১
বুদ্ধ বললেন - তুমি এক কাজ করো, গোতমী। এমন একটা বাড়ি খুঁজে বের করো, যে বাড়িতে কেউ কখনো মারা যায়নি। সেই বাড়ি থেকে, বেশি নয় - পাঁচ-ছ'টা সর্ষের দানা নিয়ে এসো। এতেই কাজ হবে। বেঁচে উঠবে তোমার ছেলে।
২
- ভালো করে ধরে তোল, ভালো করে ধরবি কিন্তু
- মাথাটা হেলে যাচ্ছে, মাথাটা হেলে যাচ্ছে রে ভাই
- ভালো করে আলতা দিন না। এই কেউ সিঁদুরটা আন
না, বিজয়ার দিন ঠাকুর তোলা হচ্ছে না ট্রাকে। বডি নিয়ে শ্মশানে যাওয়ার আগেকার দৃশ্য সব।
৩
হাসপাতালের লম্বা করিডোরের শেষে দেয়ালের ওপরদিকে লেখা -
সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ
কাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে কথাগুলো? আমার মনে হলো যেন এই "সর্বে"-র মধ্যে সবাই পড়ে না। এই "সর্বে" একটা সম্পূর্ণ অন্য ক্লাস। এরা পেশেন্ট।
এরা আমাদের মতন ঘোরতা-ফেরতা, মস্তি করতা বিশেষত্বহীন সুস্থ মানুষ নয়। এরা আলাদা। এরা আজ পেশেন্ট, আর কাল মরলেই বডি।
৪
হ্যাঁ, ইনফেকশন ছড়াচ্ছে। এটাই সত্যি।
আমার শহরে ছড়িয়েছে। আমার দেশে, হ্যাঁ। পৃথিবীতে? ছড়িয়েছে। আমার বাড়ি থেকে দু' কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে মারা গেছে পেশেন্টরা। দু'-তিন ঘণ্টার ফ্লাইটের দূরত্বে থাকা আমার দেশের প্রায় প্রত্যেকটা শহরে মারা গেছে, এবং এই মুহূর্তে মারা যাচ্ছে পেশেন্টরা।
অবশ্য গোটা বিশ্বের যা জনসংখ্যা, সেই অনুপাতে মারা গেছে অনেক কম জন। একটা ভিডিও-য় শুনলাম, যারা মারা যাচ্ছে তারা অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ।
হ্যাঁ, এতোটাই দূরে সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে। নিজেকে বোঝাচ্ছি বারবার - প্রতিদিন, এর চেয়ে বেশি লোক হার্ট অ্যাটাক বা ক্যান্সারে মারা যায়।
এভাবেই সইয়ে নিচ্ছি নিজেকে। আদর করে ইগনোর করছি একটা স্বচ্ছ, সুন্দর ইন্এভিটেবিলিটি-কে।
৫
ইতালির বের্গামো শহর। বহুদিন ঘরবন্দী থাকার পর ফ্ল্যাটের বাইরের বেঞ্চে এসে বসেছেন এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আজকাল আর বার-তারিখ মনে থাকে না।
রোদ এসে পড়ছে ওনাদের ওপর। আজকাল আর রোদ মনে পড়ে না। বের্গামোর প্রত্যেক বাসিন্দা অন্তত একজন এমন লোক-কে চেনেন, যিনি করোনা-য় ভুগে মারা গেছেন।
বের্গামো-র রাস্তাঘাটে মৃত্যু ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যু ঘুরে বেড়ায় এখানেও। তবে শুধু আজকাল নয়। চির-টা কাল ধরে মৃত্যু ঘুরে বেড়ায় প্রত্যেকটা শহরে। প্রত্যেকটা মফঃস্বল, প্রত্যেকটা গ্রাম, প্রত্যেকটা পাহাড়, প্রত্যেকটা জঙ্গলে।
আমার মতে পৃথিবীর অন্যতম ডেঞ্জারাস জিনিস হলো ফ্যান। যেকোনো মুহূর্তে খুলে মাথায় পড়তে পারে। আমার মতে, যিনি ফ্যান আবিষ্কার করেছিলেন তিনি পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। যেকোনো মুহূর্তে খুলে মাথায় পড়তে পারে জেনেও নিচে আরামে শুয়ে থাকতে পারা, শুধুমাত্র আরামের জন্য - এ জিনিস পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন।
এই বন্দিদশা একদিন শেষ হবে। দু'দিন হুল্লোড় হবে খুব।
তারপর আমরা আবার বেরোবো বাড়ি থেকে, স্কুল যাবো, কলেজ যাবো, চাকরি করতে যাবো। সব জায়গায় যাবো, একটা কনভেয়ার বেল্টে চেপে। যন্ত্র হয়ে, যন্ত্রের সামনে বসে কাটাবো রোজকার দশ'টা-পাঁচটা। ভুলে যাবো বাঁচার জন্য এই হাঁকপাঁকগুলো। ভাববো, সময় আছে তো।
ভুলে যাবো গুরুজীর কাছে বসে গান শেখার ইচ্ছেগুলো। ভুলে যাবো পাহাড়ে না যেতে পারার কষ্টগুলো। ভাববো, সময় আছে তো এখনো।
৬
১৯৪৭। প্রকাশিত হলো ৩৪ বছর বয়সী এক ফরাসি লেখকের একটি ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাস। নাম - লা পেস্তে। ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় - দ্য প্লেগ। লেখকের নাম - আলবেয়ার কামু।
এক শহরের গল্প। ইঁদুর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়লো প্লেগ। মারা গেলেন বহু মানুষ। গল্পের নায়ক, ডাক্তার রিউ, ফ্রন্টলাইনে থেকে সবটা দেখলেন।
তারপর, একদিন বিদায় নিল প্লেগ। গোটা শহর মেতে উঠল আনন্দে। ঘরে বসে সবটা দেখলেন গল্পের নায়ক, ডাক্তার রিউ।
"রিউ জানেন, যে এই গল্প কোনো চিরকালীন জয়ের গল্প নয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে যা করা উচিত ছিল - এ শুধু তার একটা গল্প। এ বিপদ আবার ফিরে আসবে - এ জিনিস আবার করতে হবে। শহরবাসীর আনন্দের আর্তনাদ শুনতে শুনতে রিউ-র বারবার মনে পড়তে লাগলো সেই এক কথা - এ আনন্দ চিরকালীন নয়, এ আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। ডাক্তারি বইয়ে লেখা আছে, এই প্লেগের জীবাণুর মৃত্যু নেই। এ প্লেগ লুকিয়ে থাকে, অসীম ধৈর্য্য এর - এ অপেক্ষা করে থাকতে পারে হাজারো বছর। আমাদের বেডরুমে, সেলারে, ট্রাঙ্কে, ছেঁড়া রুমালে কিংবা পুরোনো কাগজের দিস্তার ভেতর। আবার কোনোদিন, এ প্লেগ তার ইঁদুরদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে। মরতে পাঠিয়ে দেবে এরকমই কোনো একটা সার্থক শহরে।"
৭
বুড়োরা বেশি বকে কেন? তারা জানেন তাদের হাতে বেশি সময় নেই বলে।
একেবারে ছোট বাচ্ছারা কেন কথা বলতে পারে না? কি দরকার, এখনো তো সময় আছে অনেক।
খুব ভালো লেগেছে। দু'বার পড়লাম।
রঞ্জনবাবু, আপনি যে লেখাগুলো পড়ছেন, মন্তব্য করছেন, এটাই আমার পাওনা।
ভালো লাগল। ভালো পরিবেশনা। বক্তব্যে আরেকটু কিছু থাকতে পারত যেন।
বেশ বেশ
সুন্দর ব্যান্জনা—মন খারাপ ছুঁয়ে যায়—তবে ঐ যে—'আপনার কথা"সময় আছে তো"—
ঠিক , কষ্টটুকু পাওয়ার জন্য সময় আছে তো —সেটা ভেবেই দিন কেটে যাচ্ছে৷
সকলকে ধন্যবাদ।
দুঃখের ব্যাপার এই, যে লেখাটা আমি লিখেছিলাম গত বছর, ঠিক এই সময়েই। এবছরও লেখাটা সমান প্রাসঙ্গিক!