সন্ধ্যা আক্রান্ত শহরের ফুটপাথ। শিয়ালদহ্ স্টেশনের অদূরেই কয়েকটি পরিবার ফুটপাথে সাজিয়েছে নিজস্ব সংসার। কেউ খুদে বাচ্চাকে পড়াচ্ছে, কেউ গল্পগুজবে তো কেউ রান্নায়।
ফুটপাথে পড়াশোনা
ঘরে ফেরার তাড়া শহুরে যানবাহনগুলোর। সিগনাল বিহীন হলেই প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকলে টেল পাইপ ছড়াচ্ছে প্রবল ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার ভেতর গনগণে এক মাটির উনুনে রাত-খাবারের বন্দোবস্ত করে নিচ্ছেন মোহরজান বিবি (৪৫)। আলু-বড়ি-মাছের ঝোল ফুটছে টগবগ। সেই শব্দ ঢেকে যাচ্ছে যানবাহনের চিৎকারে। বছর তিরিশেক আগে এ শহরে আসা শুরু হয় তাঁর। মা করতেন চালের কারবার। মায়ের সঙ্গেই এই ফুটপাথে থাকা শুরু। খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলের জন্মের পর স্বামী মারা যায়। তখন থেকে গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে আসেপাশের বাড়িগুলোতে কাজ করছেন। এই ফুটপাথের সবথেকে পুরনো বাসিন্দা। লক্ষ্ণীকান্তপুর লাইনে তাঁর গ্রাম। ভোটার কার্ড সেই ঠিকানায়। তাঁকে জিজ্ঞেস করা গেল,
ভোট দেন?
“হ্যাঁ।”
ভোট দিয়ে আপনার জীবনে কিছু পরিবর্তন হল?
“কই? ফুটপাথে ছিলাম, সেই ফুটপাথেই আছি।”
বিজেপি এলে পরিবর্তন হবে?
“জ্যোতিবাবুর আমল থেকে মমতাদিদির আমল সব দেখলাম। আমাদের আর কী পরিবর্তন হবে? বিজেপি এলে শুনছি সবাইকে তাড়াবে। দেখা যাক?”
ভয় করে?
“ভয় করে কী হবে? একদিন তো মরতেই হবে।”
তাঁর বছর কুড়ির ছেলে স্নান সেরে প্যান্ট গুটিয়ে পরে মাকে দেখাতে এসেছে ঠিক আছে কিনা। মা তদারক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চুল আঁচড়ে নিতে বললেন। ছেলে যাবে কাছের মসজিদে নমাজ পড়তে। রোজা রাখাও শুরু হয়ে গেছে। এই ফুটপাথেই ভোরবেলা হবে ‘সেহরি’। আলোচনা গড়িয়ে গেল নানা দিকে।
মোহরজান বিবি
এই ফুটপাথেই থাকেন সেরিনা বিবি পুরকাইত (৩৩)। লক্ষ্ণীকান্তপুর লাইনে গ্রাম। বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাচাকাচির কাজ করেন আশেপাশের তিনটে বাড়িতে। তিন সন্তানের জননী। বাচ্চারা কর্পোরেশনের স্কুলে পড়ে। স্বামী ভ্যান চালান। কথা শুরু হয় তাঁর সঙ্গে।
লকডাউনে কী করেছেন?
“লকডাউনের সময় বাড়ি চলে গেছিলাম। বসেই ছিলাম বাড়িতে। কিন্তু খাবার জোটাতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। গ্রামের কিছু লোকের দানে চলছিল। এভাবে কী চলে? তাই শহরে চলে এলাম।”
এসেই কাজ পেলেন?
“না না, করোনার জন্য কেউ নিতে চাইছিল না। কিছুদিন বসে থাকার পর কাজে নিল। এখন কাজ করছি।”
গ্রামে কাজ আছে?
“না। শুধু চাষের সময় কদিন কাজ থাকে। সব সময় তো চাষ হয় না।”
ভোট দিয়ে আপনাদের কোনও সুবিধা হয়?
“কী সুবিধা হবে? এই ফুটপাথে জিনিসপত্র আছে। সেসব তুলে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে বলছে!”
কেন বলছে?
“উপরে সব ভদ্দরলোকেরা থাকে। আমরা গরীব…”, (চুপ করে যান তিনি।)
বিজেপি ক্ষমতায় এলে আরও ভাল হবে?
“কী করে বলবো কে খারাপ করবে, কে ভাল করবে? কী করে বলবো আমরা?... ধর্ম নিয়ে তো বেশি যুদ্ধ বাঁধাচ্ছে। মসজিদ ভাঙছে, এটা ভাঙছে, ওটা ভাঙছে… একদমই উচিত না। যেমন মানুষ আছে, খেটেখুটে খাচ্ছে তেমনই তো ভাল।”
যেসব বাড়িতে কাজ করেন ধর্ম নিয়ে কোনও সমস্যা হয়েছে?
“আমি বাঙালি হিন্দু বাড়িতে কাজ করি। ধর্ম নিয়ে সমস্যা হয়নি।”
এনআরসি হলে নাকি ঠিকমতো কাগজপত্র না দেখাতে পারলে মুসলিমদের তাড়িয়ে দেবে। ভয় লাগে না?
“ভয় তো লাগে… আমরা তো অত পড়াশোনা জানি না। সব বুঝতে পারি না। কিন্তু চারটে কাগজ আছে, একটা নেই বলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে? এটা ভুল করছে ওরা।”
ভোট দেন কী আশা করে?
“আমাদের কোনও আশা নেই। এটুকু জানি যে, যে-ই উঠুক যে-ই জিতুক খেটে খেতে হবে আমাদের।”
সেরিনা বিবি পুরকাইত
দীপা দাস (৪০) থাকতেন কাঁকুড়গাছির এক বস্তিতে। এখন শপিং মল হয়ে গেছে সেখানে। ফলে দীপার মতো অনেকেরই ঠাঁই হয়নি এই শহরে। যে সামান্য ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেছে তা দিয়ে সোদপুরে ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু কাজগুলো শহরে। রোজ অনেকটা পথ যাতায়াত। নিজের মাকে দেখতে হয়। দুই মেয়ে, বর, নাতিনাতনি নিয়ে সংসার। তাঁকে পাকড়াও করা গেল।
লকডাউনে কী করলেন?
“বাড়িতেই খুব অসুবিধায় ছিলাম। কিছুই সাহায্য পাইনি। আশেপাশের জমিতে শাকপাতা তুলে সংসার চালিয়েছি। তবে যেসব বাড়িতে কাজ করতাম তারা কেউ কেউ টাকা পাঠিয়েছে। তাই দিয়ে সংসার চালিয়েছি।”
লকডাউনের আগে যেসব বাড়িতে কাজ করতেন এখনও সেগুলো আছে?
“একই আছে। তবে কিছু কাজ চলে গেছে। টাকা কমে গেছে।”
কোনও বাড়িতে অসম্মানের শিকার হয়েছেন?
“একটা বাড়িতে হয়েছি। অসম্মানের জন্য সেই কাজ ছেড়েও দিয়েছি।”
ব্যবস্থা নিয়েছেন?
“না। চেষ্টা করিনি। কারণ, তাঁদেরকে খুব ভালবাসি, অনেক বছরের চেনা পরিচিত। থাক…”
ভোট নিয়ে কী ভাবেন?
“কিছু ভাবার নেই। যে-ই আসুক আমাদের যেন একটু উন্নতি হয়।”
এতদিন ভোট দিচ্ছেন কোনও উন্নতি হয়েছে?
“না, আমার কোনও সাহায্য হয়নি, লাভও হয়নি। গত সাত বছর ধরে ভোট দিচ্ছিও না, দেওয়ার ইচ্ছেও নেই।”
কেন?
“সোদপুরে যাওয়ার পর কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই ভোটার লিস্টে নাম উঠছে না।”
পার্টির লোকদের বলেননি?
“হ্যাঁ। প্রতি বার বলি। প্রতি বার কাগজ জমা দিই। এবারও দিয়েছি। হলে হবে, না হলে না হবে। ছেড়েই দিয়েছি।”
এবারের ভোটে বিজেপি-র খুব দাপট দেখা যাচ্ছে। কী মনে হচ্ছে?
“জানি না… যে থাকার সে-ই থাকবে।”
বিজেপি ধর্মে ধর্মে ভেদ করছে…
“এসব করে তো কিছুই হবে না। সবাই বাঁচতে চাই। হিন্দু-মুসলিম কি আছে, সবাই তো খেটে খাবে। বিজেপি আসলে এনআরসিসি না কী একটা করবে… সেসব করলেও ক্ষতি হবে কত মানুষের!”
কী চাইছেন?
“আমি মনে করছি দাঙ্গা যেন না হয়, সব মানুষ যেন শান্তি মতো থাকে। আর আমরা যারা লোকের বাড়ি কাজ করি সেই মেয়েদের যেন উপকার হয়, যে-ই ক্ষমতায় আসুক।”
দীপা দাস
অঞ্জনা দাসও (৪৬) থাকতেন ওই একই বস্তিতে। তাঁকেও চলে যেতে হয়েছে শহরের আরেক দূরের বস্তিতে। নবদ্বীপের বাড়িতে থাকে ছেলে-বউ-নাতি-নাতনি। এখানে বরের সঙ্গে থাকেন। লকডাউনে দুজনেরই কাজ ছিল না।
লকডাউনের মধ্যে কী করলেন?
“ঘরে বসেই ছিলাম। চাল, সয়াবিন, তেল- এসব দু’জায়গা থেকে পেয়েছিলাম। স্থানীয় ক্লাবও দিয়েছিল। আমাদের রেশনের বড় কার্ড। ছোট কার্ড হয়নি। সেজন্য রেশন থেকে কিছুই পাইনি। আমরা বস্তির লোকরা সল্টলেকের ওদিকে যেতাম, শাক তুলতে। ওই শাক রান্না করে খেতাম। কী করবো, বাজার করার টাকা ছিল না।”
লকডাউনের আগে যা আয় হত এখনও তা হয়?
“না। আগে আট-দশ হাজার টাকা হত। এখন অনেক কমে গেছে। আগের সব কাজগুলো নেই। কোনরকমে চালাচ্ছি।”
ভোট দিয়ে আপনার কোনও লাভ হয়?
“আমার কোনও সাহায্যও হয় না, উপকারও হয় না। সত্যি কথা। এই জন্যই রাগ করে বলি, ভোট দেব না, চুপচাপ বসে থাকবো। হা হা হা…”
বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী আপনার আয় বাড়বে?
“না না, যে-ই ক্ষমতায় আসুক ওরা নিজেদের ইনকাম…… আমরা যেরকম সেরকমই থাকবো।”
আপনার আশেপাশে কোন পার্টির বেশি রমরমা দেখছেন?
“আমার বস্তিতে দেখছি সব বিজেপি হয়ে গেছে। একটা বাড়ির দেয়ালে দেখি কি সব পার্টির চিহ্ন! তো তার সাথে বস্তির সবাই মজা করছে, ‘তুমি তো খুব চালাক! যেদিকে জল গড়াবে সেদিকে সুযোগ মত ঝুকবা মনে হচ্ছে?’ হা হা…”
অঞ্জনা দাস
দীপা ধর (৩৫) থাকেন বেহালা শীলপাড়ার এক বস্তিতে। কাজ করেন বেহালাতেই। তবে অনেকটা হেঁটে আসতে হয়। এবারই প্রথম তাঁর ও তাঁর ছেলের ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে। দুজনেই একসঙ্গে ভোট দিতে যাবেন। তাঁর স্বামী বছর এগারো হল তাঁকে ছেড়ে গেছেন। দায়িত্বও নেননি, যোগাযোগও রাখেন না। তাঁর বিয়ে রেজিস্ট্রিও হয়নি, বিচ্ছেদের কাগজও নেই। ফলে ভোটার কার্ড হয়নি এতদিন।
লকডাউনে কাজ ছিল?
“কাজ করতে হয়নি। কিন্তু যেসব বাড়িতে কাজ করতাম সবাই মাইনে দিয়েছে। কিছু বাড়ি পুরো টাকা দিয়েছে। কিছু বাড়ি হাফ মাইনে দিয়েছে। কিন্তু কেউ কাজ থেকে ছাড়ায়নি।”
ভোট দিয়ে জীবন পাল্টাবে মনে করছেন?
“কী আর হবে! যে-ই ভোটে জিতুক আমাদের কাজ করে খেতে হবে। ভোট না দিয়ে যেরকম রাস্তায় পড়ে ছিলাম, ভোট দিয়েও সেরকমই থাকবো। আমাদের উন্নতি হবে না।”
কে জিতলে ভাল হয়?
“দিদি জিতলেই ভাল হয়।”
এত লোক বিজেপি-তে চলে গেল কেন, কী মনে হচ্ছে?
“গত এক বছরে কেউ গেল না। আজ হুট করে সবাই বিজেপি-তে চলে গেল কেন? নিশ্চয় টাকা পেয়েছে বলেই গেছে। সব সিনেমা আর্টিস্টরাও দেখলাম বিজেপি-তে গেল। টাকার লোভেই গেছে। এগুলো ঠিক না। সব নিজের সুবিধার জন্যই গেছে।”
রাগ হয়?
“হ্যাঁ। কিন্তু কাকে বলবো, কেই বা বুঝবে বলুন? আমরা দিন আনি দিন খাই। যাদের টাকা আছে তারাই বুঝছে না। আমরা তো কাজের লোক!”
দীপা ধর
‘কাজের লোক’ কাজ করে যাবেন। কিন্তু তাঁদের কথা কি একবার ভেবে দেখবেন ভোটপ্রার্থী নেতানেত্রীরা? নোটবন্দী, লকডাউন, করোনা- সবকিছুই যে সবথেকে বেশি ওলোটপালোট করে দিয়েছে তাঁদের জীবন।
"... মরতে তো হবেই"
❤️❤️❤️
এইসব মানুষদের মত অনেক মানুষকে আমিও চিনি। এঁদের মধ্যে যাঁরা ভোট দেন তাঁরা নিজেদের সবচেয়ে কম ক্ষতি যাঁদের দ্বারা হবে মনে করেন তাদেরই ভোট দেন।
ও হ্যাঁ এঁদেরই বিজ্ঞ পন্ডিতরা 'ছাগল' বলে থাকেন।
এইরকম লেখা আরো আসুক। চোখ খুলে দেয়।
মাটির মানুষ দের কথা, কলকাতার নিচে যারা থাকেন, তাদের কথা। আরও লিখুন। খুব ভালো লাগলো।
মৌসুমীর প্রতিবেদন আমার খুব ভালো লাগে।
“না। চেষ্টা করিনি। কারণ, তাঁদেরকে খুব ভালবাসি, অনেক বছরের চেনা পরিচিত। থাক…”
দরিদ্র মানুষের এই মহত্ত্বকে আমরা উচ্চ/মধ্যবিত্তরা প্রতিনিয়ত দুপায়ে দলিয়ে যাই। যিনি অপমানিত হন, তিনি তবু ভালবাসেন। আর আমাদের অপমান করতে বাধে না। একদিন অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
ভোটের খবর নয়, তবু এই প্রসঙ্গে মনে হল এই লিঙ্কটা তুলে রাখি https://indianexpress.com/article/india/kerala/rs-2-lakhs-donated-only-rs-850-left-in-account-kerala-beedi-worker-is-epitome-of-benevolence-7289780/
খবর জানা দরকার ঠিক এইভাবে ভোটবাজিতে সাধারণ মানুষের কী উপকার হচ্ছে । কিন্তু, কথা হলো কাজ করে প্রত্যেকেই খাবে ।এর কোনো বিকল্প নেই ।তবে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন তো নির্বাচিত সরকার কে নিতে হবে । সর্বোপরি শিক্ষিত সচেতন মানুষের বিশাল বড় একটা অংশ আলোচনা সমালোচনা সব করে কিন্তু নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করতে এগিয়ে আসছে না। কাজেই অশিক্ষিত ক্রিমিনাল কেসের আসামি দের হাতে দেশটা তুলে দিলে একবার কংগ্রেস একবার বাম তৃণমূল গেরুয়াা যেই আসুুু দেশটার সাধারণ মানুষের অবস্থা বদলাবে না ।
নাইস
সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে এই সত্যানুসন্ধান এবং সহজ সরল ভাবে ওদের ভাষায় সেই সত্যের প্রকাশ এই লেখাটিকে বাস্তবানুগ ও মর্মস্পর্শী করেছে।
ভোট নামক লোক দেখানো প্রহসনের মুখোশ খুলে গেছে।
এটা কি ধরনের লেখা। এতো anti bjp প্রোপাগান্ডা ছড়ানো।