‘সব কুঁড়ি কুসুমিত হোক, চাই শুধু সেই আবহাওয়া’
আমাদের দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র অংশের মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সচেতনতায় যাদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেইরকম কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ করা গেল। অঙ্গনওয়াড়ি ও আশাকর্মী (ASHA- Accredited Social Health Activists)। প্রবল প্রতিকুল আবহাওয়ায় দাঁড়িয়েও যারা অক্লান্ত। লক্ষণীয় বিষয় যে এঁদের প্রায় সবাই মহিলা কর্মী। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে বলে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জীবন জ্যোতি বীমা যোজনা ও প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনার আওতায় এই কর্মীরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারবেন বলেও ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু তার কতটুকু এসে পৌঁছেছে কর্মীদের কাছে? কাজের যথাযথ মূল্য কি পেলেন তাঁরা? তাঁদের কাজের সুযোগ সুবিধাই বা কী?
কচিকাঁচাদের অঙ্গনে
নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের অধিনে আইসিডিএস [Integrated Child Development Services (ICDS)] বা অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প। ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া এটাই বিশ্বের সবথেকে বড় কমিউনিটি নির্ভর প্রকল্প। শিশু (০-৫) ও মায়ের (১৫-৪৪) স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা বিষয়ে কাজ করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রি-স্কুল শিক্ষা, পরিপূরক পুষ্টি, ভিটামিন এ, ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন ট্যাবলেট বিলি, সাধারণ রোগের চিকিৎসা ও ইমুনাইজেশনের জন্য রেফার করা, শিশু ও মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে অপ্রথাগত শিক্ষা, হাইজিন প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন এই প্রকল্পের কর্মীরা। একটি কেন্দ্রে একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও তাঁর একজন সহায়িকা থাকার কথা।
রাবিয়া খাতুন (৬১)। ১৯৮১ সালে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। মুর্শিদাবাদ জেলার বাবলাবোনা-ঘাটপাড়া-ফকিরপাড়ায় তাঁর কেন্দ্র। অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার নং ১৪০। কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল অন্যের বাড়িতে ছোট্ট একটা বারান্দায় তিনি বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। তার মধ্যেই টিফিন রেডি, ছাতু মাখা। এক একটা ছাতুর গোল্লা নিয়ে বাচ্চারা মহা আনন্দে খাচ্ছে। খেতে খেতে এই অপরিচিতর দিকে তাকাচ্ছে। চোখে কৌতূহল, মুখে মৃদু হাসি। কেউ বা অতি উৎসাহে ছড়া শুনিয়ে দিচ্ছে। একজন বাচ্চা বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রবল কান্না জুড়েছে। তাকে চুপ করাতে হিমসিম রাবিয়া খাতুন।
রাবিয়ার সহায়িকা জহুরা বেওয়া (৪০) রান্না করছেন এই বাড়ির ভেতর অন্যের রান্নাঘরে। বাচ্চাদের মায়েরা ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে বা বসে। কারও কারও কোলে ছোট্ট বাচ্চা। পুরো চিত্রটা দেখলেই বোঝা যায় গ্রামের একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করে।
কথা শুরু হল রাবিয়া খাতুনের সঙ্গে।
নিজস্ব ঘর নেই?
“জায়গা নাই নিজস্ব। পরের জায়গায় স্কুল করি। সবকিছু বাড়িতে রাখতে হয়। বয়ে বয়ে নিয়ে আসতে হয়। জ্বালানিও বয়ে আনতে হয়। বাচ্চাদের যে সুন্দর করে কিছু দেখাবো, দেয়ালে কিছু চার্ট বা ছবি টাঙাবো সেসব কিছু হয় না। খুব অসুবিধা। কিছু কিছু ইশকুল সব পেয়েছে। কিন্তু আমার মতো কিছু কিছু সেন্টার এখনও ঘর পায়নি। এখানে সরকারি জমি নেই যে নিজস্ব ঘর হবে। কেউ জমি দান করলে ঘর করে দেবে বলছে অফিস থেকে। কিন্তু এখনও কেউ জমি দেয়নি। এভাবেই চলছে। ডোমকল ব্লকে চারশ’র কিছু বেশি অঙ্গনওয়াড়ি স্কুল আছে। তার মধ্যে হাফ মতো নিজস্ব ঘর হয়েছে আর হাফ কেন্দ্র বাঁশতলা, উঠোন, এর ওর বাড়িতে।”
অন্যের বাড়ি স্কুল করতে গিয়ে কী কী সমস্যা হয়?
“দু’দিন চালাতে দেয়, চারদিনের দিন বলে, ‘এত অত্যাচার ছেলেপিলের! জিনিসপত্র ভাঙেচুরে, মায়েরা এসে আখার গোড়ায় বসে থাকে, ঘরে ঢোকে, নানান সমস্যা করে’- এইসব বলে। বাচ্চার মায়েদের বললেও শোনে না। বলে, ‘এখানে ইশকুল দিয়েছে ক্যানে? বসবো।’ ঘরে গিয়ে বিছানায় হয়তো শুয়ে পড়লো। তখন বাড়ির লোক বিরক্ত হয়। মায়েদের কোলের বাচ্চারা ঘর নোংরা করে। তো এইসব সমস্যা থাকে।”
এইসব সমস্যার সমাধান অফিস থেকে করে দেয়?
“না। অফিস থেকে বলে, ‘তোমাদের সমস্যা তোমরাই সমাধান কর।’”
যেসব বাচ্চা স্কুলে আসে তাদের বয়স কত?
“তিন থেকে পাঁচ বছর। একেবারে ছোট বাচ্চারা তো আসতে পারে না। যারা হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে তারা আসে। আর গর্ভবতী, প্রসূতি মায়েরাও সেন্টারে আসে। খাবার নিতে আসে, কিছু জানার থাকলে আসে। আগে আমার সেন্টারে বাচ্চা ছিল একশ কুড়ি জন। পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের বাদ দিয়ে এখন হয়েছে আটানব্বই জন। গর্ভবতী মা আছে দশ জন, প্রসূতি মা আছে ছ’জন।”
সব বাচ্চারা নিজে থেকে স্কুলে আসে?
“না। আমি বাচ্চাদের ডেকে আনি বা আমার সেন্টারের হেল্পার ডেকে আনে। অনেক সময় যে বাচ্চারা স্কুলে আসে তারাও ডেকে আনে। কোনও কোনও বাচ্চা নিজে থেকে সপ্তাহে একদিন বা মাসে কয়েকদিন আসে। বাকি সময় ডাকতে হয়। ডেকেও সবসময় পাওয়া যায় না।”
বাচ্চারা কী কারণে কেন্দ্রে আসতে চায় না?
“বাড়ির কেউ হয়তো কোথাও গেল বাচ্চাও তাঁর সঙ্গে চলে যায়, বাজারে ঘুরতে বা আত্মীয়র বাড়ি। এখন তো ভোটের জন্য বাচ্চাদের বাবারা বাড়ি ফিরেছে। তো বাচ্চারা বাবাদের সঙ্গ ছেড়ে স্কুলে আসতে চায়ছে না (*এইসব বাচ্চার বাবারা পরিযায়ী শ্রমিক। ভিন রাজ্যে কাজ করতে যায়।)। তাছাড়া এখন আমের সময়। বাচ্চারা সব আমতলা-জামতলা ঘুরে বেড়ায়। স্কুলে আসতে চায় না। জিরো থেকে তিন বছরের বাচ্চারা স্কুলে না এলেও খাবার পায়। তাদের সংখ্যা বেশি, পঞ্চাশের ওপর। খাবার নিতে ঠিক আসে। কিন্তু পড়ার জন্য বাচ্চাদের পাওয়া মুশকিল হয়। তিন বছরের ওপর যাদের বয়স তাদের স্কুলে আসার সংখ্যা কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।”
গর্ভবতী, প্রসূতি মা ও বাচ্চাদের কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হয়?
“বাচ্চা যেদিন জন্মায় সেদিন থেকেই বাচ্চার পরিচর্যার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ওজন মাপতে হয়; বিসিজি, জিরো ডোজ পোলিও, জিরো ডোজ হেপাটাইটিস এগুলো দিতে হয়। তারপর মাসে মাসে মনে করিয়ে দিতে হয়। আগে আমরা একাই করতাম। এখন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আশা কর্মীরা এসব করে। ওরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কখন কী করতে হবে বলে আসে। প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার ইমুনাইজেশন হয়। গর্ভবতী, প্রসূতি মায়েরাও হেলথ ক্যাম্পে আসে।”
টিকা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে আগের মতো সমস্যা কী এখনও আছে?
“প্রায় নেই। আগে সবাইকে বোঝাতে হত। কুসংস্কার ছিল যে বাচ্চাদের ক্ষতি হবে এসব খাওয়ালে বা ইনজেকশন নিলে। এখন নিজেরাই জিজ্ঞাসা করতে আসে কবে টিকা, কবে ওষুধের ডোজ। তবে হ্যাঁ, খুব সামান্য ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। তবে সেটা কুসংস্কারের জন্য নয়। কোনও কারণে আসেনি। তখন ডেকে ডেকে আনতে হয়। এই বদলটা হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য কর্মী প্রমুখের মিলিত প্রচেষ্টায়।”
কত বছর ধরে এই চেঞ্জ লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
“মোটামুটি দশ/পনেরো বছর ধরে এটা হয়েছে। প্রথম দিকে যেহেতু আমরা একাই এই কাজগুলো করতাম, গ্রামের এক একজনকে বোঝাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার যোগাড় হত। এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।”
পড়াতে গিয়ে কিছু সমস্যা হয়?
“আমাদের তো নন-ফরম্যাল এডুকেশন। চোখের সামনে যা দেখা যাবে গরু, ছাগল, মাছ, গাছপালা, নদীনালা... যা দেখা যাবে সেটাই পড়ার বিষয়। তো ধরা যাক মুরগি নিয়ে পড়াচ্ছি। মায়েরা বলে, ‘অ কী পড়্হায়? মুরগি সম্বন্ধে আবা কে জানে না? অই পড়্হা হল?’ বোঝে না তো বিষয়টা, এইসব বলে।”
তখন মায়েদের বোঝাতে হয়?
“মুরগি কী খায়, কী রং, কটা পা, কটা চোখ, ডিম পাড়ে না বাচ্চা পাড়ে... এইসবগুলা তো শিখাতে হবে? বলি মায়েদের।”
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হিসেবে কাজ করা আগের থেকে সহজ হয়েছে?
“খাতাপত্রগুলো বেশ জটিল।”
সহজ করার বিষয়ে অফিসে আলোচনা হয় না?
“হ্যাঁ। তবে আর কিছু করা যাবে না হয়তো। যেটুকু সহজ হওয়ার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, জন্মের হার কমানো, মৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদির খতিয়ান আর খাবারের হিসাব রাখা খুব জটিল।”
প্রায় চল্লিশ বছর কাজ করে কিছু সুবিধা হল?
“কোনও সুবিধা নাই। একইভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কাজ করতেই হবে যতই অসুবিধা হোক। খাবারের ক্ষেত্রে সমস্যা। একবার বাজার দর নির্ধারণ করে দেয়। ছ’মাস ধরে ওই মান্ধাতার আমলের দরই চলছে। ভাত, খিচুড়ির হিসাব আরও জটিল হয়েছে। সপ্তাহে তিনদিন ভাত, তিনদিন খিচুড়ি। ভাতের সব্জি, তেল, লবণ, ডিম আলাদা হিসাব। খিচুড়ির চাল, ডাল, তেল, লবণ, হলুদ, আলু, সয়াবিন, ডিম- এগুলোর আলাদা হিসাব। একই খাতায়, একই ফর্মে দুরকম হিসাব করতে হয়। প্রচণ্ড খাটনি, প্রচণ্ড রিস্ক। একটু ভুল হলে, একটু অসাবধান হয়ে গেলে সব ভুল। আবার প্রথম থেকে করতে হয়।”
জিনিসপত্র কি সব নিজেদের কিনতে হয়?
“অফিস থেকে দেয় চাল, ডাল, সয়াবিন, তেল, লবণ, ছাতু, চিনি। বাকি সব নিজেদের কিনতে হয়। সব্জির, আলুর, ডিমের একটা রেট দিয়ে দেয়। সেই রেট ধরে হিসেব করতে হয়।”
আর পরিমাণ কি মাথাপিছু?
“হ্যাঁ। ভাতের দিন মায়ের একশ গ্রাম, শিশুর পঞ্চাশ গ্রাম চাল। আলু মায়ের এক টাকা তেত্রিশ পয়সা, শিশুর আটাশ পয়সা মাথাপিছু। তেল ও নুন মায়ের চার গ্রাম, শিশুর দু গ্রাম। ডিম মা ও শিশুর একটা করে। খিচুড়ির দিন মায়ের চাল একশ গ্রাম, শিশুর পঞ্চাশ গ্রাম। ডাল মায়ের চল্লিশ গ্রাম, শিশুর কুড়ি গ্রাম। সয়াবিন মায়ের পঁচিশ, শিশুর বারো গ্রাম। আলু মায়ের ছাপান্ন পয়সা, শিশুর বিয়াল্লিশ পয়সা। সব্জি মায়ের এক টাকা ছিষট্টি পয়সা, শিশুর এক টাকা তিন পয়সা। মায়ের তেল ও নুন চার গ্রাম করে, শিশুর দু গ্রাম করে। ডিম মায়ের গোটা, শিশুদের হাফ। টিফিন শুধু শিশুদের জন্য... ছাতু একুশ গ্রাম, চিনি তিন গ্রাম।”
এ তো খুবই জটিল ব্যাপার!
“ওরে বাবা! মাথা খারাপ হয়ে যায়। তার ওপর আছে জ্বালানীর হিসাব। সব মিলিয়ে খুব জটিল।”
এই যে অদ্ভুত অদ্ভুত মাথাপিছু হিসাব খাবার দেওয়ার সময় কিভাবে পরিমাপ করা হয়?
“অফিস থেকে আমাদের একটা হাতা দিয়েছে। ওই হাতায় মায়েরা চার হাতা ভাত পেল, শিশু পেল দু হাতা। তবে সব্জি, আলু, সয়াবিন ইত্যাদির ক্ষেত্রে অঙ্ক মিলিয়ে মাপ করা মুশকিল। অনুমানে ভর করেও দিতে হয়। তাও আমরা ঠিকঠাক দেওয়ার চেষ্টা করি।”
কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের পেনশন, স্বাস্থ্য বীমা চালু করার কথা ঘোষণা করেছে।
“কই হল? কোনও খবর নাই। ভোটের আগে ভাঁওতা সব।”
ভোট দেন? কী ভেবে ভোট দেন?
“হ্যাঁ দিই তো। কী আর মনে করবো... দেশে শান্তি আসুক, দেশের উন্নতি হোক, মানুষ সুখে থাকুক, সমাজের উন্নতি হোক, মানুষের উন্নতি হোক, কলকারখানা বাড়ুক, চাকরি বাকরি বাড়ুক... এইসব মনে করেই ভোট দিই। যোগ্য প্রার্থীকে দিতে হয়, যে দেশের কাজ করতে পারবে।”
তো যোগ্য প্রার্থী কি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কিছু সুবিধা করেছে?
“কই করেছে? সব একইরকম আছে। যার যখন আমাদের কথা মনে আসে মুখে নানান ঘোষণা করে। শুনলাম আমাদের সাম্মানিক বাড়ানো হবে। হয়নি। আশা দেয় কিন্তু ভরসা দেয় না আরকি।”
আপনাদের দাবি কী?
“আমাদের দাবি হল স্থায়ীকরণ করবে... আমরা তো অস্থায়ী কর্মী। এখন আমরা সাম্মানিক ভাতা পাচ্ছি। স্থায়ীকরণ করবে, পেনশন দেবে, আমাদের স্বাস্থ্যের কথা ভাববে, বেতন সিস্টেম চালু করবে... ব্যাস।”
রাবিয়ার সহায়িকা জহুরা বেওয়া জানালেন, “সবকিছুই অসুবিধে... পরের বাড়ি রান্না করছি, বাথরুম-পানির কল নিয়ে সমস্যা... যার বাড়ি রান্না হয় তাদেরও অসুবিধে। একটু খ্যাচাব্যাচা হয়।”
কটা বাড়ি পাল্টাতে হয়েছে?
“এই নিয়ে তিন নম্বর। কিছু না কিছু ঝামেলায় বারবার সেন্টার পাল্টাতে হয়। খুব সমস্যা। আগের জায়গাগুলায় আরও ঝামেলা ছিল। এই বাড়িটা তাও ঠিক আছে।”
বাড়িতে কে কে আছেন?
“দুই ছেলে। স্বামী মারা গেছে। নিজের একটা বেড়ার বাড়ি, ছেলেরা করেছে। অতেই থাকি। আমি আর বাড়ি করতে পারবো না। আর কবে করবো?”
ভোট দেন?
“দিই তো।”
কিছু হল?
“কই কী হল! কিছু হওয়ার আশা নাই।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর চব্বিশ পরগণার এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী (৩২) কাজ করছেন বারো বছর। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এলো প্রায় একই চিত্র।
নিজের ঘর আছে?
“আমার সেন্টার সরকারি ঘরে চলে। কিন্তু সবার ঘর নেই।”
স্কুল চালাতে গিয়ে সুবিধা বা অসুবিধা কী হয়?
“সুবি...ধা... বলতে গেলে অসুবিধাই বেশি। ম্যাক্সিমাম মেয়েদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে কোনও ঘর নেই। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটা কোথায় চালাবে সেটার কোনও ব্যবস্থাই নেই। ম্যাক্সিমাম কোনও ক্লাবে, গাছতলায়, উঠোনে স্কুল বসাতে হয়। যদিও ‘অঙ্গনওয়াড়ি’ কথাটার অর্থই উঠোন। কিন্তু তবু নিজস্ব ঘর থাকলে সুবিধা হয়। দ্বিতীয়ত, কোথাও হয়তো কেন্দ্রের ঘর আছে কিন্তু আর কোনও ফেসিলিটি নেই... না বাথরুম, না জলের ব্যবস্থা। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো সমাধান হলেও অন্যান্য অনেকেরই এই সমস্যা থেকে গেছে। তৃতীয়ত, বাচ্চাদের পরিপূরক পুষ্টির জন্য যে উপকরণ আমাদের পাঠানো হয়... চাল, ডাল, তেল, নুন যেগুলো দেয়... সেগুলো উন্নত মানের খাবার নয়। বাচ্চাদের জন্য দেওয়া হচ্ছে ভালো জিনিসপত্র দিলে খুবই ভালো হয়। রান্নার ব্যবস্থা যেহেতু আছে আমাদের অনেক খরচা, সেইজন্য অনেক খাতা-ফর্ম মেনটেন করতে হয়। যেটা সমস্যা হয় যে বাজারের রেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের মূল্য ধরে দেওয়া হয় না। ধরা যাক, বাজারে একটা ডিম ছ’টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের ডিম-প্রতি পাঁচ টাকা রেট দেওয়া হচ্ছে। বা বাজারে পাঁচ টাকা ডিম, আমাদের দিচ্ছে সাড়ে চার টাকা। কর্মীরা কি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনবে? খুবই সমস্যা। অফিসের পরামর্শেই অনেকে তাই ব্যালান্স করে, বাজার দরের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে। এবার কী হয়, অনেক কেন্দ্রে কর্মী আছে হেল্পার নেই। তো হেল্পারের দায়িত্বও খুব বাজেভাবে কর্মীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কর্মী বাচ্চাদের পড়াচ্ছে, রান্না করছে, খাওয়াচ্ছে... সম্ভব? কিছু কিছু কর্মী নিজের টাকায় রান্নার লোক রাখে। বারোখানা খাতা মেনটেন করতে হয়, অফিসে মিটিং থাকলে যেতে হয়... অনেক কাজ। আবার অনেককিছু চেঞ্জ হয়েছে। আগে ‘শিশুবিকাশ কেন্দ্র’ বলা হত, এখন ‘শিশু আলয়’ বলা হচ্ছে। পড়াশোনাও চেঞ্জ হয়েছে... এখন বইখাতা নয়। নিয়ম বহির্ভূত পড়াশোনা... গানের মাধ্যমে, ছড়ার মাধ্যমে, ছবি দেখিয়ে, আঁকার মাধ্যমে পড়াতে হয়। এন্টারটেন করে বাচ্চাকে পড়াতে হবে। প্রেসার দিয়ে বই পড়ানো, শ্লেটে লেখানো চলবে না।”
সাম্মানিক বাড়াবে বলে ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার?
“আমাদের দেড় হাজার টাকা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমাদের কর্মীরা তো দাবি করেছিল প্রাইমারি স্কুল টিচারদের মতো প্রপার বেতন। নেটে দেখলাম দিল্লিতে মেয়েরা ধর্না দিয়েছে এই দাবি নিয়ে। কিন্তু সেটা হয়নি। যা বাড়িয়েছে খুবই তুচ্ছ একটা... আমাদের রাজ্যের কর্মীরা পাচ্ছে। এটা কিন্তু সব রাজ্যের মেয়েরা পায়নি এখনও পর্যন্ত। তা নিয়ে অসন্তোষ চলছে, প্রতিবাদ করছে মেয়রা।”
রাজ্য সরকারের কী ভূমিকা?
“আমাদের সাম্মানিক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার মিলেই দেয়। রাজ্য সরকার যেটা করেছিল...(হা হা)... এরকম ইতিহাসে হয়েছে বলে জানা নেই... হাজার টাকা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে ছ’শ টাকা কেটে আমাদের চারশ টাকা দেওয়া হচ্ছে।”
কেন?
“কেন ঠিক জানি না। শুনেছি ওই কেটে নেওয়া টাকা নাকি আশা কর্মী আর হেল্পারদের দেওয়া হচ্ছে।”
ভোট দেন? আশা কী?
“হ্যাঁ। যে কাজ করবে তাঁকে ভোট দেব। আশা করি যে-ই আসুন ক্ষমতায় তিনি যেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সমস্যার দিকগুলো খেয়াল রাখেন। এখনকার বাজারের যা অবস্থা... আমরা যা সাম্মানিক পাই তাতে চলে না। বাচ্চাদের খাবারের মান ও বাজারদর অনুযায়ী রেট দেওয়ার বিষয়টাও যেন দেখেন তিনি। তাহলে খুবই ভালো হয়।”
পেনশন যদি চালু না হয়?
“অনেক মেয়ে আছে যাদের এই কাজের ওপর নির্ভর করে চালাতে হয়। সুতরাং পেনশন চালু না হলে এই মেয়েরা কোথায় যাবে? কীভাবে জীবন ধারণ করবে?”
তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর হাতেনাতে পাওয়া গেল।
অবসরপ্রাপ্ত সহায়িকা
মনসুরা বেওয়া (৭৫)। অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা হিসেবে কাজ করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। থাকেন মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকলে। তাঁর দুই ছেলে দিনমজুর। ছেলেদের আয় যথেষ্ট নয়। নিজের জীবন চালাতে এই বয়সে ভিক্ষা করাই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। অশক্ত শরীরেই ভিক্ষা করতে বেরোতে হয়। রোজ ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েন আর ফেরেন সন্ধ্যের মুখে। তাঁর বাড়ির সদস্যদের থেকে জানা গেছে কোনও বার্ধক্য ভাতা পান না তিনি। অঙ্গনওয়াড়ি অফিসও তাঁর খোঁজ রাখে না। তাঁর বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি তাঁকে। ভিক্ষা করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
মাস ছয়েক আগে তাঁর বেড়ার ঘরে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে যায়। ডোমকল পৌরসভা থেকে তাঁকে বানিয়ে দেওয়া হয় টিনের একটা ঘর। এটুকুই পাওনা।
তিনিই কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের ভবিষ্যৎ? উত্তর জানা নেই।
আশাকর্মীর আশা ভরসা
আশা কর্মীরা ন্যাশনাল রুরাল হেলথ মিশন প্রকল্পের আওতায় কাজ করেন [National Rural Health Mission (NRHM) ]। মিশনের তথ্য অনুয়ায়ি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত তেতাল্লিশ রকমের কাজ করতে হয় ও প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা সাম্মানিক ভাতা পান তাঁরা। তেতাল্লিশ রকমের কাজে মাসে সর্বোচ্চ আয় হতে পারে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু সব এলাকায় মিশনের তালিকাভুক্ত সব কাজ থাকে না। বিভিন্ন এলাকার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ চরিত্রর ওপর কাজের ধরণ নির্ভর করে।
অন্যদিকে গ্রাসরুট লেভেলের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণায় আশা কর্মীদের অবদানের কথা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের অক্লান্ত শ্রম এই অসম্ভবকে করেছে সম্ভব।
কী বলছেন মাহফুজা খাতুন (৪০)? ন’বছর ধরে আশা কর্মী হিসেবে কাজ করেন। ডোমকল পৌরসভার রঘুনাথপুর গ্রাম তাঁর কাজের এরিয়া। থাকেন ভাদুরিয়াপাড়া গ্রামে। এই রমজান মাসে রোজা মুখেই কাজ করে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার মধ্যেও কিছুটা সময় তাঁর থেকে চেয়ে নেওয়া গেল।
কী কী কাজ করতে হয় আপনাদের?
“যেমন ধরুন কোনও গর্ভবতী মায়ের নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। একমাস পর পর টিটি ইনজেকশন দেওয়ার জন্য বলতে হয়, নিয়মিত চেকআপ করতে হয়, মাদারস মিটিং করতে হয়। মিটিং-এ মায়েদের বোঝাতে হয় গর্ভবতী মায়ের বিপদের লক্ষণ, পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মায়েদের ব্যথা ওঠে, কিভাবে ওঠে, কত ঘণ্টা থাকে... এইসব। তারপর তাদের হসপিটালে ভর্তি করা। বাচ্চা হওয়ার পর হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার তিনদিন থেকে বিয়াল্লিশ দিন পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার করে তাদের ভিজিট করা। কোনও ডেঞ্জার সাইন আছে কিনা খেয়াল রাখা। বাচ্চার ওজন নেওয়া, তাপমাত্রা মাপা, বিপি মাপা, শ্বাসপ্রশ্বাস দেখা, এক ধরণের টর্চ আছে আমাদের কাছে। সেটা দিয়ে দেখতে হয় বাচ্চাদের দৃষ্টি ঠিক আছে কিনা... নবজাতকের পুরো বডি চেক করতে হয়... গায়ে কিছু বেরিয়েছে কিনা, সবকিছু ঠিক আছে কিনা... এইসব দেখতে হয়। তারপর জিরো থেকে ছ’মাসের বাচ্চাদের পরিচর্যা, খাওয়া দাওয়া... মানে মায়ের বুকের দুধ খাবে, অন্যকিছু খাওয়ানো যাবে না, খাওয়া বা খাওয়ানোর আগে ভালো করে হাত ধোয়া। আমাদের কাজের মধ্যে... দশ থেকে উনিশ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী তাদের নিয়েও কিন্তু মিটিং করতে হয়। স্যানিটরি ন্যাপকিন দেওয়া, ন্যাপকিনের ব্যবহার, তাদের রক্তাল্পতা, নিজের শরীরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা... এসব নিয়ে বলতে হয়।”
বাচ্চাদের ক’বছর বয়স অব্দি খেয়াল রাখতে হয়?
“জিরো থেকে পাঁচ বছর অব্দি। কোন সময় কী কী টিকা নিতে হবে, টিকাগুলো নিলে কী কী সুবিধা-অসুবিধা সব দেখতে হয়।”
আপনার এরিয়ায় এই মুহূর্তে কতজন গর্ভবতী ও প্রসূতি মা আছেন?
“আমার এরিয়ায় দশজন গর্ভবতী মা, আর জিরো থেকে পাঁচ বছর অব্দি বাচ্চা আছে সত্তরটা, প্রসূতি মা এই মুহূর্তে আমার এরিয়ায় নেই। যে কজন ছিল সব মায়ের বাড়ি চলে গেছে।”
কিশোর-কিশোরীদের একসঙ্গে নিয়ে মিটিং করেন?
“না না, আলাদা আলাদা।”
কিশোরদের কী বোঝান?
“একই জিনিস। পরিচ্ছন্নতা, শরীরের পরিবর্তন, বয়ঃসন্ধি এইসব। কিন্তু কিশোরদের নিয়ে মিটিং করার সুযোগ হয়নি এখন পর্যন্ত। আমার নিজেরও লজ্জা করে আর এদের সবসময় ঘরে পাওয়াও যায় না। মিটিং-এ আসতে বললেও কিশোররা আসতে চায় না।”
কেন আসে না?
“বেশিরভাগ কাজ করতে যায় বা আড্ডা দিতে বেরিয়ে যায় বা বাড়ির কোনও কাজে বাইরে থাকে। ওদের ধরে পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার না।”
সপ্তাহে কতদিন, কতক্ষণ কাজ করতে হয়?
“আমাদের ডিউটির কোনও নিয়ম নেই। মানে চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি। যেমন আজ থার্ড স্যাটারডে অফিসে মিটিং ছিল। ডিউটি করে বাড়ি ফিরলাম। এখনই যদি কোনও মায়ের ব্যথা ওঠে আমাকে দৌড়াতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হসপিটাল পাঠাতে হবে (বিনামূল্যের)। এই ব্যাপারটা রাত বারোটাতেও হতে পারে। তখন আমাকে যেতে হবে বা সব ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
কাজ করতে গিয়ে কী কী সুবিধা বা অসুবিধার সম্মুখীন হন?
“আমাদের তো একদিন অফিস ডিউটি, বুধবার। তো অফিস করে ওইদিন গর্ভবতী মায়ের রেজিস্ট্রেশন করা খুবই ঝামেলার হয়। এবার বুধবার না করে সপ্তাহের অন্যদিন রেজিস্ট্রেশন করলে কিন্তু টাকা পাওয়া যায় না। আমাদের তো কাজের ভিত্তিতে টাকা। কিন্তু আমাদের অন্যদিন মায়ের রেজিস্ট্রেশন করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এটা খুব অসুবিধা। এদিকে আমাদের সাম্মানিক খুবই সামান্য। তারপরেও গত দু মাসের টাকা এখনও পাইনি। তারপর এই যে কাজের ভিত্তিতে টাকা পাই আমরা... এটা একেবারে অযৌক্তিক।”
কীরকম?
“কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের একটা লিস্ট আছে। এইটাতে এত, ওইটাতে অত... এরকম নির্দিষ্ট উৎসাহ ভাতা আছে। সেসব কাজ করে তার আবার প্রমাণ দিতে হবে। এএনএম (Auxiliary Nurse Midwife) দিদিরা আমাদের কাজের সঙ্গে ওদের লিস্ট মিলাবে। যদি মিলে যায় তো আমরা টাকা পাবো, নাহলে পাবো না। যেমন গর্ভবতী মায়ের রেজিস্ট্রেশনের ফর্মে যদি কেউ ডাক্তার ও নার্সের সিগনেচার করতে ভুলে যায় তো সে টাকা পাবে না। অথচ কাজটা সে করেছে। আবার গর্ভবতী মায়েদের ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার বারো সপ্তাহের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। রেজিস্ট্রেশন পিছু একশ টাকা পাওয়া যায়। তো প্রথম চেকআপ বারো সপ্তাহের মধ্যে, দ্বিতীয় চেকআপ ষোল সপ্তাহে, তৃতীয়টা আটাশ সপ্তাহে, চতুর্থ চেকআপ হয় ছত্রিশ সপ্তাহে। এবার যদি ছত্রিশ সপ্তাহের আগে বাচ্চা প্রসব হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আশা কর্মী চতুর্থ চেকআপের টাকাটাও পাবে না, রেজিস্ট্রেশনের টাকাটাও পাবে না। আগে প্রসব হয়ে গেলে আশা কর্মীদের দোষ কোথায়? আবার একজন বাচ্চার সমস্ত টিকা, ইমুনাইজেশন যদি এক বছরের মধ্যে কমপ্লিট হল তো টাকা পাবো (একশ)। আর যদি কোনও কারণে বারো মাসের জায়গায় তেরো/চোদ্দ মাস হয়ে যায় তো ওই একশ টাকাও পাওয়া যায় না। অনেক সময় বাচ্চার শারীরিক অসুস্থতার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়া সম্ভব হয় না। একইভাবে বাচ্চার দু’বছর অব্দি নানান স্বাস্থ্য সুরক্ষা থাকে। দুবছরের মধ্যে হয়ে গেলে পঞ্চাশ টাকা পাই। নাহলে সেটাও গেল আরকি। তারপর ধরুন আমাদের কেউ অসুস্থ, মেডিক্যাল টেস্ট করতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তার জন্য কোনও ছুটি দেওয়া হয় না। ছুটি যদি কেউ নেয়ও, তাহলে কিন্তু পুরো টাকাটাই যাবে, টাকা তাঁকে দেওয়া হবে না।”
অফিস থেকে প্রয়োজনীয় ফর্ম, খাতাপত্র দেওয়া হয়?
“না। আমরা নিজেরা ডায়রি কিনে নিজেদের কাজের খতিয়ান রাখি। অথচ অফিস থেকে এই খাতা দেওয়ার কথা। একটা মোটা রেজিস্ট্রেশন খাতাও লাগে। যেমন আমার এরিয়ায় এলিজিবল কাপল, সক্ষম দম্পতি আছে দুশ বাহাত্তর জন। এদের কতজন এক বাচ্চার মা, কতজন দু বাচ্চার মা, কতজন তিন বাচ্চার মা, কতজন কণ্ডোম ব্যবহার করে, কতজন পিল ব্যবহার করে, কতজন জন্ম নিয়ন্ত্রণের অপারেশন করেছে... সমস্ত লিস্ট কিন্তু রাখতে হয়। মান্থলি ওয়ার্ক সার্টিফিকেট, উৎসাহ ভাতা রিপোর্ট সংক্রান্ত যে ফর্মটা প্রত্যেক মাসে ফিলআপ করতে হয় (মাঝে মাঝে অফিস থেকে দেয়, মাঝে মাঝে জেরক্স করতে হয়), ডিউ লিস্ট (মায়েদের হিসাব রাখতে হয়), নিত্তির ফর্ম যাতে ছমাস থেকে সাত বছরের বাচ্চাদের একটা সিরাপ খাওয়ানোর হিসাব রাখতে হয়- অফিস থেকে দেওয়ার কথা, কিন্তু নিজেদের টাকায় জেরক্স করে নিয়ে কাজ চালাতে হয়। শুধু ফর্ম জেরক্স করতে প্রতি মাসে নিজেদের পকেট থেকে কিছু টাকা চলে যায়।”
সাব সেন্টারে কজন আশা কর্মী থাকেন?
“সাব সেন্টার প্রতি আটজন, সাতজন, ন’জন থাকে। আমাদের সেন্টারে আমরা ন’জন আছি।”
আপনার এরিয়ায় কতজন মানুষের বসবাস?
“একজন আশা কর্মী হাজার থেকে বারোশ পপুলেশনে কাজ করবে। আমার এরিয়ায় এক হাজার বিয়াল্লিশ জন পপুলেশন।”
কাজ করতে গিয়ে এইসব মানুষদের আপত্তির সম্মুখীন হতে হয়?
“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে খুব সমস্যা... টিকা দিলেই তো বাচ্চার জ্বর আসে, তাই না? সেজন্য বলবে টিকা দেব না, বাচ্চার জ্বর হয়। তখন আমি বলি, ‘দেখ, টিকা তো ভালোর জন্যই দেওয়া। একটা টিকায় পাঁচটা রোগ নিরাময় হয়। টিকা দিলেই জ্বর আসবে। জ্বর আসা মানেই ভালো। এবের... টিকা দিলা না, টিকা না দিলেও তো জ্বর আসে। আসে না?’ এইসব বলে বোঝাতে হয়। যে বুঝে যায় সে নিজেই যোগাযোগ করে কোথায় কখন টিকা নিতে যেতে হবে খোঁজ নিয়ে নেয়।”
গর্ভবতী মায়েরা একটা ভাতা পান?
“হ্যাঁ। বিপিএল (Below Poverty Line), এপিএল (Above poverty line) মায়েরা পাঁচ হাজার/ ছ’হাজার পায়। আমরাই রেজিস্ট্রেশন করে যে কার্ড করে দিই তার ভিত্তিতেই টাকাটা পায়।”
আপনি নবছর ধরে কাজ করছেন। আগের থেকে আলাদা কিছু বুঝতে পারেন?
“অনেক পরিবর্তন, অনেক পরিবর্তন। প্রথম দিকে লোকে জানতোও না কিছু, আগ্রহও দেখাতো না। ওই দু’ একজন মা হয়তো ব্যাপারটা ঠিকঠাকভাবে বুঝে করতো। এখন উল্টোটাই ব্যাতিক্রম। মানে আগ্রহীর সংখ্যা বেশি। আগের মতো খাটতে হয় না। নিজেরাই জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। কিছু বোঝালে বোঝে। যেমন আয়রন ট্যাবলেট খেলে প্রথম প্রথম বমি ভাব হয়, ঘুম আসে, কন্সটিপেশন হয়, মাথা ঘোরে, ট্যাবলেটটাও গন্ধ করে। তো অনেকে খেতে চায় না। কিন্তু যখন বুঝিয়ে বলবো যে এই ট্যাবলেট না খেলে পেটের বাচ্চার ব্রেন হবে না, অপুষ্টিতে ভুগবে, নরম্যাল ডেলিভারি হতে সমস্যা হবে, মায়ের হিমোগ্লোবিন কমে যাবে, রক্তাল্পতায় ভুগবে... তখন বুঝবে। কিছুদিন খেলে কিন্তু ঠিক হয়ে যায়। বুঝে যাওয়ার পর নিজেরাই ট্যাবলেট চেয়ে নেয়।”
আপনাদের সাম্মানিক ভাতায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী?
“রাজ্য সরকার আমাদের একটা ফিক্স ভাতা দেয়, সাড়ে তিন হাজার। কেন্দ্রীয় সরকার কাজের ভিত্তিতে ভাতা দেয়।”
আপনাদের পেনশন চালু হল?
“কেন্দ্র সরকার ঘোষণা করেছে। কিন্তু কবে দিবে, কবে চালু হবে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের কথারই কোনও ইয়ে নাই! আমাদের সবথেকে ভালো হবে যদি কেন্দ্র সরকার ঠিকঠাক সাম্মানিক দেয়। কারণ... আমরা তো সবাই একইরকম কাজ করছি, একই কাজ করছি... একই কাজ করেও এক একজন একেক রকম টাকা পাচ্ছে... কেউ দু হাজার, কেউ চার হাজার, কেউ তিন হাজার... যদি সবার জন্য সমান মাস মায়নে চালু করে তাহলেই আমার মনে হয় কম টাকা লাগবে। যেমন রাজ্য সরকার ফিক্স করে দিয়েছে। একটু লেট হলেও রাজ্য সরকার কিন্তু টাকা দিয়ে দেয়।”
কেন্দ্রীয় সরকারের ভাতা সময় মতো পান?
“দেরি হয়। যেমন দু মাসের বিল এখনও পাইনি। একবার তো চার পাঁচ মাসের বিল আটকে ছিল।”
কতদিন কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন?
“রাজ্য সরকার বলেছে ষাট বছর অব্দি আমরা কাজ করতে পারবো।”
আপনাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছেন?
“আমি ভাবি না। এই কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছি। ভাবতে ভাল্লাগে না। ফিল্ডে কাজ করে মানুষের কাছে সম্মান পাই। কিন্তু অফিসের ওপরের লেভেলের লোকদের কাছে সম্মান পাওয়া যায় না।”
বাড়িতে কে কে আছেন?
“আমরা চারজন, দুই মেয়ে আর আমরা দুজন। আমার ছোট মেয়ের (১১) ডাউন সিন্ড্রম, বড় মেয়ের (১৮) কিডনির সমস্যা। বড় মেয়ের প্রতি মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকার মেডিসিন লাগে। স্বামীর হার্ডওয়ারের দোকান আছে। ”
ভোট দেন?
“হ্যাঁ...”
ভোট দেন কেন?
“ভোট কেন দিই... ভারতের নাগরিক হিসাবে ভোট দিই। ভোট দিলে দেশের উন্নতি হবে, ভালো হবে, কাজ হবে... এইজন্য ভোট দিই। শুধু নিজের জন্যে ভোট না কিন্তু, সবার কথা ভেবে ভোট দেওয়া।”
একেবারে গ্রাসরুট লেভেলে যারা কাজ করছেন, যারা সামলাচ্ছেন দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক, সব কুঁড়ি কুসুমিত করার ভার যারা কাঁধে নিয়েছেন তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন হওয়া, কাজের সঠিক মূল্য পাওয়া এক অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া জরুরি- ভোট বাজার পরবর্তী সময়েও।