১
অন্ধকার। আলো। আলো - অন্ধকার - আলো। ফের অন্ধকার, তারপর পরপর আলো, আলো, আলো...
চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলাম। রাতের হাইওয়ে-তে গাড়িতে ঘুমোনোর চেষ্টা করা বৃথা। গা এলিয়ে, যতটা হয় পা সোজা করে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলেও উল্টোদিকের সোঁ-সাঁ গাড়ির আলো চোখে লাগে।
গাড়ির পেছনের সিটে বাঁ-দিকে বসে আমি। জানলা দিয়ে দেখি - ছোট-ছোট আধ-শহুরে গ্রাম, অন্ধকারে ডুবে থাকা বিষণ্ন মফঃস্বল, এইসব। এক কামরার শিব মন্দিরে সিএফএলের আলো, বোঝা যায়না মন্দির সাদা না সবুজ না নীল। হুশ করে গাড়ি বেরিয়ে যায়। বাইকের শোরুম, নোংরা ফেলার জায়গা, দেশি মদের দোকান, রেলব্রিজ। ধাবার সামনে অদ্ভুত আলো-জ্বলা ট্রাক। কালো পিচের রাস্তা, যেখানগুলো ভেঙে গেছে, সেখানেও কয়লার গুঁড়োর কালো। জানলা বন্ধ, তাই নাকে লাগে না। কাঁচে ভাপ জমে, আঙুল দিয়ে দাগ কেটে তার ভেতর দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখি। গভীর রাতে আমার ফ্লাইট।
বেশ কয়েক মাস পর বাড়ি এসেছিলাম। বহুদিন পর পর বাড়ি আসার কিছু সমস্যা আছে। একটা কাপে চা খেতাম, সেই ছোটবেলা থেকেই। একেবারে ছোটবেলায় অবশ্য দুধ খেতাম, তবে সেও ওই কাপেই। এবার চা খেতে গিয়ে দেখি একটা নতুন কাপের আমদানি হয়েছে। শুনলাম, সে'টা নাকি ধুতে গিয়ে ভেঙেছে। খারাপ লাগল, শেষটা দেখতে পেলাম না বলে। চিনামাটির কাপ, একদিন না একদিন তো ভাঙতোই - তবু...
বাড়িতে না থাকার এটাই সমস্যা, সবসময় সবকিছুর শেষটা দেখা হয়না।
২
আবার, সবকিছুর শেষ দেখতে পাওয়াও অদ্ভুত বিড়ম্বনা।
কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ফিজিক্স প্র্যাক্টিকালে এক বোতল পারদ পেয়েছিলাম। সে এক অদ্ভুত জিনিস। জলেরই মতন, তরল - কিন্তু আবার কিছুতে সাঁটে না, কাপড়-টেবিল-কাঁচ ভেজায় না। একটা পুরোনো লিপ্-বামের ডিব্বা পরিষ্কার করে, খানিকটা পারদ ঝেঁপে সেটায় ভরে সেলোটেপ দিয়ে সিল করে রেখে দিলাম। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে দেখাব। সে জিনিস এখনো বাড়িতে আছে, আমার স্কুলের বইয়ের তাকে একটা পুরোনো রেডিওর ওপর রাখা। ধুলো পড়ে ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যায় না।
সে জিনিস বাড়িতে কাউকে দেখানো হয়নি। প্রত্যেকটা ছুটিতে বাড়ি আসার সময় সেটাকে ভুলে ফেলে এসেছি আমার মেসে-ই, চৌকির তলায় সুটকেসের এককোণায় পড়ে থেকেছে ওটা। কলেজ যখন শেষ হল, সেও তখন আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু ততদিনে আমি তার ওপর ইন্টারেস্ট হারিয়েছি।
৩
এবার বাড়িতে একটা বিখ্যাত জীবনবীমা সংস্থার ক্যালেন্ডার দেখলাম। ডিসেম্বরের পাতায় একটা বুড়ো-বুড়ির ছবি। টাকলা বুড়োটা বুড়িটাকে একটা গয়নার সেট দিচ্ছে, দু'জনের হাসি হাসি মুখ - এইরকম। ছবিটা আমার অস্বস্তিদায়ক বলে মনে হলো। বুড়োটা তো কয়েকদিন পরেই মরবে, তখন বুড়িটা ওই গয়না দেখে ভেউভেউ করে কাঁদবে, হয়তো বা সেটা পুরোটাই সমাজ-সংস্কারের চাপে আলমারিতে তুলে রেখে দিতে হবে। আর বুড়ি মরলে তো কথাই নেই, ও গয়না তখন স্মৃতির বোঝা হয়ে বুড়োর গলায় ঝুলে পড়বে।
আমাদের এখানে অধুনা বন্ধ কারখানার পুরোনো কলোনির একগাদা abandoned কোয়ার্টার আছে। সেগুলোর জানলা নেই, দরজা নেই, ফ্যান-লাইট-সুইচবোর্ড সব চুরি হয়ে গেছে। তবু, অনেক ঘরের দেওয়ালে ক্যালেন্ডার আছে। সেই মৃত্যুর সময় ঘড়ি থেমে যাওয়ার মিথ্-এর মতন, সেগুলোর পাতা আটকে আছে সেই মাসগুলোয়, যে মাসে বাসিন্দারা এক এক করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র।
একটা কিছুর শেষ মানেই কি একটা কিছুর শুরু? এরকম কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
এ প্রশ্নের উত্তরটা আমার ঠিক জানা নেই। আসলে, আমার দরকার-ই নেই এ প্রশ্নের উত্তরের। আমার তো ফ্লাইট ধরার আছে।
যাদের সে সুযোগ নেই, তারা ভাবুক।
৪
Tired of lying in the sunshine staying home to watch the rain.
You are young and life is long and there is time to kill today.
And then one day you find ten years have got behind you.
No one told you when to run, you missed the starting gun.
(পিঙ্ক ফ্লয়েড - টাইম)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।