আসলে জীবন এক মহাভারত। এই মহাভারতের যতটুকু মনে আছে, তার চেয়ে বেশি যে ভুলে গেছি। জীবন এক অনিশ্চিত ভ্রমণ, কোথা থেকে মানুষ যে যায় কোথায়? আমার স্বপ্ন ছিল অধ্যাপনা করব। স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে এক আলোচনাচক্রে আমি ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আমি সূচনায় বললাম, একদিন এই ভবনের নিচ থেকে বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরেছিলাম। চান্স পাইনি। ৪৮ পারসেন্ট পেলে কি এমএসসি-র কোনো এক শাখায় পড়তে পারা যায়? তারপর বর্ধমান, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা। তাঁদের নিজেদের অধীনস্থ কলেজের বাইরের ছাত্রদের তেমন সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেক। পড়ার সুযোগ এখন অনেক। আমার হয়নি তখন। তাতে শেষ অবধি মন্দ কিছু হয়নি, কিছু একটা হয়েছে। শুধু অধ্যাপক হতে পারলাম না। কিন্তু সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি তো। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেছি। সুতরাং যা হতে চেয়েছিলাম তা যেমন হয়নি, হয়েছেও। যা হওয়া খুব কঠিন সেই রাস্তায় নিজের মতো করে চলতেপেরেছি। লেখকের জীবন কঠিন জীবন। বড় পত্রিকা নিয়েছে, নেয়নি। সবচেয়ে কঠিন সময় হলো, টের পাওয়া, লেখাটি হয়ত ঠিকঠাক হয়নি। মনে হয় হয়নি। আবার মনে হয়, আমি একই লেখা লিখছি। আগের লেখাকে অতিক্রম করতে পারছি না যখন, সেই লেখার মানে কী? এসব লিখতে আসার হাঁচি, সর্দি কাশি। একটা গল্প লিখতে বসে, আটকে গেছি, ছ’মাস বাদে গল্পটি বাগে এসেছে এমন হয়েছে কয়েকবার। আবার কোনো গল্প দুদিনে লিখে ফেলেছি এমন হয়েছে। একদিনেও হয়েছে। আসলে এসবের কোনো নিয়ম নীতি নেই। আমাকে বন্ধু কয়েকজন এমনকী সাময়িক পত্রিকা, সংবাদপত্র থেকেও বলেছে আর একটি ধ্রুবপুত্রর মতো কিছু লিখুন। কিন্তু লেখক কি পেছনে ফেরেন? এক লেখা দু’রকমে দু’বার লেখা যায়। যখন আমি নিজেকে অনুকরণ করব, তখন আমি শেষ। বারবার নতুন পথ খুঁজতে চেষ্টা করতে হয়।
লেখা আমাকে সজীব রাখে। কিন্তু লেখা যখন হয়ে ওঠে না, তার চেয়ে বিমর্ষ সময় বুঝি আর আসে না। গল্প উপন্যাস না এলে অন্য লেখা লিখলাম না হয়। ক’দিন বাদে আবার নিয়ে বসলাম অসমাপ্ত লেখা।
যে চাকরি করেছিলাম, সেই চাকরিতে উদার মনের উপরওয়ালার সাক্ষাৎ পেয়েছি অনেক। আবার অনুদার মানুষের সঙ্গে দেখা কম হয়নি। বাঁকুড়ায় একজন ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সপ্তাহান্তে দেখা করা বিধি ছিল। দেখা করে তোলা পৌঁছে দেওয়া। অলিখিত একটা বিষয় ছিল তা। কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়, মুখে বলা যায় না। আমি বুঝিনি। মাথায় একটু নিরেটই বটে। মিটিং ছাড়া যাব কেন তাঁর কাছে। তিনি বিরূপ হয়েছিলেন। তো তিনি আমার চাকরি প্রায় খেয়ে নেবেন ঠিক করেছিলেন। চার্জশিট ফ্রেম করবেন বলেছিলেন, কেন ১৩ তারিখে দেয় রিপোর্ট ১৩ তারিখেই দিতে পারিনি। ১৫ তারিখে গিয়েছিলাম সেই রিপোর্ট নিয়ে যা ছিল কাজের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কাজ করার তথ্যসম্বলিত। আসলে সবটাই দামোদর নদের বালি উত্তোলন নিয়ে। ও হলো সোনার খনি। তিনি এক ব্যবসায়ীকে নিষিদ্ধ করেছেন চিঠি দিয়ে, সেই ব্যবসায়ী দিন পনের বাদে গাড়ি হাঁকিয়ে আমাকে এসে বলছেন, স্যার বলে পাঠালেন, কাগজপত্র, চালানে সই করে আমার কাজ শুরু করিয়ে দিতে। বললাম, স্যার চিঠি দিয়ে বন্ধ করেছেন, স্যার চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা রহিত না করলে তো আমি কোনো চালানে স্বাক্ষর করতে পারব না, লিজ অর্ডার দিতে পারব না। যাদব মশায় জোরাজুরি করতে লাগলেন। তিনি আমাকে হঠাৎ বলেছিলেন, আপনার বই কী বেরুলো স্যার, কত কপি ছাপা হয়, আমি কিনিয়ে নিবো। অপমানিত লেগেছিল। স্যরি। আপনি নিজেই তো বাংলা পড়তে পারেন না, আমি অফিসে বই বেচতে বসি না। তিনি না পেরে আবার জেলাসদরে ছুটলেন। বলে দিলাম, লিখিত অর্ডার যেন তিনি না নিয়ে আসেন। অফিসিয়াল চিঠি যেভাবে আসে, সেইভাবেই আসে যেন। স্যার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর পাঠানো ব্যবসায়ীকে আমি প্রত্যাখ্যান করায়। তাঁর মুখের কথায় কাজ না করলে গোঁসা। এইসব ব্যক্তি কালের গর্ভে বিলীন হয়েছেন।
একবার এক থানার ওসি আমার টেবিলে টাকার বান্ডিল রেখে একটি জমি দখলে ১৪৪ ধারা প্রয়োগ হবে কিনা সেই তদন্তে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। রিপোর্ট আমরা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ওসি বলছেন, আর একবার যেন আমার অফিসের সারভেয়র যায়। রিপোর্ট যেন এক ব্যক্তির অনুকূলে যায়। তার বিপক্ষেই গিয়েছে রিপোর্ট ইতিমধ্যেই। আদালতের পেশকা বদলে দেবে তা। বুঝতে না পেরে যত বলি, টাকা তুলে নিন, হাওয়ায় উড়ে যাবে, ব্যাগ থেকে বের করেছেন কেন, তিনি যেন কানেই শোনেন না। বুঝতে পেরেছেন আমার চেয়ে বয়সে বড় অগ্রজ সহকর্মী। তিনি ঘরে ঢুকলেন একটি আইনের পরামর্শ নিতে। দেখেই বুঝে গেছেন। ওসিকে বললেন, এ কী করছেন, টাকা নিয়ে বেরিয়ে যান মশায়, এই অফিস আপনার থানা নয়, আর সকলে আপনাদের মতো নন। আপনি মানুষটাকে অপমান করছেন, ছি। তখন ওসি টাকা তুলে ব্যাগে ভরেন। এবং বিদায় নেন। সেই ওসি এরপর আমাকে বিব্রত করতে চেয়েছিলেন নানা ভাবে। মহকুমাশাসকের কাছে অভিযোগ করে। তাঁর ডাকা মিটিঙে আমি যাইনি। মহকুমাশাসক আমাকে মৌখিক জিজ্ঞেস করলে সব কথা বলে দিতে তিনি বলেছিলেন চাষাবাদের বিতর্কের মিটিং আপনি ডাকবেন। ওসি উপস্থিত থাকবেন। আপনি থানায় যাবেন না। কতরকম অভিজ্ঞতায় এ জীবন ভরে আছে। বিধানসভা উপনির্বাচনের রিটারনিং অফিসার করে দেওয়া হলো আমাকে। তিন থেকে সাড়ে তিন মাস গাধার খাটুনি। মুম্বইয়ের এক ট্রান্সপোর্ট কমিশনার এসেছিলেন অবজারভার হয়ে। তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখে আসতে। বই কিনতে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোরড বুকস্টোরে যেতে। যেতে বলেছিলাম কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে। তিনি এইভাবে কলকাতা ঘুরে দেখেছিলেন। নির্বাচনের কাজ কীভাবে পরিচালনা করছি আমি তা খুঁটিয়ে দেখতেন। তিনি প্রথম দিন যখন রিটারনিং অফিসারের ঘরে ঢোকেন, হাতে আলব্যের কামুর বই। মানুষটির সঙ্গে বন্ধুতা হয়েছিল। বয়সে ছোট কিন্তু টপ বস। জেলার সকল সরকারি অফিসার তাঁকে ভয় করেন। নির্বাচনী কার্যে পর্যবেক্ষক খুব ক্ষমতাবান। আমি তো আমার মতো। রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে তিনি সাহিত্য আলোচনা করেন। প্লেগ উপন্যাস নিয়ে কথা বলেন। অন্য সব অফিসাররা এসবের খোঁজই রাখেন না। নির্বাচন শেষ হলো, ফলাফল ঘোষণা হলো। তিনি চলে যাবেন। আমার হাত ধরে জেলাশাসককে বলে গিয়েছিলেন, মিঃ মিত্রকে যেন আর কখনো নির্বাচনের দায়িত্ব না দেওয়া হয়, উনি খুবই ভালো কাজ করেছেন, কিন্তু ওঁকে এত হ্যাজারডাস জব না দিলে উনি ক্রিয়েটিভ কাজ করতে পারবেন, এমন অফিসার তিনি তাঁর চাকরি জীবনে দেখেননি। সেই ট্রান্সপোরট কমিশনার পয়লা বৈশাখ এবং বিজয়া দশমীতে আমাকে প্রণাম জানিয়ে মেসেজ করতেন। কাউন্টিঙের আগের দিন একটি ঘরোয়া আড্ডায় আমি আর উনি ঘন্টা দেড় সাহিত্যের আড্ডা দিয়েছিলাম। আমি ওঁকে বুঝিয়েছিলাম। উনি আমাকে। সে ছিল এক আশ্চর্য সন্ধ্যা, আর সকল উচ্চপদস্থ আমলাকুল চুপ। আমাদের কথায় শুধু জেলাশাসক প্রবেশ করতে পারছিলেন। তিনি ছিলেন বিদুষী নারী।
ফিরে যাই শৈশবের সেই বাড়িতে। ধীরে ধীরে দণ্ডীরহাটের সাজানো বাগান (বাড়ি) নষ্ট হয়ে গেল। গোলাপবাগান, প্রবেশপথের দু’দিকে কামিনী ফুলের ঝাড়, দালানে ওঠার সিঁড়ির দুপাশে কাঁটাঝাউয়ের দুটি গাছবাড়িটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছিল। পথচলতি মানুষ আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত। পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। পুকুর থেকে রুই কাতলা ধরা হচ্ছে তা দেখেছি। দুদিকে, উত্তর এবং দক্ষিণে ছিল লম্বা দুটি বারান্দা। গ্রীষ্মের রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে শুতাম। চাঁদ আকাশে। চাঁদের আলো মুখের উপর এসে পড়ত। আমি ও আমার খুড়তুতো ভাই পবন (নিরঞ্জন) গল্প করতাম কত আগডুম বাগডুম। তখনই লিখব এমনি ভূত মাথায় চেপেছে। সে বলত লেখ ছোড়দা লেখ। অপরিণত কবিতা, গল্প তাকেই পড়ে শোনাতাম। সে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ত। রাতে শিয়াল ঘুরঘুর করত। তখন ভুলু কুকুর চিৎকার করত। ভুলু আমাদের বাড়িতেই থাকত। মেজ কাকিমা বেলা দুপুরে ডাক দিত, আতু তু তু তু। ভুলু কান খাড়া করে থাকত ঐ ডাকের জন্য। যেখানে থাকত ছুটে আসত। তাকে ভাত দিত মা কাকিরা। মনে পড়ে না কবে প্রাতঃরাশে ফেনা ফেনা ভাত, আলুসেদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল, রুটি খেতে আরম্ভ করলাম, আমার খুড়তুতো বোন পুষ্প আর আমি নুন দিয়ে রুটি খেতাম মহা আনন্দে। ছোট কাকিমা পরম স্নেহময়ী, মায়ের শাসনে তিনি হতেন আমার ঢাল। তাঁর কাছে শাসন ছিল না, ছিল আদর। বাড়িতে ছিল একটি দাঁড়াশ সাপ। দীর্ঘ কালো কুচকুচে শরীর। হঠাৎ হঠাৎ গ্রীষ্মের বেলায় পার হয়ে যেত উঠোন। মাথাটা উঁচু। পুকুরে কৃষ্ণগোধিকা ছিল। ঝোপেঝাড়ে বেজি ছিল। সজারু ছিল এদের দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। বাড়িতে হিমসাগর আম গাছ আর একটি সুগোল আমের গাছ (মা বলত লতার আম) ছিল। ছিল জামরুল গাছ, জাম গাছ। জামরুল গাছের ডালে বসে জামরুল খাওয়ার সুখ আমাদের সন্তানরা পায়নি। তারা অনেককিছুই পায়নি যা ছিল প্রকৃতিসংলগ্ন। সেইসব জীবনচর্যা এখন মুছে গেছে। যাবেই তো। শহর এসব সমর্থন করে না। কিন্তু করেও। আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী কন্যাটি প্রতিদিন সাত-আটটা পথের কুকুরকে ভাত খাওয়ায়। দণ্ডীরহাটের ছেলেবেলা ছিল অনুপম। ঠাকুমা মন খারাপ করতেন ধুরোলের জন্য। ঠাকুরদা অসুস্থ। চেয়ারে বসে থাকতেন বিমর্ষ মুখে।
কী এক অভিমানে বাবা দণ্ডীরহাট যাওয়া বন্ধ করেন। ধীরে ধীরে তাঁর মায়া চলে যায় বাড়ি থেকে। কেন যায় জানি না তা নয়। কিন্তু কিছু করার ছিল না। বেলগাছিয়ার আলো অন্ধকারে ভরা ফ্ল্যাটই বাবার কাছে ভালো। এই সময়ে গ্রামের এক জামাই একদিন হাজির বেলগাছিয়ার বাসায়।
‘জেঠামশায় আপনার ঘর তালা মারা আছে। কেশরাম মিল বন্ধ। ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকার জায়গা নেই। চাবিটা দেবেন, থাকব, এক বছরের মধ্যে জমি কিনে বাড়ি তুলে চলে যাব।’
চাবি নিয়ে চলে গেলেন তিনি। আর ওঠেননি। মৃত্যুর আগে বাবা বলেছিলেন, ওকে থাকতে দিস। তোরা তো যাবি না থাকতে। তাই হলো। তিনি আছেন। আমরাও যাই না। যাই না সেই বাল্যকালের হাওয়ামাটির গন্ধ নিতে গ্রামখানিতে। দুই কাকা তাঁদের অংশ বিক্রি করে চলে এসেছিলেন। ২০১০ সালে দণ্ডীরহাট স্কুলের রিইউনিয়নে গিয়েছিলাম। বাড়ি দেখে, সেই অন্নদানিবাস দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিল। তারপর বসিরহাট গেছি, কিন্তু দণ্ডীরহাট যাইনি। যাক যা গেছে তা যাক। শিকড়ে নগর প্রোথিত হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে থাকতে পারব না। আর শৈশবই হারিয়ে গেছে তো যাব কার কাছে?
এখন এই বয়সে বসিরহাট, দণ্ডীরহাটের নাম শুনলে চঞ্চল হয়ে উঠি। যে কাহারপল্লীর মানুষ আমাদের ছেলেবেলায় দিনমজুরি করে কোনক্রমে ভাতের জোগাড় করত, বাবুবাড়ির ছেলেদের দুপুরবেলায় বুড়ো লালু কাহার জিজ্ঞেস করত, কী দিয়ে ভাত খাওয়া হলো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাদ্যের সন্ধান নিত, তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। তাদের বাড়ির বধূটি কাউন্সিলর হয়েছে। তাদের ঘরে শিক্ষা ঢুকেছে। চাকরি করতে যাচ্ছে তাদের ঘরের মানুষ। ইস্কুল যাচ্ছে, কলেজ যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। আমাদের ছেলেবেলায় ভাবতেই পারা যেত না। চানুর কথা মনে পড়ে। অতটুকু বয়সেই মাটি কাটতে যেত। দুখে কাওরা ইসলাম নিয়ে মুসলমান পাড়ায় চলে গিয়েছিল। হয়ত ভাতের সন্ধান পেয়েছিল ধর্মবদল করে। তাদের কথা মনে পড়ে। অনন্ত জীবনপ্রবাহ। কে কোথায় আছে, কে নেই, কেউ জানি না। এখন টাকি গেলে হাসনাবাদ গেলে চঞ্চল হয়ে উঠি। হার্টবিট বেড়ে যায় ময়লাখোলা পার হলে। এই তো আমতলা। গাড়ি একটু আস্তে চলুক। আমি দেখে নিই আমাকে। ওই আমি আমতলায় এসে বসিরহাট যাচ্ছি মারটিন রেলের উঠে যাওয়া লাইন ধরে। এইতো দণ্ডীরহাট স্টেশন। রেল উঠে গেছে, স্টেশন নামটি বহুদিন লেগে ছিল টাকি রোডের গায়ে। স্টেশনের লাইন আমরা ছোটবেলায় দেখেছি টাকি রোডের গায়ে। তারপর এসে গেল ফকির হাটখোলা। সেখানে বোর্ড লাগানো, দণ্ডীরহাট। এখান থেকে পুবের দিকে রাস্তা চলে গেছে সোলাদানা হয়ে ইছামতী নদীর দিকে। এই পথ আমার স্বপ্নের পথ। যাইনি কোনোদিন এই পথে। কিন্তু ছোটবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম শুকতারা পত্রিকায়। সেই গল্পে সোলাদানা-র উল্লেখ ছিল। পড়ে আমি উত্তেজিত। এমনি উত্তেজিত হয়েছিলাম ধলতিথের মাঠের উল্লেখ আম আঁটির ভেঁপু পড়তে পড়তে আবিষ্কার করে। দণ্ডীরহাট নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, ধুলোগ্রাম। আর ছোটদের গল্পে আমতলী রূপে দণ্ডীরহাট হাজির। ছোটবেলা কেটেছে বলে ছোটদের গল্পেই বেশি আসে। এই যে জীবনের কিছুটা লিখলাম, সব লেখা হয়নি। সব কখনো লেখা হয় না। সব মনেই পড়ে না।
আমার ঠাকুরদার মৃত্যুর মাস তিনেকের মাথায় এ বাড়ির প্রথম কন্যাটির বিবাহ হয়। এক বৎসর কাল অশৌচ চলে, শাস্ত্রের নিয়ম তাই, কিন্তু কীভাবে কোন এক মন্ত্রবলে বিবাহের দিনেই বাৎসরিক শ্রাদ্ধের কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। এমনিই তো হিন্দু বিবাহের দিন প্রাতঃকালে পূর্বপুরুষদের অন্নজল দেওয়া একটি প্রথা। এই প্রথাটি আমাকে এখনো আকর্ষণ করে। আমি কয়েকবার এই কাজ করেছি খুড়তুতো বোনেদের বিবাহে। তো সেই যে বাবা কাকাদের সন্তানের প্রথম বিবাহ, তা ছিল আমার মেজ কাকা সৌরীন্দ্রমোহনের কন্যা শেফালির। বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, আদি বাসস্থান ধূলিহরের কথা। বিয়ের বর এসেছিল কলকাতার চেতলা সাহাপুর থেকে দণ্ডীরহাট। তখন কতই বা বয়স। মাঘের সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি দুটি লোক পোঁ ধরেছে উঠোনে বসে। দুই বুড়ো সানাই বাজাতে লেগেছে। আর একজন ঢোল বাজাচ্ছে। সন্ধ্যায় হ্যাজাক আর গ্যাসবাতি জ্বলেছিল। গ্যাসবাতি ছিল অ্যাসিটিলিনের শাদা আলো। ক্যালসিয়াম কারবাইডে জল দিয়ে জ্বালানো হত। লম্বা ছিল বাতিদণ্ড। তার মাথায় জ্বলত শাদা আলো লম্বা হয়ে। তখন ক্যামেরায় ছিল ফটাস বাল্ব। বরযাত্রীরা সেই বাল্ব জ্বালিয়ে ছবি তুলেছিল। ব্যবহৃত বাল্বগুলি ফেলে দিয়েছিল। বিয়ের পরদিন আমি তা কুড়িয়ে নিজের সংগ্রহশালা ভর্তি করেছিলাম। কিছু ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের প্যাকেটও পেয়েছিলাম। বিয়ের দিন অনেক রাত জেগেছিলাম। বাসর ঘরে জামাইবাবু পরিতোষ ঘোষের ভাই অসীম গান গেয়েছিল, সেই গান আমার হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে গেছে। বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা, দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা...। আমি সেই শীতের রাতে গানের ছবি যেন মনে মনে দেখতে পেয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম এক কল্পনা যা এখনো মনে আছে। চিত্রকল্পটি এতই মধুর যে ভুলবার নয়। সে আমলে কন্যা শ্বশুরবাড়ি গেলে, সঙ্গে কেউ যেত। আমি গিয়েছিলাম। সাহাপুরে জামাইবাবুর বাড়িতে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। তখন সব বিয়েতেই বাড়িতে ভিয়েন হত। পান্তুয়ার সঙ্গে বোঁদে। এই ভিয়েন বসত আগের দিন বিকেলে। সেও ছিল অসম্ভব এক আকর্ষণ। পরিতোষ জামাইবাবুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমার প্রথমেই মনে পড়েছিল সেই গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুধাবর্ষী কণ্ঠস্বরই সেই বিবাহের উপযুক্ত ছিল। যিনি অনুকরণ করেছিলেন, সেই অসীমদার কণ্ঠস্বরও ছিল অনুরূপ। আমি যেন মনে মনে গাইতে গাইতে নিমতলা শ্মশানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কেউ যদি ওঁর মাথার কাছে বসে গানটি গেয়ে দেয়। আমি মনে মনে গেয়েছিলাম। জীবন সেদিন কত সুধাময় ছিল। গানটি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাও।
তখন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিবারগুলির সন্তানদের বিবাহ হতো অতি সামান্য আয়োজনে। আমার মামাতো দিদি খুকুদির বিয়ে হয়েছিল বেলগাছিয়া বাসায়। ছাদের উপর প্যান্ডেল বাঁধার সাধ্যও ছিল না। তিন ঘরের ফ্ল্যাট, তার ভিতরে বিয়ে। একটি ঘরে নিমন্ত্রিতদের, বরযাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা, অন্য দুটি ঘরে অন্য সব আয়োজন। নম নম করেই যেন বিবাহ হলো। অথচ মামাদের অবস্থা ওপার বাংলায় ভালোই ছিল। এপারে এসে বড় বিপর্যয়ে পড়েছিলেন। আমাদের বেলগাছিয়ার বাসায় মেজ মামা, ছোট মামার বিয়ে হয়েছিল। আমাদের সকলের তো নিশ্চয়। কিন্তু তা ছাদে প্যান্ডেল করে।
দণ্ডীরহাটের বাড়িতে জায়গার অভাব ছিল না। দুইটি প্রশস্ত বারান্দা, দুই দিকে দুটি উঠোন নিয়ে তা ছিল যে কোনো অনুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত। মেজকাকার মেজ মেয়ে দীপালির বিয়েও দণ্ডীরহাট বাড়িতে। জামাইবাবু বসিরহাটের। ছোটবেলায় এইসব বিয়ে ছিল দেশ ভাগে বিচ্ছিন্ন মানুষের মিলনস্থল। যদি সকলকে নেমন্তন্ন করা সম্ভব হতো। তখন মানুষের অভাব ছিল কম না। আমাদের এমনিতে পিসি নেই। কিন্তু লতায় পাতায় কম ছিল না। দণ্ডীরহাটে এক পিসি একদিন বলছে মাকে, ভাদ্র মাসে তাল দিয়েই খিদে মেটে। গরিব মানুষের এখনো তাইই হয়। ক্ষুধা নিরসনে খুব যে এগিয়েছে দেশ তা নয়। তবে চাল দেওয়া হয় রেশনে বিনামূল্যে তা নিশ্চয় অনেকটা খিদে মেটায়।
ছেলেবেলায় সব ক’টি ঋতু দেখতে পেতাম। পুজোর পর হেমন্তের সেই অল্পবেলা, বিমর্ষ বেলা, অঘ্রানের সকালে কাঁসার গ্লাস ভর্তি খেজুর রস, পাটকাঠি দিয়ে টেনে খাওয়া। শীত এসে গেল, দূরে ধানকাটা মাঠ পেরিয়ে খেজুর পাটালির মহাল। দেখতে যেতাম। জায়গাটা নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করত। মনে পড়ে প্রতি পূর্ণিমায় আমাদের বাড়িতে এক সময় সত্যনারায়ণের সিন্নি হতো। পাড়ার ছোটরা সকলে বারান্দায় বসে যেত ভোগ সিন্নি নিতে। কবে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মনে নেই। বাড়িতে শীতের সময় রসের পায়েস, রসবড়া, দুধের পিঠে, ভাজা পিঠে মুখ সামালি হতো উৎসবের মতো করে।
কত কিছু বলিনি। কলকাতার বইমেলা যা আরম্ভ হয়েছিল রবীন্দ্র সদনের বিপরীতে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাচীর ঘেঁষে, এখন যা মোহরকুঞ্জ সেখানে। ১৯৭৫ নাগাদ সেই বইমেলা শুরু। সেই বইমেলা নিয়ে এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে, বিকাশ জানা। মেদিনীপুরের ছেলে। সিনেমা করবে স্বপ্ন ছিল। থাকত কলেজ স্ট্রিটের এক মেসে। বিকাশ বলল, চ বইমেলা যাই। বিকাশ, আমি আর সমীর চট্টোপাধ্যায়। গিয়ে দেখি মস্ত লাইন টিকিটের। সার্কাসের লাইনও এর চেয়ে ছোট হয়। বিকাশ জানা চিৎকার করতে লাগল, আরে ভাই, এখানে একজন কবি আর গল্পকার আছে, এঁদের সুযোগ করে দিন, দেখি দেখি, সরুন, লেখক কবিকে আগে জায়গা করে দিন। বিকাশ সত্যি সত্যি নিজে কাউন্টারের সামনে গিয়ে টিকিট নিয়ে এল। জনতা খুঁজতে লাগল, কই লেখক, কই কবি? সেই বিকাশ আত্মহত্যা করেছিল হতাশায়। খুব মনে পড়ে ওর কথা। কলকাতা বইমেলা রবীন্দ্র সদনের বিপরীত দিক থেকে পার্ক স্ট্রিটে উঠে এল। সেই মেলায় আগুন লাগল, কত ঘটনা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মনে। এক বইমেলায় গুন্টার গ্রাস এসেছিলেন। আমাদের কয়েকজনকে গিল্ড আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। দুপুরে গিল্ডের অফিসে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল। শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ছিলেন এই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক। তিনি নানা কথায় বাংলা ভাষার লেখকদের উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন গুন্টার গ্রাসের কাছে। একবার অস্ট্রেলিয় লেখকরা এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের একটি সেশন হয়েছিল। আমি প্রশ্নকর্তা হিশেবে ছিলাম। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু মনের ভিতরে আসন পেতে আছে। আসলে বাংলাভাষার লেখক পশ্চিমবঙ্গে এবং কিছুটা বাংলাদেশ--এ ব্যতীত আর কোথায়? পৃথিবীতে ভারতীয় সাহিত্য বলতে ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখকদের চিহ্নিত করা হয়। অথচ বাংলা ভাষার গুণবান লেখকদের নিয়ে আমরা গর্বিত হতেই পারি। তাঁরা আন্তর্জাতিক সাহিত্যের মানচিত্রে আছেন কি? ২০১৯ সালে কাজাখস্তানের এশিয় লেখক সম্মেলনে গিয়ে বাংলা ভাষার লেখক হিশেবে আমি নিজের কথা বলেছিলাম। তা অন্য দেশের লেখকদের থেকে আলাদা হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, যেমন ভাবি আমরা, তা অন্য দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা লেখকদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আমি সাহিত্যে মিথ এবং পুরাণের ব্যবহার নিয়ে বলেছিলাম। জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে বলেছিলাম। আরবের লেখক লেখিকারা আমার সঙ্গে কথা বললেন বহু সময়। জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমার বইয়ের অনুবাদ নেই? তাইই তো, তাঁরা যে পড়তে চান।
জীবনের এক একটি দিনের কিছু সময় তারার মতো নরম আলো দেয়। কাজাখস্তান যেতে দুবাই এয়ারপোর্টে আট ঘন্টা অপেক্ষার কথা ভুলব না।
~~~~~~ শেষ ~~~~~~
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, আরও লিখুন। খুবই আগ্রহ নিয়ে ধারাবাহিকটা পড়লাম।
শ্রী অমর মিত্র মশায়ের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় দিদার আলমারি থেকে নামিয়ে আনা অমৃত পত্রিকায়। তখন বোধ বুদ্ধি সেভাবে হয় নি।
লেখককে নতুন করে আবিষ্কার করলাম সাইকেল মেসেঞ্জার, আবরণ, বিশ্বনাথের জাহাজ এই সব গল্প দিয়ে। আবিষ্কার করলাম এই সব লাইনে- " জীবনের নানা মুহূর্তের অন্তর্গত বেদনা আমাকে নির্বাক করে, তা থেকে মুক্ত হতেই তো আমার লেখা। অবিরাম শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি সেই শৃঙ্খলা মোচনের উপায়ই তো আমার লেখা। .....যে বিষয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করি সেই বিষয়ে লিখি। বিষয় নিয়ে তো লিখি না। লেখার পরে তা হয়তো বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তা তো থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়ত কিছুই না । শূন্য থেকে যাত্রা।... শূন্য থেকে বিষয়ে যেতে চাই। অবচেতনায় কী আছে তা তো টের পাই না।"
লাইনগুলি পকেটে নিয়ে ঘুরেছি দিনের পর দিন। এই ভাবে চেনাশোনা হয়েছে।
আরো পড়েছি। আরো চিনেছি।
এই সব বোধ থেকে কখনও কিছু মন্তব্য করেছি এই ধারাবাহিকে। বাচালতা মার্জনা করবেন এই বিশ্বাস আছে।
সমাপ্তি বড় মনোরম হ'ল। মঞ্চে শিল্পীদের দেখি অনুষ্ঠান শেষে করজোড়ে নমস্কার করতে , আনত অভিবাদন জানাতে। গোটা অনুষ্ঠান একটি নিবেদনের মত লাগে।
এ ধারাবাহিকের সমাপ্তিতেও লেখকের বিনম্র নমস্কার, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন হৃদয় স্পর্শ করে।
এতদিন ধারাবাহিকের সঙ্গে নীলচে রঙের ছবিটি বদলে গেল কমলা রঙে- যেন এতকাল পুরাতন দিনের কথা শেষ করে বাইরের রোদ কোলাহলে পর্দা টেনে দিয়ে লেখক আবার লিখতে বসবেন। পর্দায় ছায়া পড়ছে। নতুন লেখা শুরু হবে।
পাঠকের নমস্কার রইল।
খুব ভালো সিরিজ হল এটা।
শেষ হওয়ায় একটু মন খারাপ হল। প্রচুর মানুষ আর অদেখা সময়ের চিহ্ন ধরে এগোচ্ছিলাম।
আরব লেখক লেখিকারা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কেন আমার বইয়ের অনুবাদ নেই' - - - এখান থেকেই একটা প্রশ্ন জাগল। অবস্থার কি উন্নতি হয়েছে? সেদিন একটা ফেসবুক পোস্টে দেখলাম এ বিষয়ে আক্ষেপ করা হয়েছে? অন্তত ভারতের অন্য প্রদেশের ভাষায় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ বাড়লেও হয়। যদিও সঠিক তথ্য আমি জানি না।
দীপক দাসঃ যে বইটি ২০০৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায়, তা ২২ ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করার জন্য চুক্তি করেছিল সাহিত্য অকাদেমি। তামিল, সাঁওতালি ও অসমীয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন তাঁরা এত বছর ধরে। ইংরেজি এবং হিন্দি দুজনকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে বাতিল করেছেন তাঁদের রিভিউয়ারগণ। তবে অন্য একটি বই, অনুবাদের চুক্তি হয়েছ অন্য প্রকাশকের সঙ্গে।
শেষ হয়ে হইলো না শেষ।
যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল ! আরো অনেককিছু জানবার ছিল, বোঝবার ছিল। এতো তাড়াতাড়ি শেষ হবে ভাবতে পারিনি। যেমন লেখকের জীবন ও অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি, তেমনই ব্যাপ্ত হবে আত্মজীবনী, যেন এইরকম আশা ছিল মনে মনে। তাই মৃদু বেদনাবোধ অনুভব করছি।
ঈপ্সিতা পালচৌধুরী এবং গুরুচন্ডা৯ কে অনেক ধন্যবাদ এই প্রার্থিত পাঠের সুযোগ করে দেবার জন্য।
লেখক বললেন, "পেন্সিলে লেখা জীবন " এখানে শেষ হলো। শেষ কি হলো ? প্রবাহিত জীবনের কথা কি শেষ হয় ? জীবনের শেষ কোথায় ? লেখকের জীবন তো আরও বৈচিত্র্যময়। বহুদর্শী। কত কল্পনা আর বাস্তবের যুগপৎ আকাশ আর মাটিতে পথ তৈরি হলো। ধুলিহর থেকে দণ্ডীরহাট। সেখান থেকে কলকাতার শহরের সীমানায়। একজন মানুষের মধ্যে কত মানুষ। একটা জীবনের মধ্যে কত জীবন। সময়ের ঘাটে ঘাটে বাঁধা নৌকোয় সুবর্ণ সঞ্চয় তুলে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তাইতো লেখক বলেন, জীবন এক অনিশ্চিত অভিযাত্রা। সেখানে যিনি অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন, তিনি হলেন সরকারি আপিসের চাকুরে। কিন্তু তার ভেতরে থেকে লেখক হয়ে মেটালেন সেই তৃষ্ণা। জীবন এমনই। এতটা অনিশ্চয়তায় ভরা বলেই জীবন এতো সুন্দর। যা নির্ধারিত বা নিশ্চিত সেখানে রহস্য নেই। যেখানে রহস্য নেই সেখানে আনন্দ কোথায় ? পেন্সিলে লেখা জীবন আনন্দ বেদনায় মহাকাব্যিক হোক।
শংকর কুমার মল্লিক
খুলনা, বাংলাদেশ
ভাগ্যিস অধ্যাপক হন নি!! এত বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা কি তাহলে আমরা পেতাম? বাংলা গল্প-উপন্যাসের এত খবরাখবর, লেখকদের নিয়ে এত গল্প শোনা হত কি? আত্মজীবনী মানে তো একটা সময়ের ইতিহাস। পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হলে সংগ্রহযোগ্য বই হয়ে থাকবে আমাদের সকলের কাছে।
শেষ হয়ে গেল ? নিশ্চয়ই না ! নতুন শুরুর আশায় রইলাম ৷
সময়ের ইতিহাস এ লেখা থেকে অসংখ্য উপাদানও সংগ্রহ করবে ৷ সে জন্যেই একটা ছোট্ট উল্লেখ রাখি : কলকাতার বই মেলা ,বোধ হয়, প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল ,national book trust এবং কলকাতার কয়েকটি প্রকাশনার উদ্যোগে ,1974 সালে, academy of fine artsএ ৷ উদ্বোধনে এসেছিলেন সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় , ছিলেন লেডি রাণু মুখার্জী ৷
নিরঞ্জনঃ সে মেলা দেখিনি। হয়েছিল একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের কোনো এক গ্যালারিতে। রূপা কোম্পানির মিঃ মেহেরা এবং ক্যালকাটা পাবলিশার্স এর বিমল ধর ছিলেন মূল আয়োজক। আমি রবীন্দ্র সদনের উল্টো দিকের মেলাই দেখেছি।
অসাধারণ
শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি, আটের দশকের শেষ দিকে বা নয়়ের দশকের শুরুতে ধারাাাবাহিকভাবে "আগুনের গাড়ি" পড়েছিলাম, বড় ভালো লেগেছিল। যতদুর মনে পড়ে আপনার লেখা । জেনেছিলাম বড় দুঃখের রেলের (BDR), সোনামুখী র কথা। কিন্তু এই ২৩ পর্বে কোথাও তার উল্লেখ দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। আমি কী ঠিক বললাম? ভালো থাকবেন। নমস্কার নেবেন।
kalyan Santra : আগুনের গাড়ি আমার লেখা। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় যুক্ত হবে ওই পর্ব। ধন্যবা।
একটা পর্ব হল।শেষ নয়।
শেষ হয় নি। হয় না। আশায় রইলাম
বন্ধু অমর ,
খুব মনযোগ দিয়ে পড়লাম তোর পেন্সিলে লেখা জীবন । তোর সাহিত্যিক পরিমন্ডল এবং সাহিত্যিক হয়ে ওঠার জীবন িনয়ে এ বই । তবে পাশাপাশি আছে ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ও ঠার কথাও । কিন্তু পড়তে গিয়ে মনে হোল দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের চাকরি জীবনে যে বন্ধু েদর মধ্যে কাটালে সুখে দুখে তা েদর বো ধ হয় সজ্ঞানে এড়িয়ে যেতে চেয়েছ । অকপট হতে পারনি ঝাড়গ্রামের দি ন গুলো নিয়ে । আশা করি বই আকারে যখন প্রকাশ হবে তখন আরো বিস্তৃত অকপট েলখা পাব । ভালবাসা নিস ।
হোয়াট হ্যাপেন্স ইন ঝাড়গ্রাম স্টেস ইন ঝাড়গ্রাম
সুকান্ত দে ঃঃ আমি যা লিখেছি, তার চেয়ে লিখিনি অনেক বেশি। না লেখার অভ্যাসই লেখা। আমার সাহিত্য জীবনের সূত্রগুলি লিখেছি মাত্র। সারাজীবন৷ যে মানুষগুলি আমাকে ভাবিয়েছেন, তাঁদের কথা লিখেছি। ডিগ্রুপ স্টাফ নিখিলবাবু, মুচিরাম মুর্মুর কথা লিখেছি। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মানুষ যারা তাদের কথা লিখেছি। তারাই আমাকে জীবন চিনিয়েছেন। যা লিখেছি অকপটে লিখেছি। সচেতন ভাবে বাদ দেব কেন? কতগুলি নাম লিখে লাভ কী? আমার লেখ৷ নিয়ে এক দুজন ব্যতীত কৌতুহল তো দেখিনি তেমন।
সুকান্ত দে ঃঃ যে কথা লিখিনি, তা আমার গল্প, উপন্যাসে আছে।
খুবই ভালো লাগলো । এমন বৈচিত্র্যময় চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতার এত সাবলীল উপস্থাপনা আগে কখনো পাইনি। বেশ সুন্দর। লেখক বলেছেন যা লিখেছেন, লেখেননি তার থেকে বেশি। সুতরাং আর এক অধ্যায়ের সূচনার অপেক্ষায় রইলাম।
শ্রদ্ধেয় অমর বাবু , আমরা আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ একটা জীবন কথা দিয়ে আপনি যেভাবে এতো কিছু ঘটনা , অভিজ্ঞতা টানা পোড়েন হাসি কান্না আরো ..আরো অনেক কিছু আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করলেন আমরা ঋদ্ধ হলাম !! আপনী সুস্থ এবং নীরোগ হোন এই কামনা করি !!
বন্ধু অমর, এটি যেন জীবনের একটি মহাভারত ! কত ঘটনা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে লেখাটির পাতায় পাতায় | এ লেখা জীবনের, সমাজের, ইতিহাসের প্রতিফলন | অনেক পর্ব পড়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি | তোমার সাহিত্যিক হয়ে ওঠার জীবনে কত অভিজ্ঞতা তোমাকে সমৃদ্ধ করেছে, তোমার লেখায় এসেছে | সমৃদ্ধ হয়েছি কত সুন্দর মানব জীবনের এই দলিল পাঠে |
খুব ভালো লাগল। পড়তে পড়তে চলে যাচ্ছিলাম জাম জামরুল গাছের ছায়ায়। একটা অন্য সময়ে।
অমরদার লেখার বেশ কিছুটা অংশ আমার জেলা বাঁকুড়ার পরিসরে । তাই খুবই ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করেছি নিজের দেশের রোদ আলো মাটির গন্ধে । জানতাম হঠাৎই শেষ হয়ে যাবে । প্রতিটি পর্ব পড়তে পড়তে মনে মনে চাইতাম ---চলুক চলুক । যেন শেষ না হয় ।
বাহ। খুব সুন্দর