সুন্দর ব্যাপারটা আপেক্ষিক – কারণ আমার চোখে যা সুন্দর, তা আপনার কাছে লাগতে নাও পারে! তবে কিনা একটা ব্যাপার থাকে – যেমন ঐশ্চর্য্য রাই সুন্দর, এ নিয়ে মনে হয় না তেমন কেউ দ্বিমত হবেন। তাই যদি কেউ ভিয়েতনাম ঘুরে এসে থাকেন এবং এই শহরে সময় কাটিয়েছেন এমন থাকেন, তাহলে মনে হয় তাঁরা আমার সাথে একমত হবেন যে, ভিয়েতনামের সবথেকে সুন্দর শহর খুব সম্ভবত ‘হোই-আন’।
ভিয়েতনামের দক্ষিণে হো-চি-মিন সিটি থেকে উত্তরে হ্যানয় যেতে পারেন বা ভাইস ভার্সা। কিন্তু ভিয়েতনামের মধ্যভাগটা যেন কোন ভাবেই মিস করবেন না – মধ্য ভিয়েতনামেই আছে, হুয়ে, মাই-সন, হোই-আন, ডা-নাং এই সব সুন্দর জায়গা গুলি। একে একে লিখব যদি সময় পাই বা উৎসাহ থাকে। আজকে একটু হোই-আন নিয়ে ফিরে দেখা যাক।
কোন এক শহর প্রাণপণে চেষ্টা করছে তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য-কে ধরে রাখতে, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও ক্রমে তারা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলছে পর্যটনের জন্য – এমন উদাহরণ হয়ত অনেকেই দেখেছেন আপনারা। আমার মতে হোই-আন এর একটা ক্ল্যাসিক্যাল উদাহরণ। এবার পর্যটক এখানে না আসুক এমন কেউ চাইছে না – কারণ হোই-আন এর এখনকার অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই নির্ভর করছে পর্যটন শিল্পের উপর। এই শহর এত বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে যে এখন কার দিনে ভিয়েতনামের এক অন্যতম সম্পদশালী এলাকা হয়ে উঠেছে এই শহর এবং তার আশপাশ। এমন নয় যে হোই-আন শহর আগে কোনদিন বিত্ত দেখে নি, বা বিত্তশালী কাকে বলে জানে না – বরং উল্টোটাই, ভিয়েতনামের ইতিহাসের অনেকটা অংশ জুড়ে হোই-আন খুব সম্পদশালী জায়গা হিসাবেই দেখা হত।
ভৌগলিক ভাবে দেখতে গেলে হোই-আন শহরটি ‘থু বন’ নদীর উত্তর দিকের তীরে অবস্থিত। হোই-আন শহরের ইতিহাস ঘাঁটলে এখানে মানুষ বসবাসের প্রথম নমুনা পাওয়া যায় প্রায় ২২০০ বছর আগের। একসময়ে এই হোই-আন ছিল খুবই ব্যস্ত এবং জনপ্রিয় বন্দর ভিয়েতনামের। একেবারে প্রথম দিকে এখানে প্রভাব ছিল ডং-সন কালচারের যা কিনা উত্তর ভিয়েতনামের প্রভাব। এর পরে দ্বিতীয় থেকে ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত হোই-আন ছিল বিখ্যাত ‘চম্পা’ সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ যার অনেক নিদর্শন হিসাবে ‘চম্’ স্থাপত্য বা স্তম্ভ হোই-আন শহরের পাশে আজও দেখতে পাবেন। ১৩০৭ সালে এক চম্ সম্রাট ভিয়েতনামের এক রাজকুমারকে বিয়ে করলে ‘কুয়াং-নাম’ প্রদেশটি বিবাহের যৌতুক হিসাবে দেন। কিন্তু সেই সম্রাটের উত্তরাধিকারী এটা স্বীকার করতে চাইলো না – বলল এই সব গিফট-টিফট আমি বুঝি না, কুয়াং-নাম প্রদেশ আমার! ব্যাস, শুরু হয়ে গেল মারপিট, যাকে যুদ্ধু বলা যেতে পারে – এবং যে সে যুদ্ধ নয়, প্রায় কয়েক দশক ধরে চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাদশ শতাব্দীতে এসে কিছুটা টেনশন থিতু হল – নিজেদের মধ্যে সেটেল করে নিল কেস। ফলে আবার শুরু হল ব্যবসা বাণিজ্য এই হোই-আন বন্দরকে কেন্দ্র করে।
এর পরের প্রায় চার শতাব্দী ধরে হোই-আন পরিচিত হয়ে রইল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যের বন্দর হিসাবে। অবশ্য পশ্চিম দেশীয় বণিকরা এই হোই আন কে বলত ‘ফাই-ফু’। কোন দেশের বণিকরা আসে নি এখানে! লিষ্টি বড়ই ইম্প্রেসিভ – চাইনীজ, জাপানীজ, ডাচ, পর্তুগীজ, স্প্যানীশ, ভারতীয়, ফিল্পিনো, থাই, ইন্দোনেশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, বৃটিশ, আমেরিকান – এব দেশের থেকে জাহাজ এসে নোঙর ফেলল হোই-আন বন্দরে। আর কি কি জিনিসের বাণিজ্য হত সেই তালিকাও জমকালো – সূক্ষ্ম ও দামী সিল্ক, কাপড়, কাগজ, পোর্সেলিন, নানা রকমের বাদাম, মরিচ, চাইনীজ ঔষূধ, হাতির দাঁত, ল্যাকর, মাদার-অফ-পার্ল। আচ্ছা জানি না আপনারা মাদার-অফ-পার্ল নিয়ে কতটা কি জানেন। এই নিয়ে একটা আলাদা পর্ব লিখতে হবে। নাম শুনে যেটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এগুলি কি সেই ঝিনুক যাদের মধ্যে মুক্ত থাকে? ব্যাপারটা অত সিম্পল নয়। মুক্ত যে জিনিস দিয়ে তৈরী হয় – এই মাদার পার্লের খোল গুলো সেই দিয়ে তৈরী। এদের দিয়ে তৈরী গহনা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য অমৃতা ভিয়েতনাম থেকে ল্যাকার এবং মাদার-অফ-পার্লের বেশ কিছু গহনা কিনেছিল। কেউ ইন্টারেষ্টেড থাকলে একদিন লেখা যাবে ক্ষণ সেই নিয়ে – দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না, সেটা অনেকটা শিওর।
এত সব দেশ থেকে বণিকরা এলেও চীন এবং জাপানীদের মত হোই-আনের উপর কেউ ছাপ ফেলতে পারে নি এত। এই দু দেশ থেকেই বণিকরা আসত বসন্তের সময় – উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে বইতে থাকে মনসুন বায়ুর উপরে ভর করে। হোই আন শহরে এরা থাকতে গ্রীষ্ম পর্যন্ত যখন বাতাস উপযুক্ত হয়ে উঠত বাড়ি ফিরে যাবার জন্য। মানে মোটামুটি চার মাস এখানে থাকত এরা – এই সময় থাকার জন্য এরা বানিয়েছিল নিজেদের মত করে বাড়ি। জাপানীজরা আসল প্রায় ১৬৩৭ সাল পর্যন্ত যতদিন না জাপানের সম্রাট বাইরের জগতের সাথে জাপানের সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলেন সব। কিন্তু চাইনীজরা থেকে গেল আরো অনেক দিন – তাই এখনো গেলে দেখতে পাবেন অনেক চাইনীজ মন্দির, হল বা স্থাপত্য। আর একটা ব্যাপারে কিন্তু হোই আন ভিয়েতনামের মধ্যে প্রথম – এখানেই প্রথম ভিয়েতনামের মানুষ পরিচিত হয়েছিল ক্রীশ্চান ধর্মের সাথে।
এর পরে থু-বন নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে যায় – এইভাবেই একসময় ‘তে সন’ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে হোই-আন শহর প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আবার পুননির্মাণ করা হয় এই অপূর্ব শহরটিকে, এবং তারপরে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য চলতে থাকে পুরোদমে যতদিন না থু-বন নদী মজে আসে – যেমনটা আগে লিখেছি। হোই-আন থেকে মূল বন্দর সরে গিয়ে ডা-নাং নামজ জায়গায় চলে যায়। অনেকটা আমাদের কলকাতা বন্দর গুরুত্ব হারিয়ে হলদিয়া ট্রান্সফারের মত!
এখনো গেলে সেই পুরানো হেরিটেজ কিছু দেখতে পাওয়া যাবে – আর আজকের দিনের শহরের দূষণ এবং বাজে রকম হই-চই বা ব্যস্ততার থেকে হোই-আন নিজেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু কথায় বলে কালের নিয়মে অনেক কিছু বদলে যায় – সেমন বদলে গিয়েছিল থু-বন নদীর প্রবাহমানতা – ক্রমশঃ পলি পরে পরে নদীর গভীরতা এত কমে গেল যে বাণিজ্য হেতু নৌকা/জাহাজ চালিতে হোই-আন বন্দরে আসা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে গেল। গুরুত্ব হারাতে থাকল ক্রমশঃ হোই-আন ভিয়েতনামের অর্থনীতি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি-তেও। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে হোই-আন বন্দর দিয়ে বাণিজ্য প্রায় পুরো পুরি বন্ধ হয়ে গেল। যদি ভাবেন এবার যে, কি হত যদি থু-বন নদীতে চাড়া না পড়ত বা সেই নদী বুজে না যেত! একটা খুব সহজ উত্তর আছে – তা হলে আজকে তাহলে হোই-আন কে এই ভাবে ট্যুরিজমের উপর নির্ভর করতে হত না!
বন্দর বর্জিত হয়ে যাবার পর হোই-আন খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল – যার পরিসম্পাতি হল ১৯৯০ এর দশকে, কারণ এই সময় থেকেই শুরু হল টুরিষ্ট ব্যুম। এত ট্যুরিষ্ট এখানে আসতে শুরু করে যে ঠিক এই সময়ে ধরলে হোই-আন ভিয়েতনামে এক অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিষ্ট স্পট – স্থানীয় খাবারের স্বর্গ, ফুড লাভার বা ব্লগার এই জায়গাকে খুবই পছন্দ করতে শুরু করেছে। আর এই টুরিষ্ট ইনকাম থেকে হোই-আন যে ভিয়েতনামের উপরের দিকের এক সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত হয়েছে সেটা তো আগেই লিখেছি।
পর্যটকদের জন্য এই যে এত কিছু তৈরী হচ্ছে, তা তার জন্য ফলভোগ করছে কে? কে আবার – সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক হোই-আন শহর। এই শহরের প্রাচীন ইতিহাস এবং চীন, জাপান সহ নানা দেশের সাংস্কৃতিক যে প্রভাব এখানে প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে হাত পরা শুরু হল। জাপানী বযবসায়ীদের সুন্দর সুন্দর সেই আগেকার দিনের বাড়ি, চাইনীজ মন্দির বা চা ব্যবসার সাথে জড়িত স্মৃতি গুলো এরা যত্ন করে রক্ষা করতে চাইলো, কিন্তু সব পারলো না। এত বেশী বেশী টুরিষ্ট হ্যান্ডেল করার জন্য এই ছোট্ট শহরটা রেডি ছিল না। তাহলে কি হবে? পাবলিক এসে থাকবে কোথায়! পর্যটকদের নিয়ে ব্যবসা করার জন্য সাধারণের বাড়ি এবং আসে পাশের ধান জমির বা ল্যান্ডস্কেপের পরিবর্তন হতে শুরু করল – তাদের জায়গা নিতে লাগলো বুটিক হোটেল, রেষ্টুরান্ট, লাউঞ্জ।
আর তা ছাড়া এখানে বেড়াতে এসে পাবলিক কি কি জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকবে – এটাও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল। খুব ছোট শহরে তো একদিন ঘুরলেই হয়ে যাবে – তাহলে পর্যটক-দের আরো অন্য কিছু করার মত ব্যবস্থা করতে হবে! এই ভাবেই জন্ম হল অনেক রেষ্টুরান্ট, কৃত্রিম পর্যটন এবং সাথে সাথে আরো অনেক অ্যাক্টিভিটি সেন্টারের। কালে কালে এর সাথে যোগ হল টুরিষ্টদের জন্য স্পেশাল করে সাজানো শপিং। যারা জানেন না তাদের বলে রাখি, এখন হোই-আন শহর কাষ্টম-মেড হাতে বানানো জামাকাপড়, চামাড়ার জুতো, ব্যাগ ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত। কত বিদেশী যে এখানে শুধু জামা-কাপড় বানাবার জন্য আসে ভাবতে পারবেন না।
হোই-আন এ এই সব জামাকাপড়, ব্যাগ ইত্যাদি কিভাবে কাষ্টমমেড বানাতে হয় সেই নিয়ে প্রচুর বিদেশী ব্লগ আছে – গুগুলে সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। প্রচুর অ্যাডভাইস – কি করা উচিত, কি ভাবে কাপড় বাছতে হয়, কিভাবে দর করতে হয়। বেশীর ভাগ ব্লগই কি দারুণ জিনিস তারা বানিয়েছে সেই নিয়ে লেখা – কয়েকজন তো দেখলাম আবার লিখেছে ব্লগ কেন তারা হোই-আন এ জামাকাপড় বানায় নি! কিছু ব্লগ পড়লাম – কিন্তু খানিক পড়ার পর আর তেমন এপ্রিশিয়েট করতে পারলাম না। এটা কিন্তু কেবল আমি নয়, ভারতের বেশীর ভাগ লোকই তেমন এনজয় করবেন না – সিম্পল প্রশ্ন মনে উঠে আসবে, “এ তো আমরা রোজ বাজারে দিয়ে করি – তা এত হ্যাজাবার কি আছে এতে!” তাহলে একটু খুলে বলি কেন এমন হয় -
আসলে হয় কি কারণ ভালো সিল্ক বলুন বা সুতি এবং তার সাথে ভালো টেলর আমাদের দেশে এখনো অনেক সহজলভ্য। এই যে হাতে বানানো এবং দক্ষ টেলর ব্যাপারটা ক্রমশঃ পশ্চিমা দেশগুলিতে এত বেশী খরচাসাপেক্ষ হয়ে গেছে তা ভাবতে পারবেন না! ফলে ওদের কাছে হাতে বানানো জিনিস মানেই লাক্সারি – ইতালিতে ভালো জবরদস্ত টেলার আছে, কিন্তু তাদের কেত দেখলে মাথা ঘুরে যাবে – আর দামের কথা বললাম না, এত দাম যে কেবল হলিউডের সিনেমা আর্টিষ্ট বা মিলিওনেয়াররাই সেগুলো অ্যাফর্ড করতে পারবে। কিন্তু আমাদের তো আর তেমন হয় – এখনো আপনি নিজের পাড়ায় ৫০০ মিটার হেঁটে গেলে সেই দর্জীর দোকান পেয়ে যাবেন যেটা হয়ত আপনার বাবাও ব্যবহার করতেন আর এখন আপনিও করছেন। মানছি দর্জির দোকান আমাদের দেশেও আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে, কিন্তু তবুও যা আছে তা ইউরোপ বা আমেরিকার থেকে অনেক বেশী সহজলভ্য। আমি শিওর এই লেখা যাঁরা পড়বেন তাঁরা এখনো প্যান্ট ‘কাটান’, বাজার থেকে রেডিমেড কেনেন না! বা আমার মত হলে বন্ধু আলম বাড়ি এসে মাপ নিয়ে গিয়ে জামা কাপড় বানিয়ে দেয়!
তো যা বলছিলেম, এই সবের ফলে হয় কি বিদেশ থেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত টুরিষ্টরা ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ড এসে এখানে দরজি দিয়ে জামা কাপড় বানানো্র জন্য হুমড়ি খেয়ে পরে! এই হুমড়ি খায়ে পরাকে কেন্দ্র করে হোই-আন এ গড়ে উঠেছে বিশাল মার্কেট। সার সার জামা কাপড়ের, বা লেদারের ব্যাগের বা জুতোর দোকান পাবেন যারা অত্যন্ত প্রফোশন্যাল ভাবে টুরিষ্টদের জন্য জিনিস বানাচ্ছে। এদের প্রায় সবার কাছেই বিশাল বিশাল ক্যাটালগ আছে – যে কোন ফেমাস ব্রান্ড এর কপি করে দিতে পারে – বা আপনি নিজের ডিজাইন দিলেন, সেটাও করে দেবে। আর কি স্পীডে ভাবতে পারবেন না – এ আমাদের গ্রামের টেলার বড়-ভাই এর মতন নয়, যে মাপ দেবার পর একমাস দোকান মুখো হলে গালাগাল খাবেন। বা আমার বড় জ্যাঠার মতন নয় যে সারাজীবন টেলারিং-এর ব্যবসা করেও প্যান্টের দুই পায়ের ঝুল সমান উচ্চতায় কাটতে পারল না!
এখানে আপনার কাছে মাপ নিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রথম ট্রায়াল দিতে ডাকবে দোকানে – আর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারী। কারণ এরা জানে যে টুরিষ্টরা বেশী দিন থাকবে না, তাই এই মতই বিজনেস মডেল বানিয়েছে। ভাবছেন খুব সস্তা কিনা? ইউরোপের দামের তুলনায় বেশীর ভাগ সময়েই সস্তা – কিন্তু ভারতীয় হিসাবে সস্তা নয়। কারণ একটাই – ভালো কাঁচামালের দাম আছে। ভিয়েতনামের সিল্ক খুব ভালো, কিন্তু দামী। তেমনভাবেই অরিজিন্যাল লিনেন বা চামড়ার জিনিসও দামী। সস্তায় বাজীমাত হয় না – ভালো জিনিস পেতে, ভালো দাম দিতে তৈরী থাকুন। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, এত কম জায়গার মধ্যে এত ভালো ভালো টেলার আমি আমাদের দেশেও দেখি নি।
ভারত থেকে যদি বেড়াতে যান, এই টেলার মেড জিনিসটা হয়ত তেমন আকর্ষণীয় লাগবে না। দামের ব্যাপারটা তো আগেই লিখেছি, বেড়াতে গিয়ে তো বটেই, প্রবাসী হয় ওঠার প্রথম কয়েকমাস, বা বছর বা অনেকে এর ফাঁদ থেকে বেরোতেই পারেন না – তা হল সব কিছুর বিদেশী দামকে ভারতীয় টাকায় রূপান্তরিত করা! আলু দুই ইউরো কিলো, মানে ১৬০ টাকা! এক লিটার তেল ৫ ইউরো, মানে ৪০০ টাকা! একটা ছোট্ট পেঁপে (যা কিনা আমাদের বাড়ির গরুকে দিলে মুখ ঘুরিয়ে নেবে) দেড় ইউরো, মানে ১২০ টাকা! পাগল নাকি! অনেক দেশে আবার তেলের দাম জলের (বটলড ওয়াটার) থেকে কম! এগুলো অ্যাডজাষ্ট করতেই বেশ সময় লাগে – সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। একবার অ্যাডজাষ্ট করে ফেললেই যদি আপনি প্রবাসী ভারতীয় হিসাবে ভিয়েতনামে যান তাহলে আপনারও বেশ সস্তা লাগবে জিনিসপত্র।
তবে সস্তা হোক আর না হোক এমন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে অমৃতা অল্প কিছু জিনিস কিনে বাড়ি আসবে এমনটা আবার হয় নাকি! সাজ গোজের জিনিস, জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি বাড়িতে যা আছে ছোট খাট বা মাঝারি সাইজের দোকানেও অত স্টক থাকে না! বেশ কিছু জিনিস বানিয়ে ছিলাম - দুজনার কয়েকটা ড্রেস, চামড়ার ব্যাগ, জুতো ইত্যাদি। কেবল একটা জুতোর দোকানে বেশ খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল – প্রায় বর্ডার লাইনের ঠকে যাওয়াই যাকে বলে। আমাদের যে ড্রাইভার ছিল সে প্রথম কয়েকদিন আমাদের ভালো ভালো স্থানীয় দোকানে নিয়ে গেল যেগুলো ওর চেনা শুনা – খুব বেশী জমকালো দোকান এড়িয়ে চলেছিলাম, কারণ আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কারিগর ভালো কিনা আর মেটেরিয়্যালস ভালো কিনা। ড্রাইভারটা ভালো – ওকে বলেছিলাম এমন দোকানেই আমাদের নিয়ে যেতে।
ড্রেস দিয়ে শুরু হল – বিশাল ঝাঁক চকচকে দোকান নয়, কিন্তু কাপড়ের/ছিটের স্টক ভালো। আর আমার নিজের টেক্সটাইল জ্ঞানের উপর বিশ্বাস আছে। দোকানের ভদ্রমহিলা একটু বয়ষ্কা। আর এমন দোকানে ঢুকে যা হয় – অমৃতার সাথে কেন জানি না দোকানীদের খুব ভাব হয়ে যায় – কিছু কিছু নাক উঁচু হাই-এন্ড দোকান ছাড়া এই ট্রেন্ড দেখেছি পৃথিবীর যে প্রান্তেই গেছি। অনেক সময় নিয়ে ক্যাটালগ দেখে, নিজে কিছু এঁকে অ্যাড করে দুটো গাউন টাইপের এবং আরো দুটো অন্য ড্রেস বানালো ভালো সিল্ক এবং মিক্সড ফ্যাব্রিকের। একদিনে তো আর বানানো হয় না, সেই দিন অর্ডার দেওয়া – পরের দিন গিয়ে সকালে ট্রায়াল দিয়ে, সন্ধ্যে বেলা ডেলিভারী নেওয়া। তবে সেই সব ডিটেলসে আর ঢুকছি না। সব ড্রেস গুলোই খুব সুন্দর বানিয়ে দিয়েছিলেন সেই ভদ্রমহিলা।
এর পরে লেদারের দোকানে – দুইখানি ব্যাগ বানানো হল কাষ্টম মেড, একটা আমার অফিস ব্যাগ আর অন্যটা অমৃতার। লেদারের দোকানগুলি অপূর্ব – তাই আবার পাশের দোকানে ঢুকে আবার লেডিস ব্যাগ এবং বেশ কতকগুলি বেল্ট। বেল্ট আর সেই রেডিমেড ব্যাগ সঙ্গে সঙ্গে কেনা হলেও, কাষ্টম মেড ব্যাগ পরের দিন ডেলিভারী।
এর পরে ঢোকা হল একটা দোকানে যারা খুব বিখ্যাত কাঠের জাহাজের মডেল বানাতে। মডেল মানে সেই আগেকার যুগের পালতোলা আমলে যে সব বৃটিশ, ডাচ, পর্তুগীজ, ফরাসী বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জাহাজরা সমুদ্র দাপিয়ে বেড়াতো। এগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয় – পাইরেটস অব দি ক্যারাবিয়ান সিনেমা দেখে নিশ্চয়ই আইডিয়া পেয়েছেন কিছুটা। এমন একটা কাঠের মডেল জাহাজ কেনার আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল। সেই দোকানে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল – দামের থেকেও বেশী ভাবনা দিতে হল নিয়ে যাব কি করে! কারণ যত বড় হবে নিয়ে যাওয়া চাপের – এরোপ্লেনে চেক ইন লাগেজে দিলে অক্ষত অবস্থায় ফিরবে সে জিনিস তার কোন গ্যারান্টি ছিল না! তবে এরা প্যাকিং ভালো করে – তাই মোটা মুটি সাইজের একটা কাঠের মডেল জাহাজ কিনলাম – যা এখনো আমাদের বসার ঘরে শোভা পাচ্ছে নিজের গর্বে।
আমি যে মডেলটা কিনেছিলাম সেই জাহাজের নাম ছিল “রয়্যাল সোলইল”, ১৬৬৯ সালে নির্মিত ফরাসী জাহাজ – পরের বহু বছর, প্রায় দুই দশক ধরে এই জাহাজ ছিল ফরাসীদের এক গর্বের বস্তু। ১৬৯২ সালে ফরাসী সম্রাট চর্তুদশ লুই এর আদেশ অনুসারে এই জাহাজ নিয়ে লিড করে কাউন্ট অফ ট্যুরভিল সাথে আরো ৯৭ খানি জাহাজ নিয়ে অ্যাঙলো-স্যাক্সন ডাচেদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের পরাজিত করেন। কিন্তু এই যুদ্ধ জয়ের কিছু পরেই ১৬৯২ সালের ১লা জুন, শত্রুপক্ষের আক্রমণে রয়্যাল সোলইল ধ্বংস হয়ে যায় – বাস্তব জাহাজের আজ প্রায় সাড়ে তিনশো বছর না থাকলেও, তার স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে আমাদের ঘরে।
জাহাজ কিনে প্যাকিং করে গাড়িতে ভালো ভাবে প্লেস করে আবার টুকটাক অন্য জিনিস পত্র কেনা – মাথার কাঁটা দিয়ে শুরু করে হাতের স্পেশাল কাঠের চুড়ির মতন। বিকেল হয়ে আসছিল – বাকি রইল কেবল জুতোর ব্যাপারটা। এদিকে আমাদের কেনাকাটার বহর দেখে ড্রাইভার বেশ ইতস্তত করে বলল, আমার একটা দূরসম্পর্কের ভাই আছে, তার একটা দোকান আছে – যদি আপনারা কিছু মনে না করেন, ওর কাছ থেকে যদি কিছু বানান তাহলে খুব উপকার হয়। আমরা দেখলাম বানাতে যখন হবেই, তাহলে এর ভাইয়ের দোকানেই বা নয় কেন! সেই দোকানে যাওয়া হল – ড্রাইভারের ভাইকে দেখলাম না, বরং যাকে দেখলাম তার সাথে কথা বলে খুব একটা ভালো ফিলিংস এল না। একদম পাক্কা সেলস-এর লোকজনের মত কথা বার্তা – আগের দোকানগুলোতে যে পার্সোনাল টাচটা পেয়েছিলাম, সেটা এখানে পেলাম না। আমাদের বেরিয়ে চলে আসা উচিত ছিল, কিন্তু ওই যে ড্রাইভার রিকোয়েষ্ট করেছে, তাই ইতস্তত করলাম। অমৃতা অর্ডার দিল, মানে এঁকে বুঝিয়ে দিল একটা কালো হাই হিল জুতো, যাতে স্ট্রাপটা বেশ জটিল ভাবে পেঁচিয়ে উঠে পায়ের গোড়ালির বেশ কিছু উপরে শেষ হবে। আমার কেনার কিচ্ছু ইচ্ছে হল না এর কাছে – তবুও এত জোড়াজুড়ি করল যে একটা বেশিক ডিজাইনের লেদারের স্যান্ডেল বানাতে বললাম। পরের দিন নিতে গিয়ে দেখলাম অমৃতার জুতোটা ভালোই বানিয়েছে – কিন্তু আমার স্যান্ডেলটা খুব একটা ভালো বানিয়ে দেয় নি। আর তুলনামূলক দামও বেশী নিয়ে আশেপাশের দোকানের থেকে। কিন্তু আর তর্ক করলাম না – হালকা খারাপ লাগা নিয়ে বেরিয়েছিলাম দোকান থেকে পরের দিন।
সন্ধ্যা বেলায় হোই-আন বড়ই মোহময়ী - রাতের হোই-আন হেঁটে ঘুরতে হয়। সারাদিন এদিক ওদিকে ঘুরে, শপিং করে খিদে পেয়ে গিয়েছিল – সেখানকার এক অনেক পুরানো কিন্তু খাবারের জন্য বিখ্যাত রেষ্টুরান্টে গেলাম। আমরা একটু আগেই গিয়েছিলাম বলে ভাগ্য ভালো থাকার জন্য বিনা রিজার্ভেশনেই টেবিল পেয়ে গেলাম – সেদিন ডিনারে কিছু স্পেশাল ভিয়েতনামি ডিসের সাথে এদের ভার্সেনে ডাব-চিঙড়িও খেলাম – বড়ই স্বাদ, প্রায় মুখে লেগে রইল। খাওয়া দাওয়া সেরে কোন নির্দিষ্ট প্ল্যান ছাড়াই ঘুরতে শুরু করলাম, নিজেদের মাখিয়ে নিতে শুরু করলাম রাতের হোই-আন শহরের সাথে। চারিদিকে লন্ঠন জ্বলে উঠে, ছবিতে যা দেখেন, তার থেকেও অনেক বেশী মোহময় সেই শহর। এই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঢুকে পড়লাম নদীর ওই পাড়ে সেই নাইট মার্কেটে! এখানেও নানা বিধ হ্যান্ডিক্রাফটের মেলা – এবং সত্যি বলতে কি বড়ই সুন্দর – সেই সব লিখতে গেলে এক ইতিহাস হয়ে যাবে -
আমাদের সৌভাগ্য যে ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় এই শহরের একদম কিচ্ছু ক্ষতি হয় নি। ভিয়েতনাম এবং আমেরিকার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর ফলে বেঁচে গিয়েছিল হোই-আন শহর যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে। ১৯৯৯ সালে হোই-আন শহরকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে এবং প্রাচীনত্ব বজায় রাখার জন্য খুব কড়া আইন চালু হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর হোই-আন শহরে পর্যটক আসা বেড়েই চলেছে।
তাই বলি কি ভিয়েতনাম ঘুরতে গেলে হোই-আন শহরকে মিস করবে না। কি কি দেখার আছে একটু গুগুল করলেই পেয়ে যাবেন, তাই সেই নিয়ে আর লিখলাম না। পরে একদিন না হয় লেখা যাবে এখানে কি কি খাবার ভালো বা এদের ল্যান্টার্ণ উৎসব নিয়ে। তবে কিছু দেখুন না দেখুন হোই-আন এর সেই ‘ওল্ড টাউনে’ জাপানীজ আচ্ছাদিত ব্রীজটা দেখে নিতে ভুলবেন না – ১৫৯০ সালে এই ব্রীজটি স্থাপিত হয় জাপানীজ দের দ্বারা তাদের নিজেদের কোয়ার্টারের সাথে চাইনীজ কোয়ার্টারের সংযোগ স্থাপনের জন্য। ফরাসীরা এটা ভেঙে ফেলে সমতল করে দেয় মোটর গাড়ি চালাবার জন্য – কিন্তু ১৯৮৬ সালে আবার এটাকে নির্মাণ করা হয় পুরানো আকার ও ডিজাইন অনুযায়ী। এই ব্রীজটায় দাঁড়িয়ে একটু ইতিহাস ছুঁয়ে নেবেন।
আর করো যদি মনে হয়ে আজকের হোই-আন শহরে বেশী ভিড় ভিড়, তাঁদের বলব এই সবের মধ্যেও বা শহর থেকে একটু বেরিয়ে গেলে হোই-আন শহরের এর এক অদ্ভূত সৌন্দর্য্য আছে যা আমাকে বারে বারে টানে -
ইশ! কি সুন্দর শহর! আর যেমন লেখা, তেমনই ছবি। এই সকালে চমত্কার মানসভ্রমণ হলো।
ঐতিহ্যবাহী খাবার দাবার নিয়ে আরও দুকথা লিখলে হতো। উড়ুক
আমি শুনেছিলাম আগে হই হান খুব সাদা মাটা জায়গা ছিল। ভীষন সস্তা আর পর্যটকদের আনাগোনা খুব কম বলে মূলত কলেজ স্টুডেন্টরা বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে আসত, অনেকদিন ধরে থাকত আর বেলাগাম হুল্লোড় করত। পরে নাকি সরকার ধীরে ধীরে অনেক বিধি নিষেধ আনে। পর্যটক আগমন ও বাড়তে থাকে। রিয়েল এস্টেট এর দাম ও আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়।
আর ভিয়েতনাম এর ফো এর ও অনেক গল্প শুনেছি, খেতে কি খুব ভাল নাকি ওভার হাইপড ?
ধন্যবাদ বিপ্লব
রমিতবাবু,
হোই-আন এ আজকাল যা টুরিষ্টের ভীড়! জানা নেই এরা কতদিন ঐতিহ্য বজায় রেখে শহরটাকে রাখতে পারবে। আর আমি এখানে আগে ভিয়েতনামের খাবার নিয়ে লিখেছিলাম। আমার মতে ভিয়েতনামী ক্যুজিন হচ্ছে এক আন্ডাররেটেড ক্যুজিন - এদের সারা পৃথিবীতে আরো জনপ্রিয় হবার কথা ছিল। অবশ্য এখন একটু একটু বাড়ছে ভিয়েতনামী ক্যুজিনের ব্যপ্তি
কি সুন্দর লেখা। না গেলে ও কত কিছু জানা হয়ে গেলো যা ভবিষ্যতে সাহায্য করবে। যুদ্ধ বিদ্ধস্থ দেশ হয়ে ও ভিয়েতনাম কি করে অল্প সময়ে দাড়িয়ে গেলো।
ছবি গুলো খুব সুন্দর। ভাষা কি, মানে ড্রাইভার দোকানদার দের সাথে কোন ভাষায় কথা বলেছেন। আপনার অন্যান্য সব ভ্রমন গল্পের মত এটাও একেবারে পড়ে শেষ করার মত। ধন্যবাদ ও শুভ কামনা।