গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে নয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মননশীল মর্যাদাবান পত্রিকা প্রতিক্ষণ আমাদের আশ্রয় হয়েছিল। প্রতিক্ষণের মতো সুসম্পাদিত, সুনির্মিত শারদীয় সংখ্যা তখন বেরোত না। এখনও বেরোয় না। কিন্তু প্রিয়ব্রত দেব অসুস্থ হতে প্রতিক্ষণ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল ১৯৯৮ নাগাদ। প্রকাশন সংস্থা থাকল। প্রতিক্ষণ প্রকাশিত বইয়ের অঙ্গসজ্জা অসাধারণ। আর পুস্তক নির্বাচনও। প্রতিক্ষণ আমার কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিল। হাঁসপাহাড়ি, অমর মিত্রর ছোট গল্প, নিসর্গের শোকগাথা, এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ এবং চাঁদু গায়েনের ডাকাত ধরা। অনেক পরে ‘মানুষের মুখ’ নামে একটি পকেটবই। ‘এখন মৃত্যুর ঘ্রাণ’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী। এই উপন্যাসটি ‘ধারাবাহিক মৃত্যুর বিবরণ’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল যুবমানস পত্রিকায়।
তো প্রতিক্ষণ বন্ধ হলে, আর তো লেখার জায়গা নেই। নেই বলব না, যিনি লিখতে বলতেন তাঁর পত্রিকায় লিখতাম। ৫০ টাকাতেও গল্প লিখেছি। আর সাহিত্য পত্রিকায় বিনি পয়সায় লিখেছি। বড় পত্রিকার দরজা বন্ধ। আজকাল পত্রিকায় গল্প লেখা যায়। সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকাও গল্প লিখতে বলে। এর আগে, ১৯৯০-এ প্রতিক্ষণ পত্রিকায় হাঁসপাহাড়ি উপন্যাস লেখার পর ‘বারোমাস’ পত্রিকায় আমাকে লিখতে বলেন সম্পাদক অশোক সেন। বারোমাস এবং অনুষ্টুপের তুল্য পত্রিকাও এখন আর নেই। অশোক সেন-এর মতো বড় সম্পাদকও আমি কম পেয়েছি। তাঁর কাছে, সেই মহানির্বাণ রোডে লেখা দিতে গেলে ঘন্টা দেড়-দুই কেটে যেত। জমিজমা, ভূমি সংস্কার, খাস জমি বিলি, অপারেশন বর্গাদার কার্যক্রম কেন স্তিমিত হয়ে গেল, সমবায় চাষ---কত বিষয়ে না কথা হত সেই প্রাজ্ঞ মানুষটির সঙ্গে। সাহিত্য সিনেমা, নাটক কত বিষয়েই না ছিল আড্ডা। অশোক সেনের স্নেহ পেয়েছি অফুরন্ত। শারদীয় বারোমাস পত্রিকায় গল্পের কথা তিনি মে মাস নাগাদ ফোন করে বলতেন। আমি শারদীয়র প্রথম গল্প বারোমাসের জন্যই লিখতাম। উপন্যাস লিখেছি বারোমাস পত্রিকায় তিনটি, নদীবসত, খরাবন্যার ফুল এবং কৃষ্ণগহ্বর। বইয়ের রিভিউ করেছি অনেক। দিনেশচন্দ্র রায়ের রচনা সমগ্রর রিভিউ করেছিলাম আমার হাতের লেখায় বারো পাতা। কিন্তু না আমন্ত্রণ করলে বারোমাস পত্রিকায় উপন্যাস লেখা যায় না। তখন উপন্যাস লিখব কোথায়? অথচ লিখেছি এক চটকল শ্রমিকের অন্তর্ধান নিয়ে একটি উপন্যাস। তার জন্য মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট সাহায্য করেছিল আমাকে। ভেবেছিলাম প্রতিক্ষণে দেব। হলো না। বিজ্ঞাপনবিহীন প্রতিক্ষণ বেরোবে কীভাবে? উপন্যাসের কথা অনীক পত্রিকার দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে ফোনে বললাম। দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ভালোবাসার লেখক ছিলাম আমি। স্নেহ করতেন। লেখা খুব পছন্দ করতেন। বলতেন তুমি দেশ পত্রিকায় যে গল্প লেখ, তা আমি অনীকেও ছাপতে পারি। এই সময় শারদীয়তে যে গল্পটি লিখেছ, তা কেন অনীকে দিলে না (মানুষী মাহাতোর জীবন মরণ)? অথচ আমার সঙ্গে কতবার কত রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতান্তর হয়েছে। মনান্তর হয়নি। তিনি আমার লেখা ফিরিয়েও দিয়েছেন। আবার এমন লেখা ছেপেছেন যার জন্য অনীকের গোঁড়া, তথাকথিত মার্ক্সবাদী পাঠকের নিন্দা শুনতে হয়েছে। সেই গল্পের নাম প্রাণবায়ু। দীপঙ্কর চক্রবর্তী একাই সমস্ত বিরূপ সমালোচনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই গল্পের পুলিশ অফিসার নক্সাল নিধনে দক্ষ ছিলেন। এক একটি হত্যার পর বাড়ি ফিরে স্ত্রীতে উপগত হতেন। নিহত বিপ্লবী যেন ফিরে আসত মাতৃগর্ভে। কবিতা লিখিনি, কিন্তু কবিতা হয়েছিল, দীপঙ্করদা বলেছিলেন। ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ নিয়ে কী করি। দীপঙ্করদা থাকতেন খাগড়াঘাট, বহরমপুর। ফোন করলাম। তিনি বললেন কলকাতায় রতন খাসনবিশের হাতে দিতে। তিনি অনীকের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান। অর্থনীতির নামী অধ্যাপক। তিনি পড়ে দেখবেন। দিলাম। অনীকে লিখে সাম্মানিক পাওয়া যায় না, কিন্তু পাঠক পাওয়া যায়। আমার একাংশ পাঠক অর্জন হয়েছে অনীক পত্রিকা থেকেই। অনীক শারদীয়তে উপন্যাসটি বেরোয় ২০০০ সালে। ২০০১- জানুয়ারিতে পিপলস বুক সোসাইটি বই করে। এই উপন্যাস পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন অশোক সেন। জনে জনে ফোন করে জানিয়েছিলেন। মৃণাল সেন তাঁর কাছ থেকে শুনে অনীক সাহিত্যপত্রেই ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ পড়েন। আমাকে ফোন করেন। তাঁর ফোন এক ঘন্টার আগে শেষ হত না। আড্ডা দিতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমি তো তাঁর অনুরাগী। আমাদের যৌবনকাল কেটেছে তাঁর ছবি দেখে দেখে। বাইশে শ্রাবণ থেকে আরম্ভ। কলকাতা একাত্তর, পদাতিক, ইন্টারভিউ, ভুবন সোম, খণ্ডহর---কত ছবি। মৃণাল সেন আগে আমার একটি উপন্যাস ‘ সমুদ্রের স্বর’ নিয়ে ছবি করবেন ভেবেছিলেন। তারপর ‘বালিকা মঞ্জরী’ গল্পটি নিয়ে। এইটি নব্বই দশকের মাঝামাঝি। তখন কতবার গিয়েছি তাঁর বেলতলার ফ্ল্যাটে। বেলতলাই তো। সেই সময়ের স্মৃতি বড় আনন্দের। ছবি না হোক, তাঁর কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে সিনেমার গল্প শোনা ছিল অভিজ্ঞতা। একদিন গিয়ে দেখি সুহাসিনী মুলে, ভুবন সোম ছবির নায়িকা। অসামান্য অভিনেত্রী। একটি জাপানি ডকু-ফিচার ছবির কাহিনি বলেছিলেন মৃণালবাবু, কিভাবে একটি সত্যিকারের ধর্মঘট কাহিনি হয়ে ওঠে, সেই গল্প। ছবি সব হয়ে ওঠে না। তাই হয়নি। কিন্তু অনেকটা ভেবেছিলেন। তারপর চুপ করে গিয়েছিলেন। তাঁকে ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ উপন্যাসের একটি খসড়া চিত্রনাট্য লিখে দিই আমি। তিনিই বলেছিলেন লিখে দিতে। তারপর গ্রিস গেলেন চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে। আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম না কিছুই। আশায় মরে চাষা। কয়েকজন বলেওছিলেন এতদিন যখন শুধু কথাই হয়ে যাচ্ছে, চার-পাঁচ মাস কেটে গেছে। কিন্তু চুক্তি হয়নি, হবে না ছবি। হলে ছ’মাস কথা চলত না। ছবি নির্মাণ আরম্ভ হয়ে যেত। কিন্তু লোকের কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আগে সমুদ্রের স্বর বা বালিকা মঞ্জরী নিয়েও এমনি অনেক কথা হয়েছিল। টেলিফোনে এবং ওঁর বাড়িতে। তিনি আমাকে জনৈক ইংরেজি বই প্রকাশকের কথাও বলেছিলেন। তাঁর বন্ধু। তাঁকে নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান অনুবাদ করাতেও বলেছিলেন নাকি। এখন মনে হয় তাঁর রাজনৈতিক বা দলগত বাধ্যবাধকতা ছিল। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান পছন্দ করেও আমার সঙ্গে কথা চালাতে চালাতে তিনি অন্য কাহিনির সন্ধান করছিলেন। পেয়েও গিয়েছিলেন, তবু আমার সঙ্গে কথা চলছিল। আদ্যন্ত এক মানবিক অথচ রাজনৈতিক তো নিশ্চয় সেই উপন্যাস। ছবি হলে আমার কথা বহুজনের কাছে পৌঁছে যাবে, সেই জন্যই তাঁর ডাককে একবারও অগ্রাহ্য করতে পারিনি। তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন, গ্রিস থেকে ফিরে আমার সঙ্গে চুক্তি করে ছবি আরম্ভ করবেন। কিন্তু গ্রিস থেকে ফিরে আর ফোন করেননি। মানুষও বাতাসে গন্ধ পায়। একদিন আফসার আমেদ আমাকে ফোন করে জানালো, মৃণাল সেন, তার ‘ধান জ্যোৎস্না’ উপন্যাস ছবি করছেন। চুক্তি হয়ে গেছে। একদিন মৃণালবাবুর ফোন। পরদিন চুক্তি। অভিনন্দন জানালাম। অনুজপ্রতিম আফসার আমার অতি ঘনিষ্ঠ প্রিয়জন। প্রিয় লেখক। তিনি ধান জ্যোৎস্না নিয়ে ‘আমার ভুবন’ ছবি করলেন। সেই ছবি দেখতে গেছি আমি তাঁর আমন্ত্রণে নন্দন-৩ এ। ছবি শেষে আমাকে বললেন, স্ক্রিপ্ট তাঁর কাছে থাকুক। তিনি নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান ছবি করবেনই। জীবনের শেষ ছবি হবে তা। থাকল স্ক্রিপ্ট তাঁর কাছে। আমার নিজের উৎসাহ ফুরিয়ে গিয়েছিল। স্ক্রিপ্ট রেখে দেওয়াও আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছু। ফেরত দিতেই পারতেন হবে না বলে, কিংবা ফোটো কপি রেখে। আমার নিজের তা রাখা হয়নি। সেই চিত্রনাট্য হারিয়ে গেল। আমি আর তার খোঁজ করিনি, কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম তো নিশ্চয়, আমি এক সাধারণ লেখক, কিন্তু আমারও তো সময়ের দাম আছে, চিত্রনাট্য লিখতে মাস দেড়েক তো লেগেছিল। তিনি বড় চিত্রপরিচালক। ছবিটি করতে পারেননি তৎকালীন রাজনৈতিক আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। উপন্যাস তো ছিল ভিখারি পাশোয়ান নামে হুগলির ভদ্রেশ্বরের জুটমিলের এক শ্রমিকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে। বাস্তব ঘটনা ছিল তা। ঘটনাটি নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া হয়েছিল। আমার উপন্যাসে পটভূমি ও নাম আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ছবি হয়নি। সব কিছু করা যায় না। অনেক রকম অসুবিধা থাকে। তাঁর সঙ্গে মিশতে পেরেছিলাম, এও তো বড় কথা। কিন্তু এই মেলামেশা আমার ভিতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। দিনের পর দিন নষ্ট। ছবি যেমন হয়নি, বইও ২০০৭-০৮ এর পর বাজার থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পাওয়া যেত না। আমার নিজের কাছেও বই ছিল না এমনই দশা। পিপলস বুক সোসাইটি আমাকে বলেছিল, অতিবৃষ্টিতে বাঁধাইখানায় জল ঢুকে ফর্মা নষ্ট হয়ে গেছে। যারা নতুন লিখতে এসেছিলেন, তাঁরা বইটি পড়তে চান, পি বি এস-এ গিয়ে খুঁজে পান না। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর সরকার বদলেছে। ২০১৩ সালে বইমেলায় আমাকে পি বি এস-এর একজন ডাকলেন, আসুন আসুন। আমি পি বি এস-এ যেতাম না বই নিয়ে ঐ ব্যাপার হয়ে যাওয়ার পর। বিরক্ত হয়েই ওঁদের প্যাভিলিয়নে ঢুকে দেখি নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান স্বমহিমায় বিরাজমান। সেই চল্লিশ টাকা দাম। দশ বছর আগের দাম। ঝকঝকে ফর্মা। সেই পুরোন ছাপা। কী হয়েছিল এতদিন? তাঁরা বললেন ফর্মা হারিয়ে গিয়েছিল, খুঁজে পেয়েছেন আবার। ভুল জায়গায় রক্ষিত হয়েছিল। মিসপ্লেসড। এমন হয় আমি শুনিনি আগে। না কি বইটি তাঁরাই বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলেন অদৃশ্য চাপে। কিন্তু পি বি এস-এর মানুষগুলি আমার প্রিয়জন। প্রত্যেকে আদর্শবাদী। ত্যাগী। আমি অনীক পত্রিকায় তিরিশ বছর এক নাগাড়ে লিখেছি। দীপঙ্কর চক্রবর্তী এবং রতন খাসনবিশ পরম শ্রদ্ধার মানুষ। অনীকের সঙ্গে পি বি এস সরাসরি যুক্ত না হলেও অনীক পত্রিকা পি বি এস থেকেই বিক্রি হয়। ওঁদের ভিতরে বন্ধুতার সম্পর্ক। অনীক এবং পি বি এস-কে আমি আলাদা করে দেখতাম না। এই ঘটনায় সব গোল পাকিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা, যাঁরা পার্টি করেন, তাঁদের কাছে সাহিত্য শিল্পের চেয়ে দলের মূল্য বেশি। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান উপন্যাস কিন্তু এক দলের নিন্দা করে অন্য দলের সমর্থনে লেখা তথাকথিত পার্টির লেখা নয়। এই উপন্যাস বামপন্থী দলের প্রতি বিষোদ্গারের নয়। কিন্তু ভিখারী পাশোয়ানের নিরুদ্দেশের ঘটনা সেই সময় হিমালয়ের চেয়ে ভারি হয়ে উঠেছিল সরকারের কাছে। পার্টির কাছে। একটি মানুষ যে কত তুচ্ছ, কত অবহেলার-- প্রশাসন, পুলিশ এবং বিত্তবানের কাছে, সেই লেখাই এই লেখা। উপন্যাসটি মুখে মুখে রটেছিল। এক সংবাদপত্রে এর আলোচনা করেছিলেন বিখ্যাত এক লেখক। মুখে আমাকে বলেছিলেন অনেক কথা, মা লিখ। ২৫০/৩০০ শব্দ কোনোরকমে লিখেছিলেন। এই রিভিউ নিয়ে সেই ভবিষৎবাণীই করেছিলেন পি বি এস কর্ণধার প্রশান্তবাবু। মৃণালবাবুর ছবি করা নিয়েও তিনি বলেছিলেন, হবে না। যাকে চিনতাম না, সেই স্বাতী ভট্টাচার্য আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি উত্তর সম্পাদকীয়তে এই লেখার উল্লেখ করেছিলেন। আমি পড়িনি, আমাকে খবর দিয়েছিলেন রমানাথ রায়। রাতে বাড়ি ফিরে পড়লাম। জানি না আমার সেই চিত্রনাট্য গেল কোথায়? মনে হয় ফেলে দিয়েছিলেন তাঁরা বাজে কাগজের ঝুড়িতে। মৃণাল সেনের এক জন্মদিনে তাঁর বাড়িতেই ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে দেখা। স্বদেশযাত্রা, কাটা ইলিশের গন্ধ নিয়ে তিনি অনেক কথা বলেছিলেন। গল্পটি নিয়ে ভেবেছিলেন অনেক। ছবির কথাও মাথায় নাকি এসেছিল আমার অজ্ঞাতেই। কিন্তু কাটা ইলিশের কাঁচা রক্তের গন্ধ কীভাবে পর্দায় আনবেন, পরিত্যাগ করেছিলেন পরিকল্পনা, সেও আমার অজ্ঞাতে। তিনি আমার সঙ্গে এ নিয়ে আগে আলোচনাও করতে বসেননি। কোনো কথাই বলেননি কোনোদিন। ঋতুপর্ণ পেশাদার শিল্পীর কাজ করেছিলেন। লেখককে ডেকে তাঁর সময় নষ্ট করাননি। সিনেমা বড় মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু তাঁর গল্প সিনেমা হলে যে লেখকের মোক্ষ লাভ হবে তা নয়। লেখক ধন্য হবেন না। বড় চিত্র পরিচালক তা ভাবেন কি না জানি না।
বারোমাস, অনীক ইত্যাদি পত্রিকায় লেখা প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলতে হয়। আমাকে রুশতী সেন একদিন ফোনে কথা প্রসঙ্গে বললেন, আপনি কি জানেন, আপনার একজন গভীর নিমগ্ন পাঠক আছেন? কে তিনি? অশোক মিত্র। অশোক মিত্র বারোমাস কেন যে পত্রিকায় আপনার লেখা বের হয়, খুঁজে পেতে পড়েন। আমি বিহ্বল হলাম। আমি ভদ্রলোক নই কমিউনিস্ট, এই অমোঘ বাক্য উচ্চারণ করে যিনি আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, যিনি সঞ্চয়িতা চিট ফান্ড বন্ধ করে অগণিত মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি। সঞ্চয়িতা প্রসঙ্গে বলি। এই চিট ফান্ড গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকে এসে বিপুল সুদের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় আত্মসাৎ করে। আমার বাবার হাজার তিরিশ কিংবা চল্লিশ গিয়েছিল। কত গিয়েছিল, আমরা সঠিক জানতাম না। বাবার পেনশন, সামান্য সঞ্চয়ে আমরা কোনো দিন চোখ মেলে তাকাইনি। তিনি বেলুড়মঠ, এবং অন্য কিসে তা খরচ করতেন। কাজের লোক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের দিতেন। দাদা বলে দিয়েছিল, উনি যাতে ভালো থাকেন, উনি তা করুন। দাদা আমার মা বাবাকে খুব যত্ন করতেন। তাঁরা ইচ্ছে মতো সল্ট লেকে দাদার বাড়ি কিংবা বেলগাছিয়ার ফ্ল্যাটে এসে থাকতেন। ডাক দিতেন, বাবুজি নিয়ে যা। সেই যে বাড়ি করেছিলেন দণ্ডীরহাটে, তা তাঁর মন থেকে যেন মুছেই গিয়েছিল। একটা জীবন মানুষের, কত আলো কত ছায়া দিয়ে তা পূর্ণ হয়, কে বলতে পারে। সঞ্চয়িতার জাল ছিল অদ্ভুত। বাড়ির পাশের ব্যাঙ্কের কর্মচারী ছিলেন এজেন্ট। তিনিই ব্যাঙ্কে সঞ্চিত টাকা সঞ্চয়িতায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন। ছুটির পর সন্ধেয় আমাদের ফ্ল্যাটে এসে গুজগুজ করতেন বাবার সঙ্গে। আমরা ভাবতাম বাবার কথামৃত পাঠ শুনতেই তাঁর আসা। সে আমলে তিরিশ হাজার টাকা কম ছিল না। সে যাই হোক, বাবা প্রতারিত হয়েছিলেন। সেই কর্মচারী বদলি হয়ে গিয়েছিল। সঞ্চয়িতার মালিক শম্ভু সেন আত্মহত্যা করেছিলেন, না তাঁকে মেরে দেওয়া হয়েছিল অনেক বড় বড় মানুষকে বাঁচাতে তা জানি না। এই বিষয় নিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, সওদাগর। যে কথা বলছিলাম, অশোক মিত্র আমার লেখা খুঁজে পেতে পড়েন, শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম লেখা হচ্ছে। এরপর তাঁর কাছে গিয়েছিলাম আলিপুর রোডে সোনালি অ্যাপার্টমেন্টে। তাঁর সৌজন্য, ভদ্রতা ছিল জনে জনে বলার মতো। সামান্য অতিথিকেও তিনি বিদায়ের সময় লিফট অবধি পৌঁছে দিতেন। আলাপের পর গল্প পড়লেই ফোন করতেন। আমার অকাদেমি পাওয়ার সংবাদে ফোন করে বলেছিলেন, বাড়ির সকলকে নিয়ে যাবেন। আমার স্ত্রী মিতালিকে বলেছিলেন, যাবেন সঙ্গে। জীবনের সেরা মুহূর্তটির সাক্ষী থাকবেন। সকলে গিয়েছিল আমার সঙ্গে।
সেবার বেশ কয়েকদিন বঙ্গভবনে থেকে দিল্লি শহর, পুরাতন দিল্লি, ফতেপুর সিক্রি, তাজমহল, লালকেল্লা, আগ্রার কেল্লা, গুরগাঁও ইত্যাদি ঘুরে দেখেছিলাম। ফতেপুর সিক্রিই দেখতে হয় বারবার। ভারত ইতিহাসের সোনার চিহ্ন। এ জীবন অনেক ঘটনায় সমৃদ্ধ। দিল্লিতে অনেকবার গিয়েছি। অনেক ভারতীয় লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দিল্লি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন ন্যাশানাল বুক ট্রাস্টের অরুণ চক্রবর্তী। আগে দিল্লি এসেছি একা। তেমন ঘুরিনি। ঘোরা হয়নি।
২০০১ সালে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র অশ্বচরিত মঞ্চস্থ করে। কিশোর সেনগুপ্ত এক নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মী। তিনি নিজে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। কিন্তু কখনো বলেননি নাটক কিশোর সেনগুপ্ত। সব বিজ্ঞাপনে লিখতেন উপন্যাস: অমর মিত্র। নির্দেশনা কিশোর সেনগুপ্ত। এরপরে দেখি নাট্যরূপ দিয়ে নাট্যরূপদাতা নাটককার হয়ে যাচ্ছেন। তা অবশ্য অনেক পরের ঘটনা। বাংলা রঙ্গমঞ্চে আমার গল্প এবং উপন্যাস মঞ্চস্থ হয়েছে বেশ কয়েকটি। আমি আরম্ভ করেছিলাম আন্তন চেখবের গল্প নাটকে রূপান্তরিত করে মঞ্চে আনতে। তখন বছর কুড়ি বয়স। তারপর কত বছর কেটে গেল। সায়ক দলের মেঘনাদ ভট্টাচার্য আমার বালিকা মঞ্জরী গল্প নিয়ে পিঙ্কি বুলি নাটক করেছিলেন। নাটক লিখেছিলেন ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী। তাঁকে আমি দেখিনি কখনো। আচমকা প্রয়াত হন। পিঙ্কি বুলি অসামান্য প্রযোজনা ছিল। এমন কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি করেছিলেন নির্দেশক মেঘনাদ ভট্টাচার্য, যা স্মরণীয় হয়ে আছে স্মৃতিতে। দুটি বালিকা কী অভিনয় না করেছিল। বিশেষত গ্রাম থেকে পরিচারিকার কাজ করতে আসা মেয়ে বুলির চরিত্রাভিনেত্রী। নগরের মেয়ে পিঙ্কির ভূমিকাভিনেত্রীও কম নয়। যে দৃশ্যে বিরতি হয়, সেই দৃশ্য বাংলা নাটকে খুব বেশি নির্মাণ হয়নি। এরপরে দামিনী হে। আমার আকাল গল্পের সঙ্গে যে মোটা দাগের এক কাহিনি জোড়া হয়েছিল, তা নিয়ে আপত্তি ছিল আমার। এই নাটক নিয়ে আমার সঙ্গে মতান্তর হয়েছিল সায়ক, নাট্যরূপদাতার। নাট্য সমালোচক অতি প্রাজ্ঞ। নাট্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় লিখলেন গল্প কিছুই না, যা কিছু কৃতিত্ব সব অমুকের(নাট্যকারের)। এমন তাঁর ভাষা, পড়ে নিজেকে অপমানিত মনে হতে লাগল। তিনি লিখলেন আসল কারিগর নাটককার। তিনিই সব। অর্থাৎ তিনি সৃজন করেছেন এই নাটক। হ্যাঁ গল্প তিনি পড়েননি যে তা দু সপ্তাহ বাদে ওই পত্রিকায় চিঠি লিখে তিনি নিজেই জানালেন, অমর মিত্রর গল্পটি উচ্চমানের। এটি একটি বিরল ঘটনা। যিনি নিন্দা করলেন, তাঁর প্রশংসা নেমে এল সেই পত্রিকাতেই। মনে পড়ে যায় তারাশঙ্করের হাঁসুলিবাঁকের উপকথা উপন্যাসের দুই রিভিউ একই পত্রিকায়। প্রথমটিতে উচ্চ প্রশংসা, দ্বিতীয়টিতে ঢেলে নিন্দা। সমালোচক একই ব্যক্তি। আকাল গল্পের মঞ্চায়নের পর এই সব ঘটলে আমি মেঘনাদকে জানিয়েছিলাম নাটক বন্ধ করুন। অহেতু অপমানিত হবো কেন পণ্ডিত নাটক সমালোচকের কাছে। নাটকের সংলাপে আমার অন্য গল্পও ছিল। পুরুলিয়ার পটভূমি নাটকে, সংলাপে এমন বিষয় ব্যবহার করা হয়েছিল যা দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাদা অঞ্চলের। সমালোচকের চিঠিতে মিটল কী সমস্যা? কয়েক বছর বাদে সমালোচকের সমালোচনা নিয়ে এক নাট্য পত্রিকার সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে আমাকে অবান্তর নিন্দা করে সেই সমালোচনাটি ছিল। চিঠি ছিল না। অসততা নয়? সেই পত্রিকার সম্পাদক সব জানতেন, কিন্তু সমালোচককে উচ্চে তুলতে চিঠি বাদ দিলেন। জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন, খেয়াল করেননি। নাটকের সমালোচকই প্রধান। লেখকের সেখানে মান নেই মনে হয়। নাট্যরূপদাতা অনায়াসে নাটককার হয়ে যান। মেঘনাদ এবং শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তর দৌহিত্রী কথাকলি দেব দামিনী হে নাটকে অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন। আর এক অভিনেত্রীও মঞ্চ জুড়ে ছিলেন। দামিনী হে নাটকের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি বাংলা নাটকে সমালোচক, তা যদি তিনি বড় পত্রিকায় লেখেন, তাঁর সমাদরই আলাদা। নাট্যরূপদাতাকে নাট্যকার করে তুলতে লেখকের বলিদান। তাঁরা সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠেই থেমেছেন। পরে আর পড়েননি। এরপর পাসিং শো নাটক করেন মেঘনাদ। আমি গান লিখেছিলাম নাটকের জন্য। জয় সরকার সেই নাটকে আবহ সঙ্গীত করেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন। অপূর্ব। নাটক লিখলেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। ভালো নাট্যরূপ দিয়েছিলেন পাসিং শো গল্পটির। সঙ্গে তিনিও আমার পরামর্শে আমারই অন্য গল্প জুড়েছিলেন। পাসিং শো অনেক শো হয়েছিল। তারপর পুনরুত্থান উপন্যাস মঞ্চস্থ করলেন মেঘনাদ। মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমার ভাবনার মেলবন্ধন হয়। পুনরুত্থান পুলিশ কাস্টোডিতে মৃত্যুর কাহিনি। আমলাতন্ত্র এবং পুলিশের সম্পর্কের কাহিনি। তাদের সম্মিলিত চাপে সাধারণ মানুষ এবং নিচুতলার সৎ পুলিশ অফিসারের জীবন কীভাবে নরক হয়ে ওঠে সেই কাহিনি। উপন্যাস প্রকাশিত হলে অনেক মতামত পেয়েছিলাম। এই নাটকের অভিমুখ বদল হয়ে গিয়েছিল নাট্যরূপে। এটি কয়লা খনির উপন্যাস ছিল না। আসলে ওই সময় আমি দেড় মাসের উপর বিদেশে থাকায় সম্পূর্ণ নাটক শুনিনি যা আগের তিনটিতে শুনেছিলাম। পুনরুত্থান নিয়েও একই ঘটনা। সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় সমালোচক ঔপন্যাসিককে এড়িয়ে নাট্যকার বা নাট্যরূপদাতা নিয়ে লিখলেন। আমার সঙ্গে তিক্ততা হলো। পুনরুত্থান অভিনয় বিশেষ হয়নি। কেন না আমি বহু জায়গায় আপত্তি জানিয়েছিলাম। ওঁরা বিরক্ত হচ্ছিলেন আমার অনুপ্রবেশে। আমার সমালোচনায়। নাটকই সরিয়ে দিলেন। মেঘনাদ ভট্টাচার্য এবং সায়ক দল আমাকে সম্মানিত করেছিলেন শিশিরকুমার দাস সম্মান দিয়ে। আমার গল্প উপন্যাস মঞ্চে নিয়ে গেছেন, আমি সম্মানিত, কিন্তু যেখানে আমার অপছন্দ আমি তা বলব না কেন? আমি কারো কৃপা বা অনুগ্রহ প্রার্থী নই। শিল্প সাহিত্য ছাড়া এই সমাজ আর পৃথিবীতে আমার কোনো জায়গা আছে বলে জানি না। সুতরাং সেখানে সমঝোতা করতে চাই না। যে লেখক লিখতে এসেছেন, তিনি তাঁর ক্ষমতায় লিখবেন। তাঁর গল্প উপন্যাস সিনেমা বা থিয়েটার হবে, সেই উপন্যাস বা গল্পের নিজের জোরে। কেউ অনুগ্রহ করে তা মঞ্চে বা পর্দায় আনেন না। কিন্তু আমাদের দেশে সেই মনোভাবই পোষণ করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। ঘটনা তা নয়। সাহিত্যের যাত্রা সামান্য যাত্রা নয়। লেখক তাঁর স্বাধীন মতে বিশ্বাসী হবেন। নিজের মতো বেড়ে উঠবেন। সকলের মান টুকু রক্ষা করা উচিত।
নাটক নিয়ে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের এক সুখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব আমার 'তালখেজুর' গল্প নাটক করবেন। কলকাতায় এসে ফোন করলেন। টালিগঞ্জে তাঁর একটি ফ্ল্যাট ছিল, সেখানে নাটক পাঠ হলো। ভালো লাগল। বললেন, উত্তরবঙ্গে শীঘ্রই মঞ্চস্থ হবে নাটকটি। কলকাতায় শো হলে খবর দেবেন। কলকাতায় শো হয়েছিল নাট্য একাডেমির নাট্য মেলায়। রবীন্দ্রসদন মঞ্চে। আমি আমার প্রিয়জনকে নিয়ে দেখতে গেছি অতি উৎসাহে। বাইরে পোস্টার, নাটক অমুক মুখোপাধ্যায়। হলে ঢুকলাম। নাটক আরম্ভের আগে সকল কলাকুশলী ও নাট্যকারের নাম বলা হলো। আমার নাম উচ্চারিতই হলো না। চলে এসেছিলাম বিমর্ষতা নিয়ে। কেন কিছু বলতে পারিনি তা আজও বুঝতে পারি না। বুঝতে এও পারি না, তিনি কি মনে করেছিলেন, আমার গল্প নিয়ে থিয়েটার করে আমাকে অনুগ্রহ করেছিলেন। আমি কৃতার্থ? অনেক বছর বাদে এক নাট্যদলের আমন্ত্রণে নাটক নিয়ে কিছু বলতে গিয়েছি বাংলা একাডেমি সভাগৃহে। তিনি শ্রোতা। কথা প্রসঙ্গে বললেন, তালখেজুর গল্প নিয়ে সেই নাটকের ৩০টি শো হয়েছিল। আমি আর কী বলব? বলতে চাইলাম, আমার নাম উচ্চারণ করেননি কেন? পারলাম না বলতে। আমি বলতে চাই নাট্যরূপদাতা কেন নাটককার হিসেবে আখ্যাত হবেন সমালোচকের বদান্যে। লেখক থাকবেন অনুচ্চারিত। তবে সায়ক, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র বা মালদহের নাট্যসেনা, এঁরা লেখকের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন। ধ্রুবপুত্র উপন্যাস দুই নাট্যদল, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র ও মালদহ নাট্যসেনা দুই নাট্যরূপ নিয়ে অভিনয় করেছেন। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান পথ নাটক করেছেন বেহালার আয়না নাট্যদল। সেই নাটক দেখা হয়নি করোনাকালের জন্য। আমি নিজে একটি নাটক লিখেছি। ‘শেষ পাহাড় অশ্রু নদী’। এই নাটক করিমপুরের একটি দল অশ্রু নদী নামে অভিনয় করেছেন কিশোর সেনগুপ্তর নির্দেশনায়। অপূর্ব প্রযোজনা ছিল মফস্বলের সেই নাট্যদলের। আর একটি প্রযোজনা ছিল বাঙ্গালুরুর স্মরণিক নাট্যদলের। তাঁদের প্রযোজনাও ছিল তারুণ্যের দীপ্তিতে আলোকিত। কোভিড-১৯ আক্রান্ত সময়ে নাটক এবং নাট্যদলই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। থিয়েটার যৌথ শিল্প। করোনা ভাইরাস সকলকে নিরাপদ দূরত্বে আলাদা করে দিয়েছে। সেই ভাবে কি থিয়েটার হয়?
পেন্সিলে নয়, পাথরে খোদাই করা এই অকপট জীবন আলাপ।
পড়ছি নিয়মিত
বহুদিন বাদে ভিখারি পাসোয়ানের কথা মনে পড়ল। কিন্তু দীপুদা অর্থাৎ দীপঙ্কর চক্রবর্তী কোনোদিনই শাসক বামকে পছন্দ করেননি। রতন খাসনবিশ পরে পছন্দ করেছেন। প্রশান্তদা এখনো করেন না। সুতরাং ঐ সময়ে উপন্যাসটির অন্তর্ধানের পেছনে ঠিক কী বুঝতে পারছি না। খুবই আশ্চর্য লাগছে।
লেখক হবার পেছনের এ-ই আলো আঁধারির খেলা আমি খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি। ডুবে যাচ্ছি।
প্রতিভা সরকারঃঃ আমিও এই ব্যাপারে বিস্মিত। বই পাওয়া যেত না বেশ কয়েক বছর। তারপর ১২ কিংবা ১৩ সাল থেকে আবার দেখতে পাই। ২০০৮ / ০৯ থেকেই বই পাওয়া যেত না । প্রয়াত দীপুদা, রতনদা, প্রশান্তবাবু আমার শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব। আমি এই রহস্যের কিনারা করতে পারিনি।
প্রত্যেকটা পর্বই মন দিয়ে পড়ি। এই সিরিজটা আমার কাছে খানিকটা আই ওপনারের মত। আমি সামান্য যেটুকু যা লিখি টিখি কোনোদিন,কাউকে পড়তে অনুরোধ করি নি, কোনদিন নিজের লেখা অন্য কাউকেই ট্যাগ করে দিই নি কোনোদিন কোনো অতি বিখ্যাত, মোটামুটি বিখ্যাত কারো কাছে নিজের বই দিয়ে আসি নি 'পড়ে জানাবেন' বলে।
এইজন্য... এইজন্য আমার কাছে এই লেখা অমূল্য।
মনে মনে ভেবেছি আমি পারি না এই কাজগুলো করতে সেটা আমারই সমস্যা। এই কাজগুলো করাই উচিৎ, পারাই উচিৎ।
এই সিরিজ আমাকে স্বস্তি দিল যে নাহ নেটওয়ার্কিং না পারা এমন কিছু দোষের নয়।
অমূল্য এই সিরিজ।
পেন্সিলে লেখা পড়লাম. দণ্ডিরহাটের কিশোরের ইতিবৃত্য , গ্রাম্য পরিবেশ ও সাথে সাথে অনুচ্চারিত কিছুঅংশ ,প্রকৃতির রূপ, প্রত্যন্ত মানুষের সচক্ষে দেখা ও জীবনযাত্রা সাহিত্যজীবনের যৌবনের খোরাক যেটা পরে শহরে বিস্ফোরিত হয়ে লেখকের ভারতব্যাপী কাজের পরিধি বাড়ায়।
এটা কি সেই লেখকের ফিরে দেখা.
গুরুচন্ডালি থেকে প্রকাশিত হওয়ার পরে নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান ও অন্যান্য কাহিনি পড়েছি, সেই সঙ্গে রুশতী সেনের ভূমিকাটি।
ব্যক্তিগতভাবে লেখাটি আমাকে খুব টেনেছিল- চলন, বিন্যাস আর প্রখর বাস্তবের পাশাপাশি এক অলীক ভুবনের নিম গাছ, নিম ফুলের বাস এইসব... লেখায় দুই ভুবন মিলে মিশে যাচ্ছে কেমন-
সেই নিয়ে কোনোদিন কিছু জিগ্যেস করব । আজ অন্য কথা।
একটি প্রশ্ন করেছিলাম আগেও, লেখক উত্তর দিয়েছিলেন।
আজ মোটামুটি একই ধারায় কিছু কথা-
দেখুন আমাদের মত সাধারণ মানুষ প্রায় প্রতিনিয়ত প্রাপ্য সম্মান পাই না, বঞ্চিত হই, অপমানিত হই কর্মক্ষেত্রে, যাতায়াতের পথে, তথাকথিত বন্ধুমহলে, সংসারে-
একজন শিল্পী / লেখক একজন মানুষ যখন, তাঁকেও তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে এই সব বাহ্যিক অপ্রাপ্তি, অপমান সইতে তো হয়ই। সেই সব আসছে এই লেখায়, এই জীবনচরিতে। বুঝতে পারছি।
আসলে, আমার ইচ্ছা করে লেখকের আভ্যন্তরীণ সংকট, দ্বন্দ্ব , দ্বিধা, সংশয়ের পরিচয় পেতে,দেখতে- যদি লেখক ইচ্ছে করেন।
লেখকের যে ভয় থাকে, যে আশঙ্কা থাকে- লেখার স্রোত শুকিয়ে যাচ্ছে না তো, একই কথা লিখছি না কী বিভিন্ন মোড়কে, আদৌ নতুন কিছু দিতে পারছি কী, আমার লেখা কি ফুরিয়ে আসছে, স্থবির হয়ে যাচ্ছে, কেমন হবে আমার এই নতুন লেখার বিন্যাস চলন, আঙ্গিক কী হবে, গল্প থেকে কী ভাবে উপন্যাসের দিকে যাব আমি, কী ভাবে শব্দ খুঁজব- এই সব নানা সংকট ও শঙ্কা যা এক একজন লেখকের জীবনে এক এক রকম , আবার একই লেখকজীবনের বিভিন্ন সময় সে সব বিভিন্ন রূপে দেখা যায়- এই সব সংকট, তার মোকাবিলা বা সমর্পণ- এই সব জটিলতা দেখতে চাইছিলাম আর কী-
ইন্দ্রাণীঃঃ আপনি যা চাইছেন তা আত্মকথায়, স্মৃতি কথায় লেখার জায়গা নেই। সেসব হয় সাক্ষাৎকারে। আত্মকথা মূলতই অতীত কথা। যা ঘটেছিল তা। সাক্ষাতকারে যিনি প্রশ্নকর্তা তিনিই এসব জিজ্ঞেস করে লেখককে বিপন্ন করতে পারেন।
অশেষ ধন্যবাদ।
এই রকম একটি সাক্ষাৎকারের অপেক্ষায় থাকব।
নমস্কার নেবেন।
বইটি মাঝে না পাওয়া যাওয়া নিয়ে কোন রহস্য নেই । তখন বইয়ের ফর্মা ছাপা হয়ে বাঁধাইখানায় থাকতো। প্রকাশকের চাহিদাাামত তার থেকে কিছু কিছু বই বাঁধাই হয়ে প্রকাশকের কাছে যেত। বাকি ফর্মা বাধাইখানাাা থেকে যেত।
কলেজ স্ট্রিটে জল জমা, ঘরে জল ঢুকে যাওয়া নতুন নয়। সেরকম একটি ঘটনার পর বাঁঁধাইখানার মালিক পিবিএস কে জানিয়েছিলেন যে অনেক বইয়ের ফর্মা নষ্ট হয়ে গেছে-- তার মধ্যেে নিরুদ্দেশের উপাখ্যাান ও ছিল। তার অনেক পরে তারা কিছু ফর্মা খুজে পায়। তার মধ্যে এই বইটিও ছিল। ফলে আবার কিছু বই বাজারে আসে। এর মধ্যে রহস্যের কিছু নেই ।
বইটিকে চাপা দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য পিবিএসের কারোর কোনদিন মাথায় এসেছে বলে জানিনা। অমল মিত্্রের মত একজন সুুলেখকেের কাছে তাদের প্রতি এই অমূলক অশ্রদ্ধাসূচক উক্তিতে আহত হলাম।
সুমিতা দাসঃ আচমকা অদৃশ্য হয়ে বইটি বছর চার পাঁচ বাদে বাজারে আসে। পাওয়া যেত না নিজে পিবিএস এ কিনতে পাঠিয়েও পাইনি। নিজে গিয়েও পাইনি। বইয়ের ফর্মা নষ্ট হতে পারে জল উঠে বই একটিও পাওয়া যাচ্ছে না। এক কপিও না ? তখন এমন মনে হয়েছিল। আচ্ছা, একজন লেখকের একটি বই চার বছর নেই , লেখক নিজেও পাচ্ছেন না খুঁজে। তখন প্রকাশক তো ব্যবস্থা নেবেন। বই আবার ছাপবেন না হলে লেখককে বলে দেবেন বইটি অন্য জায়গা থেকে প্রকাশ করতে। আমার ঐ বইটি হেলাফেলার ছিল না বলেই মনে করি। বই নিয়ে প্রকাশকের আগ্রহের অভাব থেকেই নানা কথার জন্ম হয়েছে। যাই হোক অনীকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহু দিনের , লেখক জীবনের আরম্ভ থেকে। আমি আমার ক্ষোভ জানিয়েছি তার সঙ্গে কৃতজ্ঞতাও। বই প্রকাশের সময় আমি পরিমার্জন করব লেখার এই অংশ।