এবার মনে হয় পার্থক্য করার সময় এসেছে । সময় এসেছে ‘সেলিব্রিটি’ আর ‘আইডল’ এর মধ্যে ফারাক খোঁজার । বলতে বাধ্য হচ্ছি না, বাধ্য করছেন আইডল থুড়ি সেলিব্রিটিরা ।
অন্তর্জাল বলছে খ্যাতি, যশ, ডাক, কীর্তি ও যশস্বী যুক্ত এমন কেউ যিনি কোন বিশেষ কারণ, ঘটনা, রটনা বা গুনবশত খ্যাতির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছেন, যাদের ওপর সবসময়ই প্রচার মাধ্যমের নজর থাকে বা তিনি নিজে প্রচারে থাকেন, তিনি সেলিব্রিটি। অন্যদিকে যেখানে কোন মানুষ নিজের জীবন প্রবাহ বা মানসিক স্তরের সঙ্গে কাউকে একাত্ম করে তার জীবনদর্শন কে আদর্শ মেনে জীবনধারণ করতে ইচ্ছুক, তাকে আইডল বলা যেতে পারে । আইডল এবং সেলিব্রিটি এর সম্পর্ক পূর্বে এতটা কাছাকাছি না থাকলেও ইদানিং এই দুই শব্দ প্রায় সমচ্চারিত বা সমার্থক। বিপদটা এখানেই।
কয়েকদিন আগেই ভারত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার প্রাপ্ৰক অভিনেত্রী হঠাৎ করে ঘোষণা করলেন ‘ইয়ে আজাদী ভিখ হে’ । নতুন কিছু নয়। ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হে’ নামক স্লোগান বা ‘হমে চাহিয়ে আজাদি’ স্লোগান আমরা আগেও শুনেছি। তাহলে এবারে পার্থক্য কোথায়। পার্থক্য হল আগের স্লোগানগুলো ছিল রাজনৈতিক। বর্তমান মুনাফাবাদী কিছু রাজনেতাগন রাজনীতির সুবিধার্থে আদর্শনীতির বিন্দুমাত্র সম্মান না করে এই সব রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করে থাকেন। সৌভাগ্য এই যে, স্লোগানগুলো আপামর জনগন স্লোগান হিসেবেই দেখেন। ‘কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও এর মতনই’।
এটাই বাঁচোয়া।
কিন্তু এন্টারটেন্টমেন্ট নির্ভর ভারতবর্ষে যেখানে ক্রিকেট ম্যাচ এর রেজাল্ট দেশপ্রেম মাপার পরিমাপক, যেখানে সেলিব্রিটি সন্তানদের মাদক সেবন কৃষক ধর্ণার চেয়েও বড় খবর, যেখানে নায়ক নায়িকাদের সামান্য অভিনয় নাকি ‘চিরাচরিত বিশ্বাসে’ আঘাত হানে, সেখানে সরকারি পুরস্কার প্রাপ্ত বহুল চর্চিত অভিনেত্রী যদি রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বা রাষ্ট্রীয় গর্বের বিপক্ষে অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা জনমানসে বলেন তার ফল সুদূরপ্রসারী হবারই কথা। এবং হয়েছেও। পাল্টা বিবৃতিতে সেলিব্রিটি অভিনেত্রী দাবি করেছেন ১৯৪৭ এ তো কোন যুদ্ধই হয় নি, বিনা যুদ্ধে এ কেমন মুক্তি। অকাট্য যুক্তি। ওনার দোষ নেই খুব একটা। কদিন আগেও এক রাজনৈতিক যুবা নেত্রীকেও শুনেছিলাম স্বাধীনতার ৯৯ বছরের লীজের কথা। আসলে বিকৃত ইতিহাস আর অযোগ্য মেধা চাষের দীর্ধদিনের লালনপালন এই বিকৃতির জন্য দায়ী।
হঠাৎ করে কারও ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া মনে হয় নিজেকে বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ উপায়। আমরা নিরক্ষরকে পার্লামেন্ট-এ পাঠাই এই ভেবে যে উনি শিক্ষার উন্নতি করবেন। আমরা গ্যাংস্টারদের আইনমন্ত্রী করার দাবি করি তাও আবার নির্বাচন করে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ ক্রিকেটারদের আইডল করি এই ভেবে যে ওনার অনুপ্রেরণা থেকে আমরা স্নাতক স্তরের সরকারি চাকুরী পাবো। যে সেলিব্রিটিরা আমাদের আইডল তারাই আমাদের সামনে মদ গুটকার বিজ্ঞাপন করে আর আমরা বিজ্ঞাপনের বিরোধ করি, সেলিব্রিটিদের নয়। ঠিক এই কারনেই চাষী না হয়েও, রাজনীতিবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থ নীতিবিদ না হয়েও কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিবৃতি দিতে হয় লতা মঙ্গেশকর বা বিরাট কোহলিদের । এবং তা সর্বজনস্বীকৃত হয়। অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদকে অনায়াসে বলে দেওয়া যায় যে উনি কিছুই বোঝেন না এবং সেটাও প্রশংসিত হয়। তাই এবার মনে হয় সময় এসেছে সেলিব্রেটি আর আইডলদের মধ্যে পার্থক্য করার।
কারন সেলিব্রিটি উবাচ যদি ‘আজাদী ভিখ হে’ হয় তাকে ভুলে যাওয়া যায় স্লোগানের মত করেই।
কিন্তু আইডল উবাচ যদি ‘আজাদী ভিখ হে’ হয় তাহলে ইহা ভয়ঙ্কর। দেশ, ভবিষ্যৎ এবং সমাজের ক্ষেত্রে।
কারন ভ্রান্ত ইতিহাস আর ভ্রষ্ট বর্তমান বিকলাঙ্গ ভবিষ্যৎ তৈরি করে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।