পড়াও / पड़ाव (পর্ব ৪)
You know how everyone's always saying seize the moment? I don't know, I'm kinda thinking it's the other way around. You know, like the moment seizes us.
(পরিচালক রিচার্ড লিঙ্কলেটারের 'বয়হুড' ছবির একটা সংলাপ।)
যোশীমঠে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। প্রত্যেকবারের মতন - এবারও।
কন্ডাক্টারকে বলা ছিল, বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাব না। জানলা দিয়ে হোটেলটা দেখা যেতেই স্যাক নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
যোশীমঠের মতন জায়গাগুলোর বোধহয় এটাই ভবিতব্য। এই জায়গাগুলো এখন শুধুমাত্র যাত্রীদের রাতের আস্তানা হয়ে বেঁচে আছে। সকলেই সন্ধ্যে করে ঢোকে, আবার আলো ফুটতে না ফুটতেই বেরিয়ে যায়। দীর্ঘ পথের পাশে ছোট্ট সরাইখানা যেন। অবশ্য, সরাইখানা শব্দটার মধ্যে একটা আরাম আছে। শীতসন্ধ্যেয় গরম কম্বলের মধ্যে শুকনো পা ঢুকিয়ে বসার আরাম।
রিসেপশনের বাইরে গাছপালার টবের পাশে সিঁড়িতে বসে ইন্দর বিড়ি ফুঁকছিল। আমায় দেখতে পেয়ে বিড়িটা ফেলে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলল - দেবা ভাই, দো সাল বাদ!
আমি বললাম - ব্যাপার কি? পায়ে এত বড় পট্টি? রীতিমত খুঁড়িয়ে হাঁটছ তো! এভাবে হাঁটবে কি করে?
দু'দিন হল, রান্নার কাঠ চিরতে গিয়ে পায়েই কুল্হাড়ী মেরে দিয়েছি। আমার আর এবার যাওয়া হবে না। গাঁও-য়েরই একজন - হরি সিং, ওকে বলে দিয়েছি। ও-ই যাবে। পুরোনো লোক, রাস্তা সব চেনে। আপ চিন্তা মত কিজিয়ে।
ইন্দর বলল।
আমার একটু রাগ হয়ে গেল। বললাম - একথা তো আগে বললেও পারতে! যাইহোক, ঘর খোলাও। তোমরা আছো কোথায়?
ইন্দর বলল - তোমারই পাশের ঘর। ৪০৪-য়ে। ফ্রেশ হয়ে একবার এস। বসা যাবে।
ঠিক হ্যায়।
আমি বললাম।
রাত-কাটানোর সাধারণ হোটেল। স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। ছোপ লাগা বিছানার চাদর, ধুলো বসা মোটা কাঁচের গ্লাস। গরম জলে মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিলাম।
আমার ন্যাপস্যাকের ভেতরের খাপে একটা ব্রাউন পেপারের খামে দু'বছর আগে তোলা দু'টো ছবি আছে। একটা ইন্দরের পোর্ট্রেট - টুপি মাথায় জঙ্গলে আধশোয়া হয়ে। আরেকটা ওর ছেলে - কৃষ্ণার। ইন্দরের বাড়িতে থাকতে থাকতে কৃষ্ণার সঙ্গে বেশ ভালো র্যাপো হয়ে গেছিল। রাতে স্টার ট্রেইল তুলতে গিয়ে কালপুরুষ চেনা দিয়ে বন্ধুত্বের শুরু।
খামটা হাতে নিয়ে ৪০৪-য়ে ঢুকলাম।
একেবারে আমাদের পাশের ঘর, অথচ ফার্ণিশিং একদম আলাদা। ঘরের একদিকের দেয়ালে সাঁটা একটা বড় চৌকি। চৌকির পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। ঘরের কিছুটা জুড়ে মেঝেতে বিছানা পাতা। বাকিটুকু-য় গাদাগাদি করে মাল ঠাসা। টেন্ট, স্লীপিং ব্যাগ-ম্যাট্রেস, বাসনপত্র, সবজি, কেরোসিনের টিন - এইসব।
ইন্দর-ই দরজা খুলেছিল, এখন আবার খাটে গিয়ে বসল। খাটে আরো দু'জন বসে আছে। একজনকে চিনতে পারলাম - দেবেন্দর।
ও খুব কম কথা বলে। আমায় দেখে একটু হাসল।
ইন্দর ইশারা করে আমায় চেয়ারটায় বসতে বলল।
চৌকির ওপর দৈনিক জাগরণ বিছিয়ে রাখা একটা আরএস-এর ফুল। হলদিরামের ভুজিয়া-টুজিয়াও আছে।
ইন্দরের হাতে খামটা দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বললাম - এসব কি করেছ ইন্দর? কাল থেকেই তো হাঁটা! আর তোমার হরি সিং কই?
ইন্দর খামটা খুলে ছবি দু'টো বের করে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর হেসে বলল - তুমি যখন ফিরবে, তখন তো আমি থাকবো না। তাই এখনই আনিয়ে নিলাম। আর হরি সিংয়ের চিন্তা তুমি কোরো না। ও কাল ভোর-ভোর ঢুকে যাবে। খুব ধার্মিক লোক ও।
আমি হাসলাম। বললাম - তুমি আমাকে এই চিনলে? গতবার তোমার গাঁও-য়ে সেই সারারাত রামলীলা মনে আছে?
ইন্দর হেসে উঠল, বলল - ঠিক। এবার শুরু কর।
প্রথম দু'টো পেগ খেতে খেতে অনেক কথা হল। কৃষ্ণার কথা, ভাবীর কথা। ইন্দর গেস্টহাউসটা দোতলা করছে। নামও দিয়েছে একটা - কৃষ্ণা প্যালেস।
গত বছরের কথাও উঠল। ইন্দর জিজ্ঞেস করল - পিছলে সালকা প্রোগ্রাম ক্যায়সা রহা?
দারুণ হয়েছিল, সহি মে। কপিল তো দারুণ ছেলে বটেই, সঙ্গে ওর পিসতুতো না মামাতো ভাই - সোনু, সে তো হেব্বি ছেলে। বিড়ি নেই সিগারেট নেই, পকেটে দেশলাই নিয়ে ঘুরছে। জিজ্ঞেস করাতে দেশলাইয়ের ডাব্বা খুলে এমন জিনিস দেখাল না, সে খেলে বুঝতে! ছেলেটা খুব লাজুক, জানো। কপিলের সামনে সিগারেট খাচ্ছিল না।
আমি বললাম।
ইন্দর হাসতে হাসতে বলল - ও ওইরকমই। ওর আসল নাম কিন্তু সোনম। সোনম নাকি মেয়েদের নাম, তাই সবাইকে সোনু সোনু বলে! ও আবার আর্মিতে যাবে বলে তৈয়ারী করছে।
সেকথা জানি। শুনে প্রথমটা খুব ভালো লেগেছিল, পরে একটু খারাপও লাগল। কার লড়াই ও লড়তে যাবে, কে জানে।
আমি বললাম।
আমার দিকে না তাকিয়ে, গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ইন্দর বলল - তোমার পক্ষে একথা বলা সোজা, দেবা ভাই।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ আরো দু'পেগ খাওয়া হল। দেবেন্দর আর অন্য ছেলেটা নিজেদের মধ্যে কি কথা বলছিল।
ইন্দর বলল - চিকেন খাবে তো? দুর্গা মা-য় বলে এসেছি। ভেতরে বসে খেতে হবে কিন্তু।
আমি বললাম - বৈষ্ণো ধাবা বলে কথা! ভেতরেই খাবো, চাপ নেই।
বাইরে বেরোতেই ইন্দর বলল - সঙ্গে পঞ্চু আছে?
সে কে?
আমি বললাম।
- পঞ্চু - রেনকোট, রেনকোট!
- কেন, বৃষ্টি হবে নাকি আবার?
- হতে পারে। দেখো।
ভালমন্দ খাওয়া হল। তাওয়া রোটি, ধনেপাতার কুচো ছড়ানো চিকেন, কাঁচা পেঁয়াজ-লঙ্কা। বাইরে ক্যাশ কাউন্টারে গান বাজছিল - যব চলি ঠন্ডি হওয়া ...
খেয়ে উঠে হোটেলের ছাদে এসে দাঁড়ালাম।
ফাঁকা, খোলা ছাদ। কড়া, ধারালো ঠান্ডা। সামনে লক্ষীপুজো, তাই আকাশে বিশাল চাঁদ। জোৎস্নায় ব্যাকলিট পাহাড়গুলো ঝুপসি হয়ে আছে। এদের মধ্যে দিয়ে হাঁটব, আগামী কয়েকটা দিন।
ঝুপসি পাহাড়গুলোর কাছে হেরে যেতে ইচ্ছে করছিল। হেরে যেতে পারলে ভাল হত। নতুন প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়ায় হেরে যাওয়ার মতন ভাল।
ইন্দরের লম্বা, ম্যানলি সিলূয়েটটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট-জ্বালানো দেশলাইয়ের আলোয় আমরা একে অপরের মুখটা এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম।
প্যাকেটটা ওকেই রাখতে দিলাম। ভ্যালিতে অলকানন্দার জলের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। দু'বছর আগেকার কথা মনে পড়ছিল।
পাস্-টার মাথায় পৌঁছে দেখি চোর্টেনগুলোর মধ্যে বসে ইন্দর বিড়ি খাচ্ছে। আমাকেও একটা অফার করল। বিড়ির আগুন থেকেই ধরিয়ে দিল, খুব হাওয়া। বলল - খেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিও, এখানে গুঁজো না।
কেন? এখানে কি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ইন্দর বলল - জায়গাটার নাম পিত্রাধার। আমরা, আসেপাশের অনেক অন্য গাঁও-য়ের লোক - সবাই এখানে শ্রাদ্ধ করতে আসে, কেউ মরলে। পুজো দেয়, পিন্ডি দেয়, এইসব। তাই বললাম।
দূরে, মেঘের মধ্যে দিয়ে নন্দাদেবী দেখা যাচ্ছিল। বিড়িটা ফেলে ক্যামেরাটা বের করতে যাবো, আমাদের চমকে দিয়ে ভ্যালি থেকে এক ঝাঁক বাদামি স্নো পিজন উড়ে হুশ করে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমাদের, আর নন্দাদেবীর মধ্যে একমাত্র জীবিত প্রাণী ওরা।
ইন্দরকে বললাম - আকাশের খুব কাছাকাছি এখানটা, বলো?
ও কি বুঝল জানিনা, বলল - হোগা।
--
সকালে ঘুম ভাঙল বেলা করে। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি, কাঁচে জলের ছিটে পড়েছে, পড়ছে।
নিচে নেমে এলাম। রিসেপশনের সিঁড়িতে বসে ইন্দর সিগারেট টানছিল। আমায় দেখতে পেয়ে সিগারেটটা ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল - হরি সিং আসেনি এখনো।
আমি বললাম - ভালো হয়েছে আসেনি। তোমার ঘরের চেয়ারটা বের করে বারান্দায় লাগাও। চায়-ও লাগাও। আজ আর বৃষ্টিতে বেরিয়ে কাজ নেই।
আছি।
অনেক ধন্যবাদ, রঞ্জনবাবু।