একটু উদ্যম, একটু অর্থবল। এটুকু থাকলেই করা যায়। জবাকুসুম তেলের কারখানা। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম। হয় নি, কারণ উদ্যম থাকলেও অর্থবল ছিল না একেবারেই।
সারাবেলা বাগানে বসে জবার পাতা ছেঁচে, বেটে, তাতে জল আর প্যারাশুট কোম্পানির তেল ঢেলে কাঁচের বোতলে ভরে শীতের রোদ খাওয়াতে হয়। তাই-ই করেছিলাম। বিকেলে রোদ পড়ে যাওয়ার পর বাগানে গিয়ে বোতলের ঢাকনা খুলে শুঁকে দেখি - সেই এক গন্ধ। জবাপাতার বুনো গন্ধ।
কতই বা বয়েস তখন। নার্সারী-কেজিতে পড়ি।
বাপ্পাটা থাকলে আরেকবার চেষ্টা করে দেখতাম। তা হয় নি। বাপ্পাকে তখন রোজ স্কুলে যেতে হত। ওর বাবা তখন সবে সবে স্কুলের অটো চালানো ধরেছিল, তাই।
এরপর কিছুদিন মরা জিনিস বাঁচানোর ব্যবসা ধরি। কিছুটা সাকসেসও হয়েছিল।
কেন্নো দেখতে পেলেই কাঠি দিয়ে ছুঁয়ে ওটাকে কুন্ডলী পাকিয়ে দিতাম। বাড়ির পেছনে, বাউন্ডারিওয়ালের পাশে বড় বড় গর্ত খোঁড়া থাকত। কেন্নোটাকে কাগজে তুলে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিতাম। পরদিন গর্ত থেকে মাটি তুলে দেখতাম কেন্নো নেই। অনেককে করে দেখিয়েছি। সবাই অবাক হয়েছে খুব।
দুটো ব্যবসাই করেছি একা একা। অনিতা চলে যাওয়ার ধাক্কা খেয়ে।
অনিতার বাড়ি ছিল মধুপুরের কাছে কোনো সাঁওতাল গ্রামে। দশ-বারো বছর বয়েসে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে। কাজ বলতে - ঘরের কাজকর্ম, আর আমাকে দেখা।
আমি অসৎ হলে বলতাম ওর গায়ের রং ছিল আবলুশ কাঠের মতন কালো। কিন্তু আমি সৎ, আর আমি জীবনে আবলুশ কাঠ দেখি নি। অনিতার গায়ের রং কালো ছিল নিঃসন্দেহে, তবে ওরকম কালো শেডের কাঠ আমি কখনো দেখি নি। আরেকটা জিনিস খুব মনে আছে। ওর মাথার তেল-চপচপ চুলের কড়া গন্ধ।
খুব ভালো হত যদি অনিতা আমায় রাতে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজের গ্রামের গল্প বলত। খুব ভালো হত যদি ওর একটা আমারই বয়সী ছোট ভাই থাকত। এধরণের মশলা নিয়ে একটা চাপা দুঃখের গল্প লেখা খুব সোজা। দুঃখের বিষয়, এক্ষেত্রে তা হয় নি। অনিতা বরাবরই খুব চুপচাপ ছিল। হুঁ-হাঁ ছাড়া কথাই বলত না।
আমার পেছন-পেছন লেগে থাকা আর আমার করা ভুলভাল কাজের জন্য বকুনি খাওয়া অনিতা খুব ভাল পারত। একদিন বাড়িতে কেউ নেই, ফিল্টারে জল ঢালবো বলে জেদ করে জ্যারিকেন উল্টে ক্যান্ডেল ভেঙে সে একেবারে যা-তা অবস্থা। বাড়ির লোকের বকুনি শুনে অনিতা প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছিল। দেয়ালের কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো নবদ্বীপের গৌর-নিতাই পুতুলের মতন অনিতার রোগা কালো চেহারাটা পরিষ্কার মনে আছে।
পরদিন অনিতা পালিয়ে গেছিল। বেশিদূর যেতে পারে নি যদিও, কাশিটাঁড় স্টেশন থেকে ওকে আবার ধরে নিয়ে আসা হয়।
সেই অনিতা একদিন পাকাপাকি চলে গেল। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে। তারপর আর ওকে কখনো দেখি নি।
আমার এখনো মনে হয় যে যদি ওকে কখনো দেখি, ওকে ওর বরের সঙ্গে নতুন বউয়ের মতন টকটকে লাল শাড়ি পরেই দেখবো।
শ্যামাপদ জ্যোতিষীর মত অদ্ভুত লোক দেখি নি। নিজে জ্যোতিষী হয়েও জ্যোতিষবিদ্যায় বিশ্বাস ছিল না। দু'হাতের আঙুলে একটাও আংটি ছিল না। বলত - আমি হলাম হোমিওপ্যাথ। রোগ হলে কোনো হোমিওপ্যাথকে নিজের ওষুধ খেতে দেখেছ?
শার্ট-প্যান্ট পরে চেম্বার করলেও গ্রামের বাড়িতে হেটো ধুতি পরেই দেখেছি বরাবর। আমাকে প্রথম দর্শনে বলেছিল - এ ছেলের রক্তে ভয় আছে, একে ডাক্তারি নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িও।
আমার এক বন্ধু, অবিনাশ - কথায় কথায় নানারকম ব্যবসার কথা বলত। কখনো মুরগির খামার, কখনো প্রেস। কয়েকদিন আগে কথা হল, বলল - করোনার টেস্ট করছে। শুনে মনে হল, ঠিকই বলেছিল বটে শ্যামাপদ জ্যোতিষী! আমার দ্বারা এসব হবে না।
কালীপুজোর দিন বড়পিসির চাপাচাপিতে শ্যামাপদর গ্রামের বাড়ি গেলাম। বাড়ির পাশেই শ্যামাপদর বিরাট কালি মন্দির। প্যাট্রনদের নাম লেখা মার্বেল বসানো কাদা প্যাচপ্যাচে মেঝে। ছোট মেলা বসেছে, কাঠের নাগরদোলা লোকে হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে। বেজায় ভিড়। সবাই খিচুড়ি খেতে এসেছে।
খিচুড়ি খাওয়ার লাইনে দু'জনকে দেখে চমকে উঠলাম! একজন রোগা, কিন্তু মাসক্যুলার পুরুষ। পাশে একজন মহিলা। নতুন বউয়ের মতন লাল টকটকে শাড়ি পরে। বুক অবধি ঘোমটা দেওয়া ছিল, তাই মুখটা দেখতে পাই নি।
মন্দিরের কথা যখন উঠলোই, তখন আরেকটা মন্দিরের কথা বলি।
সেটাও কালীমন্দির। তবে কালীমূর্তিটা কেমন যেন অন্যরকম। বিরাট বড় মূর্তি, যাকে বলে - লাইফ সাইজ। বড় বড় চোখ, বড় জিভ, বিশাল বড় খাঁড়া। একা থাকলে কেমন যেন ভয় ভয় করত। দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম - এটা কেমন কালী? দিদা বলল - এটা কালী নয় রে, এটা ধুমাবতী।
পড়ে বই পড়ে জেনেছি, ওটা কালী-ই, ধুমাবতী নয়। ধুমাবতী রোগা বিধবা বুড়ি, ঘোড়াহীন রথে বসে, রথের মাথায় একটা দাঁড়কাক। ওই মূর্তিটা মোটেই ধুমাবতীর ছিল না। বড়রাও না জেনে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলে।
মন্দিরের পরিবেশও শ্যামাপদর মন্দিরের চেয়ে অনেক আলাদা। নতুন মন্দির। ঝকঝকে শ্বেতপাথরের গর্ভগৃহ, নাটমন্দির, বারান্দা। যতবার গেছি, পুরো ফাঁকা। আমি, মা, আর দিদা ছাড়া কেউ নেই। একটু বেলা করে একজন পুরোহিত আসত। ফর্সা, রোগা, কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস হবে। ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফ। মিষ্টি করে হাসত, আস্তে আস্তে নরম গলায় কথা বলত। আমরা সবাই নিচুগলায় কথা বলতাম।
পুজো শুরু হলে আমি গর্ভগৃহের পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। একটু ঝোপঝাড় পেরিয়েই একটা বিরাট বড় সবুজ ঘাসের মাঠ। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলত। মাঠের ওপারে ধূসর জঙ্গলের রেখা।
আকাশে বর্ষার নীল মেঘ। ওরকম নীল আমি আর একবারই দেখেছি - পুরীতে, সমুদ্রের জলে।
তবে ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। সে এক অন্য গল্প।
ভালো লাগলো। জামাকাপড় পরার ক্ষেত্রে 'পড়ে' বানান লেখা গুলো শুধু একটু চোখে লাগছে। তবে সেটা নিট পিকিং .
নিট পিকিং কেন হবে? অনেক ধন্যবাদ! খুঁজে খুঁজে ঠিক করলাম :)
খুব ভাল গদ্য। লোককে ডেকে পড়ানর মতন।
এমনও হতে পারে যে মূর্তিটা কালীর কিন্তু পূজার মন্ত্রগুলি সব ধূমাবতীর। কালী প্রধানা দশমহাবিদ্যারই একটা রূপ ধূমাবতী তাই পুরো "মিথ্যা" বলেছেনটা সম্পূর্ণ সত্যি নাও হতে পারে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সম্বিৎ!
:|:, বেশ ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট! আমি এতটা তলিয়ে ভেবে দেখিনি। দেখতে কালীর মতন লাগত, তাই কালীই ভেবেছি। ধুমাবতীর মন্দির আমি কখনোই দেখিনি।
এই লেখার জাত আলাদা; ভালো লেগেছে।
খুবই ভালো লাগলো।
চমৎকার
এতজন পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন - খুব ভাল লাগছে। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ!