তাকালো।
তারপর ঘেন্নায় মুখটা নামিয়ে নিল।
যাইহোক। এবার সেই অভিযোগের কথায় আসি। অভিযোগটা উঠল একটা ঠেকে। ব্যাপার এই, যে আমি আজকাল কবিতার নামে যা লিখছি, সেসব নাকি মোটেই কবিতা হচ্ছে না। অভিযোগকারী বেশ কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। দু-তিন রকমের ছন্দ বোঝালেন - অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, দলবদ্ধ কিসব। রাগ হচ্ছিল, বেশ বোঁ হয়েও ছিলাম - কিছুই বুঝলাম না। তিনি আরো বললেন, যে সব লেখায় একটা ছবি তৈরি হওয়া উচিত। আমার লেখায় সেটাও হচ্ছে না। বেসিক্যালি লেখাগুলো সাহিত্য না হয়ে খবরের কাগজের রিপোর্ট হয়ে যাচ্ছে বেশি।
প্রথমদিকে বেশ মন দিয়ে শোনার ভান করছিলাম। মাথা নেড়ে দু-চারবার "অবশ্যই, অবশ্যই"-ও বলেছিলাম। কিন্তু এতোখানি শোনার পর মাথাটা একেবারে গরম হয়ে গেল। বেশ খানিকটা খিস্তি মেরে দিলাম। যুক্তি দেখিয়ে বললাম - আজকাল কোন খবরের কাগজে রিপোর্টের মতো রিপোর্ট পড়ছেন?
পরে মনে হলো, ভুল বললাম। কাগজে রিপোর্ট থাকে - তবে সঙ্গে তো ছবিও থাকে। ছবি দেওয়ার দরকার পড়ে, কারণ - কাগজের রিপোর্টে সত্যি সত্যিই কোনো ছবি তৈরি হয় না। যদি হতো, তাহলে চায়ের দোকানে বসে এতো লোক এতো আরামসে কাগজ পড়তেই পারতো না। পাগল হয়ে যেতো। আর তাছাড়া, কে-ই বা কবে কবিতার বইয়ে ছবি দেখেছে?
তখন গ্রীষ্মকাল। দুপুরবেলা, বেশ চাপা গরম। আমাদের বাড়িতে যিনি রান্না করেন, তিনি আমায় এসে জিজ্ঞেস করলেন - দাদা, চা খাবেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম - চা? এই গরমে? পাগল নাকি! না না, খাবো না চা এখন।
রাঁধুনি "আচ্ছা দাদা" বলেই চলে যাচ্ছিলেন, আমি ডেকে দাঁড়াতে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম - এতো গরম পড়েছে, আর আপনি এখনো ফুলহাতা ব্লাউজ পড়ে কাজে আসেন কেন? রান্নাঘরে তো ফ্যানও থাকেনা!
রাঁধুনি মৃদু হাসলেন। গ্রীষ্মের দুপুরের লু-এর মতন সেই হাসি। ডানহাত দিয়ে বাঁ-হাতের ব্লাউজের হাতা কনুই অবধি তুলে দেখালেন। দেখলাম - ব্লাউজের নিচের হাতের চামড়ার রঙ বাকি দেহের, মুখের রঙের চেয়ে একেবারে আলাদা - ফ্যাটফ্যাটে সাদা।
কিরকম একটা যেন লাগলো। ঘেন্না? জানিনা। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - এভাবে এতোটা পুড়ে গেছে? কিভাবে?
রাঁধুনি বললেন - মদ খেয়ে বর ম্যাচিস মেরে দিয়েছে।
খুব রাগ হলো আমার। একটা কর্তব্যবোধও চাগাড় দিয়ে উঠলো পেটের ভেতর। বললাম - আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, আপনি নিচে সই করে দিন। বড়বাবুকে ভালোই চিনি, থানায় গিয়ে জমা করে দিলে এফআইআর হয়ে যাবে এক্ষুনি।
রাঁধুনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তারপর মাথা নিচু করেই বললেন- দাদা, জেলে তো খাবার ভালো নয়, তাই না?
---
সেই সকালটা, আহা! মনে পড়লে এখনো দিল-টা লাফিয়ে ওঠে মাইরি।
সারারাত ঘুমোইনি। মাঠের গ্যালারিতে বসে থেকেছি সূর্যোদয় দেখবো বলে। চারিদিকে আলো যখন ফুটলো, তখন মনে পড়লো - পূর্বদিক কোনটা তাই তো জানিনা! ফোনে কম্পাস খুলে পূর্ব খুঁজে পেলাম। সেই আমার জীবনে প্রথম দরকারে কম্পাস ব্যবহার।
হস্টেল ফিরতে ফিরতে দেখি বেশ আলো ফুটেছে। দু'টো বেঁটে লোক পায়চারি করতে বেরিয়েছে, তাড়াতাড়ি হাঁটছে বলে দেখে খুব হাসি পেল। আমারও তাড়া আছে।
হস্টেল থেকে সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসের মেন গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমার দুই বন্ধু আসবে আজ। হস্টেলেই থাকবে। খাবোদাবো, রাত জাগবো। কি জানি কি করবো। খানিক অপেক্ষা করতে কুয়াশার মধ্যে ওদের দেখা গেল।
হস্টেলে ফিরতেই ওরা বললো ছাদে যাবে। তখন বেশ আলো হয়েছে। আমরা ছাদে গিয়ে বসলাম। আমার পাঁচতলা হস্টেল - বহুদূর দেখা যায় ছাদ থেকে। দূরে ট্রেন দেখা যায়, এখনও দেখা যাচ্ছে একটা।
নিচের রাস্তা দিয়ে দুধের গাড়ি, স্কুলের অটো সব যাচ্ছে। শীতের স্বচ্ছ হাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে নাকের ভেতরগুলো।
আমরা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম।
আহ...!
খুব ভালো লাগল।
হোঁচট পাথরও ভালো লেগেছিল- বলা হয় নি।
আপনার লেখায় মুড সেটিং দুর্দান্ত -
আর এই যে একটা আনমনে হেঁটে যাওয়ার ব্যাপার- বাসে উঠে পড়তেও পারি, নেমেও যেতে পারি- এই ফুল কিনলাম, বৃষ্টি হল, হয়ত ঝিরঝির বরফ পড়া শুরু হয়েছে ওভারকোটের কলারটা উঁচু করে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি- গির্জা দেখতে যেতেও পারি বা ইন্ডিয়ান স্টোরে- গোটা লেখায় অন্তর্লীন কী জানি কী করব ভাব-
অথবা এই লেখার শেষে ভোর হচ্ছে- 'নিচের রাস্তা দিয়ে দুধের গাড়ি, স্কুলের অটো সব যাচ্ছে। শীতের স্বচ্ছ হাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে নাকের ভেতরগুলো'- কী অদ্ভূত একটা মুড ধরেছেন-
নমস্কার জানবেন-